বরাবর
ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার নামের আড়ালে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় পণ্ডিতগণ।
অনুলিপি: ধিক্কারের সাথে প্রেরিত হলো তাদের বাংলাদেশী দালালদের সমীপে।
এক.
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কি অমিয়ভূষণের চাইতে বড় লেখক? দেবেশ রায়ের চাইতেও? জয় গোস্বামী কি শঙ্খ ঘোষের চাইতে বড় কবি? মৃদুল দাশগুপ্ত ও তার মতো অন্যদের চাইতে?
আবুল বাশার কি সাধন চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, ভগীরথ মিশ্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, আফসার আমেদের চাইতে বড় লেখক? (বাংলাদেশের সোমেন চন্দ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, রিজিয়া রহমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহিরদের কথা তুলছি না। আলোচনাটা ভারতীয় লেখকদের নিয়েই থাকুক)।
তাহলে শীর্ষেন্দু, বাশার, জয়দের বই উপরোক্তদের চাইতে বাংলাদেশে বহুগুণে বেশি বিক্রি হয় কেন?
বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকলেই এই প্রশ্নের উত্তর সহজেই পাওয়া যাবে। কারণ হচ্ছে, বেশি বিক্রি হওয়া লেখকদের পেছনে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাদের জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একদিন-দুইদিন নয়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে। ভাড়াটে পণ্ডিত, ভাড়াটে সমালোচক, এমনকী ভাড়াটে পাঠক দিয়েও অসংখ্য সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে কেন্দ্রে রেখে অনেক ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেইসব অনুষ্ঠানের খবর খুব জমপেশভাবে প্রচার করা হয়েছে। এইরকম নানা পদ্ধতি পুঁজি জানে। তারা সেগুলোর প্রয়োগ করেছে। এবং এখনো নিয়মিতভাবে তাদের বাংলাদেশি এজেন্টদের দিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে চলেছে। অদীক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত পাঠক তো এসব দেখেই আকৃষ্ট হয়। এদের বেলাতেও ঠিক সেটাই ঘটছে। বাংলাদেশে এদের বইয়ের বাজার উন্নত ভারতীয় বাঙালি লেখকদের চাইতে তাই অনেক বেশি। ফেসবুকে ইতোমধ্যেই তাদের ফেউরা দাবি করতে শুরু করেছে বাংলাদেশের পাঠকের তোয়াক্কা নাকি তারা করেন না। তারা কলকাতাতেই প্রকাশকদের কাছ থেকে অকল্পনীয় অংকের রয়্যালটি পান। হতে পারে তারা সেখানে অনেক রয়্যালটি পান। (সেই রয়্যালটির মধ্যে যদিও বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া কপিগুলির রয়্যালটিও আছে)। তবে বাংলাদেশের পাঠক না থাকলে কী পরিণতি হয় তা ‘দেশ’ পত্রিকার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। বিএনপি আমলে ‘দেশ’ পত্রিকাকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই এক ধাক্কাতেই পত্রিকাটি সাপ্তাহিক থেকে হয়ে গেছে পাক্ষিক। আর তার কলেবর হয়ে গেছে আগের তিন ভাগের এক ভাগ। তাদের বাকোয়াজির বদলে আমি উদাহরণটাই পেশ করলাম।
দুই.
ভারত নাকি ঈর্ষনীয় উন্নত দেশ। ভারতীয় ফেসবুকারদের বিরাট অংশ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একথা জানাতে যে আমি ভারতের প্রতি ঈর্ষান্বিত।
দুঃখিত বন্ধুরা। আমি বরং ভারতবাসীদের করুণা করি।
ভারত বিশাল ভূখণ্ডের দেশ। মাটিতে, পানিতে, পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে অফুরন্ত সম্পদ। সেই সম্পদের ব্যবহারে তারা হতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ও সমৃদ্ধ দেশগুলির একটি। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, সারা পৃথিবীতে যত মানুষ না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, তার এক-তৃতীয়াংশই ভারতবাসী। স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৪২% ভারতবাসী টয়লেট সুবিধা পায় না। মাঠে-ঘাটে মলত্যাগ করে। পুরো আফ্রিকা মহাদেশে যতজন অপুষ্টিআক্রান্ত রোগী আছে, এক ভারতেই সংখ্যাটি তার চাইতে বেশি। আমাদের তো ছোট্ট একটি দেশ। জনসংখ্যার ভারে হাঁসফাস দশা। প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে গেলে কিছুই নাই। সেই আমাদেরও নাকি বালিকাশিক্ষার হার ভারতের তুলনায় বেশি। পৃথিবীতে কৃষকরা আত্মহত্যা করে যেসব দেশে, সেগুলোর মধ্যে ভারত প্রথম সারিতে। তাদের অবশ্য আম্বানী আছে, টাটা আছে, বিড়লা আছে। এদের সম্পদ দেখেই ভারতীয়রা মহা সন্তুষ্ট। থাকুন মহাশয়বৃন্দ।
ভারতীয় ফেসবুকাররা এই দাবিও তুলছেন গর্বের সাথে যে তাদের সিনেমা, সিরিয়াল দেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষ পাগল। আমি এই দাবির বিরোধিতা করছি না। তবে কারণটা খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করি। বলিউডে আমাদের তুলনায় উন্নত প্রযুক্তি আছে। কিন্তু সেটি মূল কারণ নহে ভ্রাতা-ভগ্নীগণ। মূল কারণ হচ্ছে ভারতের মেয়েরা পর্দাতে যতখানি উরু-বক্ষদেশ-কোমর দেখায়, শরীরে পোশাকের বদলে পোশাকহীনতার যে আর্ট তারা রপ্ত করেছে, যে যৌন আহ্বানমূলক নৃত্য তারা পরিবেশনে সক্ষম, তা বাংলাদেশের মেয়েরা পারে না। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে পর্ণস্টারকে পর্যন্ত মুম্বাইয়ারা নায়িকা বানিয়ে বাজারে সিনেমা ছাড়ছেন। আবুল হাসানের কবিতার পংক্তি মনে পড়ছে– ‘গ্রীসের নারীরা উরু-ভুরু-শরীর দেখিয়ে কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে তো খেলো!’ আপনাদের যৌনতা-ব্যবসা অতুলনীয়।
আমাদের আমদানির তালিকায় ভারতীয় চাল-ডাল-পেঁয়াজ-বুটসহ অসংখ্য পণ্যের তালিকা তুলে দিয়েছেন মহান ভারতীয় ফেসবুকাররা। হ্যাঁ। অবশ্যই আমরা আমদানি করি। পয়সা দিয়ে কিনে আনি। আপনারা নিজের দেশের মানুষকে অনাহারে রেখে, অপুষ্টিতে রেখে খাদ্য বিক্রি করেন আমাদের কাছে। আপনারা মহান।
তিন.
সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলাভাগ নিয়ে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে চান আপনারা।
তার আগে একটা কথা বলা দরকার যে, বাংলার ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিল ইংরেজরা। সেটি তাদের মতো করে। ১৯৪৭-এর পরে সেই ইতিহাস রচনার অধিকারী হয়েছেন হিন্দুত্ববাদীরা। তারাও লিখছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন তাদের মতো করেই। ইংরেজদের কাছাকাছি তারাই ছিলেন ১৯০ বছর ধরে। ফলে ইংরেজদের মতোই কূট-কৌশলে তারা দক্ষ।
ব্রিটিশদের দালালিসূত্রে হিন্দু বাঙালি লেখাপড়াজানা শ্রেণী সবকিছু দখল করে রেখেছিলেন। বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্ব তারা স্বীকারই করতেন না। বাঙালিদের মধ্যে যে মুসলমানরাও আছে সেকথা জেনেও স্বীকার করতে নারাজ এমনকী সবচেয়ে মানবদরদী লেখক বলে পরিচিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্মরণ করুন তাঁর বহুল পরিচিত বাক্যটি– ‘স্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল খেলা’।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস বারংবার পড়তে হবে আমাদের। কিন্তু তিনিই যে ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রথম উদ্গাতা সেকথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। তাঁর বাঙালি আপামর বাঙালি নয়– হিন্দু বাঙালি।
শিবাজী উৎসবের আয়োজকরা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কোনো বীর খুঁজে পাননি। তাই শিবাজীকে আমদানি করলেন কলকাতায়। শুরু করলেন হিন্দু মেলা এবং শিবাজী উৎসব।
বাঙালি মুসলমান কৃষক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাটবিক্রির টাকায় তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য অর্জন করল। কিন্তু দেখল যে পাঠ্যসূচিতে কেবল হিন্দু দেব-দেবীর বর্ণনা, হিন্দু পৌরাণিক আখ্যান। পাঠ্যসূচি মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ নয়। পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদী। এ তো মুসলমানের বিশ্বাসের সাথে যায় না। পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন অভিভাবকরা। তার ফলাফল কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই। প্রমাণ হিসাবে তখনকার পাঠ্যপুস্তকও আমার কাছে নেই। তবে আমার কাছে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘জাতীয় সাহিত্য’ গ্রন্থটি আছে। সেখানে দেব-দেবীকে বুকে ধারণ করে সাহিত্যপথে অগ্রসর হবার জন্য পুনঃ পুনঃ তাগাদা দেওয়া হয়েছে। স্যার আশুতোষ মহাপ্রাণ ব্যক্তি। সর্বজন শ্রদ্ধেয়। বাঙালির শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশাল। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ধারণার কারণেই পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি হিন্দু মহাসভার বিষবৃক্ষ বাংলায় রোপণ করার মানসিকতা লাভ করেছিলেন কি না তা গবেষণা করে দেখা যেতে পারে।
ব্রিটিশবিরোধী অনুশীলন এবং যুগান্তর দল গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দু যুবকদের দ্বারাই। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ ছিল তাদের প্রেরণা। কিন্তু মুসলমান যুবক চাইলেও সেখানে সদস্য হতে পারত না। কমরেড মুজফফর আহমদ লিখেছেন যে, সদস্য হতে হলে মা কালীর মূর্তির পায়ে হাত রেখে তার নামে রক্তশপথ নিতে হবে। অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য পথ রুদ্ধ।
ভারতভাগের সময় শরৎ বসু-আবুল হাশিম-কিরণশঙ্কর-সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলার সংবিধান পর্যন্ত রচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন– সেই প্রস্তাবে জিন্নাহ সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধী-নেহরু সম্মতি দেননি।
কারণটা যতখানি রাজনৈতিক, তারচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গে বিড়লা-টাটা-বাজাজ-কানেরিয়াদের বিশাল বিনিয়োগ ছিল। অখণ্ড বাংলা ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে বিড়লাদের। তাই গান্ধীকে তিনি বাংলাবিভাগের পক্ষে মতামত দিতে বাধ্য করেছিলেন। গান্ধীর সম্মত না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ তার আশ্রম এবং কংগ্রেস চলত বিড়লাদের টাকাতেই। বাংলাভাগের পক্ষে হিন্দু বাঙালিরা যতগুলি মিটিং করেছিলেন সেগুলি সবই হয়েছিল ঘনশ্যামদাস বিড়লার কলকাতার বাড়িতে। সুনীতি কুমার দত্ত তাঁর বইতে বিস্তারিত লিখেছেন এসব নিয়ে।
হিন্দুত্ববাদী ফেসবুকাররা আমার এবং আমাদের দেশের মানুষের কাঁধে তুলে দিচ্ছেন সাম্প্রদায়িকতার দায়ভার। বারবার বলছেন পূর্ববঙ্গে ১৯৫৫ এবং ১৯৬২ সালের দাঙ্গার কথা। আমরা সেই দাঙ্গার জন্য লজ্জিত। কিন্তু তারা একবারও তো বলেন না যে ১৯৪৭ সালের পর থেকে এযাবৎ পুরো ভারতে কত ডজন দাঙ্গা হয়েছে। কত হাজার মুসলমান নিহত হয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন, কত মুসলিম নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। তারা লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, উচ্চারণও করতে চান না সেসব দাঙ্গার কথা।
ভারতীয়দের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পুরে খুলে গেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-র ভূমিধস বিজয়ে। বাংলাদেশে বিজেপি-র কাউন্টার পার্ট জামায়াতে ইসলামির মতো দল কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
অথচ তারা নন, আমরাই নাকি সাম্প্রদায়িক!
সংযুক্তি: এই গোপন সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকদের সাথে আমি বা আমরা কোনোভাবেই কোনো সংস্রব রাখতে চাই না। ভারতের সত্যিকারের মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীলরাই আমাদের সঙ্গী। তারা এবং আমরা একই যুদ্ধে লিপ্ত।
চার.
নিজের বসতভূমি চিরতরে হারানোর বেদনা মৃত্যুযন্ত্রণার চাইতে কম নয়।
দুই মাসের জন্য বিদেশে গেলে একমাস পার না হতেই দেশের জন্য বুক টনটন করতে থাকে। উন্নত দেশের অত সুন্দর জীবনের মধ্যেও বারবার মনে ভেসে ওঠে আমার হতশ্রী, নোংরা, ঘিঞ্জি, দরিদ্র শহরের কথা। যাদের নিজের দেশ ছেড়ে চিরতরে অন্য কোথাও পাড়ি দিতে হয়, তাদের কষ্ট সমানভাবে না হলেও কিছুটা অন্তত অনুভব করতে পারে যে কোনো মানবিক মানুষ। সেই কারণেই বাংলাবিভাগ মেনে নিতে না পারা ঋত্বিক ঘটকের আর্তচিৎকার আমাদের কানে বাজে। নচিকেতা পূর্বপুরুষের জন্মভিটায় এসে উঠোনে থেবড়ে বসে যখন কাঁদেন, তখন আমাদের মনও ভারি হয়ে ওঠে।
আপত্তি ওঠে তখন, যখন বাস্তু হারানোর বিষয়টিকে একপেশে করে তোলা হয়। একটানা লেখালেখি আর বলাবলির মাধ্যমে মানুষের মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কেবলমাত্র এই বাংলা থেকে হিন্দুরাই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। ভারত থেকে কেউ দেশত্যাগে বাধ্য হয়নি। আমাদের লেখক-কবিদের মধ্যে শওকত ওসমান, বদরুদ্দিন উমর, শওকত আলী, আবুবকর সিদ্দিক, হাসান আজিজুল হক, ড. আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, বশীর আল হেলালসহ আরো অনেকেই ওপার থেকে নিজেদের শিকড় উপড়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কায়েস আহমেদ তো মানিয়ে নিতে না পেরে জীবনের তিক্ততা সইতে না পেরে আত্মহত্যাই করলেন। বাংলাদেশে ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা দুর্বল। তাই পরিষ্কার কোনো সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলতে পারি, এমন কোনো শহর বা গ্রাম দেখিনি যেখানে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আসা পরিবার নেই। এমনকী পার্বত্য অঞ্চলেও। তারা লিখতে জানেন না হয়তো। জানলেও লেখেন না। হয়তো নিজেদের রিফ্যুজি পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। তাই জনসমক্ষে নিজেদের ভিটে-মাটি নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন না। নিজেদের জন্মভূমি নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেন না। কিন্তু অন্তরে যে পশ্চিবঙ্গে যাওয়া মানুষদের মতোই গুমড়ে গুমড়ে কাঁদেন, সে বিষয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করে, সে অন্তত মানুষ নয়।
বাঙালি বাদেও অন্তত ৫০ লক্ষ বাস্তুচ্যুত বিহারি বাস করছে এই দেশে। বাস করছে ঢাকা, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, নাটোরসহ বিভিন্ন শহরে। কেউ ক্যাম্পে, কেউ নিজেদের বিহারি বস্তিতে। এরাও এসেছে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় বিহারে মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া দেখে। স্বপ্নের পাকিস্তানে অন্তত প্রাণটা বাঁচবে এই আশাতে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় গান্ধী গেলেন নোয়াখালিতে। শেরে বাংলা তাঁকে বলেছিলেন– বিহারে হাজার হাজার মুসলমানকে কচুকাটা করা হচ্ছে। সেখানে না গিয়ে আপনি নোয়াখালিতে বসে রইলেন কেন? নোয়াখালিতে যেমন এসেছেন, বিহারেও তেমনই একবার অন্তত যান! গান্ধী কোনো উত্তর করেননি।
আমাদের বিখ্যাত বাঙালি লেখকরা কৃষণ চন্দরের মতো মুদ্রার দুই পিঠ দেখতে শেখেননি। ‘গাদ্দার’ এর মতো নিরপেক্ষ মানবিক উপন্যাস তাদের হাত থেকে বের হয়নি।
তাই বলে ভারত থেকে এই দেশে আসা লক্ষ লক্ষ বাস্তু হারানো মানুষের অস্তিত্ব মিথ্যা হয়ে যায় না।
সংখ্যালঘুর অবস্থা এই দেশে মহা করুণ বলে প্রচার চলে। সত্যি সত্যিই তো সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আমরা সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষরা শক্তিমানদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাই না। কিন্তু আমাদের তুলনায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার বোধ বাস্তব কারণেই অনেক বেশি।
একই অবস্থা ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। প্রতিদিনের আন্তর্জাতিক সংবাদে চোখ রাখলেই সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। কাশ্মিরে চলছে এথনিক ক্লিনজিং। শুধু কি মুসলমান? পশ্চিমবঙ্গে খ্রিস্টান মিশন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা ধর্ষণ করেছে ৭০ বছর বয়সের খ্রিস্টান নানকে। কোনো এক প্রদেশে একজন বিজেপি এমপি-র সাধারণ জীনযাপন ভাইরাল হয়েছিল ফেসবুকে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ মানুষ। পরে জানা গেল সেই সাধুজীবন যাপনকারী লোকটি সেই অঞ্চলের কয়েক ডজন খ্রিস্টানকে হত্যার সাথে জড়িত। খ্রিস্টানদের পরিচালিত মিশন হাসপাতাল এবং স্কুলটিকেও সে উচ্ছেদ করেছে এলাকা থেকে। মেটিয়াবুরুজে মুসলমান পাড়ায় ঢুকে আমার একটাই উপমা মনে এসেছিল। ইনক্যুইজিশনের সময় ইহুদিদের যেভাবে ঘেঁটোর মধ্যে রাখা হতো, সেই রকম ঘেঁটোসুলভ অবর্ণনীয় জীবন তাদের।
ইউরোপ-আমেরিকাতে ষাটের দশক পর্যন্ত কালোদের মানবাধিকার ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল যে উচ্চশিক্ষা এবং ভালো চাকুরি তারা পাবে না। তাই তারা মনোযোগ দিয়েছিল খেলাধূলার দিকে। তাদের অদম্য মনোবল আছে, গতি আছে দুই পায়ে, স্কিল আছে। তাই খেলার রাজনীতির শিকার হয়েও তারা ক্রীড়াজগতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে। কারণ খেলাতে পারফর্ম করতে হয় হাজার হাজার লোকের সামনে। সেখানে যে পারফর্ম করবে, তাকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
ভারতে মুসলমানরা জানে যে সরকারি চাকুরিতে তাদের জায়গা পাওয়ার পথে অনেক বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। তাই তাদের সচেতন অংশ ছোট থেকে বড়, নানা ধরনের ব্যবসার মধ্যে ঢুকে গেছে। আর ঢুকেছে পারফর্মিং আর্টস-এ। দিলিপ কুমার, মধুবালা, নার্গিস, শাহরুখ, আমীর, সালমান, ইরফান খান, ফারহান আখতার, নেওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীরা তাই জায়গা করে নিতে পেরেছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে ইউসুফ খানকেও দিলিপ কুমার নাম নিতে হয়েছিল, মধুবালার আসল নামও মধুবালা নয়।
বাংলাদেশের হিন্দু এবং চাকমারা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে। হিন্দুদের তো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ঐতিহ্য আছে সেই ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকেই। তাই তারা দেশের সরকারি সর্বোচ্চ পদগুলিতে জায়গা করে নিয়েছেন। এটি তাদের বেঁচে থাকার লড়াই-এরই অংশ।
উদাহরণ আর না বাড়িয়ে বরং সেইসব ক্রিমিনালদের চিহ্নিত এবং বয়কট করা প্রয়োজন, যারা লক্ষ-কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু বানিয়েছে, নিজের দেশে কোটি কোটি মানুষকে সংখ্যালঘু বানিয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা এগিয়ে আছি। কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মহাত্মাগণ আর তাদের পৃষ্ঠপোষক পুঁজির ধারকরা সেই ক্রিমিনাল দল।
আমরা তো জিন্নাহকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। লিয়াকত-নাজিমউদ্দীনদের ইতিহাসের ডাস্টবিনে পাঠিয়ে দিতে পেরেছি। লতিফ-বাওয়ানী-আদমজীদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছি।
ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবীরা কি পারবেন গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল-বিড়লা-বাজাজদের ইতিহাসের কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে?