০
১০৪৫ বার পঠিত
বাংলার বিখ্যাত কৌতুক সম্রাট গোপাল ভাঁড় ছিল নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০ – ১৭৮৩) এর বিদূষক, সভাসদ, রাজ দরবারের ভাঁড়। কথিত আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে তার সভার নবরত্ন হিসেবে অভিহিত করতেন। মাত্র দু’শো বছর আগের হলেও গোপাল ভাঁড়ের ঐতিহাসিকতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে গোপালের ঐতিহাসিকতা প্রমাণিত না হলেও দু’শো বছরের অধিককাল ধরে তার গল্প পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মানুষের হাসি আনন্দের খোরাক হয়ে টিকে আছে। গোপালের সাথে অনেক দিক থেকে সম্রাট আকবরের সভাসদ বীরবলের সাথে মিল থাকলেও গোপাল বীরবলের চাইতে বেশি অমার্জিত এবং গেঁয়ো।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা ছিল হিন্দু কিন্তু রাজা নিজে মুর্শিদাবাদের মুসলিম নবাবদের নিকট দায়বদ্ধ ছিলেন। তাকে একাধারে তাঁর প্রজাদের দাবী-দাওয়া মেটাতে হত, অপরদিকে নবাবকেও খুশি রাখতে হত। এ দোটানায় গোপাল ভাঁড় তার হাস্য-কৌতুকের মাধ্যমে রাজার চিত্তভার লাঘব করে রাজদায়িত্ব পালনে সহায়তা করত। ভাঁড় রাজ্যশাসনের মত সিরিয়াস কাজ করতে পারবে না, আবার রাজাও গোপালের দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া ঠিকমত রাজ্য পরিচালনা করতে পারতেন না। সংস্কৃত নাটকের বিদূষকের মত, ভাঁড় আসলে আদর্শ রাজার আরেক বাহ্যিক রূপ।
গোপালের নামে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মুসলিম এবং পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনের ফলে বাঙালি হিন্দু মানসে সামাজিক এবং রাজনৈতিক যে চাপের সৃষ্টি হয়েছিল, গোপাল ভাঁড়ের গল্প তা নিরসনে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছিল। ইতিহাসের বাইরে এসব গল্পের মনোজাগতিক দিকটাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। গোপালের হাস্য-কৌতুক বিদেশী শাসনের অধীনে থাকা রাজার অহংকে অটুট রাখতে সাহায্য করেছে, কোন সন্দেহ নেই প্রজাদের অসহায়ত্বও এতে আশ্রয় পেয়েছিল।
একবার নবাব রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে আকাশে ঠিক কতটি তারা আছে তা জানতে চান। রাজা পড়ল ঘোর বিপদে, এ অসম্ভব কাজ না করতে পারলে তার জীবন তো যাবেই, তার হিন্দু প্রজারা সব মুসলমান শাসকের অধীন হবে। নিরূপায় হয়ে রাজা তখন গোপালের শরণাপন্ন হয়। সব শুনে গোপাল বলল, কোন সমস্যা নাই, আমি দেখছি। আপনি এ কাজের জন্য নবাবের কাছ থেকে এককোটি টাকা এবং এক বছর সময় চান। নবাব রাজাকে এককোটি টাকা দেন, রাজা সেটা গোপালকে দেন। গোপাল টাকা নিয়ে এক বছর ধরে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করে। এক বছর পরে গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে সাতটা ভেড়া নিয়ে হাজির হন। তারপরে বলে, এ ভেড়াগুলোর গায়ে যত পশম আছে, আকাশে ঠিক ততগুলো তারা আছে। গভর্নর জানতে চাইল, তা সংখ্যাটা ঠিক কত? গোপাল হেসে জবাব দিল, তোমরা তো সংখ্যা জানতে চাওনি, কেবল কি পরিমাণ তারা আছে তা জানতে চেয়েছিল, রাজা তার কথা রেখেছেন। দরবারে অভ্যাগতদের সামনে নবাবের তা স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। নবাব তখন জানতে চাইলেন, তা এ কাজের জন্য এত সময় লাগল কেনো? গোপাল ভাঁড় জবাবে বলল, ঠিক সংখ্যক লোমের ভেড়ার সন্ধান পেতে এত সময় লেগেছে। শুনে নবাব এবং সভাস্থ সকলে হাসিতে ফেটে পড়ল।
গোপালের অনেক গল্পের মধ্যে স্ক্যাটোলজিক্যাল গল্পও আছে। একবার মোগল নবাব কৃষ্ণনগরের কাছে ক্যাম্প পাতেন, সেখানকার মাঠে খুব বলিষ্ঠ, তরতাজা একটা ষাঁড় চরছিল। গরুর মাংস খাবার লোভে গভর্নর সে ষাঁড়টাকে খেতে চাইল। সে তার কর্মচারীদের গরুটাকে জবাই করতে বলল। ষাঁড়টা ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মানত করা, একবছরের জন্য স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে তারপর রাজার স্বর্গীয় পিতার উদ্দেশ্যে সেটাকে উৎসর্গ করা হবে। কৃষ্ণনগরে গোমাতাকে ভক্ষণ করার মত ঘটন অচিন্তনীয়, রীতি বিরুদ্ধ, তদুপরি এটা হবে রাজার প্রতি অসম্মান। এরকম পরিস্থিতিতে রাজা তার অক্ষমতায় খুব অসহায় বোধ করতে লাগলেন। রাজা গোপালকে তার অসহায়ত্বের কথা জানালেন। গোপাল জবাবে বলল, কোন সমস্যা নেই। বলেই সে নবাবের কাছে গিয়ে ষাঁড়টাকে ধরার জন্য কৃষ্ণনগরবাসীর পক্ষ থেকে নবাবকে ধন্যবাদ জানালেন, এরকম দুষ্ট ষাড়কে কব্জা করায় আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, এর অনেক খারাপ গুন আছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, এ ষাঁড়টার গু খাওয়ার অভ্যাস আছে। সকালবেলা আমরা যখন মাঠে মলত্যাগ করতে যাই, তখন তাজা মল খাবার জন্য অস্থির হয়ে সে মলত্যাগকারী মানুষদের শিং দিয়ে গুতা দেয়। ভয়ে সারা শহরের মানুষের কৌষ্ঠকাঠিন্য হবার উপক্রম। আমরা হিন্দুরা তো একে মারতে পারি না, আপনি দয়া করে এ মল ভক্ষণকারী ষাঁড়টাকে মারলে সকালবেলা আমরা নিশ্চিন্তে মাঠে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে পারি। আপনাকে হাজারো ধন্যবাদ! গোপালের কথা শুনে নবাবের গা গুলিয়ে উঠল, সে কিনা একটা ষাঁড়ের মাংস খেতে যাচ্ছিল যেটা মানুষের গু খেয়ে মোটা তাজা হয়েছে। নবাব গোপালকে পালটা ধন্যবাদ জানাল, এবং গরুটাকে ছেড়ে দেবার আদেশ দিল।
শেখ আমীর শাহ নামক এক মৌলভীর হিন্দুশাস্ত্র সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান ছিল, তাই সে গোপালকে জব্দ করতে চাইত। একদিন গোপাল ভিন গাঁয়ে বন্ধুর বাড়িতে খেতে যান, গিয়ে দেখেন মৌলভীও সেখানে নিমন্ত্রিত, ভোজনে বসেছেন। গোপাল জানতে চাইল, কি খাচ্ছেন মৌলভী সাহেব? মৌলভী রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলেন না বললেন, তোমাদের অবতার খাচ্ছি। তিনি আসলে মাছ খাচ্ছিলেন, আর মাছ হিন্দুদের প্রথম অবতার। গোপালেরও শাস্ত্রজ্ঞান ভাল, সে অন্যরকম বুঝার ভান করে বলল, কোন অবতার? তৃতীয় অবতার নিশ্চয়ই। মৌলভী তখন ভোজন ত্যাগ করে ‘তওবা’ ‘তওবা’ বলে লাফিয়ে ওঠলেন। কারণ হিন্দুদের তৃতীয় অবতার হলো শুয়োর, যা মুসলমানের জন্য হারাম। শেখ সাহেবের সেদিন আর খাওয়া হল না, উপোস করেই কাটিয়ে দিলেন।
গোপাল ভাঁড়ের কাহিনীর ওপর নির্মিত বাংলা সিনেমাঃ
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন