এই লেখাটি অনেকের বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে । কিন্তু আমি নিরুপায় ।
বেঁচে আছি সেটাই তো সবচেয়ে বড় রহস্যময় একটা বিষয় ৷ কেউ যদি প্রশ্ন করে,
“কীভাবে বেঁচে আছেন বা কেন বেঁচে আছেন?”
উত্তর দেওয়াটা মোটেও সহজ হয় না । কীভাবে আর কী করে যে বেঁচে থাকা তা বেশিরভাগ মানুষই জানে না । জীবন আর মৃত্যু একটি সুতোর এপার ও ওপার মাত্র । জীবনের বিভিন্ন সময়ে সেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সুতোটা যাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে আমরা বাধ্য হই বা ছেড়ে না দিয়ে আর কোন উপায় থাকে না আজ তাঁদের কথা ও তাদের কথা ।
পক্ষকাল আগে ‘অস্ত্র পাচার’ শীর্ষক প্রবন্ধে আধুনিক এবং সমসাময়িক কালের লেখাপড়া ও শিক্ষাদীক্ষার সার্বিক হাল হকিকত বিষয়ক সামান্য এক আধটা উদাহরণকে সামনে এনেছিলাম । বলা যেতে পারে সে কেবল হিমশৈলের অগ্রভাগটুকু মাত্র । লেখাটির মুখবন্ধে বা দেহবন্ধে অনেক আশকথা-পাশকথা থাকলেও আমার দৃষ্টি এবং লক্ষ্যটি স্থির ছিল একটি বিশেষ বিষয়ে ।
এই দেশ, এই রাজ্যের পিছিয়ে পড়া গরীব এবং তথাকথিত অনগ্রসর, নিরক্ষর ও অসহায় মানুষগুলোর রোগব্যাধি, দুর্ঘটনা ও আপদ-বিপদের চিকিৎসার রূপরেখাটি অঙ্কন ।
সেই গভীর অন্ধকার ও তারমধ্যে ঘুরে বেড়ানো ছোট, বড় ও মাঝারি মাপের নানাধরনের ভূতের কথা আমি বলতে চেয়েছিলাম সেখানেই । যে ভূতেরা কেবল ঘাড়টি মটকায় না তারপরও সেই ভাঙা ঘাড় থেকে একটানা রক্ত চুষেই চলে রক্তচোষা বাদুড়ের মতো ।
কে যেন বলেছিলেন – A doctor is a visible god, – ডাক্তার হল দৃশ্যমান ঈশ্বর । কথাটি নিয়ে বিতর্ক করার লোক যে মোটেও পাওয়া যাবে না তা না । ঈশ্বরের আপন জোব্বার মধ্যে যাদের বসবাস তারা বলবে, কিসে আর কিসে – ঈশ্বরের সাথে ডাক্তারের তুলনা ৷ ব্যাটা পাপিষ্ঠ জানে না কী পাপ বা গুনাহ করলো ।
সে বলুক, তাতে কিছু যায় না আসেও না । সবাই জানে এরা যখন সুস্থ থাকে আর বিনা পুঁজির ব্যবসাটা ঠিকমতো চালায় তখন ঈশ্বর এদের কাছে প্রথম ও চরম স্থানাধিকারী । অসুস্থতার সময়ে বড় নার্সিংহোমের বড় ডাক্তার প্রথম স্থানাধিকারী তখন ঈশ্বর দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় অথবা তার পরের দিকের কোন একস্থানে চলে যায় । যদি প্রথমস্থানে থাকতো তাহলে এরা কোত্থাও যেতো না।
যদিও সেইসব হুজুর ও গুরুঠাকুররা আপৎকালে সবার আগেই পৌঁছে যায় সেরা নার্সিংহোমে এবং মারাত্মকভাবে খোঁজে তাঁদেরকেই যাঁরা অশাস্ত্রীয় ও অধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার- বদ্যি ইত্যাদি হয়েছেন । তখন কিন্তু এরা ডাকে না আপন আশ্রমে বা মাদ্রাসায় যাদের দিগগজ করেছে তাদেরকে ।
তাই মোটা দাগের সেই ধান্দাবাজদের কাছে সুক্ষ্ম দাগের ছবি আঁকার কোন মানেই হয় না ।
তবে, ডাক্তার কি সবাই ? না সবাই ডাক্তার হতে পারে ? সেরার সেরা ছাত্ররা মেডিকেল কলেজে বহু বছর পড়াশোনা করে দেশের সেরা সেরা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশ থেকে M.B.B.S./ M, D. F.R.C.S. / M.R.C.P. এইসব ডিগ্রি নিয়ে চেম্বারে বসে থাকলেও অসুস্থতার সময় এই আপনি – হ্যাঁ, আপনি নিজেও আপনার পরিচিত মানুষকে অন্তত একবার জিজ্ঞাসা করেন –
“ভাই, এইধরনের সমস্যায় ভুগছি, কোন ডাক্তারের কাছে যাবো বলুন তো । বা, কোন ডাক্তার ভালো এ বিষয়ে?”
ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় দেখেছি ও শিখিছি যে, সকলেই চিকিৎসক নয়, কেউ কেউ সত্যিই চিকিৎসক ।
২০১২ দিকে একটি ভয়ঙ্কর অসুস্থতা আমার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললো । কোলকাতার এক খ্যাতনামা , M.D, MRCP এবং যথেষ্ট বয়স্ক ও সফল চিকিৎসক, বিশাল নামডাক, যথেষ্ট আগে থেকে নাম না লেখালে তাঁকে দেখানো যায় না এমন এক ডাক্তারকে দেখালাম ।
এর আগে আমি, আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য তো বটেই আত্মীয় ও অনাত্মীয় সহ অনেক পরিচিত জনকে তাঁর নাম করেছি এবং ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় বহু জটিল ব্যাধি নিরাময়ও হয়েছে তাঁদের।
ডাক্তারবাবু আমার কাছে ধন্বন্তরি চিকিৎসক। কিন্তু এবারের এই সমস্যায় তিনি আর কিছুই করতে পারেন না। ওষুধ খাই, কাজ হয় না। দিনকে দিন অবস্থা আরো খারাপ ও আরো ভয়ঙ্কর হতে লাগলো । অবস্থা বুঝেই একদিন মরিয়া হয়ে তৎকাল টিকিট ম্যানেজ করেই চলে গেলাম C.M.C. ভেলোর, তামিলনাড়ুতেই ।
দু’সপ্তাহে ছোট-বড় মোট সতেরটি “মেডিকেল টেস্ট ” হল । অবশেষে সংশ্লিষ্ট রোগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক Dr. A. Balraj, MD,FRCS, প্রেসক্রিপশনে লিখলেন মাত্র একটিই ওষুধের নাম। সে ওষুধের নাম দেখে আমার চোখ উঠলো কপালে । এই ওষুধই তো গত দু মাসেরও বেশি সময়ধরে খাইয়েছেন আমার কোলকাতার ডাক্তারবাবু । কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম এবিষয়ে ।
অমায়িক সেই দক্ষিণী লেডি ডক্টর চোস্ত ইংরেজিতে ও অতি বিনয়ের সাথে বললেন, ” ডায়াগনোসিস ও মেডিসিন সিলেকশন ঠিক হয়েছিল, ঠিক যা হয়নি তা হল ওষুধের ডোজ সিলেকশন । ”
যে ট্যাবলেট সকালে একটা, দুপুরে একটা আর রাতে দুটো খাওয়ার কথা লিখেছেন আগের ডাক্তার এখন তার ডোজ তিনি লিখলেন – সকালে একটি ট্যাবলেটের অর্ধেক, দুপুরেও অর্ধেক আর রাতে দুটোর জায়গায় একটা । ব্যবস্থাপত্রে আরো লেখা ওই ডোজ প্রথম দশ দিনের জন্য । তারপরের দশ দিন শুধু রাতেই একটা ট্যাবলেট। তারপরের আরো দশ দিন শুধু রাতেই ওই ট্যাবলেটের অর্ধেক । তারপর আর ওষুধ খেতে হবে না । সসংকোচে বললাম, “ম্যাডাম, যদি হয় ? ” কোলকাতা ও ভেলোরের দূরত্বটা মারাত্মকভাবেই ভাবাচ্ছিল তাই মরিয়া হয়ে ওই জিজ্ঞাসা । আমার মুখ দেখেই তিনি আমার সমস্যা ও উদ্বেগ অনুধাবন করলেন । অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ের সাথে মিষ্টি হেসে বললেন – ” হবে না । আর যদি হয় তাহলে আমাকে মেইল করবেন। আপনার কেস হিস্ট্রি তো আমার ল্যাপটপে রইল । শুধু আপনার নাম ও হসপিটাল আই. ডি নম্বর আর সমস্যা উল্লেখ করেই মেইলটা করবেন । ”
আরও বললেন আগের চিকিৎসা মোতাবেক ওষুধ খাওয়া আরো মাস খানেক চললে আমার ঠিকানা নাকি বদলে যেত । মনে হল উনি আমার আগের ডাক্তারবাবুকে হয় নামে নাহলে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। শুধু বিড়বিড় করছিলেন –
উনি এই ভুলটা করলেন কীভাবে? কীভাবে? কীভাবে?
একথা বলার কারণ ছিল, কারণ কোলকাতার ডাক্তারবাবু মোটেও হেলাফেলার ডাক্তার নয় । তিনি একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক । চিকিৎসা জগতে তাঁর নাম অনেকেই জানেন। এই ভুল তাঁর না হলেই হয়তো ভালো হতো কিন্তু কী আর করা যাবে ! তাতে পূর্বোক্ত ডাক্তারের অন্যান্য কীর্তি তো এই ঘটনায় পুরো লোপ পায় না । কারণ আমি অন্যান্য বহু ক্ষেত্রেই তাঁর যে সাফল্য দেখেছি তা ভুলি কীভাবে ! তাই আজও মনেকরি ভুল সবসময়ই ভুল ।
অতঃপর Dr. A. Balraj তাঁর বিভাগের আরও পাঁচজন খ্যাতনামা চিকিৎসক যাঁরা প্রত্যেকেই MD ও এসোসিয়েট প্রফেসর র্যাঙ্কের ডাক্তার তাঁদের সবাইকে ডাকলেন ও আমার অসুস্থতার সমস্ত বিষয়টা তাঁদের সাথে সেখানেই আলোচনা করলেন । তাঁদেরকে সাবধানও করলেন যাতে এই ধরনের ব্যাপার না ঘটে কোন রোগীর ক্ষেত্রে সে বিষয়েই ।
তাজ্জব হলাম । চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগ ও রোগীর সাথে ডাক্তারের মনেপ্রাণে এই সংযুক্তি ভাবা যায় না !
অন্তত এখানে তা তো ভাবাই যায় না ।
যাঁরা বলেন ” ডাক্তার হল দৃশ্যমান ঈশ্বর ” জানি না তাঁরা ঠিক বলেন না বেঠিক কিছু বলেন ।
ছুটি হয়েগেল, বাড়ি চলে এলাম নির্দেশ মেনেই মেপে মেপে ঠিক ত্রিশ দিন ওষুধ খেলাম। একেবারে ঈশ্বরের কথা না উল্লেখ করলে অনেকেই রাগ করবেন তাই বলছি ঈশ্বরের কৃপায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম । কোন কিছুই আর করতে হয়নি । শুধু সুস্থতার সংবাদ সহ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে Dr. A. Balraj কে একটি মেইল করেছিলাম দু-মাস পরে । তাঁর রোগী ভালো আছে জেনে তিনি সন্তোষ প্রকাশ ক’রে ও অভয় দিয়ে একটি জবাবি মেইল পাঠিয়েছিলেন।
দুই হাজার বারো সাল ও আজ দুই হাজার উনিশ সাল, ব্যবধান অনেক কিন্তু সেই সমস্যা আর হয়নি ।
বর্তমান লেখাটিতে যে কথাটি আমি পরিস্কার করে এবং অকম্পিত কন্ঠে বলতে চেয়েছি তা নিশ্চয়ই জ্ঞানী, গুণী ও বোদ্ধাজন বুঝেছেন । তাহল চিকিৎসা কোন সামান্য বা তুচ্ছ বিষয় না ।
সুশিক্ষিত,সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, মেধাবী, পরিশ্রমী ও যত্নশীল চিকিৎসদের যেখানে ওষুধ ও তার ডোজ নিয়ে শতবার ভাবতে হয় সেখানে গত লেখাতে আট, নয়, কিম্বা দশ এগারো, বারো, তের, চোদ্দো কেলাস পাশ অথবা ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের M.A এর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারা যখন স্রেফ পঞ্চাশ – একশ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র মানুষের হাজার হাজার শিশুকে শ্মশান কিম্বা গোরস্থানের দিকে ঠেলে দেয় তখন জেনে-বুঝে আর চুপ করে থাকা যায় না।
যখন দেখি এরা বিজ্ঞাপনও দিয়েছে যে, কম খরচে হার্টসার্জারীও এরা করে দেবে তখন মাথাটা পুরো বনবন করে ঘোরে আর মনেহয় নিজের হার্টটি এবার ফেইল-ই করে যাবে ।
কোলকাতা থেকে চার পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে যেখানে অটোরিকশা আর মেশিনভ্যান এবং ক্ষেত্রবিশেষে নৌকা এই হল তিনমাত্র ( একমাত্র বলা গেল না ) যানবাহন আর যেখানে বিদ্যুতের খুঁটিটি পোতা থাকলেও সারাদিনে তার তার জীবিত থাকে না, আবার যখন দয়াকরে তাতে জীবন আসে তখন হাজার হাজার বেআইনি হুকিং তার সব তেজ শুষে নিলে যে বেহাল অবস্থা হয় তাতে বাল্বের চারপাশ থেকেও দূর হয় না ভূতুড়ে অন্ধকার । হায় চিকিৎসা! এখানেও হবে হার্ট সার্জারী !
কেউনা কেউ তো নিশ্চয়ই এই ভূতুড়ে ফাঁদে পড়বেই । নাহলে আর খরচ করে এত সুন্দর বিজ্ঞাপনই বা দেওয়া কেন !
সব নিয়ে জোচ্চুরি ও জালিয়াতি সয়। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে যে সমাজ জোচ্চুরি ও ছেলেখেলা করে তার বিনাশ কেউ রোধ করতে পারে না । তার বিনাশ একেবারেই আসন্ন ।
যদিও দুই তিন দশক আগের গ্রাম আর নেই । সেখানে এখন হয় পিচের রাস্তা নাহলে সিমেন্টের ঢালাই পাকা রাস্তা । আধঘন্টা থেকে একঘন্টার মধ্যে যন্ত্রচালিত ভ্যানে, অটোরিকশায় চলে যাওয়া যায় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তবু্ও এই হল প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ স্বাস্থ্যের প্রকৃত চিত্র ।
জীবনে যারা ডাক্তারির ‘ড ‘ টির সাথেও পরিচিত নয় তারা কিন্তু নিজের দেওয়া বিজ্ঞাপনেই নিজেকে ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলে নিশ্চিত হয়েগেছে । গায়ে কাপড় আর মাংস এবং মাথায় স্বাস্থ্য চেতনা না থাকা নিরক্ষর মানুষদেরকে শেষ করে তাদেরই মরণাপন্ন শিশুর আয়ুটিকে বিশেষভাবে সংক্ষিপ্ত ক’রে আনছে যারা তাদেরকে আর কীইবা বলবো ? যা বলার লোকেই বলুক ।
দশকের পর দশক ধরে এই জিনিস চলছে । ইত্যবসরে আমরা ডিজিটাল দেশের ডিজিটাল নাগরিকও হয়ে গেছি । দেশি ও বিদেশি টাকামারা NGO বা অন্য কোন মানব হিতৈষী দল বা সংস্থা হেল্থক্যাম্প করে এ বিষয়ে কিছু বলবেও না । উদ্বৃত্ত মানুষের এই দেশে হারাধনদের ছেলেদেরকে যে পারে সে ধরে ধরেই খাক । আমার সন্তানকে তো আর এই বিশেষভাবে অজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাচ্ছি না ! এই হল মানসিকতা ।
নীরবে ও তিলতিল করে সংঘটিত হওয়া এইসব অপরাধের কথা কে বলবে আর কেইবা মোমবাতি জ্বালাবে ? এরমধ্য তো দেশপ্রেমিক ও সক্রিয় মানবতাবাদী হওয়ার কিচ্ছুটি নেই ! কে যে বলে, – আমাদের বিবেক জাগ্রত নয় ! আমরা জাগ্রতই আছি, আর যদি ঘুমিয়েও থাকি তাহলে তা জেগেই ঘুমাচ্ছি, তাতে কার পিতারবা কী ?
এইসব ডাক্তারের কাছে জাল ওষুধের জোগান আর তার প্রয়োগ জলভাত । এরা ছাড়া আর কেইবা কববে সে কাজ ? সে আর এক দীর্ঘ উপখ্যান । এখানে তার জায়গা হবে না ।
হাজারের ব্যতিক্রমেও পাওয়া যাবেনাএইসব ডাক্তারদের ব্রাহ্মণ, কায়েত ও বদ্যি রোগী । তাঁদের তাল তেঁতুল বোধ আছে । তাঁরা মরলে জাত বদ্যির (Qualified Doctors) হাতেই মরবে । ডাক্তার নয় এমন বেজাতের বদ্যির কাছে অন্তত মরতে আসবে না । এদিকে মরা গরীব ও অশিক্ষিত মুসলমান, নমশূদ্র, বাগদি ও আদিবাসী ইত্যাদি মানুষেরা ভাবে ডাক্তারবাবু আর কিছু না হোক অন্তত তাদের নিজের লোক, আপনা আদমি । তাই তাকে ভরসা করাই যায় । সে মাথাটিও আরো একদল অনেক আগে থেকেই চিবিয়ে রাখে । তাদের কথা এখানে নাইবা বললামই ।
অশিক্ষিত ও অর্ধ উলঙ্গ সংখ্যালঘু, তপশিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ ও তাদের সন্তানেরা এই ভূতুড়ে অন্ধকারের বিশেষ শিকার । যেখানে এদের বাস সেখানে এইরকম ডাক্তারি ব্যবসার রমরমা ।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এইসব ডাক্তার অন্য জায়গা থেকে সামান্য কিছু এলেও এইসব প্রান্তিক মানুষ ও তাদের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের কিছু অতিচতুর এই পন্থাটি নেয় । মাছের মায়ের তো পুত্রশোক না থাকারই কথা, তাই না ! আর কওমের প্রশ্ন এলেই এরা সব এক একটা কওমি নেতা ৷ কওমের কোন ক্ষতি এরা কিছুতেই হতে দিতে পারে না যে । সেই মারাত্মক অপবিত্র ও নাপাক কাজটি ক’রে কেনইবা এরা খামাখা রৌরব নরক কিম্বা হাবিয়া দোজখে যাবে !
বেশ কয়েক বছর আগে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের স্থানীয় এক শাখাতে এক কর্মী এলেন । নাম রামচন্দ্র সরদার । আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ । অত্যন্ত সজ্জন ও সরল এক মানুষ । ধীরে ধীরে আলাপ পরিচয় ভালোই হল ।
ভদ্রলোকের বয়স তখন ৩৫ এর কিছু এদিক ওদিক। একদিন হঠাৎ শুনলাম তিনি মারা গেছেন। অবাক হয়ে গেলাম !
অনুসন্ধান করে জানা গেল ভদ্রলোকের অর্শ রোগ ( piles ) ছিল এবং সেটি সারাতে স্থানীয় এক চাঁদসী ডাক্তার এন. সি. হালদারের কাছে তার অপারেশন মানে অস্ত্রোপচার করান এবং সেই ক্ষত বিষিয়ে গিয়েই তাঁর অকাল মৃত্যুটি হয় ।
সরল রামচন্দ্র সরদার চাঁদসীর ক্ষত চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ ডাঃ এন.সি. হালদারের বাইরের কেতা আর লম্বাচওড়া বুলিতে সরলভাবে তাকে বিশ্বাস করেই তাকে ধন্বন্তরি ডাক্তার ভেবে ফেলেন এবং এও ভাবেন যে তাঁর সমস্যার জগদ্বিখ্যাত ডাক্তারটি হল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এন. সি. হালদারই। অতএব তার কাছেই করা যায় অপারেশনটি । এক সাদাসিধা সরল মানুষের সরল বিশ্বাস ও এক ঠগের প্রতারণার গল্পটি শেষ হল সরল মানুষটির মৃতদেহের উপর দিয়েই । এ গল্পটিও ডাক্তারীর গল্প ।
চূড়ান্ত বিয়োগান্ত পরিস্থিতির শেষে স্থানীয় কেউ কেউ যখন এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এন. সি. হালদারের বিখ্যাত চেম্বারে গেল তখন দেখা গেল তার ডাক্তারখানার ঝাঁপটি বন্ধ । বাইরে চকচক করছে গোটা চার-পাঁচ ভারী তালা । পাশের লোকেরা জানালো যে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এন. সি. হালদার রোগী আর. সি. সরদারের অবস্থা বুঝেই নিরাপদ সময়টি হাতে রেখেই পৌঁছে গেছেন তার উত্তর চব্বিশ পরগণাস্থিত গাইঘাটার বাড়িতেই ।
দৃশ্যমান ঈশ্বরের পাশাপাশিই তো ঘুরে বেড়ায় অদৃশ্য শয়তান । অতএব সাধু সাবধান ।