১০২২ বার পঠিত
লেখক মঈনুল আহসান সাবের এর কবিদের নিয়ে একটা নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। তিনি মাঝেমধ্যেই সামাজিকমাধ্যমে লিখে তার জানান দেন। সাবের ভাইয়ের মতন আমারও আলাদা চিন্তা রয়েছে কবি বিষয়ে। আমি মূলত কবিদের এভাবে ভাগ করি। প্রথমত কবি, তারপর ‘নষ্ট কবি’, অতঃপর ‘কষ্ট কবি’।
একটু ব্যাখ্যা করে নিই। কবি হলেন কবি। যার কবিতা আসে অন্যভুবন থেকে। সাহিত্যের অন্য সবকিছুই চর্চা করে সম্ভবত আয়ত্ত করা সম্ভব। কিন্তু কবিতা চর্চার বিষয় নয় এটা ঈশ্বর বা প্রকৃতি প্রদত্ত। যার ফলেই এর জন্ম অন্যভুবনে। কবি শুধু একটু ঘষামাজা করে উপস্থাপন করেন। কখনো ঘষামাজাও করতে হয় না, একেবারে তৈরি হয়েই আসে। যাদের আসে তারাই হলেন কবি। ‘নষ্ট কবি’ হলেন সেই কবি যিনি ঈশ্বর বা প্রকৃতি প্রদত্ত দানকে কাজে লাগান নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য। সোজা কথায় শাসক বা রাজন্যের জন্য স্তব রচনা করেন যারা। এরাই ‘নষ্ট কবি’। অন্য অর্থে রাজকবিও বলতে পারেন। এরা মূলত ‘পুরস্কার’ পিয়াসী।
‘কষ্ট কবি’ হলো সেই জনেরা, বন্ধ্যা হয়েও যারা পোয়াতির মতন হাঁটেন। অর্থাৎ এর দু’শব্দ, ওর দুই লাইন এবং তৎসম শব্দের ঋণে এরা একটা কিছু সাজান এবং যার নাম দেন ‘কবিতা’ এবং নিজেরা সেজে যান ‘কবি’। কেউ কেউ নিজেই নামের আগে কবি উপাধি কিংবা পদবি লাগিয়ে নেন। অথচ কবি সাজা কিংবা বনা যায় না, এটা তাদের ঘটে থাকে না। তারা তাদের এসব প্রসবিত ‘কবিতা’ নামক অখাদ্যকে না-না নামে চালাতে চেষ্টা করেন। কখনো নিরীক্ষাধর্মী, কখনো সারিয়ালিজম, কখনো পোস্টমডার্নিজম, এমন মোড়কেই অচল মাল চালানোর অপচেষ্টা করেন তারা। পরাবাস্তবতা না বুঝেই হয়ে উঠেন সারিয়ালিস্ট, আধুনিকতা না জেনেই পোস্টমডার্ন।
এমনি এক ‘কষ্ট কবি’র পাল্লায় পড়েছিলেন একজন সাহিত্যজন, যিনি নারী। যিনি লিখছেন এবং শেখার চেষ্টা করছেন। নারী কবি বলে কথা, সেই ‘কষ্ট কবি’ যিনি মোটামুটি ধরণের বিখ্যাত, রীতিমত আদেশ-উপদেশের ঝড় বইয়ে দিয়েছেন তার উপর। সেই নারী কবি’র তো হতবিহ্বল অবস্থা, অন্তত তার বর্ণনা থেকে তাই প্রতীয়মান হয়েছে।
বর্ণিত নারী কবি মূলত অন্ত্যমিল দিয়ে লিখেন। সে লেখাকে রীতিমত পুরানো পদ্য বলে ঝেড়ে ফেলার কথা বলেছেন সেই ‘কষ্ট কবি’। জানিয়েছেন, আধুনিক কবিতায় নাকি অন্ত্যমিল থাকতে নেই। থাকাটা রীতিমত পাপ। ভাগ্যিস শঙ্খ ঘোষ মরে বেঁচেছেন। নাহলে তো তার ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র কারণে তিনি পাপীদের কাতারে পড়তেন। নিচে শঙ্খ ঘোষ এর চার লাইন তুলে দিলাম।
‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’
অন্ত্যমিলের জন্য সেই ‘কষ্ট কবি’র ভাষায় তো কবি হিসেবে মহাপাপী হন শঙ্খ ঘোষ। আর কবিতা তো পুরা অচল মাল। এই হলো ‘কষ্ট কবি’দের কবিতা বিষয়ক চিন্তার অবস্থা।
সেই কষ্ট কবি আবার একটা গ্রুপ ধরে আছেন। কবিতার ‘কাল্ট’ আর কী। ভগবান রজনীশ টাইপ কাল্ট। সেই কাল্টে’র ধারণায় এ ধরণের সহজ শব্দযোগে লেখা অন্ত্যমিলের কবিতাগুলো ‘কবিতা’র মধ্যেই পড়ে না। কোনটা পড়ে তার একটা নমুনা দিই নিচে।
‘শেয়ালের ডিমে তা দেয় কুকুর, বের হয় হাটটিমাটিম’ এই হলো একটা লাইন। কঠিন লেখা, কি বলেন ভাই সকল? পুরো ‘কবিতা’ দিলাম না, রুচি বৈকল্যের কবলে পড়িনি বলে।
এই হলো তাদের কঠিন কবিতা। আরেক এমন ‘কষ্ট কবি’ নিরীক্ষার নামে পুরো বীজগণিতের সূত্র সেঁটে দিয়েছেন কবিতায়। বীজগণিতকে তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছেন। বড়ই কঠিন কাজ, রবীন্দ্রনাথ যা করতে পারেননি। এই ‘রামকবি’ আবার কবিতা নিয়ে গবেষণা করছেন, একদিন দেখা করতে এসে এমনটাই জানালেন। ‘রাম’ শব্দটির বিষয়ে আবার বলে নিই, না হলে অনুভূতি আহত হতে পারে। ‘রাম’ মানে হলো বড়, যেমন রামদা, রামছাগল। তেমনি ‘রামকবি’ মানে বড় কবি। সুতরাং মাইন্ড করার কিছু নেই।
সুকুমার রায় ননসেন্স রাইম বা ননসেন্স ছড়া’র সৃষ্টি করেছিলেন। মূলত শিশুতোষ ছিলো সেই ছড়ার বিষয়টি। ‘হাট্টিমাটিম টিম’ যেমন। কিন্তু আমাদের ‘কষ্ট কবি’ তথা ‘রামকবি’গণ তাদের ‘কবিতা’কেও ননসেন্স করে তুলেছেন। অবশ্য এটাও এক অর্থে সৃষ্টি বলতে পারেন। ‘ননসেন্স কবি’দের ‘ননসেন্স কবিতা’। আলোচনাই যারা বুঝে উঠলো না, তাদের আবার সমালোচনা।
‘ননসেন্স’ হলো যার কোনো অর্থ নেই। অথচ, যা একেবারেই শিশুতোষ, তা ছাড়া সব প্রকাশেরই অর্থ আছে। এই যে ধ্বনি, সেই ধ্বনি প্রকাশেরও অর্থ আছে। হাসির ধ্বনিতে বোঝা যায় আনন্দ, ‘ইস’ ধ্বনিতে ব্যথা, ‘আহ’তে বিষাদ। প্রকাশের বাইরে বোধহয় কোনো ‘ননসেন্স’ ধ্বনি নেই, যার শ্রবণ কোনো কিছুর প্রকাশ ঘটায় না। সাহিত্যের সব শাখারই কাজ প্রকাশ ঘটানো। শুধু তাই নয় অর্থবোধক প্রকাশ। কবিতাও তাই। আবোল-তাবোল শব্দ জোড়া দিয়ে অর্থহীন লাইন হলো স্রেফ ‘কষ্ট কবিতা’। সমালোচিত মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টমডার্ন কবিতাও অর্থ ধরে। নিচে দিলাম তার চার লাইন, যারও প্রকাশিত অর্থ আছে।
‘আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে।
নির্ঘাত কুকুরগুলো গন্ধ শুঁকে টের পাবে।
ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে। যা হবার হয়ে যাক।
আজ শালা এসপার কিংবা ওসপার।’
আধুনিক ফর্মে, ভাষার বয়ানে অন্ত্যমিলকে ধরা খুবই উচ্চমার্গের কাজ। শুধুমাত্র কবিরাই তা পারেন। ‘কষ্ট কবি’ তথা ‘রামকবি’দের পক্ষে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। দুই লাইনে খুব সহজে, যাকে ‘কাপলেট’ বলা হয়, তাতে যা বলা হয়; তা এক হাজার ‘কষ্ট কবি’র একলক্ষ ‘কষ্ট কবিতা’তেও লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
গালিবের কথাই বলি। ‘আমার ঠিকানা যদি ভুলে যাও, তাই তোমার বাড়ির আঙিনায় ঘর বানালাম।’ কী সহজ কথা, কিন্তু বুকের ভেতর ঢুকে যায়। ‘রামকবি’রা আবার নিজেদের জাতে উঠাবার জন্য গালিব, জিবরান, রুমির আশ্রয় নেন। অথচ সেই মহাজনরা কত সহজ বাক্যে কী গভীর কথা বলে গেছেন। সেই সহজিয়ার গভীরতা উপলব্ধি করা ‘রামকবি’দের পক্ষে অসম্ভব। অথচ তারা আবার সহজিয়াদেরই আশ্রয় নেন। ওই যে বর্ম দরকার, আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রচারের।
রবীন্দ্রনাথ তো স্বীকার করেই গেছেন, ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ এই ‘রামকবি’রা মূলত রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করেন রাজনৈতিক কারণে। নিজেদের ভেতরে ‘মাল’ নেই বলে রবীন্দ্র কাল্টের কমফোর্ট জোনে থেকে কথা বলতে পছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথ নামের বর্মটি তাদের প্রয়োজন। এই বর্মের নিচে থাকলে, বিপদ-আপদ থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যায়, তেমনি সামান্য হলেও প্রসাদটা মিলে। ওই যে, দুর্গা’র কাঠামোতে যেভাবে অসুর পূজিত হয়। এই ‘কষ্ট কবি’রা মূলত সুরহীন অসুর।
হালের আলোচিত-সমালোচিত মারজুক রাসেল এর কথাই বলি। তিনি তার লেখা ‘অল্টারনেটিভ’ দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন হাল সময়ে। এই লেখার শেষ তিন লাইন অনেকের মুখে মুখে। নিচে উদ্ধৃত করছি।
‘তোমার এলাকা ছাইড়া যাচ্ছি;
তোমারে ছাড়ার ফিলিংস্ হচ্ছে, হোক-
আমি অনেক কিছু-ছাইড়া-আসা-লোক!’
এই যে ‘হোক’ এর সাথে ‘লোক’ এর অর্থবোধক অন্ত্যমিল, এর কারণেই এই লেখা এত জনপ্রিয় হয়েছে। এই লেখাও সহজিয়া, কঠিন কিছু নেই, ‘রামকবি’দের ভাষায় যা অচল মাল। এই সকল ‘রামকবি’দের কাছে হয়তো মানুষের আনন্দ ও কষ্ট প্রকাশের ধ্বনির চেয়ে রামছাগলের ‘ব্যা’ ধ্বনিও বেশি কাম্য, শ্রুতিমধুর। যেহেতু তা বোধগ্যম নয়। সম্ভবত রামছাগলটিও হতে পারে পোস্টমডার্ন।
মারজুক রাসেল বাদ দিয়ে সরাসরি ধ্রুপদী বোদলেয়ার-এ যাই। শার্ল বোদলেয়ার, ‘রামকবি’দের আর যাই হোক এই নাম মুখস্ত আছে। এই নামের বর্মও তাদের দরকার হয়। বুদ্ধদেব বসু’র অনুবাদে বোদলেয়ার এর ‘সে রাতে ছিলাম’ এর শেষ দু’লাইন।
‘কোনো সন্ধ্যায় – নিষ্ঠুরতমা হে রূপবতী ! –
ম্লান করে দিতে ঠান্ডা চোখের তীব্র জ্যোতি ।’
কী আশ্চর্য এখানেও অন্ত্যমিল। বোদলেয়ারও তো অচল মাল, সাথে বুদ্ধদেব বসুও, কি বলেন?
ফুটনোট : রুমি বলেছেন, উপেক্ষার চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। এদের উপেক্ষাই করছিলাম। ‘রামকবি’ নামক ‘রাম ইয়ে’দের। কিন্তু যখন লিখতে আসা, সাহিত্যজন হয়ে উঠার আন্তরিক চেষ্টায় থাকা কাউকে বিভ্রান্ত করা হয়, তখন মাঝেমধ্যে শাসন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও জানি না, ‘কষ্ট কবি’দের এই শাসন কোনো কাজে আসবে কিনা। না আসুক, আমি তো আমার চেষ্টা করে গেলাম।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন