০
১১৭৫ বার পঠিত
দুই লাখেরও উপর ভালো মানুষ। আর মন্দ বড় জোর শ’পাঁচেক। দুই লাখ ম্লান হয়ে গেলো এই শ’পাঁচেকের কাছে! এই দুই লাখের তুলনায় শ’পাঁচেক তো ‘সংখ্যালঘু’। এই লঘুদের নিয়েই ‘সংখ্যালঘু’ কার্ডটা খেলতে হলো একজন অভিনেতার। মা দিবসের একটা ছবি নিয়ে কথাটা উঠেছে। সেই অভিনেতা মার সাথে একটি ছবি পোস্ট করেছেন সামাজিকমাধ্যমে। এতে কিছু মন্দ মানুষ, মন্দ রিয়েক্ট দিয়েছেন, মন্তব্য করেছেন। তাই নিয়ে ‘সংখ্যালঘু’র লাল কার্ডটা খেলেছেন সেই অভিনেতা। জানি না, তিনি এটা বুঝে করেছেন, নাকি না বুঝে।
বোঝা বা না বোঝার হিসেবে অর্থটা কী দাঁড়ায়, যারা ভালো কথার দলে, যারা ভালো মানুষ, তাদের কোনোই মূল্য নেই সেই অভিনেতার কাছে। সামাজিকমাধ্যমে পাঁচ’শ মন্দ কথার প্রতিবাদে কবিতা রচেন তিনি, তবে দুই লাখ ভালো কথার পক্ষে অভিনন্দনপত্র হয় না কেন? তিনি কি দেখেননি কত মানুষ তার পাশে রয়েছে! এত মানুষের ভালোবাসায় পাঁচশ খারাপ মানুষকে উপেক্ষা করা যেত না। রুমি’র ভাষায় উপেক্ষা হলো বিশেষ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। অথচ তা না করে সেই পাঁচশ মানুষকে ফ্রন্টলাইনে টেনে আনা হলো! কেন আনা হলো?
এই ‘কেন’ এর মধ্যেই প্রশ্নটা। মন্দ বলার শতাংশের হিসেবেটা করলে তা ভাগে কত শতাংশ হয়, দশমিক পাঁচ শতাংশেরও কম। দশমিক পাঁচ শতাংশকে কেন বাকিদের উপর প্রাধান্য দেয়া হলো! এই হিসেবের মধ্যেই রয়েছে রহস্যটা। এ এক রহস্য নাটক। এমন নাটকে অভিনেতার ‘অভি’ বাদ গিয়ে শুধু ‘নেতা’টুকু থেকে যায়।
সব দেশেই কিছু মানুষ থাকে যারা মানসিক ভাবে ধর্ষকামী। ওহ, ধর্ষকামী’র মানেটা বলে নিই। ধর্ষকামী’র আভিধানিক মানে হলো, অন্যকে কষ্ট দিয়ে যে সুখ পায়। সুতরাং ধর্ষকামী মানে শুধুই যৌন নিগৃহকারী নয়। এরা শান্তির দেশ নরওয়েতেও আছে। রয়েছে নেদারল্যান্ডেও। আমেরিকার মতন দেশে ফ্লয়েডের মৃত্যুও তাই জানান দেয়। কিন্তু এর জন্য সামগ্রিক অর্থে সেই পুরো জনগোষ্ঠী খারাপ হয়ে যায় না। অ্যামেরিকার বেশির ভাগ সাদারাই হোয়াইট সুপ্রেমেসি’র সমর্থক নন। সামগ্রিকতায় সিংহভাগকে দোষ দেয়াটা আরেক সুপ্রেমেসি। যেটা আমাদের মতন দেশগুলোতে প্রায়শ দৃশ্যমান হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলি। সেখানে কি হিন্দু সুপ্রিমেসি জায়গা করতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরাই তো সেই সুপ্রিমেসিকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে ভোটে ধর্মপন্থীরা কোন কালেই খুব ভালো জায়গা করে নিতে পারেনি। ধর্ম সভায় প্রচুর মানুষ হয়, কিন্তু ভোট দেবার ক্ষেত্রে মানুষ ঠিকই রাজনৈতিক দলগুলোকেই বেছে নেয়। এখানে আরেকটা কথা পরিষ্কার করে নিই, ভোটে কিন্তু ধর্মীয় দল এবং ধর্মের বিরোধীতাকারীদের একই ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এ দেশের মানুষ। সংখ্যালঘু কার্ড যারা অযথা খেলতে চান, তাদেরও ভেবে দেখা দরকার বিষয়টি।
আপনি যখন দশমিক পাঁচ শতাংশের কম মানুষের দায় বাকিদের উপর চাপাতে চাইবেন তখন সঙ্গত বাকিরাও আপনাকে প্রত্যাখ্যান করবে। সবাই না করলেও যাদের বোধ-বুদ্ধি আছে যারা আপনার উদ্দেশ্য ধরতে পারবেন, তারা অবশ্যই আপনার থেকে দূরে চলে যাবে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের বাংলাভাষীদের ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে গেলে এই যে অল্প কিছু মানুষের দেখা মেলে, যারা মূলত ধর্ষকামী। এরা সংখ্যায় কিন্তু বেশি নয়, ধর্ষকামীরা বরাবরই সংখ্যায় লঘু। অথচ এই লঘুদের নিয়েই ‘সংখ্যালঘু’ কার্ড খেলা হয়। আর এই কার্ড খেলার চাণক্য সংলাপ হলো, ‘মানুষ হন’। যেন যারা মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্মালম্বী তারা মানুষ নন। ধর্ম হলো দর্শন। যারা মার্ক্সিস্ট, তারা মার্ক্সের দর্শনের অনুসারী। নাস্তিকেরা নিরীশ্বরবাদী। ‘হ্যাঁ’ যখন থাকে তখন তার বিপরীতে আরেকটা ‘না’ দাঁড়িয়ে যায়। ঈশ্বরবাদের বিপরীতে যেমন নিরীশ্বর বাদ। ভাববাদের বিপরীতে বস্তুবাদ। সুতরাং দর্শনকে অস্বীকার করা মানে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে অস্বীকার করা। এক অর্থে মানুষকেই অস্বীকার করা। কারণ মানুষ অন্য প্রাণী থেকে আলাদা শুধু চিন্তার ক্ষমতার জন্য। দর্শন সেই চিন্তার বড় উপাত্ত।
এই যে জাতীয়তার নামে, রাষ্ট্রের নামে মানুষ আলাদা সত্তা তৈরি করে, এটা কি মানুষ হবার বিপরীত কথা! পশুদের রাষ্ট্র নেই, সীমানা নেই, মানুষের আছে। মানুষ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারে বলেই, তারা মানুষ। এখন যদি বলেন, আপনার রাষ্ট্রের দরকার নেই, স্বাধীনতার দরকার নেই, সংস্কৃতির দরকার নেই এসব বাদ দিয়েই মানুষ হন। হওয়া যাবে কি? যাবে না। বড়জোর প্রাণী হওয়া যাবে। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ‘মানুষ হন’ সংলাপটি স্রেফ চালাকি। মানুষের সত্তার মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার ‘মানবিক’ কৌশল।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখবেন সেখানে ধর্ষকামী’দের ক্ষেত্রে হিন্দু নামের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে এর উল্টো; মুসলিম নামের সংখ্যা বেশি। ধর্মীয় সংখ্যাধিক্যের কারণেই এমনটা হয়। কিন্তু এদের প্রকাশের ধরণ কিন্তু এক। সেই ঘৃণাবাদ। ঘৃণাবাদীতাই এদের মূলমন্ত্র।
মুশকিল হলো এই ধর্ষকামীদের মধ্যে আবার দুটো শ্রেণি আছে। একটা রাজনৈতিক। অন্যটা হলো এমনি এমনি, জোশে হুশ হারানো পাবলিক। কিন্তু মূল ঘৃণাটা উস্কে দেয় রাজনৈতিক শ্রেণি। আর তাকে বয়ে নিয়ে চলে জোশে হুশ হারানো পাবলিকেরা।
রাজনৈতিক শ্রেণিটা কীভাবে উস্কে দেয় বলি। এই যে দুই লাখের বিপরীতে পাঁচশকে সিলেক্ট করে একটা সামগ্রিক আক্রমনাত্মক আবহ সৃষ্টি করা, যাতে এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় আরো বেশি সংখ্যক মানুষ। ঘৃণার পরিধিটা বিস্তৃত হয়। দুই দলে হানাহানিটা লেগে যায়। এতে লাভ কার হয়? লাভ হয় বানরের।
বানরের পিঠা ভাগের গল্পটা জানেন তো। ওই যে, দুই বিড়াল গৃহস্থের ঘর থেকে একটা পিঠা চুরি করে নিয়ে গেলো। মুশকিল বাঁধলো ভাগ নিয়ে। তুমুল ঝগড়া দুজনের। শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো বুদ্ধিমান বানরের কাছে যাবে তারা ভাগ করার জন্য। বানর পিঠা ভাগ করতে বসলো। একটু অসমান ভাগ হলো। তাকে সমান করতে গিয়ে বানর বেশি অংশ থেকে এক কামড় নিলো খেয়ে। কিন্তু কামড়টা বেশি হওয়াতে আরেক অংশ ছোট হয়ে গেলো। ওই অংশে আবার কামড়। কামড়ের ধারাবাহিকতায় ভাগের পিঠা পুরোটাই বানরের ভোগে চলে গেলো।
এই কামড়টাই হলো রাজনীতি। আপনাদের লড়িয়ে দিয়ে আপনাদের ভাগেরটা খেয়ে নেয়া। ভাগ করে শাসন করা। ভাগ করে শাসন করতে গেলে কিছু অপারেটর লাগে। যারা ঘৃণা ছড়ানোর কাজটা করবে, করে এবং তা সুকৌশলে। আর সে কৌশল হলো ষোল আনার মধ্যে দুই আনা খাদটা বের করে আনা। তারপর ওই খাদ তথা মন্দটাকে ফোকাস করা। তারপর সেই ফোকাসটাকে বিস্তৃত করা। যাতে দুটো পক্ষ সৃষ্টি হয়। তারপর? তারপর আবার কী, সব বানরের পেটে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন