সতর্কতা:
‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস‘ উপন্যাসের বাংলা ভার্সন প্রকাশকের পূর্বানুমতি ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না, কিংবা অনলাইন বা অফলাইন কোনো মাধ্যমেই ই-বুক করে বিতরণ করা যাবে না। কেউ এ ধরনের কাজ করলে তা আইনবিরুদ্ধ কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস‘ বইটির বাংলা সংস্করণ বাংলাদেশের প্রথিতযশা প্রকাশনা অঙ্কুর প্রকাশনীর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘চারদিক প্রকাশনী‘ থেকে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, যা অনুবাদ করেছেন সালেহ মুহাম্মদ। বইটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা ও কৌতুহলের কারণে এই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারীর সাথে যোগাযোগ করি। তাঁকে অনুরোধ করি আমরা যেসব বাঙালিরা প্রবাসে আছি, যাঁরা ইচ্ছে থাকলেও বাংলা বই সংগ্রহ করতে পারি না, সেইসব পাঠকদের জন্য নবযুগ ব্লগে বইটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করলে পাঠকরা উপকৃত হতো। চারদিক কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন এবং আজ থেকে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইটির বাংলা সংস্করণ ধারাবাহিকভাবে নবযুগ ব্লগে প্রকাশ হবে। এজন্য ‘চারদিক’ প্রকাশনীর প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা। নবযুগের পাঠকদের নিয়মিত নজর রাখার অনুরোধ রইল। পাশাপাশি যাদের পক্ষে সম্ভব তাঁরা বইটির হার্ডকপি সংগ্রহ করতে পারেন। – ধন্যবাদ
======================
পূর্ব প্রকাশিতের পর…
হয়তোবা এই কারণটির জন্যেই, কেই তাকে গুরুত্বসহকারে নিল না।
যে বন্য হিংসেমী, সমাপ্তিহীন উত্তেজনা আর বারবার পাল্টাতে থাকা বিশ্বস্ততা খোয়াবগার দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল, নাটকীয় বিদায় এবং সম্ভাব্য আত্মহত্যার ঘোষণা ছিল তার প্রতি একটি বেশ নিয়মিত প্রতিক্রিয়া। আবারও একবার, সবাই পরামর্শ দিল ডাক্তার এবং পিলের। ড. ভগতের পিল সবকিছু ঠিক করে দিতে পারে, তারা বলল। সবাই ওগুলার উপরেই আছে। “আমি সবাই না,” আঞ্জুম বলল, আর সেটা আরেক দফা ফিসফিসানির সূচনা করল (পক্ষে এবং বিপক্ষে) যে অহংকারের চোরা গর্তগুলো কেমন আর আঞ্জুম নিজেকে ভাবেনটা কী?
নিজেকে কি ভাবেন তিনি? খুব বেশি না, অথবা অনেক বেশি, নির্ভর করবে আপনি কিভাবে দেখছেন বিষয়টাকে। তার উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল, হ্যাঁ। এবং সেগুলোতে এখন আর কোন অস্পষ্টতা নেই। এখন তিনি চাইছেন দুনিয়ায় ফিরে যেতে এবং একজন সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করতে। তিনি চান একজন মা হতে, ঘুম ভাঙলে তার নিজের বাসায় জেগে উঠতে, জয়নাবকে একটা স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে দিতে এবং তাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিতে তার বইপত্র আর টিফিনবক্সের সাথে। প্রশ্নটি ছিল যে, এই ধরনের উচ্চাকাক্সক্ষাগুলো, তার মত একজনের জন্য, যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক ছিল?
জয়নাব ছিল আঞ্জুমের একমাত্র ভালোবাসা। তাকে আঞ্জুম পেয়েছিলেন তিন বছর আগে। সেদিন ঝড়ো বাতাসের এক দুপুর। এরকম দুপুরগুলোতে ঈমানদারদের প্রার্থনার টুপি তাদের মাথা থেকে উড়ে যায় আর বেলুনবেচা লোকদের বেলুনগুলো সব কাত হয়ে থাকে একদিকে। একটা বাচ্চা একা একা বসে খুব চিৎকার করছিল জামা মসজিদের সিঁড়িতে। বড় বড়, ভীত চোখ। দেখতে বেদনাদায়ক ভাবে শীর্ণ ইদুরের মত একটা জিনিষ। আঞ্জুম আন্দাজ করলেন যে বাচ্চাটার তিন বছরের মত বয়স হবে। গায়ে ছিল একটি ফ্যাকাশে সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ আর একটা ময়লা সাদা হিজাব। আঞ্জুম আবির্ভুত হলেন তার সমানে আর ধরার জন্য একটি আঙুল বাড়িয়ে দিলেন। শিশুটি একবারের জন্য দ্রুত উপরে তাকিয়ে দেখল। তারপর আঞ্জুমের আঙুলটা আকড়ে ধরল আর কোন প্রকার বিরতি ছাড়া কেঁদে চলল। হিজাব পরা ইদুরটার কোন ধারণাই ছিল না যে, যার আঙুলটি সে ধরল তার অন্তরে কি ভীষণ ঝড় তুলে দিল তার বিশ্বাসের সেই অতি সাধারণ ভঙ্গিমাটি। আতঙ্কের বদলে সেই ক্ষুদ্র-প্রাণীটির কাছ থেকে উপেক্ষিত হওয়াটা এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সেই ব্যাপারটাকে প্রশমিত করল যেটাকে নিম্মো গোরাখপুরী বলত ইন্ডিয়া-পাকিস্তান। আঞ্জুমের ভেতরে যুদ্ধরত দলগুলোর মাঝে নেমে আসল নীরবতা। একটা যুদ্ধক্ষেত্রের বদলে নিজের শরীরটাকে তার মনে হল একজন স্নেহশীল আশ্রয়দাতা। এটা কেমন ছিল? মৃত্যুর মত, নাকি জন্মানো? আঞ্জুম সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। তার কল্পনায় ঘটনাটির যে পূর্ণতাটুকু ছিল, যেই সমগ্রতার বোধটি ছিল, তা ছিল জন্ম বা মৃত্যুর যেকোন একটির। তিনি নিচু হয়ে উঠিয়ে নিল ইদুরটাকে। তাকে দুহাতের মাঝে নিয়ে একটু দোল খেলেন। আর পুরো সময়টা বিড়বিড় করে গেলেন তার কলহরত কন্ঠে। এটাও বাচ্চাটাকে তার চিৎকারের প্রকল্পটি থেকে ভীত বা মনোবিচ্ছিন্ন করতে পারল না। কিছু সময়ের জন্য আঞ্জুম শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন সেইখানে, আনন্দিত মুখে হাসতে হাসতে, যতক্ষণ তার বাহুবদ্ধ প্রাণীটি কেঁদেই চলল। তারপর তিনি তাকে সিঁড়িতে নামিয়ে রেখে কিছু জ্বলজ্বলে গোলাপী রঙের হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলেন, আর তার মনোযোগ অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা হিসেবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গল্প করতে লাগলেন বড়দের বিষয় নিয়ে। তিনি আশা করছিলেন যে সময়টা কেটে যাবে আর যারই বাচ্চা এটা সে এসে নিয়ে যাবে। এটা একটা এক-মুখী আলাপচারিতা হয়ে দাড়াল, ইদুরটাকে মনে হল নিজের ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না, নিজের নামটাও না, আর মনে হল কথাও বলার বিশেষ ইচ্ছে তার নেই। যতক্ষণে সে হাওয়াই মিঠাইটা শেষ করল (বা হাওয়াই মিঠাইটা তাকে শেষ করল) তার একটা উজ্জ্বল গোলাপী দাঁড়ি দেখা দিয়েছে আর আঙুলগুলো হয়েছে আঠা-আঠা। ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচিটা কমে গিয়ে রূপ নিল ফোঁপানিতে আর শেষে একসময় নীরবতা নামল। আঞ্জুম তার সাথে সিঁড়িতে বসে রইলেন ঘন্টার পর ঘন্টা, অপেক্ষা করতে লাগলেন কারো জন্য যে আসবে তাকে নিতে, পথচারীদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন যে তারা চিনে কিনা কাউকে যার বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা নামল যখন আর জামা মসজিদের বিশাল কাঠের দরজাগুলো টেনে বন্ধ করে দেয়া হল, আঞ্জুম ইদুরটাকে উঠিয়ে নিলেন নিজের কাঁধে আর তাকে বহন করে নিয়ে চললেন খোয়াবগায়। সেখানে আঞ্জুমকে প্রচুর বকাঝকা দেয়া হল আর বলা হল এজাতীয় পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটি হতো মসজিদ কর্তৃপক্ষকে জানানো যে একটা হারানো বাচ্চা পাওয়া গিয়েছে। তিনি সেটা পরদিন সকালে করলেন।(প্রবল অনীহার সাথে, সেটা বলে দিতেই হয়, পা টানতে টানতে, আশার বিরুদ্ধে আশা নিয়ে, কারণ ইতোমধ্যে আঞ্জুম ভরসাহীনভাবে প্রেমে পড়ে গিয়েছেন)।
পরবর্তী সপ্তাহ জুড়ে দিনে অনেকবার ঘোষণা দেয়া হল অনেকগুলো মসজিদ থেকে। ইদুরটির দাবী নিয়ে কেউ এগিয়ে আসল না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে গেল, তবুও কেউ আসল না। আর তাই, অনিবার্য কারণেই, জয়নাব-যে নামটি আঞ্জুম তার জন্য ঠিক করেছিল-খোয়াবগায় রয়ে গেল অনেকগুলো মায়েদের (এবং, একভাবে বললে বাবাদের) অনেক বেশি ভালোবাসায় অতিপ্রাপ্ত হয়ে, যতটা কোন বাচ্চা আশা করতেও পারে না। তার নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে সে খুব বেশি সময় নিল না, যার থেকে মনে হয় পূর্বের জীবনটির সাথে তার খুব নিবিড় বন্ধন ছিল না। আঞ্জুম এই বিশ্বাসে এসে পৌছাল তাকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল এবং হারানো যায়নি। কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই সে আঞ্জুমকে ‘আম্মু’ ডাকতে শুরু করল (কারণ সেটাই আঞ্জুম নিজেকে ডাকতে শুরু করিয়েছিলেন)। অন্য বাসিন্দাদের (আঞ্জুমের অভিভাবকত্ব অনুসারে) ডাকা হতো ‘আপা’ (উর্দুতে, আন্টি), এবং ম্যারি, সে ক্রিশ্চান বলে, ছিল ম্যারি আন্টি। উস্তাদ কুলসুম বাঈ এবং বিসমিল্লাহ হয়ে গেলেন ‘বড় নানী’ আর ‘ছোট নানী’। ওই ইদুরটি ভালোবাসা শুষে নিত যেভাবে বালু সমুদ্রকে শুষে নেয়। খুব দ্রুতই উগ্র, স্পষ্টভাবে ধেড়ে ইদুরের মত প্রবণতা(যেটা সামলানো বেশ কষ্ট) সম্পন্ন একটা দুষ্টু ছোট্ট বালিকায় সে রূপান্তরিত হল।
এসব কিছুর মধ্যে, আঞ্জুমের মাথা দিন দিন আরো তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। বিষয়টি কোন সর্তকতা ছাড়াই তার কাছে ধরা পড়ল যে এটা সম্ভব কোন একজন মানুষের পক্ষে অন্য একজনকে এত বেশি এবং এত পূর্ণভাবে ভালোবাসা। প্রথমদিকে, নতুন নতুন এই ব্যাপারটির সাথে পরিচয়ের কারণে, নিজের অনুভুতিগুলোকে প্রকাশের তার ভঙ্গিমাটি ছিল ব্যস্ত, উত্তেজিত। যেমন নিজের প্রথম পোষা প্রাণীটার সাথে একটা বাচ্চা করে থাকে। সে জয়নাবকে একটা অপ্রয়োজনীয় পরিমাণে খেলনা আর কাপড়চোপড় কিনে দিল। (ফেনার মত, ফোলা-ফোলা হাতের ফ্রক আর চায়নার-তৈরি কিচ কিচ শব্দের হিলে আলো-জ্বলা জুতা)। প্রয়োজন ছাড়াই অনেকবার তাকে গোসল করাত, কাপড় পরাত আর কাপড় খুলত। মিলানো আর মিল নেই এমন দুই ধরনের ফিতা ছিল জয়নাবের জন্য যেগুলো আঞ্জুম এক সাথে দলা পাকিয়ে একটা পুরানো টিনে রাখত। সে বারবার জয়নাবের চুলে তেল দিত, বেণী করত আর বেনী খুলে দিত, ফিতা বেঁধে দিত আর সেই বাঁধন খুলে দিত। তাকে বেশি করে খাওয়াত, হাঁটতে নিয়ে যেত প্রতিবেশী এলাকায় আর, যখন দেখল যে জয়নাব স্বাভাবিক ভাবেই পশুপাখির প্রতি আকৃষ্ট হয়, একটা খরগোশ কিনে দিল তাকে-যে খরগোশটি খোয়াবগায় তার একদম প্রথমরাতেই একটা বিড়ালের হাতে মারা পড়ল-আর কিনে দিল দাঁড়িওয়ালা একটা নর-ছাগল যে উঠানে থাকত এবং যখন তখন, চেহারায় একটি নির্বিকার ভাব দিয়ে, তার চিকচিকে ছাগলের নাদিগুলো ছিটিয়ে পাঠাত সর্ব দিকে।
বহু বছরের তুলনায় খোয়াবগাটি তখন বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। ভাঙা ঘরটার সংস্কার করা হয়েছে আর ওটার উপরে প্রথমতলায় আরেকটা ঘর বানানো হয়েছে, যেটা এখন আঞ্জুম আর ম্যারি ভাগ করত। আঞ্জুম ঘুমাত জয়নাবের সাথে মেঝেতে একটা তোষকের উপর, তার দীর্ঘ দেহটি একটা শহর-প্রাচীরের মত রক্ষণাত্মক ভাবে বাঁকা হয়ে ছোট্ট মেয়েটির চারপাশে ঘিরে রাখত। রাতে সে তাকে ঘুম পাড়াত আস্তে আস্তে গান শুনিয়ে, এমন একভাবে যেটা গানের চেয়ে বেশি যেন ফিসফিস। যখন জয়নাব বোঝার জন্য যথেষ্ট বড় হল, আঞ্জুম তাকে ঘুমানোর আগে গল্প বলতে শুরু করল। প্রথমদিকে একটা ছোট্ট বাচ্চার জন্য গল্পগুলো একদমই যথাযথ ছিল না। সেগুলো ছিল আঞ্জুমের একপ্রকার অনিপুণ প্রচেষ্টা হারানো সময়কে পুষিয়ে দেয়ার জন্য, নিজেকে ঢুকিয়ে দেয়া জয়নাবের স্মৃতি আর চেতনায়, নিজেকে প্রকাশ করা কোন কৃত্রিমতা ছাড়া, যেন তারা একে অন্যের হয়ে যেতে পারে পুরোপুরি। জয়নাবকে ঘুম পাড়ানো দূরে থাক, অনেকগুলো গল্পই তাকে দুঃস্বপ্ন দেখাত বা ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে জাগিয়ে রাখত, ভীত আর খিটখিটে মেজাজি করে রাখে। মাঝে মাঝে আঞ্জুম নিজেও কাঁদত ওগুলো বলার সময়। জয়নাব তার ঘুমানোর সময়টাকে ভয় পেতে শুরু করল এবং নিজের চোখগুলো বন্ধ করে রাখত শক্ত করে, ঘুমের ভান করে যেন আর একটা গল্পও শুনতে না হয়। সময় গেলে, যাই হোক, আঞ্জুম (অন্যান্য জুনিওর আপাদের পরামর্শ মোতাবেক) একটা সম্পাদনার পদ্ধতি বের করল। গল্পগুলো সফলভাবে শিশুরোধক হল, আর এক সময় জয়নাবও রাত্রিকালীন প্রথাটির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল।
তার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটি ছিল-ফ্লাইওভারের গল্পটা-আঞ্জুমের বর্ণণায় কিভাবে সে আর তার বন্ধুরা এক গভীর রাতে বাড়ি ফিরল সাউথ দিল্লির ডিফেন্স কলোনি থেকে সেই পুরোটা পথ হেঁটে টার্কম্যান গেটে। তারা পাঁচ থেকে ছয়জন ছিল, সাজগোজ করা, মারাত্মক লাগছিল তাদেরকে দেখতে ডি-ব্লকের এক ধনী শেঠের বাসায় একটা হৈচৈ এর রাত পার করার পর। পার্টির পর তারা ঠিক করল কিছুক্ষণ হাঁটবে আর একটু তাজা হাওয়া খাবে। সেইসব দিনগুলোতে তাজা হাওয়া বলে একটা জিনিষ শহরে ছিল, আঞ্জুম বলল জয়নাবকে। তারা ডিফেন্স কলোনি ফ্লাইওভারের যখন মাঝপথে চলে এসেছে-শহরের একমাত্র ফ্লাইওভার সেইসময়ে-তখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আর কেউ একজন কি করার আছে যখন ফ্লাইওভারের ওপর বৃষ্টি হয়?
“তাদেরকে হাঁটতে থাকতে হবে,” জয়নাব বলত, যুক্তি বোঝা, বড়দের মত কন্ঠে।
“একদম ঠিক। তাদেরকে হাঁটতে হবে,” আঞ্জুম বলতেন। “আর তারপর কি হল?”
“তখন তোমার হিসু করার ইচ্ছা হল!”
“তখন আমার হিসু করার ইচ্ছা হল!”
“কিন্তু তুমি থামতে পারলা না!”
“আমি থামতে পারলাম না।”
“তোমাকে হাঁটতেই থাকতে হল!”
“আমাকে হাঁটতেই থাকতে হল।”
“তাই আমরা আমাদের ঘাগড়ায় হিসু করলাম!” জয়নাব চিল্লিয়ে উঠত, কারণ সে তখন এই বয়সে ছিল যখন হাগা, মুতা এবং পাদ দেয়ার সাথে জড়িত যে কোন কিছু ছিল সবচেয়ে আসল ব্যাপার, বা হয়তো পুরো ব্যাপারটাই, সব গল্পের।
“ঠিক, আর সেটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মজা,” আঞ্জুম বলত, “বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেই বিশাল, ফাঁকা ফ্লাইওভারটার উপরে, বোম্বে ডাইং তোয়ালে দিয়ে নিজেকে মুছতে থাকা একটা ভিজা মহিলার বিশাল এ্যাডের নিচে হাঁটতে হাঁটতে।”
“আর তোয়ালেটা একটা কার্পেটের মত বড় ছিল!”
“একটা কার্পেটের মত বড়, হ্যাঁ।”
“আর তারপর তুমি ওই মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করলা গা মুছার জন্য ওর তোয়ালেটা একটু নেয়া যাবে কি না।”
“আর কি বলল ওই মহিলাটা?”
“ও বলল, নেহ্যি! নেহ্যি! নেহ্যি!”
“ও বলল, নেহ্যি! নেহ্যি! নেহ্যি! তাই আমরা একদম ভিজে গেলাম, আর আমরা হাঁটতে থাকলাম….’
“আর গারাম গারাম হিসু গড়ায় যাচ্ছিল তোমার ঠান্ডা ঠান্ডা পা বেয়ে!’
অনিবার্যভাবেই এই পর্যায়ে এসে জয়নাব ঘুমিয়ে পড়ত, ঠোঁটৈ হাসি নিয়ে। দুঃখ আর দুর্দশার প্রত্যেকটা সামান্য চিহ্নও সরিয়ে ফেলা আবশ্যক ছিল আঞ্জুমের গল্প থেকে। তার খুব ভালো লাগত যখন আঞ্জুম নিজেকে একটা যৌন-মোহিনীতে পাল্টে ফেলতেন যিনি সংগীত আর নৃত্যের একটা ঝিকিমিকি জীবন যাপিত করে এসেছেন, জমকালো পোশাকে সেজে সাথে মসৃণ পালিশ করা নখ আর চারপাশে গুনমুগ্ধ ভক্তের ভীড়।
আর তাই, এইসব উপায়ে, জয়নাবকে খুশি করতে গিয়ে, আঞ্জুম নিজের জন্য একটি সরলতর, অধিক সুখী জীবনকে পুনরায় লিখতে শুরু করলেন। বদলে এই পুনঃলিখনটি আঞ্জুমকে একটা সরল, সুখী মানুষ বানাতে শুরু করল।
ফ্লাইওভারের গল্পটি সম্পাদিত, উদাহরণস্বরূপ, এই সত্যটি যে ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৬ সালে, তখন চূড়ান্ত পর্যায় ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত জরুরী অবস্থাটির যেটি একুশ মাস চলেছিল। তার নষ্ট বখে যাওয়া কনিষ্ঠপুত্র, সঞ্জয় গান্ধী, তখন যুব কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় নেতা ছিলেন (শাসক দলটির যুব-নেতৃত্বাধীন অংশ), এবং কম বেশি দেশটাকে চালাচ্ছিলেন, সেটার সাথে এমন ব্যবহার করছিলেন যেন দেশটা তার ব্যক্তিগত খেলার বস্তু। বেসামরিক অধিকারকে তখন স্থগিত করা হয়েছে, সংবাদপত্রগুলোকে সেন্সর করা হচ্ছিল এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, হাজারে হাজারে লোক (মুলত মুসলিম) ক্যাম্পে জড়ো করা হয়েছিল এবং জোর করে সন্তানপ্রদানে অক্ষম করে দেয়া হয়েছিল। একটা নতুন আইন-অন্তর্বতী নিরাপত্তা রক্ষামূলক আইন-সরকারকে ক্ষমতা দিল খেয়ালের বশে যে কাউকে গ্রেপ্তার করার। জেলগুলো ভরে গিয়েছিল, আর সঞ্জয় গান্ধীর সাঙ্গ-পাঙ্গদের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে জনগণের মাঝে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল তার হুকুম তামিল করার জন্যে।
ফ্লাইওভারের গল্পের রাতে, লোক সমাগমটি-একটা বিয়ের অনুষ্ঠান-আঞ্জুম আর তার সহকর্মীরা আবির্ভুত হয়েছিলেন যেখানে। সেটাকে পুলিশ হামলা করে ভেঙে দিল। গৃহকর্তা আর তার তিনজন অতিথিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আর নিয়ে যাওয়া হল পুলিশ-ভ্যানে করে। কেউ জানত না কেন। আরিফ, সেই ভ্যানের ড্রাইভার যেটা আঞ্জুম এবং তার সঙ্গীদের অনুষ্ঠানস্থলে বহন করে এনেছে, নিজের যাত্রীদের কোন প্রকারে একসাথে করে তার ভ্যানে তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। এই ধৃষ্টতার জন্য তার বাম হাতের আঙুলের গাঁট আর ডানপায়ের হাঁটুর বাটি পিটিয়ে ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দেয়া হয়েছিল। ম্যাটাডরটি থেকে তার যাত্রীদেরকে টেনে হিঁচড়ে নামানো হল, পশ্চাতদ্দেশে লাথি দেয়া হল যেন তারা সার্কাসের সঙ কতগুলো এবং নির্দেশ দেয়া হল কেটে পড়ার, বাসা পর্যন্ত পুরো রাস্তা দৌড়ে যেতে যদি তারা না চায় দেহব্যবসা আর অশ্লীলতার দায়ে গ্রেপ্তার হতে। তারা দৌড়াল অন্ধ আতঙ্কে, পিচাশের মত, অন্ধকার আর বর্ষণরত বৃষ্টির মধ্য দিয়ে, তাদের পা-গুলোর তুলনায় আরো অনেক দ্রুত পালাচ্ছিল তাদের মেক-আপ, ভেজা স্বচ্ছ কাপড়গুলো তাদের পদক্ষেপকে সীমিত করছিল আর গতিকে বাধাগ্রস্ত করছিল। সত্য যে, হিজড়াদের জন্য নিয়মিত অপমানের একটি অংশ মাত্র ছিল এটি, সাধারণের বাইরের কিছু নয়, সেইসব দুঃখ কষ্টের তুলনায় কিছুই না, যেগুলো অন্যদেরকে সেই ভয়াবহ মাসগুলোতে সহ্য করতে হতো।
ওটা কিছুই ছিল, কিন্তু তারপরো, কিছু একটা ছিল।
আঞ্জুমের সম্পাদনাকে উপেক্ষা করে, সত্যের কিছু অংশকে ফ্লাইওভারের গল্পটা ধরে রেখেছিল। যেমন ধরা যাক, আসলেই বৃষ্টি হয়েছিল সেই রাতে। আর আঞ্জুম আসলেই দৌড়ানোর সময় পেশাব করেছিল। সেখানে আসলেই বোম্বে ডাইং তোয়ালের একটা বিজ্ঞাপন ছিল ডিফেন্স কলোনি ফ্লাইওভারের উপর। আর বিজ্ঞাপনের মহিলাটি একদম সরাসরিই জানাল তার তোয়ালেটা ভাগাভাগি করবে না।
জয়নাব স্কুলে যাওয়ার মত বড় হওয়ার এক বছর আগে, তার আম্মু নিজেকে ঘটনাটির জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। তিনি তার পুরাতন বাসা থেকে ঘুরে আসলেন আর, তার ভাই সাকিবের অনুমতিক্রমে, খোয়াবগায় নিয়ে আসলেন মুলাকাত আলির বইয়ের সংগ্রহটি। তাকে প্রায়ই দেখা যেত পায়ের উপর পা তুলে একটা খোলা বইয়ের সামনে বসে আছেন (পবিত্র কোরান নয়), পৃষ্ঠায় আঙুল দিয়ে কোন লাইনকে অনুসরণ করতে করতে মুখ নাড়াচ্ছেন, অথবা চোখ বন্ধ করে সামনে পিছে দোল খাচ্ছেন, চিন্তা করছেন এক্ষুণি তিনি কি পড়লেন তা নিয়ে, অথবা হয়তো তার স্মৃতির ডোবাটি সেঁচে একসময় তিনি জানতেন এমন কোন কিছু তুলে আনার চেষ্টা করছিলেন।
যখন জয়নাবের পাঁচ হল, সংগীত শিক্ষা শুরু করার জন্য আঞ্জুম তাকে উস্তাদ হামিদ খানের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রথম থেকেই একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল যে সংগীত জয়নাবের জিনিষ নয়। তার ক্লাসগুলো জুড়ে সে অপ্রসন্ন চিত্তে ছটফট করত। এমন ঝামেলা লাগিয়ে দিত সুর লয়ে যে সেটাকেই একটা আলাদা দক্ষতা ভাবা যেতে পারে। ধৈর্যশীল, কোমল হৃদয়ের উস্তাদ হামিদ খান এমনভাবে নিজের মাথা নাড়তেন যেন একটা মাছি তাকে জ্বালাতন করছে। তিনি তার গালগুলোকে মৃদু-উঁচু দিয়ে পূর্ণ করে হারমোনিয়ামের সুরের চাবিগুলো চেপে ধরতেন। যার মানে ছিল, তিনি চান তার ছাত্র আরেকবার চেষ্টা করুক। সেসব বিরল মূহূর্তে যখন জয়নাব সুরের কিছুটা নিকটে হলেও পৌছাতে পারত তখন তিনি মাথা নাড়তেন আনন্দের সাথে আর বলতেন, “এই তো আমার ছেলে!”। শব্দ মালাটি তিনি শিখেছিলেন কার্টুন নেটওয়ার্কের টম এন্ড জেরি অনুষ্ঠানটি থেকে। এই অনুষ্ঠানটি তিনি খুব পছন্দ করতেন আর তার নাতিদের সাথে বসে দেখতেন (যারা পড়ছিল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে)। ছাত্রটি ছেলে হোক বা মেয়ে তাদের সকলের জন্য এটা ছিল প্রশংশার সর্বোচ্চ রূপ। এটা জয়নাবকে তিনি দান করতেন সেটা তার প্রাপ্য ছিল বলে নয়। বরঞ্চ সেটার কারণটা ছিল আঞ্জুম আর তাকে নিয়ে হামিদ খানের সেই স্মৃতি যে সে (যখন সে আফতাব ছিল)কত সুন্দর গান গাইত। আঞ্জুম সবগুলো ক্লাসের মধ্যে বসে থাকত। তার চিকন, মাথার-ফুটো-দিয়ে পোকার গুঞ্জনটি পুনরায় দেখা দিত। এইবার সেটা দেখা দিত একটা নীরব প্রদর্শক হিসেবে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জয়নাবের পথছাড়া কন্ঠটিকে বশে আনতে এবং সেটাকে সঠিক রাস্তায় রাখতে। ওটাতে কোনই লাভ হল না। ধেড়ে ইদুরটা গাইতে পারত না।
জয়নাবের প্রকৃত অনুরাগ, দেখা গেল, পশুপাখির প্রতি। পুরাতন শহরের রাস্তায় সে ছিল একটা ত্রাস। সে মুক্ত করে দিতে চাইত সব অর্ধেক-ন্যাড়া, অর্ধ-মৃত সাদা মুরগীগুলোকে যেগুলোকে নোংরা খাচাগুলোর মধ্যে ঠেসে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল আর খাচাগুলোকে বোঝাই করা হয়েছিল একটার উপরে আরেকটাকে, কসাইয়ের দোকানের সামনে। সে আলাপ করতে চাইত প্রত্যেকটি বিড়ালের সাথে যারা তার পথের সামনে দিয়ে ছুটে যেত। খোলা নর্দমা দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্ত আর গরু-মুরগি জবাইয়ের উচ্ছিষ্টের মধ্যে খুঁজে পাওয়া প্রত্যেক বিলাপরত ছন্নছাড়া কুকুরের বাচ্চাদের সে নিয়ে যেতে চাইত বাসায়। সে কানে তুলত না যখন তাকে বলা হতো যে কুকুররা নাপাক-নাজি-মুসলিমদের জন্য আর ওদেরকে ছোঁয়া ঠিক না। ওই বড়, লোমশ ইদুরগুলোর কাছ থেকে সে সরে আসত না যেগুলো তাড়াহুড়ো করে চলে যেত সেই রাস্তা ধরে যেটা দিয়ে তাকে হাঁটতে হতো প্রতিদিন। হলুদ মুরগির ঠ্যাঙের তোড়া, কেটে ফেলা খাসীর পায়া, ছাগলের মাথার পিরামিড যেগুলোর চোখগুলো একদৃষ্টিতে খোলা, অন্ধ আর নীল আর বড় বড় ইস্পাতের বাটিতে জেলীর মত থিকথিক করে কাঁপতে থাকা ছাগলের মুক্তোর মত সাদা মগজগুলোর দৃশ্যের সাথে সে যেন কখনই মানিয়ে নিতে পারত না।
তার পোষা ছাগলের সাথে যোগ করার জন্য, যেটা, ধন্যবাদ জয়নাবকে, রেকর্ড সংখ্যক তিনটি বকরী-ঈদ জবাই হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছে, আঞ্জুম তাকে এনে দিলেন একটা সুদর্শন মোরগ, যে তার নতুন মালেকিনের স্বাগত আলিঙ্গনের প্রত্যুত্তর জানাত একটি হিংস্র ঠোকর দিয়ে। জয়নাব কাঁদত জোরে জোরে, যন্ত্রণার তুলনায় অনেক বেশি হৃদয় ভঙ্গের বেদনায়। ঠোকরটি তাকে সংযত করেছিল, কিন্তু পাখিটির জন্য তার ভালোবাসায় কোন কমতি ঘটল না। যখনই এই প্রেম মোরগটি তার কাছে আসত সে তার হাতগুলো জড়িয়ে নিত আঞ্জুমের পায়ের চারপাশে আর আম্মুর হাঁটুতে চুক চুক করে কতগুলো চুমু পৌছে দিত। চুমুর মাঝে মাঝে যে মাথা ঘুরিয়ে স্নেহময় আর ভালোবাসার দৃষ্টিতে মোরগটির দিকে তাকাত যেন তাতে করে তার আদরের পাত্রটি আর চুমু প্রাপ্ত পক্ষটির কারোরই কোন সন্দেহ থাকবে না যে ঘটনা কি ঘটছে আর চুমুগুলো আসলেই কার উদ্দেশ্যে। কোন কোন দিক থেকে ভাবলে, জয়নাবের প্রতি আঞ্জুমের আচ্ছন্নের মত ভালোবাসাটাই সমানুপাতিকভাবে প্রতিফলিত হতো পশুপাখির ব্যাপারে জয়নাবের ভালোবাসার আচ্ছন্নতায়। জীবিত প্রানীদের প্রতি তার কোন কোমলতাই, অবশ্য, তার রাক্ষুসে মাংস ভক্ষণের পথে বাধা হয়ে দাড়াত না। বছরে অন্তত দুবার আঞ্জুম তাকে পুরানো কেল্লার ভেতরের চিড়িয়াখানাটিতে নিয়ে যেত। ওখানে গন্ডার, হিপ্পোপটেমাস আর তার প্রিয় চরিত্র বর্ণিও থেকে আসা বাচ্চা গিবনটার কাছে জয়নাব বেড়াতে যেত।
টেনডার বাডস নার্সারী স্কুলের কেজিবি (কিন্টার গার্ডেন সেকশান বি) তে তাকে ভর্তি করার কয়েক মাস পরে সাকিব আর তার বউকে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল তার অফিসিয়াল বাবা-মা হিসেবে-এমনিতে স্বাস্থ্যশক্তিতে ভরপুর ধেড়ে ইদুরটাকে একটা অসুস্থতার সময় পার করতে হল। খুব গুরুতর কিছু ছিল না, কিন্তু অসুখগুলো বারবার হচ্ছিল, আর এটা তাকে ক্লান্ত করে ফেলল, প্রত্যেকটা অসুখ তাকে পরবর্তীটার জন্য রেখে যেত আরো অরক্ষিত করে। ম্যালেরিয়ার আগে হল-ফ্লু তার আগে হল দুটো ভিন্ন দফায় ভাইরাল জ্বর, একটা তেমন কিছু না, দ্বিতীয়টা চিন্তিত হওয়ার মত। অসহায়ের মত আঞ্জুম জয়নাবকে নিয়ে ছটফট করত আর তার খোয়াবগার দায়িত্ব (যেগুলো এখন প্রধানত ছিল প্রশাসনিক আর রক্ষণাবেক্ষণমূলক) পরিত্যাগ বিষয়ক গুঞ্জনগুলোকে পাত্তা না দিয়ে রাত দিন ধেড়ে ইদুরটার সেবা করত, মনে গোপন, বাড়তে থাকা আতঙ্ক নিয়ে। তার বদ্ধ বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গেল যে কেউ একজন তার (আঞ্জুমের) সৌভাগ্যে ইর্ষান্বিত হয়ে জয়নাবকে মন্ত্র করেছে। তার সন্দেহের সূচকটি সংশয়হীনভাবে নির্দেশিত হল সায়ীদার দিকে, খোয়াবগার তুলনামুলকভাবে নতুন একজন বাসিন্দা। সায়ীদা আঞ্জুমের তুলনায় বেশ কমবয়সী ছিল, এবং জয়নাবের স্নেহের জন্য সারিতে দ্বিতীয়জন। সে গ্রাজুয়েট ছিল আর ইংলিশ জানত। তার চেয়েও বড় কথা, সে হালের নতুন ভাষাটা জানত-সে সিসম্যান শব্দটা আর এফ থেকে এম আর এম থেকে এফ ব্যবহার করতে পারত আর সাক্ষাৎকারগুলোতে নিজেকে সম্বোধন করত ‘ট্রান্সপার্সন’ বলে। আঞ্জুম, অন্যদিকে, ঠাট্টা করে এসবকে বলত ট্রান্স-ফ্রান্স ব্যবসা, আর জেদির মত নিজেকে একজন ‘হিজরা’ বলে সম্বোধন করার ব্যাপারে জোর দিত।
নতুন প্রজন্মের আরো অন্য অনেকের মতই, সায়ীদা প্রথাগত সালোয়ার কামিজ আর পশ্চিমা পোশাকের মধ্যে সহজেই বদলা বদলি করত। জিনস, স্কার্ট, হল্টার-নেক যেগুলো তার দীঘল, চমৎকার পেশীবহুল পিঠটাকে দেখিয়ে বেড়াত। আঞ্চলিক স্বাদ আর পুরাতন দুনিয়ার মায়ামন্ত্রে তার যতটুকুই দৈন্যতা থাকুক, সেটা সে পূরণ করে ফেলত তার আধুনিক বিষয়ের বোঝাপড়া, তার জ্ঞান এবং লৈঙ্গিক অধিকারের দলগুলোর (দুটো কনফারেন্সে সে বক্তব্য পর্যন্ত দিয়েছে) সাথে তার সংলগ্নতার মাধ্যমে। এইসব কিছু তাকে আঞ্জুমের থেকে বেশ ভিন্ন একটা দলে স্থাপন করত। একই সাথে, মিডিয়ার এক নম্বর জায়গাটি থেকে সায়ীদা আঞ্জুমকে সরিয়ে দিয়েছিল। নতুন প্রজন্মের আনুকূল্যে বিদেশি পত্রিকারা পুরাতন বিচিত্রদেরকে ঝুড়িতে নিক্ষেপ করেছিল। বিচিত্রগণ মানানসই ছিলেন না নতুন ভারতের চেহারাটির সাথে-একটা পারমাণবিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির একটি উত্থানশীল লক্ষ্যস্থল। উস্তাদ কুলসুম বাঈ, একজন কূটকৌশলী বৃদ্ধা-নেকড়ে, পরিবর্তনের এই বাতাসগুলোর বিষয়ে হঁশিয়ার ছিলেন, আর খোয়াবগায় লাভের আগমন দেখতে পেলেন। তাই সায়ীদা, যদিও তার বয়োজ্যেষ্ঠতার অভাব ছিল, আঞ্জুমের সাথে নিবিড় প্রতিযোগিতায় ছিল উস্তাদ হিসেবে খোয়াবগার দায়িত্ব গ্রহণের যখন উস্তাদ কুলসুম বাঈ সেটায় ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, যেটা, ইংল্যান্ডের রাণীর মতই, করার ব্যাপারে তার কোন তাড়াহুড়ো আছে বলে মনে হতো না।
উস্তাদ কুলসুম বাঈ এখনও খোয়াবগার প্রধান সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ছিলেন, তবে সেটার দৈনন্দিন বিষয়াদিতে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন না। সকালগুলোতে তার বাতের ব্যথা তাকে কষ্ট দিত। তাকে তার চারপাইয়ে করে উঠানে শুইয়ে দেয়া হতো। লেবু আর আমের আচারের বয়ামগুলোর সাথে তিনিও রৌদ্রস্নাত হতেন। পাশে আটার পোকা দূর করা জন্য খবরের কাগজের উপর গমের আটা বিছানো থাকত। যখন রোদ খুব বেশি গরম হয়ে উঠত তাকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হতো ভেতরে। সেখানে তাঁর পা টেপা হতো আর সরিষার তেল মালিশ করা হতো তার কোচকানো চামড়ায়। তিনি এখন পুরুষদের মত পোশাক পড়তেন। একটা দীর্ঘ হলুদ কুর্তা-হলুদ কারণ তিনি হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার একজন শিষ্য ছিলেন-আর পরতেন এক টুকরো চেকপ্রিন্ট চাদর। বুক থেকে নিচে ঝুলে থাকত। তার মাথার যে পাতলা সাদা চুলগুলো কোনমতে তার তালু ঢেকে রাখত সেগুলোকে তিনি পিছনে একটা ছোট ঝুঁটি করে বাঁধতেন। কোন কোন দিন তার পুরাতন বন্ধু হাজী মিঞা, যিনি রাস্তার মাথায় সিগারেট আর পান বেচতেন, এসে হাজির হতেন তার সর্বকালের প্রিয় ফিল্মের অডিও ক্যাসেট নিয়ে, মুঘাল-এ-আজম। প্রত্যেকটা গান আর সংলাপের প্রত্যেকটা লাইন তারা অন্তর দিয়ে মুখস্থ করেছিলেন। তাই টেপটির সাথে সাথে তারাও গাইতেন আর বলতেন। তারা বিশ্বাস করতেন এমন কেউ নেই যে আর কোনদিন ওভাবে উর্দু লিখতে পারবেন। আর কোন অভিনেতা নেই যে কোনদিন দিলীপ কুমারের শব্দচয়ন আর বাচনভঙ্গির কাছাকাছি আসতে পারে। কোন কোন দিন উস্তাদ কুলসুম বাই সম্রাট আকবরের অভিনয় করতেন আর একই সাথে হতেন তার ছেলে শাহজাদা সেলিম, সিনেমার যে নায়ক, আর হাজী মিয়া হতেন আনারকালি (মধুবালা), সেই দাসী-কন্যা যাকে ভালোবেসেছিলেন শাহজাদা সেলিম। কখনো কখনো তারা ভূমিকা পাল্টাতেন। অন্য আর কিছুর তুলনায়, তাদের এই সম্মিলিত পরিবেশনটি আসলে ছিল, একটা হারানো অহংকার আর মৃতপ্রায় ভাষার জন্য উদ্দীপনা।
এক সন্ধ্যায় আঞ্জুম ছিলেন উপরতলায় তার রুমে ধেড়ে ইঁদুরটির উষ্ণ কপালটি ঠান্ডা পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন যখন তিনি উঠানে একটা গোলমালের আওয়াজ শুনলেন- উঁচু গলার স্বর, দৌড়রত পা, লোকজনের চিল্লাচিল্লি। তার প্রথম সহজাত বোধটি ছিল অনুমান করা যে আগুন লেগে গেছে। এটা প্রায়ই ঘটত-রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা খোলা বৈদ্যুতিক তারের বিশাল, জটপাকানো দংগলটির একটি অভ্যাস ছিল নিজে নিজে অগ্নিশিখায় বিস্ফোরিত হওয়ার। তিনি জয়নাবকে তুলে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। সবাই উস্তাদ কুলসুম বাঈয়ের রুমের টিভির সামনে জড়ো হয়েছিলেন, টিভির ধিকধিকি আলোতে তাদের চেহারাগুলো আলো হয়ে আছে। একটা বাণিজ্যিক বিমান একটা লম্বা বিল্ডিঙের মধ্যে ক্র্যাশ করেছে। তার অর্ধেকটা এখনও বেরিয়ে আছে, শুন্যে ঝুলে আছে অনিশ্চিতভাবে একটা ভাঙা খেলনার মত। মুহূর্তের মধ্যে একটা দ্বিতীয় বিমান একটা দ্বিতীয় বিল্ডিঙের মধ্যে ক্র্যাশ করল আর একটা আগুনের গোলকে পরিণত হল। খোয়াবগার সাধারণত বাচাল বাসিন্দারা মৃত্যুর মত নীরবতা নিয়ে দেখল যে লম্বা বিল্ডিংদ্বয় বালুর স্তম্ভের মত ধ্বসে পড়ল। সবদিকে ধোঁয়া আর সাদা ধূলা। ধুলাটাও দেখতে অন্যরকম-পরিষ্কার আর বিদেশি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষেরা লম্বা বিল্ডিঙগুলো থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আর ভাসতে ভাসতে নিচে নামতে লাগল ছাইয়ের কতার মত।
এটা কোন চলচ্চিত্র ছিল না, টিভির লোকগুলো বলেছিল। এটা আসলেই ঘটছিল। আমেরিকায়। নিউ ইয়র্ক নামের একটি শহরে।
খোয়াবগার ইতিহাসের দীর্ঘতম নীরবতাটি ভাঙল অবশেষে একটি প্রগাঢ় জিজ্ঞাসায়।
“ওরা কি ওখানে উর্দু বলে?” বিসমিল্লা জানতে চাইলেন
কেউ জবাব দিলেন না।
রুমের ভেতরের ধাক্কাটি জয়নাবকেও ছুয়ে গেল আর সে তার জ্বরজনিত একটি স্বপ্নের ঘোর থেকে নড়েচড়ে উঠেই সরাসরি আরেকটির মধ্যে চলে গেল। টেলিভিশনের পুনঃপ্রচার বিষয়টার সাথে সে পরিচিত ছিল না, তাই সে বিল্ডিংয়ের মধ্যে দশটা বিমানকে ক্র্যাশ করতে গুনল।
“সবমিলিয়ে দশটা”, যে শান্তভঙ্গিতে ঘোষণা দিল, তার নতুন, টেন্ডার বাডস ইংলিশে, আর নিজের মোটা, জ্বরগ্রস্থ গালটাকে আঞ্জুমের গলার উপর তার স্বস্থানে ফিরিয়ে দিল।
জয়নাবের উপর যে জাদু করা হয়েছে সেটা পুরো বিশ্বকেই অসুস্থ করে দিয়েছে। এটা ছিল শক্তিশালী সিফলি জাদু। আঞ্জুম চোখের কোনা দিয়ে চতুর একটি দৃষ্টিপাত করল সায়ীদার দিকে দেখার জন্য যে সে কি নির্লজ্জের মত নিজের সফলতাকে উদযাপন করছে নাকী নিষ্পাপের ভাব ধরছে। অতিকৌশলী কুত্তীটা অভিনয় করছিল যে সে অন্য সবার মতই বিরাট একটা ধাক্কা খেয়েছে।
ডিসেম্বর নাগাদ পুরাতন দিল্লিতে বন্যা বয়ে গেল আফগান মানুষদের, যারা পালিয়ে এসেছিল যুদ্ধবিমান থেকে- যেগুলো তাদের আকাশে গান গাইত অমৌসুমী মশার মত, আর বোমার থেকে যেগুলো ইস্পাতের বৃষ্টির মত ঝরে পড়ত। অতি অবশ্যই মহান রাজনীতিবিদদের (পুরাতন শহরে, যেটার মধ্যে ছিল প্রত্যেক দোনাকদার আর মাওলানা) নিজ নিজ তত্ত্ব ছিল। বাকীদের ক্ষেত্রে, তাদের কেউই কিছুতেই বুঝতে পারত না আমেরিকার লম্বা বিল্ডিঙগুলোর সাথে এই অভাগা লোকগুলোর সম্পর্কটি কোথায় ছিল। কিন্তু পারতই বা কিভাবে? কে ছিল আর আঞ্জুম ছাড়া যে জানত এই ধ্বংসযজ্ঞের নেপথ্যের মূল কারিগর ওসামা বিন লাদেন, আতংকবাদী নয়, অথবা জর্জ ডব্লিউ বুশ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও নয়, বরঞ্চ আরেকটি অনেক বেশি শক্তিশালী, অধিক ধূর্ত, শক্তি: সায়ীদা (গুল মোহাম্মাদ), বাসিন্দা: খোয়াবগা, গলি ডাকোটান, দিল্লি-১১০০০৬, ভারত।
যে দুনিয়ায় ধেড়ে ইদুরটা বেড়ে উঠছৈ তার রাজনীতিটাকে আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য, আর একই সাথে ওই শিক্ষিত সায়ীদার সিফলী জাদু কে নস্যাৎ করে দেয়া বা অন্তত আগেই বুঝে ফেলার জন্য, আম্মু সংবাদপত্র পড়তে শুরু করলেন আরো মনোযোগের সাথে এবং টিভির খবরও দেখতে শুরু করলেন (যখনই অন্যরা তাকে সুযোগ দিত ডেইলী-সোপগুলো থেকে সরে অন্য চ্যানেলে যাওয়ার।)
লম্বা বিল্ডিংগুলোর মধ্যে যে বিমানগুলো উড়ে এসে ঢুকে গিয়েছিল তারা ভারতের অনেকের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসল। দেশটির কবি প্রধানমন্ত্রীটি আর তার কিছু বয়োজেষ্ঠ্য মন্ত্রীগণ একটা পুরাতন সংগঠনের সদস্য ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন যে ভারত আসলে মূলতঃ একটি হিন্দু জাতি এবং, ঠিক যেভাবে পাকিস্তান নিজেকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, ভারতেরও সেরকম হিন্দু হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেয়া উচিত। এর কিছু সমর্থক আর আদর্শবাণী খোলাখুলিভাবে হিটলারের প্রশংসা করত আর ভারতের মুসলিমদেরকে তুলনা করত জার্মানির ইহুদীদের সাথে। এখন, হঠাৎ করেই যখন, মুসলিমদেরকে শত্রুজ্ঞান করার ব্যাপারটা বেড়ে গেল, সংগঠনটির কাছে এরকম মনে হতে লাগল যে পুরো বিশ্ব এখন তার দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। কবি-প্রধানমন্ত্রীটি আধো আধো বোলে একটা বক্তৃতা করলেন, বাচনভঙ্গি চমৎকার, শুধু সেই দীর্ঘ, ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো বিরতিগুলো ছাড়া যখন তিনি তার তর্কের সুত্রটি হারিয়ে ফেলছিলেন, যেটা বারবার ঘটছিল। তিনি একজন বৃদ্ধ লোক ছিলেন, কিন্তু তার একটা যুবা পুরুষের মত মাথা ঝাঁকি দেয়ার ভঙ্গিমা ছিল, অনেকটা ১৯৬০ সালের বোম্বে ফিল্মস্টারদের মত।
‘এই মুসালমান, সে পছন্দ করে না অন্যকে’ তিনি বললেন কাব্যিকভাবে হিন্দীতে, এবং তার মানদণ্ডের বিবেচনাতেও যথেষ্ট দীর্ঘ একটা সময় বিরতি দিলেন। “তার বিশ্বাস সে ছড়াতে চায় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।” এই দ্বিপদী চরণটি তিনি তৎক্ষণাৎ রচিত করলেন এবং নিজের ব্যাপারে অতিরিক্ত খুশি হয়ে গেলেন। প্রত্যেকবার যখন তিনি মুসলিম বা মুসালমান বললেন তার আধো আধো বোলটি একটা ছোট বাচ্চার মতই আদুরে শোনাল। নতুন বিধানে তাকে একজন আধুনিক বিবেচনা করা হয়েছিল। তিনি সাবধান করে দিলেন যে যা ঘটেছে আমেরিকায় তা খুব সহজেই ভারতে ঘটতে পারে এবং যে, এখন সময় হয়েছে সরকারের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে একটি নতুন জঙ্গি-বিরোধী আইন পাশ করার।
প্রত্যেক দিন আঞ্জুম, খবরের নতুন দর্শক, বোমা বিস্ফোরণ আর জঙ্গি হামলা নিয়ে টিভির প্রতিবেদনগুলো দেখতেন যেগুলো হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছিল ম্যালেরিয়ার মত। উর্দু পত্রিকাগুলো প্রতিদিনই বহন করে নিয়ে আসত পুলিশের কথিত ‘এনকাউন্টার’ নামক এক জিনিষে কম বয়সী মুসলিম ছেলেদের মারা যাওয়ার গল্প, অথবা জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকালে হাতে নাতে ধরা পড়ার এবং গ্রেপ্তার হওয়ার খবর। একটা নতুন আইন পাশ হয়েছিল যেটার আওতায় সন্দেহভাজনদের মাসের পর মাস কোন বিচার প্রক্রিয়া ব্যতীতই আটকে রাখা যেত। খুব একটা সময় যেতে না যেতেই সব কারাগারগুলো ভর্তি হয়ে গেল কমবয়সী মুসলিম পুরুষদের দিয়ে। আঞ্জুম সর্বশক্তিমানকে ধন্যবাদ দিলেন যে জয়নাব মেয়ে। এটা অনেক বেশি নিরাপদ একটা ব্যাপার।
যখন শীত পড়ে গেল, ধেড়ে ইঁদুরটার একটা গাঢ়, বুকে-বসে-যাওয়া কাশি হল। আঞ্জুম তাকে চায়ের চামচে করে করে হলুদ মেশানো দুধ দিতেন আর সারা রাত জেগে জেগে শুনতেন জয়নাবের হাপাঁনির মত বিজবিজ শব্দ। তার নিজেকে একেবারে অসহায় মনে হতো। তিনি হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দর্গায় উপস্থিত হয়ে একটু কম উগ্র খাদিমদের একজনের সাথে কথা বললেন যাকে জয়নাবের অসুস্থতার ব্যাপারে তিনি আগেও ভালোভাবে জানিয়েছিলেন আর জিজ্ঞেস করলেন যে কিভাবে তিনি সায়ীদার সিফলি জাদুকে নস্যাৎ করে দিতে পারেন। বিষয়গুলো হাতের বাইরে চলে গিয়েছে, তিনি ব্যাখ্যা করলেন, আর এখন যখন জিনিষটা একটা ছোট্ট মেয়ের ভাগ্যের থেকেও বেশি কিছুর সাথে জড়িত, তার, আঞ্জুমের, যিনি ছিলেন সেই একমাত্র ব্যক্তি যিনি জানতেন সমস্যাটা কি, কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যা করা দরকার তা করার জন্য তিনি যতদূর যাওয়া প্রয়োজন যেতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি যেকোন মুল্য দিতে রাজী ছিলেন, তিনি বললেন, এমনকি যদি তার মানে দাড়ায় ফাঁসির মঞ্চে যাওয়া। সায়ীদাকে আটকাতেই হবে। তার খাদিম সাহেবের আশীর্বাদ দরকার। তিনি নাটকীয় আর আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন, লোকজন ঘুরে তাকাতে লাগল আর খাদিম সাহেবের তাকে শান্ত করতে হল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে জয়নাব তার জীবনে আসার পর থেকে তিনি আজমীরে হযরত গরীব নওয়াজের দর্গায় গিয়েছিলেন কি না। যখন তিনি বললেন যে এই কারণ আর সেই কারণে তার সেটা করা হয়ে ওঠেনি, তিনি তাকে বললেন সমস্যা ওইখানে, কারো সিফলী জাদু নয়। তিনি তার সাথে একটু বেজার হলেন যে আঞ্জুম নিজেকে জাদুবিদ্যা আর মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করতে দিলেন যেখানে হযরত গরীব নেওয়াজ রয়েছেনই তার সুরক্ষার জন্য। আঞ্জুমের মন পুরোপুরি মানল না, কিন্তু স্বীকার করলেন যে তিন বছর ধরে আজমীর শরীফে না যাওয়াটা তার নিজের দিক থেকে একটা মারাত্মক ত্রুটি হয়ে গিয়েছে।
সেটা ছিল ফেব্রুয়ারির শেষদিক যতদিনে জয়নাব কিছুটা সুস্থ হয়েছিল যে আঞ্জুমের মনে হল তাকে সে কয়েক দিনের জন্য রেখে ঘুরে আসতে পারে। জাকির মিঞা, এ-ওয়ান ফ্লাওয়ারের মালিক এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টার, রাজী হলেন আঞ্জুমের সাথে ভ্রমণ করতে। জাকীর মিঞা ছিলেন মুলাকাত আলির একজন বন্ধু মানুষ আর আঞ্জুমকে তার জন্ম থেকে চিনতেন। তার বয়স সত্তর ছাড়িয়ে আশির দিকে যাচ্ছিল, একজন হিজড়ার সাথে ভ্রমণ করছেন দেখে লজ্জিত হওয়ার মত বয়সটা তার ছিল না। তার দোকান, এ-ওয়ান ফ্লাওয়ার, ছিল মূলত একটি কোমর সমান উঁচু সিমেন্টের বেদী, একটা এক মিটারের বর্গ, আঞ্জুমের পুরাতন বাসার একটি বারান্দার নিচে অবস্থিত, রাস্তার সেই বাঁকটিতে যেখানে চিতলী কাবাব এসে খুলেছে মতিয়া মহল চোখে-মুখে। জাকির মিয়াকে এটা ভাড়া দিয়েছিলেন মুলাকাত আলি-আর এখন সাকিব-এবং সেখান থেকে তিনি এ-ওয়ান ফ্লাওয়ার পরিচালনা করেছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। তিনি সারাদিন একটা মোটা কাপড়ের ওপর বসে থাকতেন, মালা গাথতেন লাল গোলাপের আর (আলাদাভাবে) নতুন-কড়কড়ে টাকার নোট দিয়ে যেগুলোকে তিনি ভাজ করে বানাতেন ছোট ছোট ফ্যান আর ছোট ছোট পাখি। তিনি এসব তৈরি করতেন বররা তাদের বিয়ের দিনে পরবে বলে। তার প্রধান চ্যালেঞ্জটি ছিল এবং এখনও হল যে তার দোকানের ক্ষুদ্র জায়গাটুকুর মধ্যে, ফুলগুলোকে তাজা আর ভিজা ভিজা রাখা এবং টাকার নোটগুলোকে কড়কড়ে আর শুকনা রাখা। জাকির মিয়া বললেন তার আজমীর যাওয়া দরকার আর ওখান থেকে পরে যাবেন গুজরাটের আহমেদাবাদে। আহমেদাবাদে তাঁর কিছু কাজ আছে, তাঁর স্ত্রী-পরিবারের সাথে। আজমীর থেকে তিনি একা একা ফিরে আসলে যেই হেনস্থা আর আপমান সহ্য করতে হবে (দেখে ফেলার এবং একই সাথে না দেখে ফেলারও) সেই ঝুঁকির তুলনায় আঞ্জুম জাকির মিয়ার সাথে আহমেদাবাদে ভ্রমণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তার দিকে থেকে, জাকির মিয়া, এখন বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন আর সাথের মালামাল টানাটানিতে সাহায্য করার মত কেউ একজন পাশে আছে এতেই তিনি বেশ খুশি ছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে যখন তারা আহমেদাবাদে যাবেন তারা ওয়ালি দাখানির মাজারটি থেকে ঘুরে আসতে পারেন, সেই সপ্তদশ শতাব্দীর উর্দু কবি, প্রেমের কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত, যার প্রবল ভক্ত ছিলেন মুলাকাত আলি, এবং কবি সাহেবের আশীর্বাদও নেয়া যেতে পারে। তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনার তারা সমাপ্তি টানলেন হাসতে হাসতে কবি সাহেবের একটা দ্বিপদী চরণমালার আবৃত্তি করে-মুলাকাত আলির প্রিয়গুলোর একটি-
“প্রেমের তীর বিধিল যারে
বোঝার মত ভারী তার তো লাগেই দুনিয়ারে”
কয়েকদিন পর তারা ট্রেনে করে বেরিয়ে পড়লেন। তারা আজমীর শরীফে ব্যায় করলেন দুই দিন। আঞ্জুম ভক্তদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে চললেন আর একহাজার রুপি দিয়ে একটা সবুজ আর সোনালী চাদর কিনলেন জয়নাবের নামে হযরত গরিব নেওয়াজের প্রতি নিবেদন হিসেবে। দুই দিনই তিনি পাবলিক পেফোন থেকে খোয়াবগায় ফোন করলেন। তৃতীয় দিনে, জয়নাবের দুঃশ্চিন্তায়, আহমেদাবাদগামী গরিব নেওয়াজ এক্সপ্রেসে ওঠার ঠিক আগে তিনি আবারো ফোন করলেন আজমীর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে। সেটার পর তার বা জাকির মিয়া কারো কাছ থেকেই আর কোন খবর পাওয়া গেল না। জাকির মিয়ার ছেলে তার মায়ের পরিবারকে আহমেদাবাদে ফোন করল। লাইনটা দেখা গেল কাজ করছে না।
চলবে…
আগের পর্বসমূহ:
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস (বাংলা অনুবাদ) ১ম পর্ব
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস (বাংলা অনুবাদ) ২য় পর্ব