২
১৩২৫ বার পঠিত
দুই মহাজোটে বিভক্ত বাংলাদেশের বিদ্যমান মূলধারার রাজনীতিতে মহাসংকট ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন জোট দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। তারা অবশ্য তাদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবও রাখছে। অন্যদিকে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাবহির্ভূত জোট নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অনড় অবস্থান ঘোষণা করছে।
ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে শাসক শ্রেণীর দলগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নতুন নয়। নব্বই দশকে এ ধরনের এক সংঘাত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের মাধ্যমে নিরসন হয়। যে প্রক্রিয়ায় এ বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়ছে তা বিধিসম্মত নয় বলে আদালত সম্প্রতি রায় দিয়েছে (অবশ্য আরো দু’টার্মের সুযোগ রেখে)। তবে ক্ষমতাসীন জোট এ রায়ের সুযোগ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের পথে এগুচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের ৪১ বছর হয়ে গেছে। এ সময়কালে ৯টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে – কখনো দলীয় সরকারের অধীনে, কখনো সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে এবং নব্বই দশক হতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-এর অধীনে। দলীয় ও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলোতে বুথ দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, সিল মেরে বাক্স বোঝাই করা, ভোটারবিহীন নির্বাচন (ভয় দেখিয়ে), ফল পরিবর্তন এবং প্রশাসন ব্যবহার- সবকিছুই ঘটেছিল। তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-এর আমলে এমন প্রকাশ্য ভোট ডাকাতি ব্যাপকহারে হয়নি। যদিও পরাজিত দলগুলো বরাবরই সূক্ষ্ম কারচুপি ও মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তনের অভিযোগ তুলেছে এবং ফলাফল প্রত্যাখ্যানসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে সংসদ বজন করেছে, যা অদ্যাবধি চলছে। বস্তুত, গত ২২ বছর ধরে জাতীয় সংসদ মূলত একজোট তথা একদলীয়, তাই অকার্যকর। তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টাকা দিয়ে নমিনেশন ক্রয়সহ নির্বাচনে অঢেল কালোটাকার ব্যবহার শুরু হয়, যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বস্তুত, নির্বাচন এখন কালোটাকা, পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রশাসনিক আনুকূল্য নির্ভর হয়ে উঠেছে। ভোটদান দায়িত্ব পালন নয়, ভোটারদের কাছে এটা কিছু টাকা প্রাপ্তির উপায়, তাই উৎসব হয়ে উঠেছে। ৩০০টি আসন এখন কয়েকশত কালোটাকার মালিকের দখলের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
গত ৪১ বছরে এই বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচিত সরকারগুলো পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাধারণ মানুষ নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সরকারের মধ্যেকার শাসনে কোন তফাৎ খুঁজে পায় না। এ সময়কালে মানুষ কখনো একদলীয় স্বৈরশাসন, কখনো সামরিক স্বৈরশাসন বা কখনো সংসদীয় স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। রাষ্ট্র নিপীড়নকারী, অত্যাচারী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন আয়োজনের পদ্ধতি বদলালেও বা সৎ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপ বা স্বৈরতন্ত্র ঠিকই বজায় থাকে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না। সরকার বদলায়, কিন্তু শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি একই থাকে, কারণ এরা সকলেই অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি। সংবিধানে যুক্ত থাকা নানা অগণতান্ত্রিক ধারা ও বিধির বলে এরা স্বৈরশাসন বহাল রাখে। সার্বভৌম ব্যক্ত নয়, এ অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার উৎস শাসক শ্রেণীর সামরকি সশস্ত্রতা। শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার আর এক উৎস বহিঃশক্তি। এ অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহিঃশক্তির স্বার্থ রক্ষা করে, তাই এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বহিঃশক্তির নগ্ন হস্তক্ষেপ লক্ষ্যণীয়। তাই দলীয় সরকার, তত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য যে কোন নামে নির্বাচনের আয়োজন করা হোক না কেন – এ অবস্থায় স্বৈরশাসন বহাল থাকবেই এবং সাংবিধানিক-রাজনৌতিক সংকট দেখা দিবেই।
বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রকি রাষ্ট্র্রে পরিণত করতে হলে-
প্রথমত, সংবিধানের সকল অগণতান্ত্রিক ধারা ও বিধি বাতিল করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যে ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উপর দাঁড়িয়ে এই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকে থাকে সেগুলো বদলিয়ে গণতন্ত্র চর্চার উপযোগী করতে হবে।
তৃতীয়ত, যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে সেগুলোর দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ গড়ে দিতে হবে।
চতুর্থত, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীততে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ প্রতহিত করতে হবে।
উক্ত কাজগুলো সম্পন্ন না করে যতই সৎ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক বা তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসুক তাতে এই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গায় কোন আঁচড়ই পড়বে না।
বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে উপরোক্ত শর্তসমূহ সৃষ্টিতে আমি একটি অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করছি । নিম্নলিখিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ (সামাজিক ও রাজনৈতিক) সমন্বয়ে গড়ে উঠবে এই জাতীয় সরকার ।
কর্মসূচীসমূহঃ
১. নির্বাচনকে কালোটাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত করা। এ জন্য – (ক) দুর্নীতিবাজ , কালোটাকার মালিক ও সন্ত্রাসীরা যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে, ও (খ) সকল চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, কালোটাকার মালিক ও সন্ত্রাসীদের সম্পদ বাজয়োপ্ত করতে হবে।
২. নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিচার বিভাগকে পরিপুর্ণ স্বাধীন করা।
৩.সংবিধান সভা নির্বাচনের আয়োজন করা। সংবিধান সভা নিম্নলিখিত বিধিগুলো পর্যালোচনা করে গণতন্ত্রের উপযোগী করবে-
ক) বর্তমান সংবিধান প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর একক সর্বময় ক্ষমতা বাতিল করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা
খ) প্রচলিত নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন
গ) ১৪২ ধারা বাতিল ও সাংসদদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা
ঘ) রিকল সিস্টেম প্রবর্তন
ঙ) বড় ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনে পার্লামেন্ট নয়, সংবিধান সভা ডাকা। ছোটখাটো পরিবর্তনে জনগণের রেফারেন্ডামের শরণাপন্ন হতে হবে।
৪. শাসন ব্যবস্থায় জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও আমলাতান্ত্রিক শাসন বিলোপ সাধনে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। জনশাসনের প্রাথমিক স্তর হবে ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্বশাসিত আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে জেলা সরকার। স্বশাসিত জেলাসমূহ হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চা ও প্রয়োগের ভরকেন্দ্র।
৫. জাতীয় সম্পদ অনুসন্ধান,উত্তোলন, বিক্রি ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সকল চুক্তি বাতিল করা। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরধী সকল চুক্তি বাতিল করা।
৬. নতুন সংবিধানের আলোকে নির্বাচনের আয়োজন করা।
—
লেখক হাবিবুর রহমান বঙ্গরাষ্ট্র ওয়েবসাইটে নিয়মিত লিখেন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
আগস্ট ১৩, ২০১২; ৩:২৭ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশী জনতা যতই আশায় বুক বাধেন, দেশ ততই রসাতলে, ততই স্বৈরাচার, লুটপাটের পথে ধাবিত হয়।
কে হবেন সেই মহানায়ক, যিনি করিবেন বাংলাকে উদ্ধার?
আগস্ট ১৪, ২০১২; ১২:০৪ পূর্বাহ্ন
সহমত- *ok*