০
২১৯৪ বার পঠিত
ওসমান মল্লিক নামে একজন “তাবলিগ জামাত” নিয়ে একটি লেখা নামিয়েছন দেখলাম। বেশ কিছু ভুল তথ্য ও ভুল ধারনা রয়েছে সেখানে। আসুন ভুল গুলো শুধরে নিই। তাঁর লেখা থেকেই কথা গুলো তুলছি।
১) “১৯০৬ এ ভারতে প্রথম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ তৈরী হয় আর তার বছর কুড়ি পর ১৯২৫/১৯২৭ নাগাদ মোহাম্মদ ইলিয়াস আল-কান্ডলাউই, এখন যেখানে হরিয়ানা রাজ্য তারই এক এলাকা, মেওয়াতে, তাবলিগী জামাত সংগঠনের জন্ম দেন।”
মুসলিম লীগ সৃষ্টির সঙ্গে তাবলিগীদের সৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই। কেন তিনি মুসলিম লীগকে টানলেন বোঝা গেল না ? তবলিগীরা রক্ষনশীল, অরাজনৈতিক, ইসলামীয় সংস্কারপন্থী। আদর্শগতভাবে “রাজনৈতিক ইসলাম” বা ওয়াহাবিজমের বিরোধী। সালাফিদের সঙ্গেও এদের আদর্শগত বিরোধ রয়েছে। আপনি এ জায়গায় ঘেঁটে ঘ করে ফেলেছেন। তাবলিগ জামাত সৃষ্টি হয়েছে ‘আর্য সমাজ’ এর কাউন্টার ডিসকোর্স হিসাবে, যে ‘আর্য সমাজ’ ধর্মান্তরিত মুসলামানদের বৃহত্তর হিন্দু সমাজে “ঘর ওয়াপসি” করতে শুরু করে মগজ ধোলাই এর মাধ্যমে। তাবলিগ জামাত হল এর বিপরীতে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের স্বধর্মে টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কারপন্থী নীরব আন্দোলন। ইসলামীয় জাতীয়তাবাদ নয়, বরং ইসলামীয় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনায় এদের উদ্দেশ্য। ব্যক্তি চরিত্র ইসলামীয় মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই ঘুন ধরা সমাজ বদলানো সম্ভব বলে এদের বিশ্বাস। “মুসলিম লীগ” বা “জামাতে ইসলামির” মত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খোয়াব এরা দেখে না। এরা “দ্বীন” নিয়ে চিন্তিত, “দুনিয়া” নিয়ে নয়। আর হ্যাঁ, ওটা “তবলিগী জামাত” নয়, “তাবলিগ জামাত”। তাবলিগের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের “তাবলিগী” বলা হয়।
২) “তাবলিগের প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য পদ নেই, তবে দাবী করা হয় ১৮০ থেকে ২০০ টা দেশ জুড়ে তাবলিগী জামাতে সক্রিয় সদস্য আছে পনেরো থেকে পঁচিশ কোটি মুসলমান।”
ভুল তথ্য। এখনও অব্দি ১৬৫ টা দেশে তাবলিগীদের সংগঠন রয়েছে। সংখ্যাটা ৮০ মিলিয়ন।
৩) “প্রায় নারী বর্জিত এই সংগঠনের নানা বয়সের পুরুষ সদস্যরা ছোট ছোট দলে ‘চিল্লা’ করতে চল্লিশ দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে।”
ভুল ধারণা। “মাস্তুরাত জামাতের” কথা জানেন ? এটি দম্পতিদের নিয়ে হয়। এই জামাতে মহিলারাও তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের কাজে যুক্ত থাকে। বিবাহিত মহিলারা স্বামীদের সঙ্গে জামাতে অংশগ্রহণ করে। এই জামাত হয় সাত দিনের। শুধু ৪০ দিনের নয়, ৩ দিনের, ১২০ দিনের, এমনকি এক বছরের জামাতও আছে। এক বছরের জামাতকে তাবলিগীদের পরিভাষায় “সাল লাগানো” বলে।
৪) “এরা সুফী মুসলিমদের এরা ঘৃণা করে।”
পারিবারিকভাবে মৌলানা ইলিয়াসের পিতা মৌলনা ইসমাইল ছিলেন চিশতিয়া সুফি ঘরাণার অনুসারী। মৌলান ইলিয়াসও সেই প্রভাব মুক্ত নন। চিশতিয়া সুফী পীরের মুরিদ ছিলেন তিনি। দারুল-উলুম-দেওবন্দের ছাত্র হলেও মৌলানা ইলিয়াসের পারিবারিক সুফি ঘরানার প্রভাব তাবলিগ জামাতেও আছে। একইসঙ্গে দেওবন্দ ও সুফি ঘরাণার মিশেল তবলিগ জামাতে দেখতে পাওয়া যায়। চিশতিয়া ও কাদেরিয়া ঘরানায় পীরকে ৪০ দিন পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে একটি কামরায় বদ্ধ থেকে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর উপাসনা করতে দেখা যায়। এটি এক ধরনের ধ্যান। একটা লম্বা সময় ধরে আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগ সাধনই এ ধরণের উপাসনার উদ্দেশ্য। চিশতিয়া ধারা অনুসরণ করে মৌলানা ইলিয়াস পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে থাকেন। শেষে তিনি এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হন যে চিশতিয়া সুফি ধারার মত একটি ঘরে বদ্ধ হয়ে উপাসনা না করে মসজিদে এই কাজ করলে কেমন হয়। তাঁর মতে এই সময়পর্বটিকে একজন মুসলমান দলগতভাবে ইসলাম চর্চা ও প্রসারে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। এখান থেকেই “চিল্লা” এর সৃষ্টি। “চিল্লা” শব্দটি এসেছে ফারসী “চাহাল” থেকে, যার অর্থ চল্লিশ। তবে নিজের আহরিত জ্ঞান দ্বারা তিনি তাবলিগ জামাতকে সুফি ধারার থেকে স্বতন্ত্র ধারায় বিকশিত করতে সফল হন। বর্তমানে একদম নীচু তলার তবলিগীদের একাংশ সুফি ঘরানার প্রতি বিরুপ হলেও সেটা সার্বিক চিত্র নয়।
৫) “তাবলিগী জামাতের আর একটি বড় কাজ অন্য ধর্মের মানুষদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা। বলা বাহুল্য ক্রমাগত এই প্রচারের মাধ্যমে তাবলিগ সদস্য সংখ্যা বহুগুন বেড়েই চলে।”
আমি জানি আপনার কাছে এই বক্তব্যের কোন এভিডেন্স নেই। থাকার কথাও নয়।এভিডেন্স ছাড়া এধরনের কথা বলা সমীচীন নয়। ভারতবর্ষে তবলিগীরা কোন অমুসলিমকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পেরেছে এমন কোন নজির নেই। সালাফিপন্থী জাকির নায়েক এখানে ধর্তব্য নয়। ইউরোপে কিছু খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীকে এরা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারলেও সংখ্যাটি অতি নগন্য। কোন বলপ্রয়োগ নেই, তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ যেখানে ধর্মীয় পরিচয় মারাত্মক রিজিড সেখানে তবলিগীদের পক্ষে ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়া চালানো অসম্ভব। ভারতীয় উপমহাদেশে এরা “চিল্লা” চলাকালীন বা আসরের নামাজের পর “গাস্ত” এর সময় নন-প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের কাছে গিয়ে বিনীতভাবে কোরান তেলোয়াত, নামাজ-রোজা কায়েম করার উপদেশ দেয়। এটুকুই এদের ক্ষমতা। আপনার বয়ানে যেমন ভয়ঙ্কর ক্ষমতাবান হিসাবে তবলিগীরা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে তেমনটা মোটেই নয়।
৬) “দিল্লীর নিজামুদ্দিন এলাকায় তাবলিগ মার্কাজ -তাবলিগি জামাত বিশ্ব সংগঠনের কেন্দ্র।”
‘মার্কাজ’ হল কোন দেশের তাবলিগ সংগঠনের প্রধান কেন্দ্র। এলাকাটির নাম “মার্কাজ” নয়। নিজামুদ্দিন এলাকার বাঙাল-ওয়ালী মসজিদ হল ভারতের তাবলিগীদের “মার্কাজ”। পাকিস্তানের তাবলিগীদের “মার্কাজ” হল রাইবান্দ, বাংলাদেশে ঢাকার কাকরাইল মসজিদ।
৭) “মার্চ মাসে দিল্লীর তাবলিগ মার্কাজে হাজার হাজার তবলিগী জামাত সদস্যরা জমায়েত হয়। তাদের মধ্যে অন্তত ১৩০০ জন ছিলো বিদেশী। তারা আমেরিকা, বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স, বেলজিয়াম সহ বহু এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলমান এবং তাবলিগ জামাতের সক্রিয় সদস্য।”
তাবলিগ জামাতে সদস্য হিসাবে নাম নথিভুক্তকরণের কোন বালাই নেই। তাই সক্রিয় সদস্যপদ বলে কিছু হয় না। জামাতে অংশগ্রহণ করা না করা স্বেচ্ছাধীন। বাধ্যতামূলক নয়।
পুনশ্চঃ আমিও মতাদর্শগতভাবে তাবলিগ জামাতের তীব্র বিরোধী। কিন্তু লিখতে বসে ভুল তথ্য ও ধারনা দেওয়াটা কাম্য নয়। ওসমান মল্লিক সাহেবের ভুল তথ্য ও ভুল ধারনায় ভরা লেখা প্রচুর শেয়ার হচ্ছে, সে কারনেই এ লেখার অবতারনা। উপরের লেখায় আমার কোন ভুল থাকলে সেটাও ধরিয়ে দিতে পারেন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন