১
১০৭৪ বার পঠিত
এক প্রিয়জনের অনুরোধে আরেকজনকে কীভাবে ব্রাউজার বেইজড প্লাটফর্ম থেকে ফেসবুকে লাইভ করা যায় তা দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। বেশ কয়েকটি ব্রাউজার বেইজড প্লাটফর্ম রয়েছে, তারমধ্যে জুম, স্ট্রিম-ইয়ার্ড এগুলো হালে বেশ জনপ্রিয়। করোনাকালে ফেসবুক লাইভের দাপট বেড়েছে। যত ফেসবুক লাইভ চলছে, তা মূলত এসব প্লাটফর্মের মাধ্যম্যেই।
কিন্তু সেই ভদ্রলোককে যতই দেখাচ্ছিলাম ততই তিনি গুলিয়ে ফেলছিলেন। প্রায় ঘন্টা দুয়েক। অবশেষে নিজেকেই ব্যর্থ মেনে ক্ষান্ত দিলাম। ক্ষান্ত দেয়ার পর মনে হলো, অনর্থক ছিলো সেই চেষ্টা, পুরোপুরি পণ্ডশ্রম। যিনি ব্রাউজার কী সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। উইন্ডোজ সম্পর্কে তেমন জানা নেই। তিনি কী করে বিষয়টি বুঝবেন। এতে তাকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। তার যতটুকু প্রয়োজন তিনি ততটুকু জানেন এবং তার কাজ চলে যায়। লাইভ প্লাটফর্ম নিজেকে অপারেট করতে হবে এমন চিন্তা তার মাথাতেও ছিলো না। তাকে যদি এখন সেই স্ট্রিম-ইয়ার্ড বা জুম বোঝাতে যাই, তার তো পারার কথা না। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে না দেয়াটাই তখন সঙ্গত।
আমাদের দেশেও এমন এক শ্রেণির লোকজন আছেন, যারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে সিদ্ধহস্ত। তারা আমাদের দেশের গরীব মানুষদের যখন প্রলেতারিয়েত হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন তাদের বক্তৃতা শুনতে আসা গরীব মানুষেরা হাই তোলেন। না তুলে তো উপায় নেই। গরীব মানুষগুলো প্রলেতারিয়েত কী জিনিস তা বোঝেন না। তারা তাদের পেটের ক্ষুধাটুকু বোঝেন। ফুটো চাল দিয়ে ঝরা পানি গায়ে অনুভব করেন। শতচ্ছিন্ন কাপড়ে সম্ভ্রম ঢাকার যন্ত্রণাটা বইতে পারেন। বিপরীতে প্রলেতারিয়েত মানে সর্বহারা, এ বিষয়টিই তাদের অবোধ্য। না, এমনটাই হওয়ার কথা।
প্রলেতারিয়েত বোঝার জন্য যতটুকু শিক্ষা দরকার, রাষ্ট্র সে শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি তাদের জন্যে। সুতরাং তাদের কাছে মার্ক্স এর তত্ত্ব আর আমসত্ত এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাদের কাছে এসব তত্ত্ব প্যাচালেরই নামান্তর। অথচ তত্ত্ব না কপচে সাধারণ কথা ও উদাহরণ দিয়েও বোঝানো সম্ভব। কিন্তু না, ওই যে আমার মত দুই ঘন্টা পণ্ডশ্রম করতেই উৎসাহ তাদের বেশি। জ্ঞানী প্রমাণের চেষ্টাতেই সমস্ত আগ্রহ উত্থিত। সেই উত্থান অনেকটা ধর্ষকের শিশ্ন উত্থানের মতন। অন্যের ইচ্ছা থাক না থাক, তাকে প্রবিষ্ট করাতেই হবে।
দেখবেন, সামাজিকমাধ্যমে এই শ্রেণিটি কে কত জানেন তা প্রমাণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। কে কত বড় পণ্ডিত তা প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাদের আত্মতৃপ্তি অন্যার্থে রাগমোচনও বলতে পারেন, হয় না। তারা পরস্পরকে বোঝাতে চেষ্টা করেন প্রলেতারিয়েতদের জন্য তারা কতটা ভয়ানক চিন্তা করেন, কত ভয়াবহ ভাবে ভাবেন। অন্যদিকে তাদের দেখলে সেই প্রলেতারিয়েতরাই হাই তোলেন।
শ্রমিক মুক্তির আন্দোলনে তাদের সাথী বারোজন। না, মাইকম্যান সহ তেরোজন। এই তাদের সভা-সঙ্ঘ। আর সামনের হাই তোলা অডিয়েন্স। যে বক্তৃতা দেন সে বাদে অন্য এগারো জন মাঝেমধ্যে জিকির দিয়ে ওঠেন, মানে স্লোগান আর কী। তখন, অডিয়েন্সের তন্দ্রা কাটে। মাথা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসে তারা। তারপর আবার সেই তন্দ্রা, আবার জিকির, আবার ঝাঁকি। এই হলো তত্ত্ব কপচানোদের আটকে যাওয়া সিন। বারোজন যে মূলস্রোত নয়, লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে যে মূলস্রোতের সাথে মিশতে হবে, তেমন ইচ্ছাও তাদের নেই। লক্ষ্যে পৌঁছানো তাদের উদ্দেশ্য নয়, নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করাই তাদের মোক্ষ। বলতে পারেন, তাদের লক্ষ্য নেই, মোক্ষ আছে।
সামাজিকমাধ্যমে এদের দাপটে মাঝমধ্যে অস্থির লাগে। মনে হয়, কত বোঝেন তেনারা। ঠিক সেই কলকাতার বাবুর মতন। যেন আমরা সেই মাঝি, আমাদের জীবনের চৌদ্দআনাই মিছে। তবে ঝড়ের সময় বাবু কাবু। তারপরেও তার যে ষোলআনাই মিছে, মাঝি বুঝলেও বাবুর তা বোধগ্যম হয় না। সেই মোক্ষের খেলা, রোগ-শোক-জরার ঊর্ধ্বে ওঠা। ওই যে, বারোজন, মাইকম্যানসহ তেরো। আর সামনের ঝিমানো অডিয়েন্স। প্রায়শই রাগ এবং মাঝেমধ্যে আফসোস হয়, এরা যে কবে মাটি ও মানুষের পালস বুঝবে। কবে যে বুঝবে তাদের ষোলআনাই মিছে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
মার্চ ১৬, ২০২১; ১২:৪০ অপরাহ্ন
কত কি বলে গেলেন খুব সহজে। বলা দরকার ছিল। ধন্যবাদ।