মুখবন্ধ
আলোচ্য গ্রন্থটি একটি গবেষণা সন্দৰ্ভ যা বাংলায় আফগান শাসনের ইতিহাস নিয়ে রচিত। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহ কতৃক গৌড় বিজয় থেকে শুরু করে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দাউদ শাহ কররানীর রাজমহলের যুদ্ধে মোগলদের হাতে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত এর সময়কাল বিস্তৃত। সময়কাল ও ঘটনাসমূহ মাত্র ৩৮ বছরের যা ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন বিদেশি শাসনের ইতিহাসের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি একক, কিন্তু গুরুত্ব ও তাৎপর্যে সময়টি যুগান্তকারী, বিশেষত বাংলায়। বাংলার রাজনীতিতে শেরশাহ এবং তার উত্তরসুরীরা খুবই গুরুত্বপূৰ্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের সার্বভৌমত্বের সময়কাল সংক্ষিপ্ত কিন্তু শাসক হিসেবে তারা এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকায় দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। দিল্লির শাসক হিসেবে আফগানদের কর্তৃত্ব ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি কেড়েছে বটে। কিন্তু দিল্লির সূরা সালতানাতের অংশ হিসেবে বাংলার ইতিহাস এবং পরবর্তীকালে বাংলায় আফগান শাসকেরা ঐতিহাসিকদের নিকট থেকে তাদের প্রাপ্য গুরুত্ব লাভ করেননি।
সুতরাং রাজনৈতিক সমাজ হিসেবে বাংলায় আফগান কর্তৃত্বের উপর গবেষণার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হয়। শেরশাহের শাসন এবং বাংলায় আফগান শাসকেরা ঐতিহাসিকদের নিকট থেকে খুব কম মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। স্যার যদুনাথ সরকার তার ‘হিষ্ট্রি অব বেঙ্গল” গ্রন্থের ২য় খণ্ডে বাংলায় আফগান শাসন নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রাপ্ত সূত্র নিয়ে বাংলায় আফগান শাসনের ইতিহাস রচনার এখানেই প্রথম চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মাত্র বিশ পৃষ্ঠায় দুই অধ্যায়ে রাজকীয় প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কে. আর. কানুনগো তার ‘শেরশাহ (১৯২১) এবং শেরশাহ এন্ড হিজ টাইমস’ (১৯৬৫) গ্রন্থদ্বয়েও রাজকীয় প্রেক্ষাপটে শেরশাহ সম্পর্কে লিখেছেন। এখানে গৌড় বিজয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে। শেরশাহের পরবর্তী সময় নিয়ে বিজ্ঞ পণ্ডিত কোন আলোচনাই করেননি। নীরোদ ভূষণ রায় তার ‘সাকসেসরস অব শেরশাহ’ গ্রন্থে বাংলায় আফগান শাসন সম্পর্কে পর্যাপ্ত আলো ছড়াতে পারেননি। ড. আব্দুল করিম-এর ‘বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল’ উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা থেকে ১৫৭৬ সালে কররানী আফগানদের পতন। পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের উপর একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ। এখানেও মাত্র ৩৪ পৃষ্ঠায় বাংলায় আফগান শাসনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
আমার এই গ্রন্থটিকে নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এতে দুটো পরিশিষ্ট সংযুক্ত আছে। প্রথম অধ্যায়ে ইতিহাসের সূত্রসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বিদ্যমান রচনাবলির একটি বিবরণ এবং গবেষণার ক্ষেত্র নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আফগান বিজয়ের পূর্বে বাংলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কে. আর. কানুনগো শেরশাহের গৌড় বিজয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু শেরশাহের পরবর্তী সময় নিয়ে কোন আলোচনা করেননি। অন্যান্য পণ্ডিতেরাও এ বিষয়টি নিয়ে পর্যাপ্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করেননি। কীভাৰে এক শক্তিশালী শাসক আলা-আল-দীন হুসেন শাহের পুত্র সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের অধীন বিশাল বঙ্গরাজ্য, শাশারামের ক্ষুদ্র এক জায়গীরদারের পুত্রের আক্রমণের কাছে হার মানলো তাই নিয়ে বিস্তারিত ভাবে উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। বাংলার সুলতানের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাসমূহ যা পূর্বের পণ্ডিতেরা সাময়িক সূত্র/উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন মাত্র, তাকেই সুনির্দিষ্টভাবে এবং বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আনা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে শের শাহের গৌড় বিজয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পূর্ববতী পণ্ডিতদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে হয়েছে। গবেষণাটি মূলত এককভাবে আফগানদের নিয়ে।] চতুর্থ অধ্যায়টি শেরশাহের বংশধরদের নিয়ে এবং বাংলায় তার কর্তৃত্বের সুসংহতকরণ বিষয়ে যা পূর্ববতী ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি তাতো আকৃষ্ট করেই নি এমনকি ফারসি ভাষার ঐতিহাসিকরাও তা উল্লেখ করেননি। বিষয়টা সম্ভব সর্বোচ্চ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এতে মুদ্রা, শিলা লিপি, পর্তুগিজ, আরাকানীয় এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন সূত্রের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে কিছু নূতন উপকরণ যেমন খোদাই করা বাণী, মুদ্রা এবং ফারসি ভাষার সাহিত্যকর্ম ‘গঞ্জ-ই রাজ এর সহযোগিতায় শামস আল দিন মুহাম্মদ শাহ গাজির বংশের রাজকয়ী উত্থান ও পতনের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায় হচ্ছে কররানী বংশের ইতিহাস। কিছু নতুন খোদাইকৃত বাণীর উদ্ধার আমাকে এতদসংশ্লিষ্ট কিছু পূর্ব ধারণার পুনঃব্যাখ্যা দিতে সক্ষম করেছে। সপ্তম অধ্যায় প্রধানত শেরশাহ সূরের প্রশাসনিক বিষয়ের ওপর নিবদ্ধ। অষ্টম অধ্যায়ে প্রথমবারের মতো দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে আফগান শাসনের কারণে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। নবম অধ্যায়টি উপসংহার যেখানে প্রধান বিষয়গুলোকে সংক্ষিপ্তকরণ করা হয়েছে। পরিশিষ্ট-১ এ ফরিদখান বাঘ/সিংহ হত্যা করে শেরখান উপাধি লাভ করেছিলেন মর্মে প্রচলিত সাধারণ বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করা হয়েছে। পরিশিষ্ট-২ এ মুদ্রা ও সাহিত্য কর্মসূত্রের ওপর ভিত্তি করে শের শাহের অভিষেক অনুষ্ঠান বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আরবি, ফার্সি, উর্দু এবং বাংলা ভাষার শব্দ বা বাগধারার ব্যবহারের ক্ষেত্রে উচ্চারণগত চিহ্নসমূহ তুলে দেওয়ার জন্য আমি পাঠকদের কাছে দুঃখিত। এটা করা হয়েছে শুধুমাত্র কম্পিউটারে লেখার সুবিধার্থে। আর এটা করতে গিয়ে আমি ঐ সব শব্দের বানানকে উচ্চারণের সরলতায় ব্যবহার করেছি।
আগেই বলেছি এ বইটি আমার ১৯৮৬ সালে সমাপ্ত পিএইচ. ডি ডিগ্রির জন্য কৃত সন্দর্ভের একটি সংশোধিত রূপান্তর। সন্দর্ভটি ১৯৮৭ সালে আমাকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি এনে দেয় যা আমি দেশের বরেণ্য ঐতিহাসিক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল করিমের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেছিলাম। আমার সমগ্র শিক্ষা জীবনে ড. করিমের অবদান অতুলনীয় ও ব্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স গ্রহণকালে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। ঐতিহাসিক গবেষণা কার্যক্রম তিনি আমাকে হাতে কলমে প্ৰশিক্ষণ দিয়েছিলেন সেই ১৯৬৮ সাল থেকে যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করি। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আমার পি.এইচ.ডি গবেষণাকালে তিনি আমাকে সফলভাবে গবেষণা সমাপ্ত করা পর্যন্ত নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আমার গবেষণা সহায়ক সব ধরনের উপকরণ ব্যবহারে সহজ প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। আমি তার কাছে চিরঋণী। আমার এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং গবেষণার সুপারভাইজার তার শেষ আনুষ্ঠানিকতাও সুচারুরুপে করেছেন আমার এই গ্রন্থের একটি মুখবন্ধ লিখে দিয়ে যা বইয়ের শুরুতেই দেখা যাবে। আমার পরম দুর্ভাগ্য এই যে তিনি বইটির প্রকাশিত রূপ দেখে যেতে পারেননি। আমার বাবা এবং আমার নিজের আধ্যাত্মিক গুরু আল হাজু শাহ সৃফি মুহাম্মদ আবুল হোসেন মুজাদেদী সাহেবের নিকট আমি অন্তরের দিক থেকে কৃতজ্ঞ। তার ভালবাসা, যত্ন এবং আর্শিবাদ। আমাকে আমার বর্তমান অবস্থান পর্যন্ত এনে দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবির স্যার এর কথা আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি। আমার গবেষণাকালীন সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগীয় সকল শিক্ষকের নিকট কৃতজ্ঞ। তাদের উৎসাহ ও সহযোগিতার জন্য আমি আমার ইতিহাস বিভাগীয় সকল জুনিয়র ও সিনিয়র সহকর্মীদের জানাই কৃতজ্ঞতা।
প্রফেসর মুকাদেসুর রহমান (মরহুম) এবং প্রফেসর আসমা সিরাজুদ্দিন-এর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ তারা সমগ্র গবেষণাকালে আমাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন। প্রফেসর সিরাজুদ্দিন আমার পাণ্ডুলিপির চূড়ান্ত সংস্করনটি আদ্যোপান্ত পড়েছেন, ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করে দিয়েছেন, সমালোচনা করেছেন এবং পরবর্তী সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বইটি প্রকাশনার বিভিন্ন স্তরে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছেন যা ছাড়া বইটির প্রকাশনা সম্ভব হতো না। আমি প্রফেসর মাহমুদুল হককে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই পাণ্ডুলিপির প্রাথমিক পাঠদানের জন্য এবং পরামর্শ প্রদানের জন্য, বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতার জন্য প্রফেসর মোহাম্মদ আলী চৌধুরী এবং মি. বকুল চন্দ্র চাকমাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।
আমাকে শিক্ষাছুটি প্রদান ও গবেষণা বৃত্তি প্রদানের জন্য আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট কৃতজ্ঞ। উপাচার্য প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ এবং প্রো- উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আলাউদিনের নিকটও আমি ঋণী। কারণ তারা চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বইটি ছাপার বিষয়ে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। এই গবেষণা কার্যক্রম চলাকালীন দেশে বিদেশে যে সমস্ত গ্রন্থাগার আমি ব্যবহার করেছি। তাদের গ্রন্থাগারিক ও সর্বস্তরের কর্মচারীদের আমি ধন্যবাদ জানাই আমাকে একান্তভাবে সহযোগিতার জন্য। আমি বিশেষ করে। ধন্যবাদ জানাই মি. এস.এম. আবু তাহের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিককে। আমি বিশষ ভাবে ধন্যবাদ জানাই মওলানা আজাদ কলেজ, কোলকাতার অবসর প্রাপ্ত উর্দু, আরবি ও ফার্সি ভাষার অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুস সুবহানস্যারকে। প্রফেসর মো. ইকবাল হোসেন, বিভাগীয় প্রধান,ইংরেজি, কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, এবং মি. মুফাখখারুল আনাম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ঢাকাকে ধন্যবাদ জানাই বিভিন্ন সময়ে তাদের সহযোগিতার জন্য। বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক সহায়তার জন্য আমি পরিচালক, প্রেস, জনাব সেকেন্দার আলমকে ধন্যবাদ জানাই। কম্পিউটারে টাইপ করে দেওয়া ছেলেটির জন্যও আমার স্নেহ ভালবাসা রইল।
আমার সহধর্মীণী মনোয়ারা বেগম (হীরা) এর অতুলনীয় ত্যাগ ও সার্বক্ষণিক উৎসাহ প্রদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ না করলে আমি আমার দায়িত্ব পালনে অ-কৃতজ্ঞই থেকে যাবো। আমার দুই সন্তান ডা. আব্দুস সালাম এমবিবিএস এবং স্থপতি ওয়ালী মুহাম্মদ, যারা তখন শিশু ছিল, তাদের আত্নত্যাগ না থাকলে আমি গবেষণা চালিয়ে যেতে পারতাম না। তারা দীর্ঘদিন আমার স্নেহ থেকে বঞ্ছিত থেকেও কোন অভিযোগ না। করায় আমার ঋণ অপরিশোধ্য হয়ে রয়েছে। এই বইয়ের প্রচ্ছদ মুদ্রণ, সুচিলিখন ও ডিজাইন করেছে স্থপতি সন্তান ওয়ালী মুহাম্মদ। পরিশেষে বিভাগীয় সকল নতুন ও পুরাতন সহকর্মীকে জানাই শুভেচ্ছা।
আবদুস সাঈদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অক্টোবর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ