০
১৭৭০ বার পঠিত
তুয়ারেগ জনগোষ্ঠী সাহারা মরুভূমির মানুষ। নীল রঙের কাপড় পরিধান করায় তাদেরকে অনেকে ‘Blue People‘ হিসেবে চিনে। তুয়ারেগ মানুষদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হোল তাদের পুরুষেরা সবসময় মাস্ক পরে থাকে । এমনিতে মরুভূমিতে জীবন কাটানো জনগোষ্ঠী চলাফেরার সময় বালু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে মুখ ঢেকে রাখে। কিন্তু তুয়ারেগ পুরুষদের মধ্যে মুখ ঢেকে রাখা এক কঠিন প্রথা।
তুয়ারেগরা বর্বর ভাষায় কথা বলে, ভাষার নামও তুয়ারেগ, এটি তামাজিগ ভাষার সদস্য। কাউকে বর্বর, বারবারিয়ান বলা এগুলো গ্রিকদের শিক্ষা। গ্রিসের বাইরের যে কাউকে তারা বর্বর এবং বারবারিয়ান বলে সম্বোধন করতো, পূর্ব ইয়োরোপের মানুষদেরকেও তারা বর্বর বলেছিল, কিন্তু তুয়ারেগের ভাগ্যে সেটা রয়ে গেল।
আফ্রিকান ‘রহস্যময়’ শহর টিম্বাক্টু তুয়ারেগ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকেন্দ্র। আফ্রিকান অভিযাত্রীদের টিম্বাক্টু যাত্রা নিয়ে অনেকগুলো কাহিনী আছে।
তুয়ারেগরা মুসলিম। একসময় সাহারা পাড়ি দিতে হলে বর্বর তুয়ারেগদের দরকার পড়তো। মুসলিম শাসনামলে তাদের খ্যাতি চূড়ান্ত হয়। তুয়ারেগরা তখন ট্রান্স-সাহারান ব্যবসা পরিচালনার কাজ করতো। সাহারার বাণিজ্যিক রুট তুয়ারেগদের দখলে ছিল।
তুয়ারেগরা একই নামের ভাষায় ( যা তামাশেক নামেও পরিচিত ) কথা বলে। তামাশেক আফ্রোশিয়াটিক পরিবারের বারবার শাখার অন্তর্গত। অন্যান্য আমাজিগ ভাষার সাথে তুয়ারেগ ভাষার পার্থক্য হোল তুয়ারেগ ভাষায় অনেক আরবী প্রভাব পড়েছে। আরবী আফ্রিকা অঞ্চলের ল্যাটিন। আফ্রিকান ভাষাগুলোর অতীত ঐতিহ্য খুঁজতে গেলে আরবি ভাষাতেই সেটা খুঁজতে হয়।
বর্বর জাতি, যাযাবর, বর্বর থেকে বাংলা বর্বর শব্দটি এসেছে। সেক্ষেত্রে বর্বর মানে খারাপ এটা বলা যায় না। বিশেষ করে যখন বর্বর একটা জাতির নাম, ৫ থেকে ৭ কোটি মানুষ। তারা সভ্যতার অন্যদের মতো থিতু হয়নি। সাহারা মরূভূমিকে তারা তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছিল। গ্রিক βάρβαρος (barbaros pl. βάρβαροι barbaroi), প্রাচীন গ্রিক ভাষায় যার মানে “non-Greek-speaking” or “non-Greek peoples“
রাণী তিন হিনান
তিন হিনান ছিলেন ৪র্থ শতকের তুয়ারেগ রাণী। সাহারা মরুভূমিতে দক্ষিণ আলজেরিয়ার হগার পর্বত এলাকায় তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। রাণী তিন হিনান প্রাক-ইসলামিক যুগের নারীপ্রধান সমাজের রাণী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন, “Queen of the Hoggar”,”Queen of the camp”, “Woman of the tents”। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কিছু আভাস এখনও তুয়ারেগ জীবনাচরণে রয়ে গেছে।
ইবনে বতুতা তুয়ারেগদের খ্যাতির সময় ১৩৫২ সালে সেখানে গিয়েছিলেন। মালির রাজা মানসা মুসা তখন অনেক বিখ্যাত ছিলেন। মানসা মুসা হজ্জ্বে যাবার সময় মিশর এবং সৌদি আরবে এমন পরিমাণ স্বর্ণ দান করেছেন যে পরবর্তী ১০০ বছর সে এলাকায় স্বর্ণের বাজার মন্দা ছিল।
মানসা মুসার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তুয়ারেগদের শহর টিম্বাক্টু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-গবেষণার নগরী হিসেবে গড়ে ওঠে। হজ্জ্বযাত্রীদের চলার পথে পড়ায় টিম্বাক্টু’র গুরুত্ব বাড়ে। বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে তখন খুব ব্যস্ত শহর ছিল।
ফরাসী অভিযাত্রীর লেখা বই:
১৮৯৭ সালে প্রকাশিত বই ‘Tombouctou la mystérieuse‘ , লেখক Felix Dubois (১৮৬২-১৯৪৫), ফরাসি সাংবাদিক। ১৮৯৫ সালে প্যারিস থেকে সেনেগাল ডাকার হয়ে তিনি নাইজের নদী তুয়ারেগ শহর জেনে Jenne ভ্রমণ করেন, যাকে তিনি “jewel of the valley of the Niger” বলে উল্লেখ করেছেন। সেখান থেকে তিনি টিম্বাক্টুতে পৌঁছান, শহরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝাতে তিনি বলেন,
“The camels transfer their burdens to the canoes, and the vessels confide their cargoes to the camels, Timbuctoo being the place of trans-shipment.”
সাহিত্যিক ও ধর্মীয় চিন্তার কেন্দ্র হিসেবে টিম্বাক্টু শহরে অনেক মসজিদ ও লাইব্রেরী ছিল। দশম শতকে সেখানে University of Sankoré প্রতিষ্ঠা করা হয়। টিম্বাক্টুতে ত্রয়োদশ শতক থেকে বিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ে লেখা বিপুল পরিমাণে ( ৭ লক্ষ) পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে।
ফরাসী দখল
ফরাসিরা টিম্বুকটুতে তুয়ারেগদের হারিয়ে দিয়ে মালি দখল করে নেয়। তারপরে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য আফ্রিকার সেই অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন কৃত্রিম রাষ্ট্রে ভাগ হয়। উপনিবেশকাল শেষ হওয়ার পর তুয়ারেগ আবাসভূমি নাইজার, মালি, আলজেরিয়া আর লিবিয়া নামের রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল।
আধুনিক নেশন , রাষ্ট্রব্যবস্থা তুয়ারেগদের কমপক্ষে ৫ টি দেশের মধ্যে ভাগ করে ফেলেছে।দক্ষিণ -পশ্চিম লিবিয়া থেকে দক্ষিণ আলজেরিয়া , নাইজার , মালি এবং বুর্কিনা ফাসো পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় তুয়ারেগ মানুষের বসবাস।
১৮২১ সালের একটি ফরাসি বইয়ে সশস্ত্র তুয়ারেগ পুরুষদের চিত্রিত করা হয়েছে।
১৯৯০ সাল থেকে, নাইজার ও মালিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তুয়ারেগ গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হয়েছে এবং অনেক শরণার্থী তৈরি করেছে ।
এখন তারা তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনাচরণ হারিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে। এতবড় একটা জনগোষ্ঠী হয়েও তাদের নিজদের কোন দেশ নেই। আগেও ছিল না। কিন্তু আগে গোটা সাহারা মরুভূমি তাদের বিচরণভূমি ছিল। এখন জাতিরাষ্ট্রের সীমানায় তাদের পরিচয় চাপা পড়ে যাচ্ছে। তুয়ারেগদের বিচরণের এলাকায় ইউরেনিয়ামের খনি থাকায় সে এলাকার প্রতি এখন অনেকের নজর, তারাও চাইবে না তুয়ারেগরা আগের জীবনাচরণে ফিরে যাক। তারসাথে আছে তুয়ারেগদের উপরে ধর্মীয় মৌলবাদীদের আক্রমণ।
আধুনিক সময়ে তুয়ারেগদের সংগ্রামের চেয়ে তাদের সঙ্গীত মানুষের মনে বেশি নাড়া দিয়েছে। তুয়ারেগরা ফরাসী কলোনি হওয়ায় ফরাসি ভাষার মাধ্যমে ইয়োরোপে তাদের এক্সেস তৈরি হয়। ডেজার্ট ব্লুজ নামে পরিচিত এসব গানে পাশ্চাত্যের সঙ্গীত বিশেষ গীটার এবং আফ্রিকা ও আরবের সঙ্গীতের ফিউশান। আমেরিকার বিখ্যাত গিটারিস্ট রক এন্ড রোল ঘরানার গায়ক জিমি হেন্ড্রিক্স তুয়ারেগদের উপরে ভীষণ প্রভাব ফেলে।
সাহেল সাহারা মরুভূমির বেল্ট, প্রতিরক্ষাকারী ইকোসিস্টেম। সাহেলকে বলয়া হয় –
“ ecoclimatic and biogeographic realm of transition in Africa between the Sahara to the north and the Sudanian savanna to the south”।
সাহেল অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, সাহারা মরুভূমির গতি থামাতে হলে তুয়ারেগ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান দরকার।
আমার ইউটিউব চ্যানেলে তুয়ারেগ মানুষ, তাদের ভাষা ও সংঙ্গীত নিয়ে মাত্র ৪ মিনিটের ভিডিও:
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন