খন্দকার নিজেকে মন্ত্রীসভার সবচেয়ে জ্ঞানী লোক বলে মনে করে। আর মনে করবেই বা না কেন! খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের মাঝ দিয়ে এই জ্ঞান প্রতিভাত হলে তখন পরিখা খননে পটু গোত্রটির নাম হয় খন্দকার। ফলে তখন থেকেই খন্দকারেরা নিজেদের অত্যন্ত অভিজাত মনে করে। খন্দকের যুদ্ধের পরিখা খননের পর; মক্কার লোক খন্দকারদের নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতো; কখন আবার কোথায় পরিখা খনন করে বসে। কোন কোন খন্দকার আবার ফুলে ফেঁপে এতোটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে, কেউ কেউ বলা শুরু করে তারা আবুবকর সিদ্দিক ও হজরত আলীর চেয়ে অধিক প্রজ্ঞাবান। কেবল আত্মীয়তার কারণে তারা মূল্যায়িত হচ্ছেন; কিন্তু খন্দকার গোত্রের জ্ঞানীজনদের মূল্যায়ন নেই।
খন্দকারেরা এসসময় বাগদাদে সেকেন্ড হোম বানিয়ে ফেলে; কারণ বাগদাদে তখন আধ্যাত্মিকতার রমরমা ব্যবসা। আধ্যাত্মিক-আচারে খুব গম্ভীরভাবে কথা বলতে হয়। গাম্ভীর্যই খন্দকারের অলংকার। কিছু বৃদ্ধ খন্দকারকে মদিনায় রেখে; চালাক-চতুর খন্দকারেরা বাগদাদে আধ্যাত্মিকতার আসর জমায়। অপেক্ষাকৃত নবীন খন্দকারেরা ফারসি হেফজ করে হেফাজত খানার তহশীলদার হয়ে পড়ে। খন্দকারদের নৈশভোজের টেবিলে তখন তাদের ফারসি জানার অহংকারের আলাপ স্থায়ী হয়। লোকমুখে খন্দকারদের ফারসি জানার আলাপ ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারের জন্য যে পীর-ফকিরেরা বাগদাদ থেকে বঙ্গাল মুল্লুকে যাচ্ছিলেন, তারা খন্দকারদের অনুরোধ করেন, আমাদিগের সহিত চলুন; আমরা রাজা হইতে যাইতেছি; আর কতকাল তহশীলদার হইয়া কাটাইবেন!
পীর-ফকিরের বহরে যোগ দেয় খন্দকার গোত্র। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুবর্ণগ্রামে পৌঁছে খন্দকারেরা হাহাকার করে, পীর-ফকিরের কথা শুনিয়া ভ্রম হইলো; বাগদাদ ছাড়িয়া এই গ্রামে আসিয়া পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হইলো না।
আরবি-ফারসি জানার কারণে সুবর্ণগ্রামের মানুষ তাদের ঈশ্বরের পরেই অধিক জ্ঞানী লোক হিসেবে স্বীকৃতি দিলো। এ থেকে খন্দকার গোত্রের মাঝে জ্ঞানের গাম্ভীর্য আরো স্ফীত হলো। খন্দকার শুধু খন্দকারের সঙ্গে গল্প গুজব করে; অন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মনে হয়, উঁহু উহাদের উচ্চারণ ঠিক হইতেছে না। আবার নৈশভোজের সময় কার কোন আরবি-ফার্সি-উর্দু উচ্চারণে ভুল হইয়াছে উহা অভিনয় করিয়া দেখাইতে থাকে শিশু খন্দকারেরা। শিশুবেলা থেকেই খন্দকারের মনে এই বিশ্বাস প্রোথিত যে, তারা জ্ঞানী লোক; বাকিরা কিছুই শেখে নাই; আরে উহাদের তো উচ্চারণই হয়না।
বৃটিশেরা এসে ইংরেজি শিক্ষা চালু করলে, বাগদাদ থেকে আগত পীর ফকির গ্রামের অভিভাবকদের বলে, উহা ইহুদি-নাসারার ভাষা; উহা শিখিলে গুনাহ হইবে।
পীর-ফকিরেরা সিদ্ধান্ত নেয়, খন্দকারেরা ইংরেজি শিখে এ ভাষাকে কুক্ষীগত করলে; ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতায় সুবিধা হবে; সেইসঙ্গে ইংরেজি ভাষার উপনিবেশের অভিজাত শ্রেণীর তকমা জুটে যাবে।
খন্দকারেরা তাদের উপযুক্ত কন্যার বিবাহের জন্য বোকা ও দরিদ্র মেধাবী পাত্র খুঁজে বের করে; তাদের জন্য বিবাহ-ভাতা চালু করে। গোত্রপ্রধানকে অন্যেরা জিজ্ঞেস করে, অন্য গোত্রের পাত্রকে অর্থ-নাশ করিয়া পরিবারে আত্মীকরণের হেতু কী!
গোত্রপ্রধান স্মিত হেসে বলেন, ইহা খন্দকারের অর্থনীতি। মেধাবী পাত্র আত্মীকরণের এই বিনিয়োগ সুদে-আসলে উঠে আসবে; একটু ধৈর্য্য ধরো। আর নিজেদের গোত্রের মধ্যে বিবাহ সীমাবদ্ধ রাখলে তা থেকে উতপাদিত শিশুর বুদ্ধাংক কম হয়; ইংরেজ ডাক্তাররা এমন বললেন।
ইংরেজ যুগের অবসানের পর অনেক নেচে-কুঁদে পাকিস্তান বানানোর পর পীর-ফকিরেরা আবেগে আকুল হয়। কিন্তু শেষ খন্দকার চিন্তা করে, পাকিস্তানের জন্য প্রাণ-পাত করলেও মন্ত্রী তো তারা বানাবে না; এমন পার্টি ধরতে হবে; যাতে মন্ত্রী হওয়া যায়।
শেখ মুজিব শিক্ষা আর প্রজ্ঞা দেখলে অত্যন্ত আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠেন। ফলে বহুভাষাবিদ শেষ খন্দকারের বন্ধুত্বের আহবান উনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না।
তবে শেষ খন্দকার তার এতোকালের অভিজ্ঞতায় এটুকু ঠাহর করতে পারেন, এই দেশ বৃটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশ যাই হোক; এইখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংঘর্ষটাই চিরস্থায়ী সংস্কৃতি। লুডু খেলায় হারা-জেতা নিয়ে যারা মাথা ফাটাফাটি করে; সেই আইলামে জাহেলিয়াতে শান্তির সম্ভাবনা একেবারেই নাই।
শেষ খন্দকার তার পরিবারে আত্মীকৃত মেধাবী জামাইদের নির্দেশনা দেয়, আর একবার হিজরতের প্রয়োজন; ইংল্যান্ড-এমেরিকার দিকে যাত্রা করো; আর আমি এইখানে রাজা হওয়ার শেষ চেষ্টা করি।
শেখ মুজিবের সামনে শান্ত-স্থিতধী-স্বল্পভাষী খন্দকারকে দেখে অন্যেরা তাকে আড়ালে আবডালে সুশীল বলে; বিশেষ করে যারা বাংলা ‘ছ’ বর্ণটিকে আয়ত্বে আনতে পারে না; তারা ছ বর্ণ সঠিকভাবে উচ্চারণকারীদের সুশীল বলে। এরা জ্ঞানপাপী-সুশীল এইসব গালি দিয়ে শিক্ষার প্রতি বিষময় প্রতিক্রিয়া দেখালেও; নিজের ছেলে মেয়েকে বলে, ছ’-বর্ণের উচ্চারণ শেখো; তোমাদেরকে সুশীল হইতে হবে।
শেখ মুজিব যে কোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা ও গালি না দেয়া লোক; তাই খন্দকারকেই তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য পার্টি তহশীলদার বলে মনে হয়।
শেখ মুজিব খন্দকারকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন; আর খন্দকার ভেতরে ভেতরে বলে, আল্লাহ একজন মানুষকে সবই দেন, যেমন সুদর্শন-তেমনি জ্ঞানী- বাগ্মি-আর জনপ্রিয় মুজিব; অথচ খন্দকারকে আল্লাহ শুধু বহুভাষাবিদের গুন দিলেন; আর কিছুই দিলেন না; শেরওয়ানি পরলে তা কাকতাড়ুয়ার মতো ঝুলে থাকে শরীরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খন্দকার চিন্তা করে, ভগ্ন স্বাস্থ্যের জিন্না-নেহেরুরা মাথায় টুপি পরে যে সৌন্দর্য এনেছেন; সেটাই তার জন্য সহি।
শেখ মুজিব ;বঙ্গবন্ধু খেতাব পেলে; খন্দকার মনে মনে আরো কষ্ট পায়। তরুণ ছাত্রদের প্রতি উষ্মা জন্মে, কী হইতো আমাকেও বঙ্গ-খন্দকার খেতাবখানি দিলে!
খন্দকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; তার মনের ভাব মুখে থাকে না। মুখে সবসময়ই নির্ভরযোগ্যতার চিহ্ন। এমনিতে সব ঠিকই আছে; কিন্তু সেই বাগদাদের শ্রেষ্ঠত্বের বোধ তাকে রাত জাগায়; প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে ঈর্ষাকাতর করে তোলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই খন্দকার বংশের বাতিগুলো পশ্চিমের দেশগুলোতে চলে যায়। তারা চুপচাপ লোক; কোথায় কোন লুডু খেলা নিয়ে সংঘর্ষে পড়ে প্রাণ যাবে; সেই ঝুঁকি রাখতে চাননা গোত্রপ্রধান।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রীসভায় বসে বসে খন্দকার লক্ষ্য করে, এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেও কলকাতায় নানা ন্যারেটিভের লুডু খেলা নিয়ে বচসা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে কাজ ফেলে সেই বচসা মেটাতে হয়। ইতিহাস তৈরির আগেই ইতিহাসে কার প্রাধান্য থাকবে তা নিয়ে বীর-পুরুষদের বচসা। খন্দকার এসব দেখে আর মিটি মিটি হাসে, আমার নাতি নাতনি সেকেন্ড হোমে; সুতরাং এইদেশে তোমরা যত খুশি লুডু নিয়া মারামারি করো।
খন্দকারের একটু সিগেরেট পান ছাড়া আর কোন খারাপ অভ্যাস নাই। মদ্যপান তার বিশেষ অপছন্দ। কলকাতায় দেশপ্রেমিকদের মদ্যপান করতে দেখে সে বলে, কেন শরাব পান করছো হে বীরেরা; বরং গিয়ে রক্ত পান করো। এমন রক্তপানের মরশুম আর আসবে না।
দেশ স্বাধীন হলে, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে খন্দকার টিফিন বাটিতে করে চুঁই সেমাই আর মুরগার সালুন নিয়ে হাজির হয়। এরকম একটা গোছানো ব্যাপার তো আছেই তার। অন্যেরা যেখানে বিক্ষিপ্ত; খন্দকার সেখানে শান্ত; চক্ষু নিমিলিত।
মুক্তিযুদ্ধে কে কত বীরত্ব দেখিয়েছে তা নিয়ে ন্যারেটিভের লুডু খেলার খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে। সবাই হিন্দু ও অ-বাঙ্গালিদের বাড়ি দখল; বাংলোতে উঠে চকরা বকরা জামা পরে পাকিস্তানি-বৃটিশ সাহেব সাজার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। রাতারাতি রুলিং এলিট হবার দক্ষযজ্ঞে বঙ্গবন্ধু আর্তনাদ করেন, সব দেশ পায় হীরার খনি; আমি পেলাম চোরের খনি। মোসাহেবি করতে সহমত ভাইয়েরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরকে জ্যান্ত পীরের মাজার বানিয়ে ফেললে, বঙ্গবন্ধু তীব্র বিবমিষায় বলেন, চাটার দল আমার সামনে এসে সাধু সাজে; আর চোখের বাইরে গেলেই লটর-পটর করে।
বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীনের মাঝে কিছুটা অভিমান তৈরি হয়; রুলিং এলিট খলিফারা তাজউদ্দিনের সততা আর ঋজুতাতে বিরক্ত। এমন সুশীল তাদের দু’চোখের বিষ। এতো মেধাবী কেন হবেন তিনি; তিনি কেন খলিফাদের মতো ফেল করা ছাত্র হলেন না! প্রত্যেকদিন কানের কাছে এসে তালগাছেরা বলে, লিডার তাজউদ্দীনকে আনফ্রেন্ড করেন।
বঙ্গবন্ধু মনে মনে ভাবেন, এদের কাছে বন্ধুত্ব কত সস্তা ব্যাপার; স্বার্থে আঘাত পড়লেই প্রিয় মানুষ অপ্রিয় হয় এদের। এরকম বিষণ্ণ মুহূর্তগুলোতে খন্দকার সোফায় নীরব হয়ে বসে খলিফাদের লুডু খেলা নিয়ে সংঘর্ষ দেখে। মিট মিট করে হাসেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম এই কলহপ্রিয় কুরাইশদের কথা।
বঙ্গবন্ধু টের পান, স্বার্থের জন্য লুডু খেলোয়াড়েরা তাকেও খুন করতে পারে। তাই খন্দকারকে বলেন, আমার কিছু হলে আমার ছেলে-মেয়েদেরকে একটু দেখবেন ভাই।
খন্দকার আশ্বস্ত করেন, ও আপনি চিন্তা করবেন না বঙ্গবন্ধু।
সেনাবাহিনীর লুডু খেলোয়াড়েরা পাকিস্তান আমলের বেতন-ভাতা-সুবিধা কেন কমে গেলো; তা নিয়ে অসন্তুষ্ট। আর আওয়ামী লীগের লুডু খেলোয়াড়েরা যত্র-তত্র দেশপ্রেমের চেকপোস্ট বসিয়ে চেতনা মাপামাপি করছে। রক্ষীবাহিনী ভক্ষক বাহিনী হয়ে উঠেছে। জাসদের অস্থির পাখিরা আওয়ামী লীগের সহমত ভাইদের তৈরি করা ‘রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের আবহে’ তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে।
যুদ্ধাহত দেশে ক্ষমতা আর লুন্ঠনের ভাগবাটোয়ারায় পাগলপারা নতুন রুলিং এলিটেরা মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়াচ্ছে ছোট বেলায় ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর আর পাকা আমের মধুর রসে রঙ্গিন করি মুখ-এর লাস্যে।
আওয়ামী লীগ একটি তালগাছ হয়ে উঠতে থাকে; দেশ স্বাধীন কইরা তোমাগো মাথা কিইনা নিছি; এইরকম ভাব ধরে ঘুরছে হাঞ্জব্যাক অফ চেতনাদামেরা।
কোথায় দেশ গড়বেন বঙ্গবন্ধু; তার সময় চলে যায়, ছোট ছোট গ্রুপ-উপগ্রুপের কোন্দল মেটাতে। খায়ের খাঁ-রা সারাদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশ দেয়, লিডার সুশীলেরা বড্ড সমালোচনা করে আপনার। শিক্ষা খুব খারাপ জিনিস; এইডা হাড়ে হাড়ে বুঝতেছি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, বাবারা তোমরাও একটু পড়ালেখা করো; যাতে শিক্ষিত লোকের ভাষা বুঝতে পারো। নিজেরাও তাদের মতো গুছিয়ে সমালোচনার উত্তর দিতে পারো।
কিন্তু সূর্যের চেয়ে বালি সবসময় গরম। তাই প্রজ্ঞাবান লেখককে চেতনাপাণ্ডারা রাস্তায় ধাওয়া দিয়ে বলে, ধর হারাম জাদারে।
খন্দকার আওয়ামী লীগেরই কিছু শিক্ষিত লোককে নিয়ে আগামসি লেনে লুডুর আসর বসায়। চুক চুক করে বলে, পিতা বৃহত্তর স্বার্থে পুত্রকে কুরবানি করার ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে পুত্রও প্রয়োজনবোধে পিতাকে কুরবানি দিতে পারে।
খন্দকার”রাষ্ট্রপতির ভাষণের” একটি খসড়া প্রস্তুতের কাজে লেগে যান। দেশকে একটু সুশৃংখল করতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু। মুশতাক তাতে সম্মতি দিয়ে বলেন, শৃংখলা ছাড়া কোন দেশ কী গঠিত হয়! আপনি ঠিকই করিয়াছেন।
তাজউদ্দীন ফোনে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, রাজনীতিতে এক্সিট পয়েন্ট খুব জরুরি মুজিব ভাই। এক্সিট পয়েন্ট বন্ধ হয়ে গেলে আপনিও মরবেন; আমরাও মরবো।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এটা চিরস্থায়ী ব্যাপার নয়; বাকশাল দিয়ে চেষ্টা করে দেখি; নয়তো ফিরে আসা যাবে সনাতন গণতন্ত্রে। দেশটা পুনর্গঠন হয়ে গেলে আমি গ্রামে ফিরে গিয়ে অবসর জীবন কাটাবো। কিন্তু ‘সোনার বাংলা গড়া’র যে অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম; তা পূরণ না করলে আমরা কেউ শান্তি পাবো না।
দেশে তখন যুদ্ধ ফেরত অস্থির পাখিদের ডানা ঝাপটানি; দেশের মালিক তারা; আর ১৬ ডিসেম্বরে মাথায় পতাকা বেঁধে শাহবাগ মাতানো বীরেরা যৌবন জ্বালায় অস্থির। হোলিয়ার দ্যান দাও হয়ে কোথাও বিন্দুমাত্র সরকার সমালোচনা দেখলেই, অই পাকি দালালডারে ধর বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এরফলে চেতনার নব্য বীরপুঙ্গবেরা যেখানে যাকে লাঞ্ছিত করে; তাদের ক্ষোভ জমা হয় বঙ্গবন্ধুর ওপর।
আগামসি লেনের লুডুর টেবিলে বসে খন্দকার বলেন, তাওয়া যথেষ্ট গরম হইয়াছে; এখনই পরোটা ভাজিবার আদর্শ সময়।
১৪ অগাস্ট দুপুরে খন্দকার টিফিন বাটিতে করে হাঁসের মাংসের তরকারি নিয়ে ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলেন, হাঁসের মাংস উনার খুব পছন্দের; আজ নৈশভোজে পরিবেশন করলে বাধিত হই।
বত্রিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে আসার সময় খন্দকার মনে মনে বলেন, দ্য লাস্ট সাপার।
১৫ অগাস্ট গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হানা দেয় পূর্ববঙ্গের ঠগীরা। শিশু রাসেলকে হত্যায়ও বিন্দুমাত্র অনুতাপ হয়নি যাদের; তারা স্বদেশের নরভোজি; এমন হিংস্র লোক ভূ-ভারতে নেই। ৩২ নম্বরের সিঁড়িয়ে পড়ে থাকে রক্তাক্ত বাংলাদেশ। এরপর যেসব সকাল আসে তা রাতের চেয়েও অন্ধকার।
শাহবাগের রেডিও স্টেশনে খন্দকার পৌঁছান তার দীর্ঘকাল ধরে তৈরি করা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ড্রাফট নিয়ে। সেটি পাঠ করে স্টুডিও থেকে বের হলে রাতারাতি তার সহমত ভাই হয়ে পড়া লোকেরা; যারা বঙ্গবন্ধুর অনুগ্রহে রেডিওতে চাকরি পেয়েছিলো; তারা এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানায়, শতাব্দীর সেরা বক্তৃতা আলেমপনা; এই বক্তৃতা ইতিহাস হবে; এর ছত্রে ছত্রে জ্ঞানের দীপ্তি।
খন্দকার প্রশংসায় আকুল হবার লোক নয়; সে কেবল মুচকি হেসে বলে, এ বক্তৃতা তো একদিনে লিখিনি।
(পুনশ্চঃ এটি একটি কাল্পনিক ছোটগল্প; ইতিহাসের কিছু উপাদান থাকলেও; এটা কোনভাবেই ইতিহাস নয়। তাই ‘ইতিহাস-অনুভূতি’তে আঘাত পেয়ে তেতে ওঠা প্রত্যাশিত নয়। বিশ্বের নানাভাষায় এরকম ফিকশনাল গল্প ও চলচ্চিত্র প্রচলিত। কোন ভক্তিমূলক পাঠকের অনুভূতি আঘাতের দায় লেখকের নয়।)