০
১৩৮৯ বার পঠিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সামাজিকমাধ্যমে হতাশা ব্যক্ত করলেন, যা লিখতে চাচ্ছেন তা লিখতে সাহস না করার জন্য। লিখতে না পারাটা আমাদের দেশে নতুন নয়। এক সময় সামাজিকমাধ্যম ছিলো না, ভরসা ছিলো গণমাধ্যম। তাও আবার প্রিন্ট ভার্সন। সেখানে হাতেগোনা গুটিকয়েক মানুষ লিখতেন। আর কেউ লিখতে পারেন কিনা, তা জানারও উপায় ছিলো না। তবে আশার কথা ছিলো, সেই হাতে গোনা কজন মানুষই মানুষের মনের ভাষাটা পড়তে পারতেন। আর সেই ভাষাই উঠে আসতো তাদের কলমে। দু’একজন ব্যতিক্রম থাকলেও অন্যরা সবাই মানুষের ভাষাতেই কথা বলতেন। যার ফলে তাদের ভাষাটা ছিলো অসম্ভব রকম শক্তিশালী। আবুল মনসুর আহমেদ থেকে শুরু করে এই ঘরানার সবাই মোটামুটি ভাবে দেশ ও মানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাদের একটা লিখার জন্য মানুষ অপেক্ষা করতো।
এখন লিখেন অনেকেই। সেই লিখা প্রকাশ হবার অপেক্ষায় থাকেন লেখক নিজেই। আর অন্যরা থাকেন গালি দেয়ার প্রতীক্ষায়। সামাজিকমাধ্যমের কল্যাণে সেই গালির প্রকাশটা আমাদের সমুখে দৃশ্যমান। কেন এই গালি, এর উত্তর পরিষ্কার, তাদের লেখা মানুষের ইচ্ছার বিপরীতে। তাদের ভাষা গণমানুষের হয়ে উঠতে পারেনি বলেই এই গালি। এমন একজনের কথা বলি। যার লিখার নিচে মানুষের মন্তব্য পড়তে পড়তে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং সাথে লজ্জিতও। অথচ ওই ভদ্রলোকের লজ্জা নেই। উনি সম্ভবত অতিরকম ভদ্র। সাত চড়েও রা নেই টাইপ আর কী। তার লিখার নিচে যদি একশ মন্তব্য থাকে, তারমধ্যে নব্বইটি তার চিন্তার বিপক্ষে। আর সাতজন নিরপেক্ষ, তিনজন তার পক্ষে।
অবশ্য এখন গণমাধ্যমের অভাব নেই। আগে হাতেগোনা গণমাধ্যম আর হাতেগোনা লেখক ছিলেন। তাই তাদের দায়িত্ববোধটাও বেশি ছিলো। তাদের মানুষের কথা চিন্তা করতে হতো। মানুষের চাহিদা বা প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের লিখতে হতো। মানুষের বিরোধীতা করলে কাগজের বিক্রি কমে যেতে পারে এমন চিন্তাও তাদের ছিলো। এখনতো উল্টো। এখন গণমাধ্যম হলো ব্যাকআপ। মালিকদের ব্যবসা ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠছে ক্রমেই গণমাধ্যমগুলো। এখন গণমাধ্যম আর গণমাধ্যমকর্মীদের মালিকানায় নেই। সবই কর্পোরেট। আজ আর কাগজ বিক্রির পয়সা বা বিজ্ঞাপন থেকে পত্রিকা বা মাধ্যম চালানোর কথা ভাবেন না মালিকরা। এখন অন্যায্য উপার্জনের সাপোর্ট হচ্ছে গণমাধ্যম। সুতরাং সেখান থেকে আয়ের চিন্তা মালিকদের মাথায় নেই। সেটা লোকসানি প্রকল্প ভেবেই তারা কাগজ বা মাধ্যম চালায়।
যার ফলেই মালিকদের মানুষের চাহিদা বা প্রত্যাশার প্রতি কোন টান নেই। তাদের টান নিজ স্বার্থের প্রতি। সুতরাং সে মাধ্যমে কে কী লিখলো তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। শুধু তা তাদের স্বার্থের বিপক্ষে না গেলেই হলো। আর তাই লেখক বাছার ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত পছন্দটাই গুরুত্ব পায়। নিজে যেহেতু মাধ্যমের সাথে যুক্ত এবং সম্পাদনার মতও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, অভিজ্ঞতাতো কিছুটা রয়েছেই। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই বলা, ইংরেজিতো দূরের কথা এক লাইন বাংলাও যারা বিশুদ্ধ ভাবে লিখতে পারেন না, তারাও আজ মাধ্যমে উপসম্পাকীয় লিখেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ঝাড়েন। সেগুলোকে রি-রাইট করতে হয় সম্পাদনার সাথে যুক্তদের, তারপর তা মানুষের কাছে যায়। মানুষ ভাবেন এ লেখা বোধহয় তাদেরই। অথচ লেখা নয় অনেক সময় শুধুমাত্র চিন্তাটাই সেসব লেখকদের থাকে, আর পুরোটাই নতুন করে লিখা।
যাক গে, যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। একজন শিক্ষকের আক্ষেপ লিখতে সাহস না করার জন্য। আরে ভাই, আপনি লিখতে পারেন বলেই না আক্ষেপ। কারণ আপনি লিখলে মানুষের মনের কথা বলতে চাবেন। তাদের চাহিদা আর প্রত্যাশা থাকবে সে লিখায়। আর তা ক্ষমতাবানদের বিপক্ষে যাবে। স্বভাবত তাই যায়। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার বিপরীতেই থাকে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাধররা। মানুষের কথা থামিয়ে দিতেই তাদের কর্মশক্তির বেশিরভাগ খরচ হয়ে যায়। তাকান এমন দেশগুলো দিকে, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার এদের শক্তির অর্ধেকের বেশি ক্ষয় হয় মানুষের প্রতিবাদকে রুখে দিতে। আপনি লিখতে চাইলে তো তাই হবে। আপনার লিখা যদি মানুষের পক্ষে যায়, তাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে তবে তাকে থামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা হবেই। আর সেই থামিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া হলো আপনাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা। চাণক্যের ‘সাম-দান-দন্ড-ভেদ’ সবই প্রয়োগ করা হবে আপনাকে থামিয়ে দিতে। বোঝানো হবে, কেনার চেষ্টা হবে, দন্ড দেয়া হবে। তাতেও না হলে চরমপন্থাটি অবলম্বন করা হবে। এই তো হয়, এমনটাই ঘটে।
সুতরাং এই চার চক্রের কথা স্মরণে রেখেই আপনাকে লিখার চিন্তা করতে হবে। লিখবেন যখন তখন বিপ্লবের পরিণতি মাথায় রেখেই লিখতে হবে। নিজেকে মনে করতে হবে বিপ্লবীর জায়গায়। ভাবতে হবে অক্ষরও কখনো গুলি-বোমার চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে প্রতিপক্ষের কাছে। শব্দবিপ্লব যাকে বলে। প্রতিটি বিপ্লবীরই এমনটা ভেবেই বিপ্লবে সামিল হওয়া উচিত। না হলে, ‘বোবার শত্রু নাই’, এমনটা ভেবে চুপচাপ থাকাই ভালো। তবে মুশকিল হলো, এখন বোবারাও শত্রু মুক্ত নন। এখন শক্তির পক্ষে ধোয়া না ধরলে, বোবাদের নামও প্রতিপক্ষের খাতায় উঠে যেতে পারে। এখানে নিরপেক্ষ বা জনগণের পক্ষ বলে কিছু নেই। এখানে রয়েছে শুধু আমার পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ। সুতরাং, লিখতে হলে দন্ডের কথা ভুলে মেরুদন্ডটা সোজা রাখতে হবে এবং তারপর বিপ্লবে সামিল হতে হবে।
কাকন রেজা : লেখক, সাংবাদিক।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন