১৪৩২ বার পঠিত
যেকোনো শিক্ষা নিজেই গ্রহণ করিতে হয়। এ কাজে কেহ সমাজ-প্রতিষ্ঠানের অধীনতায় থাকে, কেহ থাকে না। যে থাকে না তাহাকে আমরা বলি নিজে নিজে শিখিয়াছে বা Self thought। নিজে নিজে শেখার অসুবিধা হলো এই যে, সমাজে সে শিক্ষা গ্রহণীয় হইবে কী না তাহার অনিশ্চয়তা ও সময়ের দীর্ঘযাত্রা। একলব্যের পূর্বে এবং পরবর্তী কয়েকহাজার বছরে নিজে নিজে শেখার উদাহরণ নাই। গত ৫০-৬০ বছরে ইউরোপ আমেরিকায় বেশকিছু Self thought জন্মলাভ করিয়াছেন, সে রেফারেন্সেই বিপুল উৎপাদক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরাও ইদানীং সকাল বিকাল Self thought জন্ম দিতে লাগিয়াছি।
খ.
লোকশিল্পীর স্বশিক্ষিত হইবার সুযোগ নাই। জীবনের কশাঘাতে তাহাকে সেই শিশুকালেই ওস্তাদের (সেটা পিতা-মাতা হইতে পারে, হইতে পারে অন্য কেহ) শিষ্যত্ব গ্রহণ তাহার নিয়তি। যদি গ্রাম্য লোককলায় তাহার অন্ন তবে প্রতিভা থাক বা না থাক, ইচ্ছা থাক বা না থাক পিতার পেশাই তাহার পেশা। নড়ার জো নাই। আর নারী গেরস্ত ঘরের বৌ, সে ঘর-লেপিতে, সূচি কাজে কিংবা রাধিতে পারঙ্গম না হইলে সংসার কীভাবে সুখের হইবে? মা-মাসীর স্কুল পাশ দিয়া সে ভর্তি হয় শাশুড়ির কলেজে। তারপর পুত্র কন্যার বিশ্ববিদ্যালয়। নাতী নাতনিরা সহপাঠি হইলে মুক্তি, নচেৎ পুত্রবধুর ঝাটা। নড়িবার জো নাই। ইউরোপিয় নগর সভ্যতার উপনিবেশে যে ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী নগরের পথে হাটিলো তাহার অন্ন যোগাইতে প্রতিভার প্রয়োজন পড়িলো। বাজারের ওস্তাদের জল টানিতে টানিতে প্রতিভার শিশুকাল কৈশোর ছুইলে তবে রঙের বাটি স্পর্শ করিবার অনুমতি মিলিলো। ওস্তাদের পছন্দ হইলে তবে জুটিবে তুলি ধরিবার পারমিশন। সেটা কবে হইবে, আদৌ হইবে কীনা জানা নাই। ইহাতো আর ইংরেজি স্কুল নহে যে বছরের সিলেবাস বছরে শেষ হইবে। কেহ শিখিলো কীনা তাহা দেখিবার জন্য পাশ নম্বর আছে। ওস্তাদ ও বাজার বিবেচনার দায় নাই। বাজার চাহিলো না, ওস্তাদ চাহিলো না-প্রতিভা মরিলো তুলির আঁচড় না টানিয়াই। ইহাই লোকশিল্প বা Folk Art।
তো লোকশিল্প আমাদের কী কাজে লাগে?
ঘর সাজাইতে ঘরের নারী শিল্পীর সঙ্গে বাজারের চিত্রীর মিশেলে ঘর হয় রুচি স্নিগ্ধ, লক্ষী মন্ত। আর আজ যখন ঘর ও বাহিরের মাঝামাঝি কলাগাছের আড়াল নাই, তখন? প্রথমে নজরদারী, তারপর গুণ বিচারী…
গ.
নতুন ঝকঝকে নকশাদার রিক্সায় উঠিতে মনচায়, ভাড়ায় দু’পয়সা বেশী দিতেও ভালো লাগে। রিক্সা পেইন্টার নগর ফোকের শিল্পী, কাস্টমার চায় তাই রাজ্জাক-ববিতার ছবি। কাস্টমার চায় তাই আল্লাহ-মুহাম্মদ।
নুতুন বউয়ের সংসার তাহার টিনের ট্রাঙ্কে। তাহাকে বানায়, তাহাকে সাজায় কে? সে যে আরবান ফোক। কাস্টমার চায় না, টিনের ট্রাঙ্ক তাই রঙ ধরে স্প্রেগানের, তুলি সব নির্বাসনে।
ফরাসী-জাপানী কাস্টমার চাহিতেছে, তাহা দেখিয়া কিছু কাস্টমার সস্তায় কিনিলেন আর্ট। বাংলার শিল্প। বাংলার নিজস্ব শিল্প। এ তার নতুন বিজ্ঞাপন। বাজার বাঁচিয়া রইলো।
ঘ.
তো Folk Art একটি ইউরোপিয় শব্দ, তাহার বাংলা করা হইয়াছিল লোকশিল্প, ইদানীং ইহাকে জনশিল্পও বলা হইতাছে। কারন ইংরেজী ডিকশনারী পড়িয়া জানা গ্যাছে Folk মানে জনগোষ্ঠি। আসা যাক ইতিহাসে, রেনেসার প্ররিপ্রেক্ষিত ও কাঠামো জ্ঞান ইউরোপকে সমৃদ্ধ করিলো, উন্নত করিলো, হইলো শিল্পবিপ্লব। হইলো উপনিবেশ স্থাপন। ইউরোপিয় শিল্পের বিপরীতে নেটিভ শিল্পের কী মর্যাদা হইবে? ইউরোপিয় শিল্পের পরিচিতিতে রেনেসার পরিপ্রেক্ষিত এক বিশাল আবিস্কার। তাই যাহাতে প্ররিপ্রেক্ষিত জ্ঞান নাই তাহাই লোকচিত্র- ইউরোপের বাহিরের জগতের সকল চিত্রকলাই তাই Folk Art। কিন্তু প্রতিচ্ছায়া ও তৎপরবর্তীরা আঁকতে চাইলো পরিপ্রেক্ষিত ও কাঠামো জ্ঞান অতিক্রান্ত কিছু, যা নিছক দৃষ্টি মনোহর নয়। জীবনের নতুনতর সত্যকে খুঁজিতে চায়। চলো তবে আফ্রিকায়, কী জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সে রচিয়াছিল পিরামিড? চলো এশিয়ায় ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যানের ধংসস্তুপের নীচে খুঁজি যিশুর ঠিকুজি। আছে ভারত ও চীন, আরো আছে হকুসাইয়ের জলচ্ছাসের জাপান। রেনেসাঁর ইউরোপের এ অজানাকে জানিবার আকাঙ্খা। কিন্তু উপনিবেশিক ইউরোপ? সে জানাইলো নেটিভ শিল্পই লোকশিল্প, যাহার পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান নাই। কিন্তু ইউরোপের শিল্প (Industry) নেটিভ শিল্পের বাঁচিয়া থাকিবার আশাকে তিরোহিত করিতে প্রথমে আঙ্গুল কাটিয়াছিল কারিগরের, আজ তাহার ডিজাইন ও প্রযুক্তি আরবান ফোককেও নিশ্চহ্ন করিলো বলিয়া। তবে কী আমরা এই সব ফোককে বাঁচাইবার জন্য লাগিয়া পড়িবো? না, তাহা জরুরী নয়, সম্ভবও নয়। বাজার চাহিদা ব্যতীত বাজারী শিল্প বাঁচে না। আর ইউরোপ তার জ্ঞান প্রশ্নেই তার জাদুঘরে এই সব উপাদানকে ঠাঁই দেবে। হ্যাভেল আসবেন কালীঘাটের পটকে ব্রিটিশ জাদুঘরে নিতে। হেনরী গ্লাসী আসবেন ধামরাই ডোকরা নিতে। ফরাসী-জাপানীরা আসবেন রিক্সাচিত্র নিতে। আমরা আহা উহু করবো আর আর ইউরোপ-আমেরিকার শিল্প (Art) ও শিল্প (Industry) অনুকরণে শিল্প রচিবো। কখোনই জানিতে চাহিবো না রুমালে, বালিশের অচ্ছাদনে কোন কালে কেন গাঁয়ের বধু লিখিয়া ছিলেন ‘যাও পাখী বলতারে, সে যেন ভূলে না মোরে’।
ঙ.
সকল শিল্পই তাঁর সমাজ ও সময়ের সাক্ষর। রুগ্ন শিল্প, সেটা Industry হোক আর Art হোক, তাকে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচানো যায় না। জ্ঞান হচ্ছে তাই- যা খুঁজে বার করে কী কারণে এ শিল্পের উৎভব কী কারণেই বা তার বিনাশযাত্রা। এটাকেই জ্ঞানযাত্রা বলে, কেহ কেহ বলেন সাধনা, সমকালীন ইংরেজিতে বলে Research। সক্রেটিস এ বাংলায় জন্ম নেননি, আমাদের নবীও নন তিনি। কিন্তু আজ আমরা চাই বা না চাই ইউরোপের ন্যায় তিনি আমাদেরও রাসুল। মোবাইল ফোন হাতে তাকে অস্বীকার করা মূর্খতা বৈ আর কিছু নয়। তো আসুন মুহম্মদ বর্ণিত এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার নবীর এক নবী সক্রেটিসের Know thy Self কে জানি। হ্যাভেল বা গ্লাসীর আপেক্ষায় না থেকে বুঝতে চেষ্টা করি জামদানীর সুতাটা কীভাবে আমাদের, কেন আমাদের? ইহার কলা বা কৌশলটিও জানা হইবে তাতে। আমাদের হ্যান্ডলুমগুলিই কম্পোজিট লুমে পরিণত করা সম্ভব হবে। চীনের তৈরি যন্ত্রদিয়ে আমাদের পোশাক বানাতে হবে না। এ পক্রিয়াকেই শিল্প (Industry) বলে।
চ.
যেখানে এ প্রক্রিয়া অনুপস্থিত, সেখানে লোকশিল্পই আমাদের শিল্প ও শিল্প, সেখানেই তাই উন্নয়নের প্রয়োজনে উন্নয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। রামপাল বা পদ্মাসেতু ব্যতীত উন্নয়ন তাই সেখানে ধরা দেয় না। ইউরোপ প্রদত্ত নোবেল জয়ী অর্থ পণ্ডিত আমাদের বলে যান- উন্নয়নই আসল, গণতন্ত্রের চেয়ে অধিক। তাহার কৈশোরের শান্তি নিকেতনে পটুয়া যামিনী রায়-এর ঠাই হয়নি। তা আমাদের জানা ও অজানা।
ছ.
লোকশিল্প একই সাথে Art & Industry। আধুনিক শিল্পের (Art) ন্যায় তার কোন স্বাধীন সত্তা নেই। বাজারকে উপেক্ষা করবার কোন সক্ষমতা ইউরোপীয় উপনিবেশ-এর আগমনের পূর্বেও ছিলনা আজো নেই। আজ তার বাজার ইউরোপিয় রুচীর বৈচিত্র সন্ধানী মনে। স্বভূমে বা স্বগোত্রে তার কদর ক্রমাগত কমিতেছে। খুব সাধারণভাবেই বলা যায় ইউরোপিয় প্রযুক্তি পণ্যের সস্তা দর ও চকমকানির বিপরীতে তাহার টিকিয়া থাকাটি অসম্ভব। তাহাকে বাচানো যাইবে না, ইহাই সত্য। কিন্তু তাহাকে চিরতরে হারানোর আগে তাহার কাছ থেকে তাহার গল্পটি শোনা যেতে পারে। একজন মনসুরউদ্দিন বা জয়নুলে ইহা হইবে না। বাংলা ভারতের Thomas Newcomen বা Edmund Cartwright বা Charles Fredrick Weisenthal বা Barthélemy Thimonnier কেও প্রয়োজন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জানুয়ারি ১৬, ২০১৮; ৮:০৮ পূর্বাহ্ন
তাইতো হচ্ছিল হচ্ছে
স্থান কাল পাত্রে
রাজনৈতিক এখনো পুজিপতির পূজারী
সাধকের উপাদানে টান লাগে
ভেসে গেলো জলঘোড়া
শ্রমিকগণ ভুল বিজ্ঞাপন বুঝতে পারলোনা ,
মস্তিষ্ক অসাড়
কারো ব্যক্তিগত বাইজী নন শিল্পসাধক।