০
১০৮৭ বার পঠিত
বাংলার তেভাগা আন্দোলনের কথা নিশ্চই শুনেছেন সেই রক্তক্ষয়ী কৃষক আন্দোলনের নেতা ইলা মিত্র জন্মেছিলেন সেন পরিবারে আজকের এই দিনে ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ সনে, কলকাতায়। কৃষক ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ইতিহাসে নিজের আসন করে নিয়েছেন তিনি। তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গরিব কৃষকদের ‘রানী মা’ হতে পেরেছিলেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত কৃষকরাই তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এর জন্য তাকে কারাভোগসহ অমানুষিক নির্যাতন সইতে হয়েছে।
১৯৪৬-৪৭ সালে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে তখনকার পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গে যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল সেটি ই তেভাগা আন্দলন, তা ছিল যেমন যেমন বেগবান তেমনি স্বতস্ফূর্ত। ৬০ লাখ দুঃস্থ ভাগচাষী হিন্দু, মুসলমান, উপজাতি মেয়ে-পুরুষ জীবনকে তুচ্ছ করে ঐ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
সেসময় বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৃটিশ শাসনের পূর্বপর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন কৃষকেরা। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদারদের সাথে ফসল উত্পাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফসল উত্পাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে কারণে উত্পাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এই ব্যবস্থার নাম ‘আধিয়ারী’।
জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উত্পন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বশান্ত হয়ে একসময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেতমজুরে।
ইলা মিত্র যখন কলকাতায় বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ. সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই তাঁর রাজনীতির সাথে পরিচয় হয়। কলেজ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলায়ও তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫-৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী।
নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল বঙ্গাব্দ হিসেবে ১৩৫০, বাংলায় শুরু হলো দারুন দুর্ভিক্ষ নাখেতে পেয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় ধুকে ধুকে মৃত্যু বরণ করে, বঙ্গাব্দ হিসেবে ১৩৫০ তাই লোক মুখে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত সেই দুর্ভিক্ষ, সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় মন্বন্তর। এই দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নেয়। এসময়কার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে শোষিত কৃষকেরা। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের, এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার মহিমচন্দ্রের পুত্র বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্র মিত্রের সাথে ইলা মিত্রের বিয়ে হয় । জমিদারি রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়েও উদারপন্থী ইলা মিত্রের স্বস্তি ছিল না। তিনি তাঁর কমুনিস্ট স্বামীর আদর্শে আরো ঘনিষ্ঠ হলেন গণমানুষের রাজনীতির সাথে । পরবর্তীতে স্বামী রমেন মিত্রের সহযোগিতায় গ্রামের নিরক্ষর মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেন।
তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের একভাগ জমির মালিকের, এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ৪৭ সনে দেশভাগের পরে দিনাজপুরে কমুনিস্ট নেতা কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় দিনাজপুর, রংপুরে ভালোভাবে দানা বাঁধে তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষিদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। রমেন্দ্র মিত্র গ্রামের কৃষক সমাজকে সংঘবদ্ধ করার উদ্যেগে কোলকাতা থেকে নিজ গ্রাম রামচন্দ্রপুর যান। পরবর্তীতে সেখানে স্বামীর সাথে ইলা মিত্র সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র। ১৯৫০-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিনি জেলে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে চিকিৎসার জন্য পেরোলে মুক্তি দেয়া হয় তাঁকে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষ সহযোদ্ধা। ইলা মিত্র ও তার স্বামী রমেন মিত্র বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সদর দপ্তর ছিল ইলা মিত্রের বাড়ি। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন এবং জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন এই সংগ্রামী নারী। এই কিংবদন্তি নেত্রী ৭৭ বছর বয়সে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
পঞ্চাশের মন্বন্তর ও চার্চিল এর ভূমিকা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪৩ সে ইচ্ছে করে ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন – সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে এমনটা দাবি করা হয়েছে৷ ডয়েচে ভেলে সম্প্রতি প্রকাশ করে যে
তখন জাপান সবে বর্মা দখল করেছে৷ ফলে ভারতে তখন চালের অভাব দেখা দিয়েছিল৷ যা খাদ্য ছিল, ঔপনিবেশিক সরকার তখন তা সৈন্যদের খোরাক হিসেবে মজুত করে রেখেছিল৷ আতঙ্কে সাধারণ মানুষও চাল মজুত করতে শুরু করে৷ ফলে বাজারে চালের দাম আকাশছোয়াঁ হয়ে পড়ে৷ তাছাড়া জাপানি হামলার ভয়ে ব্রিটিশ শাসনযন্ত্র নৌকো ও গরুর গাড়ি বাজেয়াপ্ত বা ধ্বংস করতে শুরু করে৷ খাদ্য সরবরাহের গোটা কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই সব পদক্ষেপের ফলে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়৷ গ্রামের মানুষ খাবারের আশায় দলে দলে কলকাতা শহরে এসে পড়ে৷ রাস্তাঘাটে তখন ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যেত৷ শিশুসহ কঙ্কালসার মায়েদের মৃতদেহ পড়ে থাকত৷ অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসক ও উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালিরা দিব্যি খেয়ে দেয়ে বেঁচে ছিল৷
জার্মানিবাসী বাঙালি মধুশ্রী মুখার্জি প্রায় ৭ বছর ধরে অজানা অনেক নথিপত্র ঘেঁটে একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার’ বা ‘চার্চিলের গোপন যুদ্ধ’৷ তাঁর দাবি, চার্চিল নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিলেন৷ বাংলায় ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর হাজার আবেদন সত্ত্বেও তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেই কাজ করতে দেন নি৷ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও চার্চিল ও তাঁর মন্ত্রীরা সেই অনুমতি দেন নি৷ ভারত ও ভারতীয়দের প্রতি তাঁর মনে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছিল, তার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে৷ ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী লিও আমেরি’র ডায়রি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে মধুশ্রী মুখার্জি লিখেছেন, ‘‘চার্চিল ও হিটলারের মনোভাবের মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখতে পাইনি৷
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন