আমরা ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার কথা বইয়ে পড়েছি। এটি শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, পুঁজিবাজারে ধসের মধ্য দিয়ে। দিনটা ছিল ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। এক দিনেই স্টক মার্কেটে শেয়ারের দাম হু হু করে কমে যায়। আতঙ্কিত হয়ে লোকেরা এক দিনেই ১ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ওই দিনটা ইতিহাসে ব্ল্যাক থারসডে নামে জায়গা করে নিয়েছে।
অর্থনীতিতে ক্ষয় ধরেছিল আগে থেকেই। কোম্পানির সম্পদের মূল্যমানের তুলনায় শেয়ারের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বাইরে থেকে এটা বোঝা যায়নি। যখন হুঁশ হয়, শেয়ারবাজারের ওপর মানুষের আস্থা টলে যায়। দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে লোকেরা অনেক দিনের জমানো শেয়ার ঝটপট বিক্রি করে দিতে থাকে। এত দিন প্রচার ছিল যে অর্থনীতি বেশ রমরমা। দেখা গেল এটা ছিল অনেকটাই ফাঁকা বুলি।
শুরুটা যুক্তরাষ্ট্রে হলেও পরে তা ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে অর্থনীতির এই মন্দাভাব চলে ১৯৩৩ সালের মার্চ পর্যন্ত—টানা ৩৩ মাস। চার ভাগের এক ভাগ মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। কয়েক মাসের ব্যবধানে বার্লিন শহরেই বেকারের সংখ্যা সাড়ে চার গুণ বেড়ে যায়। বৈশ্বিক জিডিপি কমে যায় শতকরা ২৭ ভাগ। একই সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস নামে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। এত টাকা নগদ দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর ছিল না। ব্যাংকে লালবাতি জ্বলতে থাকে।
মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেয়। উৎপাদনব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। অর্থনীতির চাকা থেমে যায়। ভোগবিলাস তো দূরের কথা, অনেক মানুষ শুধু আলু খেয়ে দিন কাটায়। ওই সময় হটডগ বেশ জনপ্রিয় হয়। দামে সস্তা, পেটও ভরে।
১৯৩২ সালের দিকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন কাজ হারায়। ওই সময় সরকার বদল হয়। ডেমোক্র্যাট দলের ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেন চার দিনের জন্য। ঘোষণা করেন ১০০ দিনের আপৎকালীন কর্মসূচি। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য চালু করেন ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন। পুঁজিবাজারে অনিয়ম ঠেকানোর জন্য তৈরি করেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। তিনি আরও কতগুলো যুগান্তকারী কাজ হাতে নেন, যা ‘নিউ ডিল’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে ছিল টেনেসি ভ্যালি অথরিটি। এর আওতায় তৈরি হয় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র।
কর্মসংস্থান তৈরির জন্য চালু করেন ওয়ার্কস প্রোগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর মাধ্যমে পরবর্তী আট বছরে ৮৫ লাখ লোক স্থায়ী চাকরি পায়। লোকদের ভিক্ষা দেওয়া বা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর যে সংস্কৃতি রাজা-বাদশারা চালু করেছিলেন এবং দানবীর হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন, তিনি ওই পথে হাঁটেননি। সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হয় ঐতিহাসিক সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো চালু হয় বেকার ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ও প্রবীণদের জন্য পেনশন। ওই সময় একটা কথা চাউর হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র চালু হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। পৃথিবী আর আগের মতো নেই। রাষ্ট্রগুলো নানা সম্পর্কের জালে একে অন্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বড় কোনো অর্থনীতির দেশে কোনো অঘটন ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া হয় দুনিয়াজুড়ে। এখন তো সারা দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে। সাম্প্রতিক করোনা–কাণ্ডে সবাই এখন জেরবার। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমরা কি আরেকটি বৈশ্বিক মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?
দৈবদুর্বিপাকে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যা, খরা, সুনামি, সাইক্লোন তো লেগেই আছে। তার ওপর আছে অসুখ-বিসুখ। এসব বালা-মুসিবত সচরাচর একটি–দুটি দেশ বা একটি অঞ্চলে হানা দেয়। আমরা জানি, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের মানুষ শত শত বছর ধরে আক্রান্ত হচ্ছে। আফ্রিকার অনেকগুলো দেশ খরার কবলে আছে বছরের পর বছর। সেখানে চলছে দুর্ভিক্ষ। নিকট অতীতে এইডস একটা মরণব্যাধি হিসেবে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলকেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন যে উপদ্রবটি দেখা যাচ্ছে তিন মাস ধরে, তাতে গোটা দুনিয়া হিমশিম খাচ্ছে। ধনী-গরিব, উন্নত-অনুন্নত, সাদা-কালো, গ্রাম-শহর, কমিউনিস্ট-ক্যাপিটালিস্ট—কোনো বাছবিচার নেই। সবাইকে আক্রমণ করছে। এ জন্য কেউ তৈরি ছিল না।
গত শতকের আশির দশকে নাগরিক সমাজে নতুন একটা কথা চালু হয়েছিল, থিংক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি। এখন এই প্রবচন ছাড়া গতি নেই। আজকের দুনিয়া প্রচণ্ড রকম বাণিজ্যনির্ভর। একটি দেশ একটি পণ্য হয়তো সস্তায় তৈরি করে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ওই দেশ ওই পণ্যের বাজার দখল করবে, এটাই সত্য। একই পণ্য দেশে তৈরি করতে যদি বেশি খরচ হয়, ওটা বিদেশ থেকে আমদানি করাই লাভজনক। বিশ্ব বাণিজ্যের ব্যাকরণ এভাবেই তৈরি হয়েছে। আমরা যেমন আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভোগ্যপণ্য কিংবা শিল্পের জন্য কাঁচামাল জোগাড় করতে চীন ও ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকি, তেমনি আমাদের পণ্য রপ্তানির জন্য তাকিয়ে থাকি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান—এসব দেশের দিকে। শ্রমশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় জায়গা হলো পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো।
এখন প্রায় সব দেশেই চলছে লকডাউন। কলকারখানা বন্ধ। যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত। পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন কোথাও কোথাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে বা একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চললে অর্থনীতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের হার খুবই কম। কর্মজীবীদের বড় অংশটি হয় স্বনিয়োজিত পেশায় আছেন অথবা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করেন। যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাঁদের একটা ক্ষুদ্র অংশ নানা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরে। তাঁরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পান, উৎসব বোনাস পান, দুর্যোগের সময় সবেতন ছুটি পান, অবসরে গেলে পেনশন পান। তাঁদের জীবন খুবই সুরক্ষিত।
কর্মজীবীদের বড় অংশটি, বলা যায় শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ, কিংবা তার চেয়েও বেশি, ইনফরমাল সেক্টরে আছেন। তাঁদের একটা অংশ চাষবাস করেন। এর বাইরে আছেন অগণিত রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেস্তোরাঁশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, বাসাবাড়ির বুয়া-দারোয়ান-ড্রাইভার। তাঁদের কারও নিয়োগপত্র নেই, নিয়মিত আয় নেই, অবসরে পেনশন নেই। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। তাঁদের শ্রমের চাহিদা প্রধানত শহর এলাকায়। তাঁদের থাকার জন্যই গড়ে ওঠে বস্তি। গ্রামে ফিরে যাও বললেই ফিরে যাওয়া যায় না। সেখানে জমি নেই, কাজ নেই। টুটাফাটা প্রজেক্ট বানিয়ে এ সমস্যার সমাধান হয় না।
আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নামে মুখরোচক কিছু কর্মসূচি আছে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের মাধ্যমে নির্দিষ্টসংখ্যক লোকের কাছে ভাতা-অনুদান পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মান্যবর মন্ত্রী বা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা তরতর করে কর্মসূচির নাম বলে দেবেন। সবই ঠোঁটস্থ। রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো ঠিকমতো ঠিক জায়গায় পৌঁছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। জিজ্ঞেস করলে জবাব পাওয়া যায়, সিদ্ধান্ত হয়েছে, নির্দেশ দিয়েছি, কমিটি বানিয়েছি ইত্যাদি। কদিন আগে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে ভোলায় এক সাংবাদিক জনৈক চেয়ারম্যানের গুণধর ছেলের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়েছেন। এ দেশে ‘রিলিফ চোর’ কথাটা অনেক বছর আগেই চালু হয়েছিল। মানুষ অতীতের সঙ্গে বর্তমানটা মিলিয়ে দেখে। দুর্যোগ ব্যবসা এখনো লাভজনক।
আমার আশঙ্কা, আমরা একটা দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছি। যেসব দেশ আর্থিকভাবে সচ্ছল, প্রযুক্তিতে উন্নত, বাণিজ্য ভারসাম্য যেখানে অনুকূল, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সৎ ও দক্ষ, তারা এই সমস্যা উতরে যেতে পারবে। কিন্তু আমাদের কী হবে?
আমাদের দেশটা আয়তনে ছোট। মানুষ গিজগিজ করছে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি—এটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। গেরস্ত চাষাবাদ করেন, গার্মেন্টস মজুররা সকাল-সন্ধ্যা খাটেন, প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠান। তাঁরাই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। দেশটা যাঁরা চালান, তাঁদের বেতন-ভাতা হয়তো চালু থাকবে, হয়তো তাঁদের জন্য বড় অঙ্কের বিমাব্যবস্থা হবে। কিন্তু ইনফরমাল সেক্টরের কোটি কোটি কর্মজীবীর কী হবে? তাঁদের জন্য আমাদের রূপকল্প কী?
একটা দৃশ্য কল্পনা করুন, রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়ে গেছে, ফ্যাক্টরি বন্ধ, সেচব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে, মানুষ কাজ হারাচ্ছে। এমন অবস্থার মোকাবিলা আমরা কীভাবে করব? আমরা তো এখনো তর্কে মশগুল—শারীরিক দূরত্ব বনাম সামাজিক দূরত্ব, কোনটা ঠিক। দেশের তাবৎ পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞ টিভি-ফেসবুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। একটু ভাবুন। সামনে দুর্দিন আসছে। সামাজিক শৃঙ্খলা যদি একবার ভেঙে পড়ে, তাহলে কেউ নিরাপদ থাকবেন না।
এখন তো মহামারি দেখছি। এরপর আসবে প্রলয়। বাগাড়ম্বর বন্ধ করে একটা আপৎকালীন পরিকল্পনা তৈরি করা খুবই জরুরি। এখন তো এক সপ্তাহ করে ‘ছুটি’ বাড়ছে। ন্যূনতম তিন বছরের জন্য একটা প্যাকেট পরিকল্পনা চাই। রিলিফ নয়। রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর দুর্বল জায়গাগুলো মেরামত করতে হবে। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের স্বাস্থ্য খাত কত নাজুক, কত ভঙ্গুর। ওখানে বিনিয়োগ বাড়ান। ইতালি-যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে সান্ত্বনা খুঁজবেন না। আগে মানুষ বাঁচান। তাহলে দেশ বাঁচবে।
আমার এই লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোতেও প্রকাশিত হয়েছে।