ইউরোপ যদি ধর্মের শাসন থেকে তার রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে না পারত তবে কি ইউরোপ বা পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ পৃথিবীর উপর এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, না, পারত না। বরং ইউরোপ আজও মধ্যযুগের অন্ধকারে পড়ে থাকত। ফলে হয়ত পৃথিবীও পড়ে থাকত মধ্যযুগের অন্ধকারে। কারণ ধর্মের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা ইউরোপ ছাড়া আর কোথায়ও এভাবে শুরু হয় নি। চতুর্দশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটে তার মধ্য দিয়ে সেখানে বিদ্যমান ধর্ম এবং যাবতীয় অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। রেনেসাঁর উদ্ভব হয় প্রাচীন বিস্মৃত গ্রীক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পুনরুজ্জীবনের ফলে।
অবশ্য ইউরোপে পরলোকমুখী ধর্মের বিপরীতে জীবন ও বস্তুমুখী যুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয়েছিল ধর্মীয় শক্তির বিরাট ক্ষয় ও ব্যর্থতার ফলে। ইউরোপের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় তার ধর্মগুরু পোপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যীশুখ্রীষ্টের জন্মভূমি ও তীর্থস্থান জেরুজালেম ও প্যালেস্টাইনকে মুসলমানদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ১০৯৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শুরু করে। এরপর থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত অনেক কয়টি ক্রুসেড পরিচালিত হয়। খ্রীষ্টানরা প্যালেস্টাইন এবং জেরুজালেম দখল করলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারে নি। প্যালেস্টাইনে শেষ খ্রীষ্টান দুর্গের পতন ঘটে ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে। আর এভাবে ক্রুসেড শেষ হয়।
একাদশ থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বৎসরের যুদ্ধে বিপুল সম্পদ ও প্রাণহানি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ক্রুসেড ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা পশ্চিম ইউরোপে ধর্মীয় শক্তি তথা ক্যাথলিক চার্চের মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে নিদারুণ আঘাত হানে। এটা পশ্চিম ইউরোপে জীবনবাদী এবং সেকিউলার চিন্তা-চেতনার উত্থান ও বিস্তারের জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এই কারণে আমরা ক্রুসেডের ব্যর্থতা বা পরিসমাপ্তি এবং নবজাগরণের সূচনার কালের মধ্যে এমন সঙ্গতি ও সম্পর্ক দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে পঞ্চম এবং শেষ উল্লেখযোগ্য ক্রুসেডের সময় ছিল ১২১৭ থেকে ১২২১ খ্রীষ্টাব্দ। এরপর ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে তথা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ সময়ে প্যালেস্টাইন এলাকায় শেষ খ্রীষ্টান দুর্গের পতন হলে ক্রুসেডের কালের অবসান হয়। নবজাগরণ চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ নিলেও তার সূচনা প্রকৃতপক্ষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকেই হয়। সুতরাং ব্যাপারটা এমন যে, ব্যর্থ ধর্মযুদ্ধের কাল শেষ হবার সঙ্গে সফল ও আলোকিত নবজাগরণের কাল শুরু হয়েছে।
কিন্তু নবজাগরণের পথ বাধামুক্ত ও মসৃণ ছিল না। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেককে তাদের স্বাধীন ও নূতন চিন্তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বিদ্যমান ধর্মীয় তথা চার্চের ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে প্রকৃতি ও জগৎ সম্পর্কে বক্তব্য প্রদানের জন্য গ্যালিলিওকে (১৫৬৪-১৬৪২) গৃহবন্দী করা হয়। বন্দী দশায় তাঁর মৃত্যু হয়। ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) চার্চের আদালত আগুনে পুড়িয়ে মারার রায় দিলে সেভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়।
নবজাগরণ, ধর্ম সংস্কার আন্দোলন, যুক্তিবাদ এবং আলোকপ্রাপ্তি, রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব, কোন কোন দেশে নিরংকুশ রাজতন্ত্রের অবসান ও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি কতকগুলি ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউরোপ এগিয়েছে ধর্মের শক্তিকে ক্রমাগত কোণঠাসা করে। এভাবে রাষ্ট্রের উপর সেখানে ধর্মের যে আধিপত্য এতকাল ছিল তার অবসান ঘটেছে। এর ফলে ধর্ম সেখানে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এভাবে ইউরোপে ধর্মের শক্তির ক্ষয় হয়েছে।
কিন্তু ধর্মের শক্তিক্ষয় হওয়ায় ইউরোপের শক্তিক্ষয় হয় নি; বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং ইউরোপ এমন শক্তির অধিকারী হয়েছে যার সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা সারা পৃথিবীর প্রায় কারও হয় নি। এভাবে ইউরোপ ধর্মের শক্তি নিয়ে মধ্যযুগে ক্রুসেডের মাধ্যমে যে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বড় কাজ করতে সক্ষম হয়েছে যখন তা ধর্মের পরিবর্তে যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিদ্যার আশ্রয় নিয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া এই তিন মহাদেশ আবিষকার ও জয় করে ইউরোপীয়রা সেগুলিকে নিজেদের আবাস ভূমিতে পরিণত করেছে। এক সময় শুধু জেরুজালেম বা প্যালেস্টাইন নয় উপরন্তু প্রায় সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য দখল করে নিয়ে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রায় সমগ্র এশিয়া এবং সম্পূর্ণ আফ্রিকা মহাদেশ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দখলে চলে যায়।
ধর্মের শক্তিতে এশিয়া-আফ্রিকা ইউরোপের অগ্রাভিযান ও আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারে নি। বরং ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রযুক্তি বিদ্যা যতটুকু সম্ভব আয়ত্ত করেই এক সময় এশিয়া-আফ্রিকার পদানত দেশগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও অধিকাংশ দেশই আজও বহন করে চলেছে পরাধীনতা তথা উপনিবেশিক কালের অনেক কিছুর ধারাবাহিকতা। ভিন্ন বা পরোক্ষ রূপে পাশ্চাত্যের আধিপত্য অথবা নিয়ন্ত্রণ এখনও অব্যাহত। তবে পৃথিবীব্যাপী আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণে এক সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস্ ইত্যাদি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের যে প্রাধান্য ছিল সেটা এখন নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫) পর থেকে এই জায়গা অধিকার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রাক্তন উপনিবেশিক দেশগুলোর পুরাতন ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে সেগুলোকে পাশ্চাত্যের শোষণ-লুণ্ঠন কিংবা বাজার ব্যবস্থার অধীনস্থ রাখার ক্ষেত্রে এখন নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯১-তে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তিতে পরিণত হবার পর প্রাচ্য তথা প্রাক্তন উপনিবেশিক এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো নূতন করে উপনিবেশবাদী হুমকির সমমুখীন হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী- উপনিবেশবাদী কায়দায় সামরিক অভিযান চালিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাক দখল।
এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ব্যবস্থাকে মোকাবিলা করে যে কয়টি রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে বলিষ্ঠভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল তাদের সবারই উত্থানের অন্যতম পূর্বশর্ত ছিল রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মের অপসারণ। এর সর্বোচ্চ প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ক্ষেত্রে। এটা অবশ্য লক্ষণীয় যে এই দেশগুলোর প্রায় সব কয়টি ছিল খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলির কমিউনিস্ট বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন বিষয় ছিল। নিজস্ব শক্তিতে ধর্মের শাসন থেকে রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকরভাবে মুক্ত করার দাবী যে মুসলিম দেশ করতে পারে সেটা হচ্ছে তুরস্ক। এ ক্ষেত্রে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামালের ভূমিকা যুগান্তকারী।
কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশই তুরস্কের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় নি। বরং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট শিবির যতদিন টিকে ছিল তত দিন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের নাস্তিকতা বিরোধী সংগ্রামের নামে সোভিয়েত ও সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়েছে এবং একইভাবে পা দিয়েছে ধর্মীয় রাজনীতির ফাঁদে। পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশে ধর্ম চর্চায় শিথিল এবং এমনকি ধর্ম বিশ্বাস ক্রমাগতভাবে হারাতে থাকলেও বাইরে ধর্ম প্রচার বা রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর থেকেছে। বিশেষত বিপুল তেল সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় রাজনীতি এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎমুখী সরকারগুলির সংরক্ষণ এবং ইসলামী শক্তিসমূহের উত্থানে পাশ্চাত্যের ভূমিকা অজানা নয়। তেল সম্পদে সমৃদ্ধ না হলেও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের অধিকারী আফগানিস্তান দখলের পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে উগ্র ধর্মীয় শক্তির উত্থান ঘটায়। এই ধর্মীয় শক্তির সাহায্যে সেখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটানো হয়। এরপর যখন প্রয়োজন মনে করেছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান চালিয়ে উগ্র ইসলামী শক্তিকে উচ্ছেদ করে সেখানে তার পুতুল কারজাই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আফগানিস্তানের স্বাধীনভাবে উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন প্রচেষ্টাকে বাধা দানের ইতিহাস এটাই প্রথম নয়। অতীতে বাদশাহ আমানুল্লাহ যখন তুরস্কের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে আফগানিস্তানের আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন তখন ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ ব্যয় করে তাঁকে উৎখাত করার জন্য মোল্লা এবং ধর্মাশ্রিত শক্তিসমূহকে সংগঠিত করে। এর পরিণতিতে আমানুল্লাহ সিংহাসনচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং তাঁর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন প্রয়াস ভেস্তে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকা কালে মুসলিম পৃথিবীতে শুধু যে কমিউনিজম কিংবা সমাজতন্ত্রের প্রভাব ও প্রসার রোধ করার জন্য পাশ্চাত্য ধর্ম ও ধর্মীয় শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিত তাই নয়, উপরন্তু মুসলিম দেশগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করে যাতে তার সমকক্ষ না হয়ে ওঠে তার জন্যও ধর্ম ও ধর্মীয় শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিত। বিশেষত ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং তেল সম্পদের কারণে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার প্রয়োজনে পাশ্চাত্যের নিকট সেখানে ধর্মের প্রভাব ও প্রাধান্য রক্ষার প্রয়োজন সর্বাধিক ছিল এবং আজও আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যেমন এই প্রয়োজন শেষ হয় নি তেমন ইসলামী জঙ্গী শক্তি কর্তৃক ২০০১–এর ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরেও এই প্রয়োজন শেষ হয় নি।
তবে মৌলবাদ বা ইসলামের আক্রমণাত্মক ও উগ্র রাজনৈতিক রূপ পাশ্চাত্যের পছন্দ নয়। কারণ এই ইসলাম বিশ্বাসীদের একটা কাফের বা বিধর্মী শক্তি লাগে যার বিরুদ্ধে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ করে তারা স্বর্গ লাভ করবে বলে মনে করে। এতকাল কমিউনিস্টরা এই কাফেরদের প্রথম সারিতে অবস্থান করত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১ নম্বর কাফের শক্তি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে এতকাল তার দ্বারা লালিত মৌলবাদীদের ১ নম্বর কাফের শক্তিতে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের প্রধান শত্রু ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রূপে মার্কিনের ভূমিকা তাকে আরও বেশী করে মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিনের আফগানিস্তান ও ইরাক দখল। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন রাজনৈতিক ইসলাম এবং মৌলবাদের উগ্র ফল সম্পর্কে আতংকিত। তবে ইসলামের কিছু নমনীয় রূপ যে তাদের নিকট সমাদৃত তা গোপন নেই। এই কারণে বাংলাদেশে এতকাল ধরে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করে ধর্মাশ্রিত রাজনীতির চর্চা হলেও মার্কিন শাসকদের নিকট থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মডারেট বা মধ্যপন্থী মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে প্রশংসাপত্র জুটে।
পাশ্চাত্য নিজেদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও রাজনীতির উপর ধর্মের হস্তক্ষেপ এবং শাসন পছন্দ না করলেও প্রাচ্যে বিশেষত মুসলিম পৃথিবীতে এর বিপরীতটাই পছন্দ করে যদি সেটা তাদের স্বার্থে আঘাত না করে। প্রাচ্য বিশেষত মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলির উত্থান রোধের জন্য এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মকে লালনের প্রয়োজন তারা অনুভব করে।
রাজনীতিতে ধর্মের সমস্যাকে দেখতে গিয়ে আমি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টাকে এভাবে দেখি। সেকিউলারিজমের প্রতি অঙ্গীকার বা ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করে ব্যক্তির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত করার অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শাসক গোষ্ঠী এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয় দেয় নি; এমন কি সেটা ১৯৭২-এর সংবিধানে সেকিউলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূল নীতি হিসাবে ঘোষণার পরেও। বিশেষত ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর দেশ যাত্রা করেছে উল্টা পথে। আর এভাবে দেশে রাজনীতিতে ধর্মের দাপট বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে উগ্র ইসলাম তথা মৌলবাদের প্রভাব।
বাংলাদেশে মৌলবাদ ক্ষমতা দখল করতে পারবে কিনা আর পারলেও তার রূপ এবং পরিণতি কি হতে পারে সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তবে আমার কাছে যে প্রশ্নটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে যেভাবে ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতির উপর ধর্ম যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং করছে তাতে প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে জাতি ও রাষ্ট্র হিসাবে আমরা কোন দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব কিনা। জাতি বা রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বসভায় আমরা নিশ্চয় মর্যাদার অবস্থানে নেই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতাও অধীনতামূলক।
অবশ্য কেউ কেউ ধর্মের ভিতর প্রগতিশীলতার উপাদান দেখতে পান। এটাকে তাঁরা পাশ্চাত্যের এবং মার্কিনের আধিপত্য বিরোধী সংগ্রামের হাতিয়ার করতে চান উগ্রতা ও সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় না দিয়েই। মানলাম তাঁরা সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিবেন না। কিন্তু তাঁরা পাশ্চাত্যকে মোকাবিলা করবেন কি করে? ধর্মকে আশ্রয় করে, নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মুক্ত চিন্তা ও যুক্তি চর্চা ক’রে? আমাদের চেতনা যদি উন্নত হবার পরিবর্তে হয় অনুন্নত, পশ্চাৎপদ, অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ তবে কি আমরা কোনদিন পাশ্চাত্যের তৈরী করে দেওয়া গণ্ডী ভেঙ্গে আমাদের নিজস্ব উন্নয়নের পথ ধরে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতে পারব? আসলে ধর্মের আশ্রয় নিয়ে যাঁরা পাশ্চাত্যকে মোকাবিলা করার কথা বলেন তাঁরা প্রকারান্তরে উট বা ঘোড়ার পিঠে চেপে ঢাল-তলোয়ার দিয়ে মিসাইল বা ট্যাংককে মোকাবিলা করার বুদ্ধি দেন।
নভেম্বর ২২, ২০১৭; ৪:১৯ অপরাহ্ন
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আলোচনা। লেখকের সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলতে পারি, এই আলোচনার সাথে কে একমত হবেন বা ভিন্নমত পোষণ করবেন সেটা তত বড়ো বিষয় নয়, যতটা বড়ো বিষয় এই আলোচনাতে ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণটই উঠে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশের বিষয়ে এটা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলতে চাই, যতদিন বাঙালি ধর্মের মোহে নিজেকে হতবুদ্ধি করে অজ্ঞান করে রাখবে, ততদিন বাংলাদেশ কখনোই বিশ্বসভায় সামনের সারিতে পৌঁছাতে পারবে না। দেশে কটি হাইরাইজ আছে, কটি উড়ালপুল আছে, কত মানুষ ইনটারনেট ব্যবহার করছে প্রধান নগরীর জমির দাম কতটা আকাশ ছোঁয়া, এইসব তথ্যের উপর দিয়ে কোন দেশর উন্নতি নির্ভর করে না। এই উন্নতি কি করে সম্ভব হয়, সেটিই মূল আলোচনায় লেখক অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও তথ্যনিষ্ঠ ভাবে দেখিয়েছেন। সেই সাথে আরও একটি বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ, মার্কীন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে কিভাবে বিশ্বরাজনীতিকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেই স্বার্থের প্রয়োজনেই যখন যে দেশটিকে যেরকম ভাবে নিয়ন্ত্রনের দরকার পড়ে তার, তখনই সেই দেশের উপর সে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এই সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে বহু বছর ধরেই সে আগাম প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির সাথে যোগ থাকলেই এই মহাসত্যটকু উপলব্ধি করতে পারবো আমরা। এইকথা বলার কারণ একটিই, আজকে বাংলাদেশে যে মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে ধীরে ধীরে, তার পেছনে পেন্টাগণের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে আফগানিস্তানে পরিণত করে তুলতে পারলেই একদিন গণতন্ত্র রক্ষার অজুহাতে মৌলবাদ ধ্বংসের অজুহাতে বাংলাদেশে ইউএস মেরিন নামিয়ে দেওয়া সহজ হবে। আর তাহলেই চীনের নাকের ডগায় মিসাইল বসিয়ে চীনকে বাগে রাখার কাজটিই সম্পূর্ণ হবে। এখন মার্কীণ যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই আজকের বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের আমদানি করা হয়েছে। এই কারণেই ব্লগার নিধন, হেফাজতি সমস্যা ইত্যাদি। এইগুলিই হলো সেই বেসিক প্রস্তুতি। কিন্তু এই দেশটি এই প্রস্তুতি নিতে পারছে যে, তার একটাই কারণ, বাঙালির সমাজ বাস্তবতায় ধর্মের সাথে রাজনীতির ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ওতপ্রতো ভাবে জড়িয়ে থাকা। আমাদের রাষ্ট্রতন্ত্র রাজনীতি থেকে ধর্মকে যদি পৃথক করা যেত, তাহলে মার্কীণ প্রভুরা এত সহজে আমাদের ভুখণ্ডে তাদের নীলনকশার আমদানী করতেই পারতো না। শামসুজ্জোহা মানিকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটির মূল প্রাসঙ্গিকতাই এইখানে। জাতি বুঝতে পারলে ভালো। নয়তো কপাল পুড়তে দেরি নাই বাংলাদেশের।