১২৪৪ বার পঠিত
বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকে দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি শেখানো হয়ে থাকে। অনেকে ধর্মীয় কারণে আরবীও শিখে থাকেন। তারপরও ইংরেজি ভাষায় ভাবপ্রকাশে আমরা পারংগম নই । একটানা দশ-বার বছর ইংরেজি শিখেও আমরা ইংরেজি বলতে পারি না, শুদ্ধভাবে বলা দূরের কথা।
আমাদের কোন এক এমপি বা মন্ত্রী ইংল্যান্ডে ভ্রমণশেষে দেশে ফিরে বলেছেন, আর যাহোক ওখানকার বাচ্চারা পড়াশোনায় খুব ভাল, দেখলাম ফরফর করে ইংরেজি বলছে। জোকস্ হতে পারে, আবার সত্যও হতে পারে কারণ গতকয়েক সংসদে যে ধরণের লোক মন্ত্রী হচ্ছেন তাদের পক্ষে এ ধরণের মন্তব্য করাটা অস্বাভাবিক না। এছাড়া নজির আছে, পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পীদের বলেছিলেন, ‘আপনারা রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না’।
ইংরেজিতে কথা বলা এত কঠিন কিন্তু দেখা যায় মিডল-ইস্টে দু’বছর কাজ করে এসে গ্রামের অশিক্ষিত লোকজন আরবী বলতে পারছে। গ্রামে-গঞ্জে দেখা যায় আরব-ফেরত দুজন একসাথ হলে বাংলায় সবকথা বললেও তাদের গোপন কথাগুলো আরবীতে বলছে। বাংলায় আরবের বদনাম করা যাবে না, যা বলার আরবীই শ্রেয়, লোকজন বুঝতে পারবে না। আমাদের গ্রামের একজন বিদেশ থেকে দেশে চিঠি লিখেছে, ‘এখানে সবকিছু আরবীতে বলে শুধু আজানটা বাংলায় দেয়।’ সেও দেখা গেল বছর কয়েকের ভিতরে ভাল আরবী শিখে ফেলেছে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? শিক্ষামাধ্যমে দ্বিতীয় ভাষা শেখার এত চেস্টা-চরিত্র করার পরেও কেন উন্নতি হচ্ছে না? আমার মতে দ্বিতীয় ভাষা শেখাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু না করে আরও দেরীতে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে শুরু করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন,’ আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন।’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখলেও শুধু অক্ষর পরিচয় আর শব্দ আর ছড়া (রাইম) শিখতে পারে। শুরুতেই একেবারে বাক্যগঠন , ‘দ্য কাউ’, ‘জার্নি বাই বোট’ ইত্যাদি রচনা মুখস্হ করতে শেখানোটা বোকামি। আমরা ভাষা শেখা শুরু করি মাঝখান থেকে, ফলে আজীবন গোড়ায় গলদ থেকে যায়।
বিদেশী ভাষা যদি শিখতে হয় , এসএসসি বা কলেজ পাশ করে কোন প্রতিষ্ঠানে শিখে নিলেই হল। ততদিনে মাতৃভাষা বাংলা আপনার আয়ত্বে। সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাষা আপনি এক বছরের চেষ্টায় ইংরেজির চেয়ে ভাল শিখতে পারবেন, অথচ ইংরেজি আপনাকে ক্রমাগত দশ-বার বছর যাবত শেখানো হয়েছে।
বর্তমান সিস্টেমে কলেজ পাস করেও আপনি ইংরেজি শিখতে গেলে দেখবেন ভাল শিখতে পারছেন না। একটা গল্প বলি,দু’বন্ধু ওস্তাদের কাছে গান শিখতে গেছে। একজনের আগে কিছু শেখা ছিল, আরেকজন কখনও গান গায়নি। ওস্তাদ বলল, যে কখনও গান শেখেনি তার লাগবে ছয়শত টাকা আর অন্যজনের বারশত টাকা। যে গান শিখেছে সে বলল, আমিতো কিছু জানি, আর ও কিছুই জানেনা, তাহলে ওর কম লাগবে কেন ? ওস্তাদ বলল, ও তো কিছুই জানে না তাই যা শিখবে তাই ওর কাছে নতুন, আর তোমার ক্ষেত্রে আমাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। যা কিছু ভূল শিখেছ তা শোধরাতে হবে, তারপরে নতুন করে শিখবে।
এখন কোন ভাষা শিখবেন, অবশ্যই ইংরেজি প্রথম, তারপরে অন্যভাষা। ভাষা শেখার জন্যে ইংরেজি খুবই সহজ ভাষা। একটা কথা প্রচলিত আছে, আপনি ত্রিশদিনে ইংরেজি শিখতে পারবেন। ফরাসী ত্রিশমাসে, আর , জার্মান ত্রিশবছরে। ইংরেজি আর বাংলা গ্রামারে বিশেষত লিঙ্গভেদ এবং কাল বা সময়ের(টেন্স) ব্যাপারে প্রচন্ড মিল। ফলে বাংলাভাষীরা অনায়াসে ইংরেজি বুঝার কথা।
ফরাসী এরথেকে পৃথক, অনেকগুলো কাল। ক্রিয়াপদের রুপ আর প্রতিটি শব্দের লিংগ জানতে অনেক সময় লাগে, সবকিছু হয় পুংলিংগ বা স্ত্রীলিংগ, ক্লীবলিংগ বলে কিছু নেই। ফরাসীতে হিন্দীর মত ক্রিয়াপদেরও লিংগান্তর আছে। যেমন, মেয়ে হলে বলে, ‘যাতি হু ম্যায়।’ ছেলে হলে বলবে,’ যাতা হু ম্যায়।’ ফরাসীর একটা জিনিস আবার বাংলার মত উচ্চারণে,বর্ণনায় আপ-ডাউন নেই, একেবারে বহতা নদীর মত। ইংরেজি এর ব্যতিক্রম, শব্দের আগে পিছে বিভিন্ন জায়গায় জোর দিতে হয়। তবে কোন কিছু পরিষ্কার বুঝাতে হলে ফরাসী একমাত্র ভাষা।ওরা বলে, সো নে পা ক্লের্, নে পা ফ্রঁসেই, অর্থাত্ কোন কিছু বুঝতে পরিষ্কার না হলে তা ফরাসী না। যেমন, তার বন্ধুরা সেখানে উপস্হিত ছিল। পূর্বোল্লেখ না থাকলে বুঝা যাবে না , তার, বন্ধু(রা) কি পুরুষ না মহিলা। কিন্তু ফরাসীতে এ সমস্যা নেই, সব বুঝা যায়। এছাড়া উচ্চারণ একটা গঠনরীতি মেনে চলে। ইংরেজিতে যেমন বি ইউ টি- বাট , কিন্তু পি ইউ টি- পুট, এটা ফরাসী ভাষায় একেবারে নেই। অনেকে বাংলাকে বলে থাকেন এশিয়ার ফ্রেন্চ। আর জার্মান পুরোপুরি খটমটো ভাষা, সবসময় মনে হয় এটেনশান। লোকে বলে জার্মানরা শুয়ে বা বসে প্রেমালাপ করতে পারে না। ডাহা মিথ্যা, জার্মানরা রোমান্টিসিজমের জনক। তবে জার্মান ভাষায় প্রচুর পরিমাণে সমাসবদ্ধ শব্দ, এককথায় প্রকাশ, বাংলায় যেমন , অঘটনঘটনপটিয়সী,কিংকর্তব্যবিমুড়। তাই শব্দ শিখেও এগুলো না জানা এবং সঠিক প্রয়োগ আয়ত্ব না করা পর্যন্ত বিপদ।
এশিয়ায় প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিবর্তনের দিক থেকে আদিম অবস্হানে আছে চীন,জাপান আর কোরিয়ার ভাষা। এখনও সিম্বল বা প্রতীকের মাধ্যমে তারা ভাব প্রকাশ করে। জাপানীরা বলে কান্জি। ৮-১০ হাজার প্রতীক শিখলে আপনি পত্রিকা পড়তে পারবেন। জাপানীরা নিজেদের ব্যাপারে আবার খুব বিনয়ী। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান লিখেছেন , কারও বাগান দেখতে হলে বলবে, ‘কেন আই লুক এট ইউর গজাছ,বিউটিফুল গার্ডেন?’ আর নিজের ক্ষেত্রে বলবে, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু ভিজিট মাই হাম্বল গার্ডেন।’ ফাইনম্যান জাপানে অবস্হানকালে দেখলেন, সবাই তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। কিছু বললে একসাথে তিনচারজন লাফ দিয়ে ওঠে তা করার জন্যে। একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কি আমি কিছু বললে সবাই এরকম করে কেন? সে বলল, মিঃ ফাইনম্যান আপনি যেভাবে জাপানীজ বলছেন, তা আদেশমূলক। জাপানীরা এমনিতে খুবই বিনয়ী, আদেশ শুনে ভাবছে আপনি খুব রাগী, তারা আপনার যথেষ্ট সেবা করছে না। ফাইনম্যান বুঝলেন সমস্যাটা কোথায়। উনি জাপানীজ শিখছেন, মিলিটারী গাইডবই থেকে।
চীনা ভাষায় আবার ক্রিয়াপদের কোন কাল নেই। কাল বুঝাতে তারা শব্দ ব্যবহার করে।যেমন, আই গো দেয়ার ইয়েস্টারডে। আই গো দেয়ার টুমরো। জানি না তারা আরও অতীতে কিভাবে যায়? যাই হোক ,চায়নীজ, কোরিয়ান,জাপানীজ এ তিনভাষা সবচেয়ে কঠিন আয়ত্ব করা। আমরা যে পরিমাণে ‘চাইনিজ’ খাচ্ছি বাংলাদেশে , তার সাথে পাল্লা দিয়ে চাইনিজদের সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে শেখার জন্য চাইনীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স আছে যাতে জাপানীজ ভাষা শুধু বলতে শেখানো হয়। আমি নাম দিয়েছি, ‘মূর্খ জাপানী’,অশিক্ষিত একজন জাপানীজ যেমন শুধু তার ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে। খুবই কার্যকরী, অল্পসময়ে আপনি জাপানী ভাষায় ভাববিনিময় করতে পারবেন। আমাদের আরবী শেখাটা আবার অন্যরকম, পড়তে জানি, বলতে বা বুঝতে পারি না। অবশ্য তাতে সওয়াবের ব্যাপার জড়িত। মুর্খ জাপানীতে সওয়াব হয় কি না জানি না, তবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়।
আমাদের আরবী জ্ঞানের মত নামগুলো অনেকসময় আরবীতে যা মানে দাঁড়ায় জানলে তা অনেকসময় অসম্মানজনক। যেমন, হারেস মানে দারোয়ান। জানলে হয়ত কেউ এসব নাম রাখত না। আমাদের মত মিসকিনদের , রফিক কাতেরাল্লা,রফিক খাতেরাল্লা জানাটাই সিরাতুল মুস্তাকিম বা সোজা রাস্তা। তবে মডার্ণ এরাবিক শেখা যেতে পারে, খুবই চালু ভাষা। কায়দা, আমসিপারার আরবীর চাইতে অনেক সোজা বলে শুনেছি।
ইংরেজির আবার রকমফের আছে। ব্রিটিশ, আমেরিকান, পিজিন,ক্রেওল ইত্যাদি। এরমধ্যে ঝগড়া হলো আমেরিকান আর ব্রিটিশ ইংরেজির। বার্নাড শ বলেছেন, আমেরিকা এন্ড ইংল্যান্ড আর টু নেশন ডিভাইডেড বাই কমন ল্যাংগুয়েজ। আমেরিকানরা এতটা পরিবর্তন করেছে যে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট বা ইংলিশ বুঝতে চায় না বা পারে না এবং হাসাহাসি করে। যদিও হলিউডে ব্রিটিশ উচ্চারণের কদর অনেক। একটা মজার কথা প্রচলিত আছে, আপনি যদি দু’টি ভাষা জানেন তাহলে বাইলিংগুয়াল, তিনটি জানলে ট্রাইলিংগুয়াল, আর একটা ভাষা জানলে আপনি আমেরিকান। আমার মতে শিখলে আমেরিকান অ্যাকসেন্ট শেখা ভাল। ভারতীয়দের অ্যাকসেন্ট নিয়ে লোকজন হাসাহাসি করলেও সাহিত্যের বাজারে ওদের অবস্হা রমরমা। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত সবচেয়ে বড় ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রি। বিশ্ববাজারে ঐ ইংরেজি দিয়েই তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু যে কাজের জন্যে ভাষা শিখতে হবে এমন নয়। অনেকে শুধু মূলভাষায় সাহিত্য পড়ার জন্যে রাশান ভাষা শিখে থাকেন। আমাদের প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা মূলভাষা থেকে ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ করার জন্যে জার্মান ভাষা শিখেছেন। অনেকে কারিকুলাম ভিটায় ভাষাগত যোগ্যতা দেখাতে, ইমিগ্রান্ট হতে ভাষা শিখেন। যেমন এক বন্ধু লিখেছে, বাংলা মাতৃভাষা, বলতে পারে ইংরেজি,হিন্দী, লিখতে পারে ইংরেজি,বাংলা , পড়তে পারে বাংলা,ইংরেজি। বলা উচিত, শুনতে পারি সব ভাষা, কিন্তু বুঝি এই কয়েকটা।
দ্বিতীয় ভাষা শেখার আরও গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি লন্ডন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, দ্বিতীয় ভাষার চর্চা মগজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমার মনে হয় আলঝেইমার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখতে পারে। তবে স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা শেখার সমস্যাটা সবদেশেই আছে। ইংল্যান্ডে দেখা যায় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাচ্চারা স্কুলে ফরাসী বা জার্মান শিখে। কিন্তু কাজের সময় দেখা যায় আসলে তেমন শিখতে পারেনি। আমেরিকায় তেমনি স্কুলে স্প্যানিশ শিখে বাচ্চারা তেমন বলতে পারে না। আমার মনে হয় মাতৃভাষার বাইরে কিছু শিখতে হলে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রয়োজন,ম্যাচিওরিটি আর আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটা দরকার। স্কুলের পাঠ্য হলে একধরণের বোঝা মনে হয়। নাহলে সেই গল্পের মত, ভাইয়া কথা বলিস না স্যার কিন্তু পড়াচ্ছে।
আরেকটা বিসষয়, ভাষা শুধু পড়াশোনা বা লেখার ব্যাপার নয়। যে উদ্দেশ্যেই শেখা হোক না এ হল আরেকটা সংস্কৃতির সাথে একাত্ব হওয়ার একটা উপায়। তাই ভাষা শেখার সাথে সাথে ঐ ভাষার সংস্কৃতির যোগাযোগ ঘটাতে হবে। আমি যদিও অতি অল্পবয়সে আরেকটি ভাষা শেখানোর পক্ষপাতী নই, তবু কিছু পরিবর্তন করা যেতে পারে। একটা ছোট্ট উদাহরণ, মিঃ আলী ইজ আ পুওর ফার্মার না বলে মিঃ জন বা পিটার বলাটাই সংগত। আলী ,সাবিনা, গণি মিয়া এরা ইংরেজিতে কথা বলে না। ছোট শিশু যখন পড়বে সাথে ছবিতে প্যান্টপরা জন বা পিটারকে ট্রাক্টর দিয়ে চাষবাষ করতে দেখবে তখন তার কল্পনায় সে অনেকদূর চলে যাবে। আলী বা গণি মিয়াকে সে বাংলা বইতে পড়বে। মোট কথা ভাষার সাথে ঐ ভাষায় প্রচলিত কালচারকেও শিখতে দিতে হবে, না হলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।