বাংলায় এবং ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রথাগত ধর্ম আর ‘জাত-পাতের’ সীমানা পেরিয়ে মানুষকে মিলন মেলায় নিবার প্রয়াস যুগ যুগ ধরে হয়েছে। অতীত কাল থেকে, এক দিকে, হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতি প্রথা তথা ‘জাত-পাত’ থেকে হিন্দু সমাজকে মুক্ত করে একটা বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, অপর দিকে, হিন্দু ও মুসলমানকে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কাঠামো থেকে মুক্ত করে আরও বৃহত্তর সমাজ নির্মাণের প্রয়াস অনেকে করেছেন। যারা এই প্রয়াস করেছেন তারা সাধারণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা সমাজের এক গোপন কোণে আশ্রয় নিয়েছেন। মূল ধারায় তারা জায়গা করতে পারেন নাই। অবশ্য পাঞ্জাবে নানক আলাদা ও শক্তিশালী ধর্ম সম্প্রদায় গঠন করতে পেরেছেন। বাংলায় ‘জাত-পাতের’ বিরুদ্ধে চৈতন্যের হিন্দু ধর্মসংস্কার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ। বরং তার অনুসারীরা প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণব নামে একটি নূতন জাতে পরিণত হয়েছিল এবং জাতপাত ভিত্তিক বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তবে বৈষ্ণব নামের এই ‘জাত’ও হয়েছিল সমাজের অনেকটাই প্রান্তবর্তী এবং অনেক কাল ধরে এরা বাস্তবে বা সামাজিকভাবে বিলুপ্ত। এদের অবস্থা অনেকটা আধুনিক কালের ব্রাহ্মদের মত, যাদের লুপ্ত অস্তিত্ব সম্পর্কে বই-পত্র থেকে জানতে পারা যায়।
তবু বাংলায় প্রথাগত ধর্ম এবং বর্ণজাতিভেদের বলয় ভাঙ্গার চেষ্টাটা সুদীর্ঘ কাল ধরে বিশেষত সমাজের নীচ তলায় বহমান ছিল। কিন্তু সেগুলি সাধারণভাবে হয়ে থেকেছে সমাজের প্রান্তবর্তী এবং অনেকাংশে সমাজ বিচ্ছিন্ন। যশোর-কুষ্টিয়া-নবদ্বীপ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাউল আন্দোলনের গতিধারাকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে এই ধরনের সামাজিক আন্দোলনগুলির সমাজ বিচ্ছিন্নতা এবং পরিণতিতে এগুলির মধ্যে গোপন ক্রিয়া বা আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর নানান ধরনের বিকার বা বিকৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য লালন বা তার মত কিছু সংখ্যক বাউল অনেক ভিন্ন এবং পরিশীলিত। বিশেষ করে লালন সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক আন্দোলনকে সংস্কার ও পরিমার্জিত ক’রে এবং সে কাল ও সমাজের গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ক’রে একটা উন্নত ও মানবতাবাদী দার্শনিক ভিত্তি দিতে চেয়েছিলেন বলে ধারণা করি। সম্ভবত বাউলদের অনেকের এবং আরও বিশেষভাবে লালনের দর্শনকে প্রচলিত অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে মানুষবাদী বলাটা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে। লালনের বিশ্ব ঈশ্বর ও দেবতার পরিবর্তে নারী-পুরুষ সমন্বিত মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
যাইহোক, সমাজের মূলধারা বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং জাতপাত ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙ্গে বের হতে পারে নাই। শুধু বাংলা বলে কথা নয়, এটা সমগ্র উপমহাদেশ সম্পর্কেই সাধারণভাবে প্রযোজ্য। বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বলতে আমি প্রধান ধর্ম হিসাবে বিদ্যমান দুই ধর্ম হিন্দু ও ইসলামকে বুঝাচ্ছি। হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গে চলে আসে জাতপাতের বিষয়টা, যদিও হিন্দু সমাজে অতীতের মত জাতপাতের দোর্দণ্ড প্রতাপ আর নাই। তবে আজ অবধি তার শক্তিকে খাটো করে দেখার কারণ ঘটে নাই। এটা সবচেয়ে ভাল বুঝা যায় বিয়ের ক্ষেত্রে। অবশ্য যান্ত্রিক সভ্যতার এই গতিশীলতার যুগে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও বর্ণজাতির মানুষদের পক্ষে সর্বদা ও সর্বত্র ছোঁয়াছুঁয়ি আর একত্র আহারের বিষয়ে বিধিনিষেধ পালন সম্ভব নয় বলে সর্বত্র সেটা আর সেভাবে নাই। তবে তার জের কোথায়ও নাই এ কথা ভাবা বা বলা ঠিক হবে না।
ভারতবর্ষে অসংখ্য বর্ণজাতি বা জাতপাতের বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে উঠা হিন্দু ধর্ম হিসাবে পরিচিত ধর্মের শক্তির জায়গাটা বুঝতে না পারলে আমরা এ থেকে মুক্তির পথও খুঁজে পাব না। ভাল-মন্দ যা-ই বলি প্রতিটি ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের পিছনের সামাজিক বাস্তবতাকে বুঝতে না পারলে আমরা শুধু পথ হাতড়ে মরব। হিন্দু ধর্মের শক্তির উৎস বুঝতে হলে উপমহাদেশের অগণিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, উপজাতি ও ভাষার মানুষদের সকলের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিয়ে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ গঠনের উপযোগী একটা দর্শন ও ব্যবস্থা হিসাবে হিন্দু ধর্মকে চিনতে পারতে হবে। প্রায় সব জায়গায় বৃহত্তর সমাজ গঠনে বলপ্রয়োগ বা যুদ্ধ যে ভূমিকা পালন করেছে ভূ-প্রকৃতি ও সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ইত্যাদি কারণে ভারতবর্ষে সেটা সম্ভব হয় নাই। এখানে তার পরিবর্তে সুদীর্ঘ কাল ধরে প্রধানত ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছে। এই ধর্ম আজ আমাদের নিকট পরিচিত হিন্দু ধর্ম হিসাবে। অসংখ্য জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, প্রথা, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসসহ স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে একটি বৃহত্তর সমাজ গড়ে তুললেও যা এই ধর্ম ও তার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজকে এক ধরণের ঐক্য দিয়েছে তা হল আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বেদ কেন্দ্রিক ধর্মচর্চার অধিকারী হিসাবে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতির রক্তগত বা কুলগত পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। তবে বহুসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করতে গিয়ে হিন্দু সমাজ ও ধর্ম হয়েছে আশ্চর্য রকম স্ববিরোধ ও অসঙ্গতিতে পূর্ণ। এটা ঠিক যে ব্রাহ্মণ নেতৃত্বাধীন সমাজ বহু স্ববিরোধ ও অসঙ্গতিকে ধীর গতিতে অতিক্রমের চেষ্টা করেছে। এভাবে সমাজে এক ধরনের সঙ্গতি ও মতৈক্যও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি রক্ষা পেয়েছে। কারণ বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সমাজ কাঠামো স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি লালনের জন্য উর্বর ভূমি হিসাবে কাজ করেছে।
অসংখ্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পরমত সহিষ্ণুতা ও জীবনাচরণের ভিন্নতার প্রতি অনুমোদন ইত্যাদির গুরুত্ব আছে বৈকি। তবে নিরঙ্কুশ কোনও ব্যবস্থাই ভাল নয়। কারণ একটা কালে তার উপযোগ থাকলেও কাল পরিক্রমায় তা উপযোগ হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল এবং ক্ষতিকর হয়ে পড়তে পারে। বিশেষত পার্থক্য বা বিভেদ ও ভিন্নতার উপর জোর দিতে গিয়ে সেটাকে যখন অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন করতে চাওয়া হয় তখন তার লাভের দিকের চাইতে ক্ষতির দিকটা প্রবলতর হয়ে উঠে। এবং আরও ক্ষতি হয় তখন যখন জন্মগতভাবে নির্দিষ্ট পেশা বা কর্মের সঙ্গে পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণাকে সংযুক্ত করে অপরিবতর্নীয় ‘জাত’ তথা বর্ণজাতি সৃষ্টি করা হয় এবং এভাবে চরম বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক সম্পর্কভিত্তিক অসংখ্য গোষ্ঠীতে স্থায়ীভাবে বিভক্ত এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই রকম ধর্মের প্রভাবে উচ্চবর্ণের প্রতাপের সামনে যেমন নিম্নবর্ণ ম্রিয়মান ও হীনমন্য থাকে তেমন অসংখ্য বিভক্তির কারণে সমাজ হয়ে থাকে স্থবিরপ্রায় বা অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন। বিচ্ছিন্নভাবে কখনও কোনও বর্ণজাতি বা ব্যক্তি কিছু গতিশীল বা সৃষ্টিশীল হলেও সামগ্রিক সমাজের বাধার কারণে অথবা সমর্থন বা অংশগ্রহণের অভাবে তাদের কর্ম তেমন কার্যকর কোনও রূপ নিতে পারে না। মানুষ জাগতিক কর্মের তুলনায় পরলোকমুখী হয়ে পড়ে। সমাজ তার অন্তর্গত ক্ষুদ্রতার কারণে বৃহৎ সৃষ্টি দূরে থাক বৃহৎ চিন্তাই করতে পারে না। অসংখ্য ভাগে বিভক্ত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং রাখার ক্ষেত্রে অলোকবাদী ধর্ম ও অলৌকিক সত্তা ও শক্তিসমূহতে বিশ্বাস সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই রকম সমাজে ভাগ্যবাদ যেমন জাঁকিয়ে বসে তেমন প্রকট হয়ে দেখা দেয় গুরুপূজা, গ্রহশান্তি, ভাগ্যগণনা এবং ভূত-প্রেত, দেবতা-অপদেবতাদেরকে তুষ্ট করার জন্য সামাজিক হিড়িক। প্রতিটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী যেমন বৃহত্তর সমাজের ভিতরে থেকেও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বা নিঃসঙ্গতায় ভুগবার কারণে দুর্বল ও অসহায় বোধ করে তেমন এইসব ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীতে আবদ্ধ মানুষরাও অসহায় বোধ করে। ফলে মানুষ সমাজ-শক্তির ও তার নিজের দুর্বলতাকে পূরণ করতে চেয়ে নানান অতিপ্রাকৃতিক ও অলৌকিক শক্তির আশ্রয় খুঁজে। যেহেতু অন্ধ বিশ্বাস ও অন্ধ ভক্তিবাদের বাজার রমরমা থাকে সেহেতু এই বাজারের চাহিদা পূরণে দলে দলে হাজির হয় তথাকথিত অলৌকিক বা অতিমানবিক ক্ষমতা সম্পন্ন সাধক-গুরু-বাবা ইত্যাদি।
ভারতীয় জনসমাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে বৌদ্ধ ধর্ম জন্ম নিয়ে এক সময় প্রসার লাভ করলেও এখানে তা সমাজের নীচের দিকে বিশেষ করে গ্রামসমাজে ততটা জনপ্রিয় হতে না পারায় এখান থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ কিছু মৌলিক বিষয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ এই উভয় ধর্মে যথেষ্ট মিল আছে। যেমন উভয় ধর্মই আত্মার পুনর্জন্মে ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী। এছাড়া জীবহত্যা হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী নিষিদ্ধ না হলেও হিন্দু সমাজের একটা ব্যাপক অংশ জীবহত্যাকে ঘৃণা করে এবং নিরামিষভোজী। আসলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে প্রায় অপরিবর্তিতভাবে ধারণ করতে গিয়ে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। ফলে কালীর মত দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি যেমন আছে তেমন আছে তার বিরোধিতাও। তবে সকল বিভক্তি ও স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও বেদ ও ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার ধারণার ভিত্তিতে এবং সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণকে কেন্দ্রে রেখে তত্ত্বগতভাবে চতুর্বর্ণে সমাজের বিভাজন ঘটিয়ে হিন্দু সমাজের উদ্ভব, প্রসার ও স্থিতি।
আসলে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলতে চাওয়া উপজাতি বা সমাজ কিংবা জাতিগুলি অসংখ্য বিভক্তি ও বিরোধকে মেনে নিয়ে মোটামুটি সহাবস্থানের ভিত্তিতে যে সমাজ গড়ে তুলেছে সেটাই হিন্দু সমাজ হিসাবে পরিচিত একটা সমাজকে গড়ে তুলেছে। ঐক্যের চেয়ে বিভক্তি, মিলনের চেয়ে স্বাতন্ত্র্যের উপর জোর দিয়ে মানুষ যেখানে সহাবস্থানের ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চায় সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্ম মানুষের সঙ্গে মানুষের দৃঢ় ঐক্য, সম্প্রীতি ও সামাজিক মর্যাদার সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চায় সেগুলি জায়গা পাবে কেন? যতই উন্নত হোক, কল্যাণবাদী হোক যে জিনিসের সামাজিক চাহিদা থাকে না তা টিকবে কেন? সুতরাং বর্তমান পৃথিবীর এক বৃহৎ ধর্ম হলেও বৌদ্ধ ধর্ম তার জন্মভূমি ভারতবর্ষ থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে। তার অস্তিত্ব এখানে নগণ্য।
এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে মুসলিম শাসন পূর্ববর্তী ভারতবর্ষের বৃহৎ নির্মাণ যা কিছু আজ অবধি টিকে আছে সেগুলির অধিকাংশ হিন্দু দেব-দেবীদের মন্দির। সম্রাট অশোক নির্মিত স্তম্ভগুলি কিংবা আরও পরবর্তী কালের লৌহ স্তম্ভের (একজন গুপ্ত রাজা কর্তৃক আনুমানিক ৪০২ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত) কথা বাদ দিলে উল্লেখ করার মত নির্মাণ আর কয়টা আছে? এটা ঠিক যে বৌদ্ধদের কিছু বৃহৎ নির্মাণ ছিল। বিশেষত তাদের মঠ এবং বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলির অনেক কয়টিই মুসলমান আক্রমণকারীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, যেমন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য মুসলিম পূর্বযুগে অনেক উন্নত নগর ছিল যেগুলির প্রায় সবই আক্রমণকারী মুসলমানদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মুসলমানদের হাতে অল্পকাল পূর্বে ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের সমৃদ্ধ নগর বিজয়নগরের ভয়ঙ্কর ধ্বংসের ঘটনা আমরা জানি। কিন্তু এও সত্য যে আধুনিক যুগে যেমন তালেবান, আইএস ইত্যাদি মুসলমান জঙ্গীরা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ধ্বংস করেছে তেমন মুসলমান রাজা-বাদশাহদের অনেকে মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও এখনও অনেক মন্দির টিকে আছে। আর কিছু না থাকলেও কিছু কিছু এলাকায় প্রাচীন অনেক মন্দির আছে।
সাধারণভাবে বস্তুগত সভ্যতার আর সব নিদর্শন নির্মাণ ও রক্ষার প্রতি গুরুত্বের তুলনায় মন্দির ও বিগ্রহ বা প্রতিমা নির্মাণ ও রক্ষায় ভারতীয় হিন্দু সমাজ ও সভ্যতার মনোযোগ ও গুরুত্ব থেকে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা বেরিয়ে আসে। অগণন জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত ও অগণন ভাগে বিভক্ত এই সমাজে ধর্মবিশ্বাসই মানুষ ও সমাজকে যতটুকু সম্ভব ঐক্যবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করার পিছনে সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশেষ করে মন্দিরগুলি সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অঞ্চল ভেদে জনপ্রিয় বা পূজিত বিভিন্ন দেবতার স্থান হয়েছে একেকটি মন্দির। মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মূল নেতৃত্ব থেকেছে ব্রাহ্মণের হাতে। ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে বৃহত্তর সমাজ গঠনের মূল নিয়ন্ত্রণ পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে তারই হাতে। তার ছত্রছায়ায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ অনেক ধর্ম-বিশ্বাস, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানকে রক্ষা করে বর্ণজাতির কাঠামোতে জায়গা করে নিয়েছে। তাই এখানে অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ও অলোকবাদী ধর্মের এত গুরুত্ব। এভাবে সমাজের ভিতরের বস্তুগত দুর্বলতাকে মানুষ পূরণ করতে চায় ভাবগত শক্তি দিয়ে, বিদ্যমান জগতের বাইরে অবস্থিত কল্পনার জগতের শক্তিসমূহের কল্পনা দিয়ে। আর তাই আর সব কিছু বাদ দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আর বিগ্রহ নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠায় সমাজের সর্বাধিক শক্তি, মনোযোগ, মেধা ও সম্পদ নিয়োজিত হয়। এই একই কারণে এখানে রাষ্ট্র নির্মাণে এত অমনোযোগ এবং ধর্ম তথা ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত সমাজের তুলনায় বস্তুজীবন বা জাগতিকতা নির্ভর রাষ্ট্রের এত দুর্বলতা।
ভারতবর্ষের ভূপ্রকৃতি, ঐতিহ্য, কৃষি সমাজ ও সভ্যতার শক্তি এবং জনবিন্যাসের জটিলতার কারণে সহিংস, আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও এই ভূভাগে ইসলাম তেমন একটা সুবিধা করতে পারে নাই। মুসলমানরা ইউরোপ ছাড়া আর কোথায়ও এভাবে ব্যর্থ হয় নাই। অবশ্য তারা কখনই সমগ্র ইউরোপ জয় করতে পারে নাই। কিছু কালের জন্য ইউরোপের খুব সামান্য অংশই তারা অধিকার করে রাখতে পেরেছিল। এখন আরও সামান্য কিছু জায়গা তাদের অধিকারে আছে। অবশ্য ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ধরলে স্পেনে তাদের দখল মোটামুটি আটশত বৎসর ছিল। তারপর তারা সেখান থেকে উৎখাত হয়। গায়ের জোরে মুসলমানরা যেমন স্পেনে ঢুকেছিল তেমন গায়ের জোরেই তাদেরকে সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত বিতাড়ন করা হয়েছিল।
অথচ খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সময়টা এবং একাদশ শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মাহমুদের ১৭ বার ভারত লুণ্ঠন অভিযান এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মুসলিম হানাদারদের আক্রমণ অভিযানগুলিকে বাদ দিলেও ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীতে গোরী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ শত বৎসর ভারতবর্ষের অধিকাংশ তাদের অধিকারে ছিল। মুসলমানরা তাদের ধর্ম প্রসারের জন্য অন্য সব জায়গায় যা করেছিল এখানে তা করে নাই এ কথা বলা মানে কিছু না জেনে কথা বলা কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার করা। অধ্যাপক লালের হিসাব অনুযায়ী ১,০০০ থেকে ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ভারতবর্ষে ইসলামের আগ্রাসনে ছয় থেকে আট কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল (এমএ খান, জিহাদ : জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, প্রকাশ- ২০১২, ব-দ্বীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা- ২৭০)। অর্থাৎ ৮ম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে আরব মুসলিম বাহিনী বৃহত্তর সিন্ধু অঞ্চলে যে ধ্বংস ও হত্যা যজ্ঞ পরিচালনা করে এবং ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের পরেও মুসলিম হানাদাররা যে সকল হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে এই হিসাবের ভিতরে সেগুলিকে ধরা হয় নাই। এর পরেও উপমহাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়ে গেছে। এ থেকে বুঝা যায় গায়ের জোরে আর সবখানে যা-ই পারা যায় যাক ভারতবর্ষে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।
অথচ এটাও সহজবোধ্য যে অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে বের হতে না পারলে ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের জাতি ও রাষ্ট্রগুলির পক্ষে আধুনিক সভ্যতার চাহিদা পূরণ করে উন্নত, শক্তিশালী ও মানবিক হয়ে উঠা সম্ভব নয়। আজ ভারত-রাষ্ট্র মানবিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যতটুকু উন্নতি ঘটাতে পেরেছে সেটুকু সম্ভব হয়েছে তার প্রথাগত ধর্মের প্রভাব থেকে তা যতটুকু নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে তার জন্য। কিন্তু ভারত-রাষ্ট্র আজও অজস্র সঙ্কট, অমানবিকতা ও স্ববিরোধে জর্জরিত হয়ে আছে। তার মূলেও রয়েছে তার ধর্ম বিশেষত হিন্দু ধর্ম। এটা ঠিক যে আইন করে সেখানে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র জাত-পাতের তথা বর্ণজাতির নিয়ম মেনে চলে না কিংবা চলে না দৈব বিধান, জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনা আর ধর্মগুরুদের নির্দেশ মেনে। কিন্তু ধর্ম তো শুধু আইনের বিষয় নয়। তাই ধর্মের প্রভাব রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নানানভাবে প্রভাবিত এবং এমনকি নিয়ন্ত্রণও করে। আর বিশেষত জাত-পাতের বিষয়টা হিন্দু ধর্মের এমন এক অন্তর্গত বিষয় যা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা বিভিন্ন সমাজ বা জন-গোষ্ঠীর বিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যের পথ ধরে তার অঙ্গীভূত হয়েছে। একে কি শুধু আইন করে উপড়ে ফেলা যায়? এর জন্য যে বিরাট সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন সেটা কি ভারত-রাষ্ট্রে আজ অবধি হয়েছে? হয় নাই। কিন্তু কেন হয় নাই?
আসলে সমস্যাটাকে সমস্যা মনে করা হয় নাই। বাংলায় এবং উপমহাদেশে আধুনিক কালে যারা সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব করতে চেয়েছেন তারা অর্থনীতির মধ্যে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার উৎস এবং সেহেতু সমাধানও খুঁজে বেড়িয়েছেন। সুতরাং ধর্ম তাদের জন্য বিচার্য বিষয় হবে কেন? ধর্ম? সেটা তো অর্থনীতি এবং ফলে উৎপাদন পদ্ধতি, উৎপাদন সম্পর্ক ও বিনিময় প্রক্রিয়ার ফল! সুতরাং এ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে কেন? কত সহজ পাটিগণিতের সূত্রে ফেলে তারা প্রায় শতাব্দীর ব্যর্থতার মহাকাব্য রচনা করলেন! কিন্তু তাদের চৈতন্য কোনও কালেই হল না। ওটা অবশ্য তাদের হবারও নয়। হাঁ, আমি মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টদেরকে বুঝাচ্ছি। অবশ্য প্রশ্ন করা যৌক্তিক হবে যে, অন্যরাই বা কী করছেন! বিপ্লবী হোক আর অবিপ্লবী হোক সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনায় যখন সত্য অনুসন্ধানের পরিবর্তে জনতুষ্টি অথবা কোনও না কোনও প্রতিষ্ঠিত ধারার মধ্যে জায়গা সন্ধান করা হয় তখন যত অশুভ হোক স্থিতাবস্থার অবসান আশা করা যায় না।
জাত-পাতের ধর্মকে রেখে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সাধারণ মানুষদেরকে পরস্পরের সঙ্গে মিলাবার চেষ্টাটা যেমন পণ্ডশ্রম মাত্র তেমন তাদেরকে প্রকৃত স্বাধীন, গতিশীল, মানবিক ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষে পরিণত করাও অসম্ভব ব্যাপার হয়ে থাকবে। বিশেষত সমাজের নীচ তলার জন্য এটাই সাধারণ সত্য। আর শেষ পর্যন্ত সমাজের সৌধ তো গড়ে উঠে এই নীচ তলার সংখ্যাগরিষ্ঠ আমজনতার উপর। তাদের রুচি, চিন্তাধারা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা এগুলিই শেষ পর্যন্ত সমাজের জন্যও নির্ধারক হয়ে উঠে। যারা যত দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে এগুলিকে ব্যবহার করতে বা কাজে লাগাতে পারে সমাজের মূল নিয়ন্ত্রণ যে শেষ পর্যন্ত তাদের হাতেই চলে বা রয়ে যায় সেটা বুঝতে কি বেশী বুদ্ধি লাগে? এরপরেও কারও বুঝতে অসুবিধা হলে কষ্ট করে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর কালজয়ী উপন্যাস ‘লালশালু’ পড়তে পারেন। যে সমাজের মানুষদের কাছে পীরের মাজারের এত চাহিদা সেই সমাজে মাজার উদ্ভাবনের জন্য ‘লালশালু’র মজিদদের অভাব হবে কেন? ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলিতে ব্রিটিশ শাসকরা যাবার সময় তাদের অনুগত যে মজিদদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে গিয়েছিল তারা আজ অবধি যে এখানকার রাষ্ট্রগুলির হাল ধরে আছে এটা বুঝবার জন্য বেশী পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। তবে হাঁ, আধুনিক কালের রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে এদের আধুনিক শিক্ষা ও কলা-কৌশল লাল শালুর মজিদের চেয়ে বেশী রপ্ত করতে হয়। তা হোক, নীতি-নৈতিকতা বোধ ও ধূর্তামিতে এরা লাল শালুর মজিদেরই স্বগোত্রীয়।
যাইহোক, হিন্দু ধর্মকে রেখে যেখানে এক ‘জাতের’ হিন্দুকে আরেক ‘জাতের’ হিন্দুর সঙ্গেই মিলানো যায় না সেখানে মুসলমানের সঙ্গে তাকে মিলানো যাবে কী করে? যুগ যুগ ধরে এই উপমহাদেশে সে চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলে সে চেষ্টা সফল হয় নাই। আবার মুসলমানকেও ভিন্ন কারও সঙ্গে মিলানো যায় না। হিন্দুর সমস্যা এক ধরনের, মুসলমানের সমস্যা আর এক ধরনের। তবে ফল উভয়েরই প্রায় এক রকম। হিন্দু নিদারুণভাবে আত্মবদ্ধ। নিজের সংকীর্ণ গণ্ডী রক্ষাতেই সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অজস্র ক্ষুদ্র গণ্ডীবদ্ধ থাকায় তার শক্তিও ক্ষীণ। সুতরাং সে আক্রমণাত্মক হবে কী করে? সে ঘৃণা দিয়ে, বাধা দিয়ে অন্যকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। সেটা এক দিক থেকে ভাল। সে সাধারণত সেভাবে আগ্রাসী এবং হিংস্র নয়। তবে এটা ঠিক যে তার এই চরিত্র আগ্রাসী এবং হিংস্রদের জন্য সুখকর জায়গা তৈরী করে দেয়। একপাশে নির্বীর্যতা না থাকলে অপর পাশে বর্বরতার উত্থান হবে কী করে?
মুসলমান হিন্দুর বিপরীত। সেও অন্যকে ঘৃণা করে। তার ধর্ম সেটাই শিখিয়েছে। যে তার বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত নয় সে তার ঘৃণার বস্তু। শুধু তাই নয়, তার উপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ বা আগ্রাসন চালানো তার ধর্ম অনুযায়ী সিদ্ধ এবং পুণ্য কর্ম এবং এমনকি ধর্মীয় বিধানে বাধ্যতামূলক। কারণ ইসলামকে সমগ্র বিশ্বে জয়যুক্ত এবং আর সব ধর্ম বা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত করাই কুরআন তথা ইসলামের ঘোষিত লক্ষ্য। সুতরাং যুদ্ধ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ তার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। শুধু যে কুরআন ও হাদীস এগুলিকে অনুমোদন দিয়েছে তাই নয়, অধিকন্তু সমগ্র পৃথিবীর ইসলাম বিস্তার ও চর্চার ইতিহাসের সঙ্গে এগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি কতকগুলি আচার ও অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে যেমন ইসলাম ধর্ম হিসাবে বিবেচ্য হতে পারে না তেমন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও দাসকরণের প্রতি অনুমোদন বাদ দিয়েও ইসলাম ধর্ম হিসাবে বিবেচ্য হতে পারে না। এর বাইরে ইসলাম আছে একথা যারা বলে তারা হয় ইসলাম সম্পর্কে কিছুই না জেনে কথা বলে, নয় তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে এ কথা বলে, যেটা পরিষ্কার মিথ্যাচার হলেও ‘তাকিয়া’ বা কৌশল হিসাবে ইসলাম সম্মত। ইসলামের নবী স্বয়ং যে এই ‘তাকিয়া’র আশ্রয় নিতেন সেটা আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি।
বিশ্বাসী মুসলমানকে ভিন্ন ধর্মের বা বিশ্বাসের কারও সঙ্গে মিলাবার চেষ্টাটা পণ্ডশ্রম মাত্র। এ ধর্ম এতটাই পরমত অসহিষ্ণু। এমনকি নিজের মধ্যেও এতটুকু ভিন্নমতের জায়গা সে রাখে না। একটু ভিন্নতা দেখা দিলেই বিধর্মী বা কাফের বলে মুসলমানরা একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং খুনাখুনি শুরু করে। পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নী বিরোধের দিকে দৃষ্টি দিলে এ কথার সত্যতা বুঝা যায়। বিশেষত মতের ভিন্নতার কারণে বিগত কয়েক শত বৎসর লক্ষ লক্ষ শিয়া মুসলমান সুন্নী মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। শিয়া হত্যার এই ধারা আজও বহমান। স্বাভাবিকভাবে এর প্রতিক্রিয়ায় সুন্নী হত্যাও হচ্ছে। আহমদী বা কাদিয়ানীদের উপর অন্য মুসলমানদের নির্যাতন ও আক্রমণ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। এই হচ্ছে ইসলাম! বস্তুত ইসলামের ভিত্তি রচনায় নারী এবং বিধর্মী বা ভিন্ন মতের অনুসারীদের প্রতি সহিংস ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভূমিকা অপরিমেয়।
এমন এক বাস্তবতায়, এক দিকে, হিন্দু হিসাবে পরিচিত ধর্মকে রক্ষা করে কী করে বৃহত্তর ও সংহত সমাজ গঠন করা যাবে, অন্য দিকে, ইসলাম ও হিন্দু এই দুই ধর্মকে রেখে উন্নত ও মানবিক সমাজ দূরের কথা মুসলমান ও হিন্দু এই উভয় সম্প্রদায় বা সমাজের মিলনে বৃহত্তর ও সংহত সমাজ গঠন করা যাবে কী করে? এটা সম্ভব নয় বলে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠা দূরে থাক নিজ সমাজের মানুষদেরকেই একটা সংহত সমাজের অধিকারী করা সম্ভব হয় নাই। অন্যদিকে মুসলমানদের সমস্যা সম্পর্কেও বলেছি। যদিও খুব সামান্যই এখানে বলেছি। কারণ সেই আলোচনার জায়গা এটা নয়। অন্যত্র আমার বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থে সেই আলোচনা করেছি। যেমন গ্রন্থ হিসাবে উল্লেখ্য ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ এবং ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’।
বহু জাতি ও সমাজ নিয়ে গঠিত ভারত অর্থাৎ ভারত-রাষ্ট্রের সমস্যা নিয়ে এই মুহূর্তে আমার ভাবনা গৌণ। আমার মুখ্য ভাবনা এই মুহূর্তে বাঙ্গালী জাতি এবং আরও বিশেষ করে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রকে নিয়ে। এখানে ধর্ম বিশেষত এখানকার দুই প্রধান ধর্ম ইসলাম ও হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে কী করে বৃহত্তর সামাজিক ও জাতীয় ঐক্য এবং একটি সুসংহত, মানবিক, গণতান্ত্রিক, উন্নত ও শক্তিশালী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? অবশ্য ইসলাম বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্ম হওয়ায় ইসলামের সমস্যার সমাধান খুঁজাটাই আমার বিবেচনায় আমাদের নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হওয়া উচিত। বিশেষত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি যে ধরনের আচরণ এতকাল যাবত মুসলমানদের দিক থেকে করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে তাতে মুসলমানদের এই ধরনের আচরণের উৎস অনুসন্ধানের জন্য তাদের ধর্মবিশ্বাস তথা ইসলামের স্বরূপ অনুসন্ধান আরও জরুরী বলে মনে করি। এ দেশে স্বাধীনতার এত কাল পরেও হিন্দু নির্যাতন ও বিতাড়ন যে মাত্রা নিয়েছে তাতে বাঙ্গালী জাতি গঠন দূরের কথা বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বই এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ধর্ম সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ধর্মবিশ্বাসমুক্তদের হত্যার কর্মকাণ্ড। এভাবে পরিস্থিতির জটিলতা নবতর মাত্রা নিয়েছে।
শুরুতে যে কথা বলেছি প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রথাগত ধর্মের কাঠামো ভেঙ্গে বের হবার প্রয়াস বাংলায় এবং এই উপমহাদেশে যুগে যুগে হলেও সাধারণভাবে সেগুলি সফল হতে পারে নাই। ইসলাম আসার আগের কথা আলোচনায় নাই বা আনলাম। ইসলাম আসার পর একদিকে হিন্দু ধর্মের সংস্কার করে জাত-পাতের অবসান ঘটানো, অপর দিকে হিন্দু ও মুসলমানে মিলনের বহু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এটা বাস্তবসম্মত নয় বলে সাফল্য আসে নাই। প্রথমত, হিন্দু ধর্মকে মেনে নিয়ে জাত-পাতের অবসান ঘটাবার স্বপ্ন যেমন আকাশ-কুসুম কল্পনা তেমন হিন্দু ও ইসলাম ধর্মকে রেখে হিন্দু ও মুসলমানের মিলন ঘটানোর স্বপ্নও অবাস্তব স্বপ্ন। সুতরাং এই দুই ধর্ম থেকে বাংলা এবং উপমহাদেশের মানুষকে মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে হবে। এ ধরনের কোনও চেষ্টা অতীতে কম-বেশী হলেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পশ্চাৎপদতা এবং সেই সঙ্গে সমাজেরও পশ্চাৎপদতা এবং বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ (অব্যাহত মুসলিম আগ্রাসন এবং সবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ-আগ্রাসন ও দুইশত বৎসরের আধিপত্য) ইত্যাদি নানাবিধ কারণে সেগুলি সফল হয় নাই। তবে পৃথিবী আজ অনেক এগিয়েছে। এইসব অলোকবাদী, অন্ধ, পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল এবং অমানবিক ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে এগুলিকে উৎখাত করে আধুনিক যুগোপযোগী বিকল্প সামাজিক আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা আজ সম্ভব। এভাবে মানুষের বৃহত্তর মিলনও সম্ভব।
তবে অন্ধ বিশ্বাসনির্ভর এই সব ধর্ম থেকে মানুষের মুক্তির লড়াইকে যদি আমরা রাজনীতি বিযুক্ত লড়াই হিসাবে দেখি তবে সেটা হবে নিষ্ফল ও ব্যর্থ। এই লড়াই শুধু বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ শাসন-শোষণ ব্যবস্থা উচ্ছেদের লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, অধিকন্তু এই শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে সেই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গেও সংযুক্ত। প্রথাগত ও অলোকবাদী ধর্মের বেড়ীতে আবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে শক্তিরহিত হওয়ায় বাংলা এবং উপমহাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীনতা থেকে বের হতে পারছে না। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী এখানে তাদের যে উপনিবেশিক ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিল আজ অবধি আমরা সেই অধীনতা মূলক এবং নিকৃষ্ট শাসন ও শোষণের ব্যবস্থা থেকে মুক্তি অর্জন করতে পারি নাই। আন্তর্জাতিকভাবে এই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব এক সময় ব্রিটেনের হাতে থাকলেও ১৯৪৭-এর পর তার নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব হস্তান্তরিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট। এভাবে এখানে ধর্ম ও সাম্রাজ্যবাদ পরস্পর বিজড়িত এবং একে অন্যের পরিপোষক। সুতরাং বিদ্যমান ধর্ম এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার পারস্পরিক বিজড়নের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই আমাদেরকে বিদ্যমান ধর্মের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াইকে দেখতে হবে।