০
১৭৭২ বার পঠিত
কাকন রেজা :
তসলিমা নাসরিনের দাবি তিনি অব্যাহত হুমকির মুখে দেশ ছেড়েছেন। ভালো কথা, অনেকেই ছেড়েছেন। আবার অনেকেই দেশে আছেন চরম ক্ষতি স্বীকার করেও। সেটা মূলত চিন্তা ও তার গভীরতার উপর নির্ভর করে। ভার বহনের ক্ষমতাটা কার কতটুকু সেটাও একটা বিষয়। হেমলক পানের আগে সক্রেতিস বললেন, ‘আমি মরতে যাচ্ছি, তোমরা বেঁচে আছো, কিন্তু কোনটা তুলনামূলক ভালো তা ঈশ্বর জানেন।’ এই তুলনার জায়গাটা বুঝতে পারাই হলো চিন্তার গভীরতা।
তবে কেউ কেউ দেশ ছাড়েন সুবিধার জন্য। যেমন আফগানিস্তান ছাড়ছেন অনেকেই। তালেবানদের ভাষায়, তারা উন্নত জীবনযাপনের আশায় দেশ ছাড়ছেন। আফগানিস্তান একটি দরিদ্র দেশ, সুতরাং ধনী দেশের উন্নত জীবনের আশাতেই তারা যাচ্ছেন। তালেবানদের অনেক কিছুই পছন্দ করি না, তবে দেশ ছাড়ছেন যারা তাদের বিষয়ে এ মন্তব্য নিয়ে খুব বেশি বলার কিছু নেই।
‘নেইম ও ফেইম’ এর আশায় দেশ ছাড়ার প্রবণতা নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। অনেকের অ্যাসাইলাম পাবার নানান কাণ্ডকারখানার খবরও শ্রুতির বাইরে নয়। খোদ সরকার সমর্থক হয়েও অলৌকিক প্রাণনাশের আশঙ্কায় দেশ ছাড়ার কাহিনিও জানা আছে। যারা কিনা দেশের বাইরে গিয়েও সরকারেরই কথা বলছেন। প্রবল ক্ষমতাধর সরকার, দল ক্ষমতায় থাকতে যারা সেই দলের আত্মিক অংশ হয়েও দেশত্যাগ করেন, অনেকটা থালায় খেয়ে থালা ফুটো করার মতন। যাদের জন্য দল ও সরকার প্রশ্নের সম্মুখিন হয়, তাদের কী বলবো? তসলিমা নাসরিন বলবো? তসলিমা কখন কাদের পারপার্স সার্ভ করেছেন তা দিবালোকের মতন পরিষ্কার, এতে কোনো জটিলতা নেই। সুতরাং তার দেশে ফিরতে অসুবিধা কোথায় প্রশ্নটা ধাক্কা খায় সেখানেই।
তার অভিযোগ, তার পাসপোর্ট নবায়ন হচ্ছে না। তিনি নিজে পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন অ্যাসাইলামের আশায়। সেই পাসপোর্ট কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় নবায়ন হবে বা হয় তা জানতে খুব ইচ্ছা করে। আছে কী সেরকম নিয়ম? বিবিসি তসলিমাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, তসলিমা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন, কিন্তু তার পাসপোর্ট নবায়ন করা হয়নি। তসলিমা একই সাথে স্বীকার করেছেন, তার ইউরোপিয় দেশের পাসপোর্ট আছে, কিন্তু সেগুলোতেও ভিসা দেয়া হচ্ছে না।
অদ্ভুত না। অন্যদেশের পাসপোর্ট আছে, মানে আপনি অন্যদেশের নাগরিক। সেই দেশের নাগরিক হতে হলে দেশী পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হয়, যতদূর জানি অ্যাসাইলামের এটাই নিয়ম। পাসপোর্ট যদি সারেন্ডার করেন তবে তিনি কোন পাসপোর্ট দেশী দূতাবাসে জমা দিলেন? প্রশ্নটার বিষয়ে খোলাসা করেনি খোদ বিবিসিও। এটাও খবরটির একটি বড় দুর্বলতা। খবরটিতে এ প্রশ্ন আসা উচিত ছিলো। খবরটি যিনিই পড়বেন, তিনিই মোটাদাগে বুঝতে পারবেন বিবিসি তসলিমাকে প্রমোট করছে।
বিবিসি এই খবরটি করেছিলো ২০১৩ এর আগস্টে। তখন তসলিমার অনুসারীরা মানববন্ধন করেছিলেন ঢাকায়, তাকে ফেরানোর দাবিতে। সে সময়ও এই প্রশ্নগুলো উঠে এসেছিলো, কিন্তু ঢাকার মূলধারার গণমাধ্যমের অনেকগুলিই এ প্রশ্নকে আগে বাড়তে দেয়নি। কেন দেয়নি সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রশ্ন তুলেছিলাম আমি ও আমার মতন অনেকেই।
হালে তসলিমার জন্মদিনে তাকে নিয়ে উচ্ছাস এবং সমালোচনা দুটোই নতুন করে প্রশ্নটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছেন তসলিমা নাসরিন। নারীদের মানুষ হবার কথা না বলে পুরুষদের প্রতিপক্ষ হিসেব দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। দু’পক্ষ লড়ছে। এক পক্ষে মুক্তমনা নামের কিছু মানুষ, বিপরীতে কিছু অতিধার্মিক, ধর্মান্ধ। রয়েছেন বকধার্মিকও। আর এই লড়াইয়ে অনেকে নিচ্ছেন অ্যাসাইলামের সুযোগ। কেউ আবার এনজিও খুলে নারী স্বাধীনতার বেপার করে চলেছেন। কেউ লিখে চোঙা ফুঁকিয়ে মুফতে নাম কামাচ্ছেন। হয়ে উঠছেন ‘বাদ’ না বোঝা ‘নারীবাদী’। মাঝ থেকে নারীদের আরো নিগৃহিত হতে হয়েছে, হচ্ছে। পুরুষরা সুযোগ পেলেই বউ পেটাচ্ছ ‘তসলিমা নাসরিন হইছস’ এই সংলাপ আউড়ে। আর এই সংলাপ আউরানোর সুযোগটা করে দিয়েছেন খোদ তসলিমা নাসরিন। এটা তার একধরণের অর্জনও বলা যায়। নারী মুক্তির নামে নারীর উপর অত্যাচার-নির্যাতনের সিলমোহর হয়ে দাঁড়িয়েছে তসলিমা নামটি।
জরায়ুর স্বাধীনতা যে মানুষের স্বাধীনতা নয়, এ কথাটি বোঝার ক্ষমতা এই বয়সেও আয়ত্ত করতে পারেননি তিনি। নিম্নাঙ্গের স্বাধীনতার সাথে ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতার কোনো যোগসূত্র নেই, এটা বোঝার মতন চিন্তার গভীরতা তসলিমার কখনোই আসবে না। আর সে কথাই বলে গেছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা’র উক্তি কোন বিশেষ চিন্তার ফল নয়। তসলিমার কাজ-কারবার বুঝতে খুব বেশি তীক্ষ্ন মেধার প্রয়োজন হয় না, মোটামুটি মানের হলেই চলে।
আহমদ ছফার কথাই বলি। তিনি বলেছেন, তসলিমা ব্যবহার হন। এই ব্যবহারের বিষয়টি ছফা পতিতাবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিবেশ্যা’ শব্দটি অনেকেই ব্যবহার করেন। বুদ্ধির ক্ষেত্রে চর্চার চেয়ে ‘জীবী’ শব্দটি যখন প্রিয় হয়ে ওঠে, তখন বানিজ্য ব্যাপারটা চলে আসে। আর মগজ শরীরে অংশ হওয়ায় শরীর বেচার অভিধা যুক্ত হওয়া অনেকেই স্বাভাবিক মনে করেন। কিন্তু আমি করি না বরং বিরোধীতা করি। বেশ্যা শব্দটির মধ্যেও কিছুটা সম্মান থাকে। অনেকেই উপায়হীন হয়ে শরীর বিক্রি করেন। কেউ করেন গ্যাঁড়াকলে পড়ে। কিন্তু বুদ্ধি যারা বেচেন, তারা না উপায়হীন, না গ্যাঁড়াকলের গ্যাঁড়ায় আটকেছেন। তারা বেচেন তাদের উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করতে। উদাহরণ, তসলিমা নাসরিন। তবে এর থেকেও উচ্চমার্গের উদহারণ রয়েছে। রয়েছেন তসলিমার চেয়েও কুলীন ‘বুদ্ধিজীবী’। সে কথাও এক সময় আলোচনা করা যাবে। আজ তসলিমা পর্যন্তই থাক।
শেষ কথায় বলছি। তসলিমাকে নিয়ে এই যে আমাদের আলোচনা সেটাও কিন্তু এক ধরণের প্রচার। এটাও তার পক্ষে যায়। দীর্ঘতর হয় তার প্রবাসের আয়েশী জীবন। তসলিমা শিবলিঙ্গে পানি ঢালছেন এই ছবি দেখিয়ে কেউ যদি ভাবেন, এটা ধর্মীয় চিন্তা থেকে করেছেন তসলিমা। সে ভাবনাটাও সম্পূর্ণ ভুল। এটাও তসলিমার ধান্ধা। ভারতের ক্ষমতাসীনদের খুশি করা এবং একই সাথে বিতর্কিত কিছু করে আলোচনায় থাকা। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতন। একটু ভেবে দেখবেন, শিবলিঙ্গে পানি ঢালার বিষয়টি তার পূর্বের কোনো চিন্তার সাথেই যায় না। বরং সেসব চিন্তার বিপরীত। আর এই পানি ঢালা কোনো শিল্পচর্চার মধ্যেও পড়ে না। সুতরাং সেই, স্রেফ ধান্ধা। আর এমন মানুষকেই কেউ কেউ শিরে শিরোধার্য করে ফেলেছেন। বলিহারি।
ছবি সৌজন্য : সামাজিকমাধ্যম।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন