২
১০০৮ বার পঠিত
নারীবাদ নিয়ে অনেকরকম জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা, সমালোচনা, বিভ্রান্তি, কটূক্তি রয়েছে। এই শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিন্তা-চেতনাকে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। রেখেছে সংশয়াগ্রস্ত করে। হীনমন্যতারও চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যখন নারীবাদকে কটাক্ষ করে কথা বলে। অনেকের কাছে নারীবাদ বিষয়টা খেলো মনে হতে পারে, তবে এর গভীরতা উপলব্ধি করার ক্ষমতা তাদেরই আছে; যাদের মনুষ্যত্ব আছে। মনুষ্যত্ব বিবর্জিত মানুষের পক্ষে নারীবাদের মর্ম বোঝা আসলেই কঠিন। অথচ, এই নারীবাদ শব্দেই নারী ও পুরুষের মৌলিক মুক্তি ও শক্তির উৎস রোপিত। বিষয়টি বুঝতে হলে নারীবাদের আদ্যপান্ত বুঝতে হবে।
‘নারীবাদ‘ শব্দটিতে নারী অস্তিত্বের গভীর সত্তা নিহিত আছে। এতে আছে নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা, নারী সচেতনতা এবং নারী অস্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের মূলমন্ত্র। সেইসাথে সামাজিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে সমতার ভিত্তিতে নারীবাদ বিষয়টির অবতারণা হয়। সমাজের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোতে নারীর সমান অধিকারের কথা এসেছে। বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীবাদ বিষয় এসেছে। তাছাড়া নারী তার নিজের জীবনের ওপর, পছন্দের ওপর কর্তৃ্ত্ব এবং বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন ও পুরুষের একক কর্তৃ্ত্বের পরিবর্তনই নারীবাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে প্রতিপাদ্য হচ্ছে। দয়া নয়, করুণা নয়, মানুষের মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলার শক্তিই হলো নারীবাদের মজ্জাগত চেতনা।
নারীবাদের প্রথম শর্ত হলো নারীর অর্থনৌতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তিই হলো সবকিছুর চালিকা শক্তি। শিশু বয়স থেকে নারীকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, এ জীবন তার নিজের, তাকেই গড়ে তুলতে হবে। তারজন্য যা যা উপকরণ দরকার তার সবরকম সহযোগিতা এবং সরবরাহের নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা নারীকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে হলে এবং জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হলে তার দৃঢ় মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। যারা এই মানসিকতা রাখেন না, তারাই পরনির্ভরশীল হয়ে সমাজে পরগাছা রূপে বেঁচে আছেন। তারা হয় পিতার আশ্রয়ে, নাহয় স্বামীর আশ্রয়ে, সন্তানের আশ্রয়ে নতুবা অন্যকোনো অসদুপায়ে বেঁচে থাকার পায়তারা করে। অনেকসময় এই শ্রেণীর নারীর জীবনযাপনের জন্যও নারীবাদ শব্দটি আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে শিক্ষা, জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও নারী পরিবার বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে। অন্যদিকে নারী নির্যাতনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, শ্রমের মূল্যায়ন, নারীর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া এখনো দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রত্যেকটি নারী যদি সচেতন হয় অনতিবিলম্বে এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই।
নারীবাদের আরেকটি শর্ত, শিক্ষাদীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে মেধা ও মননের সংযোগে কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠা। মননশীল চিন্তা-চেতনায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করা। সৃষ্টিশীল কোনো না কোনো কাজে মনোনিবেশ করা। এতে নিজের ভেতরে নিজেকে আবিস্কার করা এবং নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার মানসিকতা তৈরি করা। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। উপযুক্ত শিক্ষাই শারিরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান সহায়ক অস্ত্র। শিক্ষাই মুক্তি এবং শিক্ষাই জীবনের আনন্দ। তাছাড়া নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, সম-অধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গী প্রখর করা, সকল পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণে নারীকে উদ্বুদ্ধ ও দক্ষ করা, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র বিমোচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়তা করা, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবার গঠনে উৎসাহিত করা এবং যৌতুৃক ও নারী নির্যাতন রোধ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারে এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মপ্রত্যয় নারীর মধ্যে সৃষ্টি করা যা নারীবাদ শব্দের অলংকার।
সর্বোপরী নারীই পারে; একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে। যদিও পুরুষশাসিত সমাজ তা কখনওই চায়নি। এক্ষেত্রে নারী নিজেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে- কীভাবে তার অর্থনৈতিক এবং মানসিক মুক্তি আসবে; তার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর সেভাবেই অনেক নারী বিশ্বয়ানের যুগে পুরুষের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এখন কাজ করে যাচ্ছে। নারী স্বাধীনতা এবং নারী ক্ষমতায়নে মুখ্য ভূমিকাও রাখছে অনেক নারী। অথচ কিছুকিছু ক্ষেত্রে ‘নারীবাদ‘ শব্দটি যেনো পুরুষবিদ্বেষী শব্দরূপে পরিগণিত হচ্ছে। কিন্তু কেন? এই বিদ্বেষভাব অনেক তথাকথিত সচেতন পুরুষের কাছ থেকেই আসছে, আবার অনেক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মহিলারাও নারীবাদের বিপক্ষে বিদ্রুপভাব প্রকাশ করে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ‘নারীবাদ‘ শব্দের ছত্রছায়ায় এমন কোনো নেতিবাচক কিছু কেউ করে থাকলে তা নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে! তাইবলে ‘নারীবাদ‘ শব্দটিকে কটাক্ষ করে কেন?
সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকলে একটি স্বাস্থ্যবান সমাজ গড়া সম্ভব নয়। একইভাবে তা কখনোই গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে দাবি করতে পারবে না। নাহলে নেপোলিয়ন কেনই বা বলবে, ‘আমাকে এক শিক্ষিত মা দাও। আমি তোমাদের উন্নত জাতি দিবো‘। নারীবাদ শুধু নারীর জন্য নয়, পরিবার, সংসার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য নারীবাদ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারীবাদ দিতে পারে সুস্থ সমাজ সংসার এবং রাষ্ট্রের একজন সুস্থ ধারক ও বাহক। নারীবাদের বিপক্ষে বিদ্বেষভাব দেখিয়ে যারাই নেতিবাচক ইঙ্গিত দিবেন, তাদের বিশেষভাবে জানা উচিত – নারী,পুরুষে সাম্য, মৈত্রী তৈরি না হলে দেশ ও জাতি কখনো উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে পারবে না। উন্নতবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়। অতএব জয়তু নারীবাদ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
অক্টোবর ৪, ২০১৭; ১০:১১ অপরাহ্ন
প্রথম সর্বনাশের সূত্রই হচ্ছে মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্মগুলি! আর ধর্মের ভিত্তিই হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি! যে ক্ষমতার বিন্যাসকরণ শুরুই হয়েছে নারীর উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে! তাই পৃথিবীর সব ধর্মেই নারীর অবস্থান দ্বিতীয় লিঙ্গে ! সেখান থেকেই লড়াইটা শুরু করতে হয় নারীবাদী আন্দোলনগুলিকে ! ধর্মের এই নাগপাশ, সময়ের অগ্রগতির সাথে কতটা মুক্ত হচ্ছে সেটা বিতর্কের বিষয়! কিন্তু দেখার বিষয়, যুগ পরিবর্ত্তনের সাথে সাথে ধর্মের বাঁধন একটু একটু করে আলগা হলেও প্রভুত্বের অনুষঙ্গগুলি নতুন নতুন রূপে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে থাকে সমাজ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার অলিতে গলিতে ! যার ধাক্কা খেতে হয় নারীকে আধুনিক জীবনের পরতে পরতে!
ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র নারীর উপর প্রভুত্ব করার এই যে মানসিকতা আমাদের রক্তের ভিতরে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পুরুষত্বকে,এর থেকে মুক্ত হওয়ার মতো শিক্ষা আমাদের পরিবেশে আজও অপ্রতুল! তাই শুরু করতে হলে শুরু করতে হবে ঐ শিক্ষার বনিয়াদ থেকেই! সেখান থেকেই বিষবৃক্ষের শিকড় কাটার প্রস্তুতি নিতে হবে! আর এ’ দায়িত্ব নিতে হবে সেই নারীকেই! এই কাজে নারীকে নির্ভর করতে হবে নিজের আত্মপ্রত্যয়ের উপর ! পুরুষতন্ত্রের শিক্ষায় সাধন হবে না এই কাজ ! পুরুষতন্ত্রের বিপ্রতীপে নারীবাদের প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে পুরুষতন্ত্রের শিকড় কাটার শিক্ষার ভিত তৈরী কিন্তু অসম্ভব ! তাই অবাস্তব ! দুঃখের বিষয় নারীবাদী আন্দোলনগুলি এইখানে এসেই দিশা হারাচ্ছে ! নারীর জীবনবোধের পরিসরে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সভাসমিতির মঞ্চে কিংবা গবেষণা গ্রন্থের সূচীতে নারীবাদের ঘোষণা কোনোদিনও সত্য হয়ে উঠবে না! কার্যকর হবে না সমাজ জীবনের কোনো স্তরেই! নারীবাদের মূলে যে দুটি বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন, সে দুটি হল, নারীর নিজের উপর আত্মনির্ভরতার দৃঢ়তা ! এবং পুরুষের প্রভুত্ব অস্বীকার করার প্রতিজ্ঞা ! পুরুষতন্ত্র এই ব্যাপারে বাধা দেবেই! কারণ পুরুষতন্ত্রের চরকায়, নারীর পুংনির্ভরতা ও পুংপ্রভুত্ব স্বীকারের তেল নিয়মিত যোগান বন্ধ করতে পারলেই পুরুষতন্ত্র বিকল হয়ে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য ! তাই বাধা যখন প্রবল, প্রতিরোধের যুদ্ধও তখন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলা দরকার !
আত্মনির্ভরতার পথে প্রথমেই অর্জন করতে হবে আত্মপ্রত্যয় ! আত্মপ্রত্যয় গড়ে ওঠে আত্মসমীক্ষা এবং চলমান অভিজ্ঞতার যুগলবন্দীতে ! সেইখানেই বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রকে ধরে রাখলে দেখা যায় ঘরে বাইরে সর্বত্র নারীই কয়েক ধাপ এগিয়ে পাশের পুরুষটির থেকে! এই কয়েক ধাপের হিসেবটি, পুরুষের স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী না থেকে নারী যদি নিজের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবেই প্রাথমিক কাজটি শুরু করে দেওয়া যায় সার্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ! মনে রাখা দরকার যুদ্ধ পুরুষের বিরুদ্ধে নয় ! পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ! এবং এটাও স্মরণে রাখতে হবে ব্যক্তি পুরুষ এই পুরুষতন্ত্রেরই ফসল! তাই সেই পুরুষকেও বিচ্ছিন্ন করতে হবে পুরুষতন্ত্র থেকে!
নভেম্বর ১, ২০১৭; ১:১২ অপরাহ্ন
অসংখ্য ধন্যবাদ। চমৎকার বলেছেন।