১৭২২ বার পঠিত
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ফোরাম সার্ক কার্যকর হতে না পারায়; দু’টি অক্ষ শক্তি তৈরি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে। একদিকে রয়েছে পাকিস্তান-চীন-রাশিয়া-ইরান। আর অন্যদিকে রয়েছে ভারত-এমেরিকা-জাপান-অষ্ট্রেলিয়া। এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে এগুলো বানিজ্য জোট। কিন্তু ভেতরে কী অভীপ্সা কার; এটা এখনি বলা কঠিন।
পাকিস্তান একাত্তরের বাংলাদেশ গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ধিকৃত হয়। এরপর আফঘানিস্তানে এমেরিকার সঙ্গী হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এতে করে বাজে ইমেজের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার আন্ডার ডগ হয়ে পড়ে দেশটি।
ইন্দিরা গান্ধী নকশাল হত্যা ও শিখ হত্যার মতো মানবতা বিরোধী অপরাধ করলেও; তার ছেলে রাজিব গান্ধীর ক্লিন ইমেজের কারণে আঞ্চলিক রাজনীতিতে এগিয়ে যায় ভারত। রাজিব আধুনিক চিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ফোরাম সার্ক সক্রিয় থাকলে; আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তা ইতিবাচক হবে।
কিন্তু সেই নেহেরুর আমল থেকে কংগ্রেসে অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ পরে বেশ কিছু কট্টর হিন্দু নেতৃত্বে থাকায়; রাজিবের মৃত্যুর পর থেকেই পাকিস্তান শব্দটিকে ইসলামের সমার্থক হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে থাকে প্রণব মুখার্জি টাইপের কট্টরপন্থী হিন্দু নেতারা। প্রকাশ্যে ইসলামকে গালি দিলে খারাপ শোনায়; তাই ইসলামের পরিবর্তে পাকিস্তান শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়।
ভারতের এই হিন্দুত্ববাদী মনোভঙ্গির বিপরীতে ইসলামপন্থী জজবার অভাব ছিলো না পাকিস্তানে। ফলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ডামাডোলে হিন্দু-মুসলমান ঘৃণার দোকানগুলো বেস্ট সেলার হয়ে পড়ে। এই পচা হিন্দু বনাম পচা মুসলমান দ্বন্দ্বের যৌক্তিক কোন কারণ নেই। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার কিছু হীন মানুষ; নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গে জীবনের একমাত্র বিনোদন পায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড মনমোহন সিং অর্থনীতিবিদ হওয়ায় উনি জানতেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বানিজ্য করলে; এই অঞ্চলেই আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অর্জন সম্ভব। পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত সেন্সিবল শাসক পারভেজ মুশাররফকে নিয়ে ‘কাশ্মীর’-কে স্বশাসন দিয়ে ভারত-পাকিস্তানকে তাদের চিরশত্রুতার ভ্রান্ত ক্ষেত্র থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করেন ড সিং। কিন্তু সেসময় প্রণব মুখার্জি রীতিমত মনমোহন সিং-এর শেরওয়ানির কোণা ধরে রেখে শান্তি ও সমঝোতায় যেতে বাধা দেন। পরবর্তীতে শিবসেনার মন্দিরে গিয়ে মি মুখার্জি নিজের কট্টর হিন্দু চেহারাটি উন্মুক্ত করেন।
লন্ডনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার সময় রাহুল গান্ধী কারো নাম উল্লেখ না করে বলেন, কংগ্রেসের মধ্যের রক্ষণশীল দু’একটি প্রাচীন মানসিকতার লোকের কারণে তারুণ্য কংগ্রেসে আসতে নিরুতসাহিত বোধ করেছে।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কোন বাস্তব সম্মত কারণ না থাকলেও দু’টি দেশে পচা হিন্দু ও পচা মুসলমান মানসের বাতিল লোকজন সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে রয়েছে। চিন্তার জগতে এরা অষ্টাদশ শতকের পাতকুয়ার ধারে বসে আছে।
এই দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে পাকিস্তান-চীন ও ভারত-এমেরিকা দুটি প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এখন এই দুটি পক্ষে ব্যবসা-বানিজ্যের স্বার্থে আরো কিছু দেশ যুক্ত হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের গ্রাম্য-দ্বন্দ্বে শহর থেকে বড় বড় মোড়ল এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অশনি ঘটনা; এটা বোঝার মতো মানসিক কাঠামো ধর্মান্ধতায় বুঁদ ভারতীয় ও পাকিস্তানি শিবিরে অনুপস্থিত।
ভারতের মধ্যে ‘কুইন অফ দ্য’ পার্টি টাইপের একটা মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। সেজে গুঁজে ‘ভারত’ পার্টিতে এলে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে; তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে হবে; এমন একটা ম্যাগালোম্যানিয়া ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে রয়েছে। এরকম অনেক আপা থাকেন পাড়ায়; যারা চান জুঁই-চামেলি-চরৈবতি-চম্পা সবাই তার বাড়িতে এসে তার মাথার উকুন তুলে দেবে; মাথায় জবা-কুসুম তেল বসিয়ে দেবে; কিন্তু জুঁই-চামেলি-চরৈবতি-চম্পারা নিজেদের মধ্যে যেন মেলামেশা না করতে পারে; সেদিকে প্রখর দৃষ্টি তার। এই করতে গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ফোরাম সার্কের মৃত্যু হয়।
বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদির ‘গুজরাট অতীত’ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরে গণহত্যা চালানো; মুসলমানদের শায়েস্তা করতে নাগরিক আইন সংশোধন করে বৈষম্য সৃষ্টি; ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের ওপর বিজেপির নির্যাতন; রোহিঙ্গা প্রশ্নে সীমান্ত বন্ধ রেখে গণহত্যা হতে দেয়া; এসবের মাঝ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ইমেজ তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাওয়ায়; তাদের জঙ্গীবাদের ভুতের নাচন অজনপ্রিয় হয়ে পড়লে; অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত নেতা ইমরান খান এসে পাকিস্তানের ইমেজ কিছুটা পুনরুদ্ধার করেন। অতীতে ভারতে যেমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষিত ও সমঝোতা করতে পারার মতো নেতা ছিলেন; পাকিস্তানে সেরকম নেতা ছিলো না। কিন্তু মোদি বনাম ইমরানের ক্ষেত্রে ঠিক এর উলটো ঘটনাটা ঘটে যায়।
নেহেরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধী হয়ে মনমোহন সিং-এই কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের স্বাভাবিক সখ্য ছিলো। কিন্তু মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে সেই সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্য না থাকায়; দক্ষিণ এশিয়ায় তিনি একা হয়ে পড়েছেন।
ভারতের এরকম একটি নিঃসঙ্গ অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সুখকর নয়। কেননা চীন-রাশিয়া বনাম এমেরিকার যে দ্বন্দ্ব; তা প্রকাশের সম্ভাব্য প্রক্সি গ্রাউন্ড হয়ে দাঁড়াতে পারে দক্ষিণ এশিয়া। অতীতে পৃথিবীর প্রক্সি গ্রাউন্ডগুলোতে অক্ষ শক্তিগুলোর নৈরাজ্য আমরা দেখেছি।
এখন কট্টর হিন্দুত্ববাদী মানস ও কট্টর ইসলামপন্থী মানসেরও সেই রমরমা অবস্থা নেই; বলা যায় এ হচ্ছে ভাটার সময়। ঘৃণা-বিদ্বেষের হাডুডু ক্লান্ত এ অঞ্চলের মানুষ। এসময় ইতিবাচক মনোভঙ্গিতে সার্ককে সক্রিয় করার মাধ্যমেই কেবল; এ অঞ্চলে বহিরাগত সুপার পাওয়ারের টহল বন্ধ করা যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এর পররাষ্ট্র নীতিতে সবসময়ই ইতিবাচক। বাংলাদেশের নেতৃত্বেই দক্ষিণ এশিয়ার সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি প্রশমন সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ নেতা এই মুহূর্তে। দক্ষিণ এশিয়ার আসন্ন বিপর্যয় ঠেকাতে শেখ হাসিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন বলে মনে হয়। নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিতান্ত নবীন; তাই তারাও খুব সম্ভব শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে স্বাগত জানাবেন; আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন