কয়েকমাস আগে জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে আলোচনার এক পর্যায়ে জার্মানি, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের সোস্যাল সিস্টেম সম্পর্কেও অনেক কথা উঠে এসেছিল। সেইসব আলোচনায় বাংলাদেশে অবস্থানরত (তাঁদের কারুর কারুর ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও রয়েছে) কিছু সাংবাদিক, গবেষক বন্ধু বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে আমেরিকায় জনগণের মৌলিক অধিকার নিষ্চিত করা হয়।
অপরদিকে আমার বক্তব্য ছিল, জার্মানির ধারেকাছেও তাদের জনগণের মৌলিক অধিকার নেই। আমার এই বক্তব্যে কেউ কেউ ঊষ্মা প্রকাশ করে টিজও করেছিলেন। এই বলে, যে আমি জার্মানিতে থাকি বলেই জার্মানির প্রশংসা করছি। সেসময় বাংলাদেশের কোনো কোনো কম্যুনিস্ট বিপ্লবী অপ্রাসঙ্গিকভাবে হিটলারের প্রসঙ্গ সামনে আনার চেষ্টাও করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন ‘জার্মানি হিটলারের দেশ’। হিটলারের দেশে থেকে আমি কতোবড় অন্যায় করছি।
আরেক ‘কম্যুনিস্ট’ লেখক (রাজনীতিবিদ নন), নাট্যকার ও গবেষক কামালুদ্দিন নীলুর নাটক দেখে স্তালিনানূভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেই রাগ সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসান ও জোবায়েন সন্ধির ওপরে উগড়ে দিয়ে ধারাবাহিক সিরিজ রচনাও করেছিলেন। সেই সিরিজে লিখেছিলেন আমরা (নাস্তিক, মুক্তমনা ব্লগার) ইউরোপে আশ্রয় নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে (এর অর্থ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পেয়ে) স্তালিনের বিরুদ্ধে কুৎসারটনার মিশনে নেমেছি। নবযুগ ব্লগ, অংশুমালী ম্যাগাজিন, অর্পিতা রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে পরবর্তী পর্বে আরও আসছে ডটডটডট লিখে আমাকে হুমকীও দিয়েছিলেন। বছর ঘুরতে চললেও, স্তালিনবাদী ওই বিপ্লবীর পরবর্তী পর্ব এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
আরেক ‘কম্যুনিস্ট’ বিপ্লবী বাংলাদেশে পেঁয়াজের দামবৃদ্ধির সময় জার্মানিতে আশ্রয় নেয়া নাস্তিক-মুক্তমনা ব্লগারদের দিকে ইংগিত দিয়ে কুৎসিত পোস্ট দিয়েছিলেন। জার্মানিতে ২০ টাকায় ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনতে পাওয়া যায়, এরকম আজগুবি কথা লিখে, টিজ করার চেষ্টা যে, সবকিছু কেন জার্মানিতেই হবে। মাত্র ২ ইউরো মূল্যে এখানে ৫ কেজি পেঁয়াজ পাওয়া যায় এর প্রমাণসহ একটা পোস্টও দিয়েছিলাম গতবছর অক্টোবর মাসে। এরপর ‘কমুনিস্ট’ বিপ্লবী চুপ। আগে নিয়মিত ওয়ালে হাজির হলেও এরপর থেকে লাপাত্তা। আওয়ামী সরকারবিরোধী চিমটি কাটা টিংটিং স্ট্যাটাস, কম্যুনিস্ট বিপ্লব, শ্রেণি সংগ্রাম, মার্ক্সবাদ, মাওবাদ তত্ত্ব’র বয়ান দিয়ে সাচ্চা ‘কম্যুনিস্ট’ ভাব দেখালেও চরম ফ্যাসিস্ট ‘আওয়ামী কবি’দের আসরেও তার সরব উপস্থিতি ও ভালোবাসার নজিরও দৃশ্যমান। জার্মানি নিয়ে এঁদের চরম ঘৃণা, জার্মানিতে আসতে না পারার আপসোসও। কিন্তু যে মার্ক্সবাদ কপচিয়ে নিজেকে বিপ্লবী পরিচয় দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, সেই মার্ক্স যে এই জার্মানির সেটা তখন বেমালুম ভুলে যান। ভুলে যান মার্ক্সের দেশ মানেই হিটলারের দেশ।
আরেকদল আছেন ডানপন্থী কিংবা ইসলামপন্থী। এদের বিস্তর অভিযোগ জার্মানি সব নাস্তিকদের আশ্রয় দেয়। জার্মানি মানেই নাস্তিকদের দেশ। খুব ভালো অভিযোগ। কিন্তু তারা একবারও বলে না, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের সবচেয়ে বেশী আশ্রয় দিয়েছে কোন দেশ। মুসলিম বিশ্বের বাইরে পাশ্চাত্যের কোন দেশে মুসলিমদের সবচেয়ে বেশী সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান দেয়া হয়। কোন দেশে মুসলিমদের নমাজ পড়ার জন্য মুসলিমদের হাতে গির্জার চাবি তুলে দেয়া হয়। তারা উল্লেখ করে না, পৃথিবীতে কোন দেশের মসজিদে ইমামতি করেন একজন নারী। তারা উল্লেখ করে না, জার্মানি সারা বিশ্বের কতজন মুসলিমকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা উল্লেখ করে না জার্মানি কতোজন বিএনপি-জামাতের নেতা কর্মীকে আশ্রয় দিয়েছে। অথচ কথায় কথায় উল্লেখ করে জার্মানি কেবলমাত্র নাস্তিকদের আশ্রয় দেয়। হাতে গুণে বলতে পারবেন কয়জন নাস্তিক কিংবা মুক্তমনা ব্লগারকে জার্মানি আশ্রয় দিয়েছে? চোখ প্রসারিত করে দেখলেই গোণা সম্ভব। বড়জোর ৮ থেকে ১০ জন বাংলাদেশী নাস্তিক ব্লগার জার্মানিতে আশ্রয় পেয়েছে। এর কমই হবে হয়তো, বেশী নয় মোটেই।
একটা জিনিশ খেয়াল করলেই বোঝা যায়, সব শ্রেণির বাঙালিদের (বাংলাদেশী) মধ্যে জার্মানি বিষয়ে একটা ঈর্ষা বিদ্যমান। এই ঈর্ষা ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয়প্রাপ্ত বাঙালি (বাংলাদেশী) অপরাপর নাস্তিক-মুক্তমনা-নারীবাদী ব্যক্তিদের মধ্যেও প্রবলভাবে দৃশ্যমান। ইউরোপে জার্মানির অবস্থা সবচেয়ে ভালো হবার কারণে তারা জার্মানিতে অবস্থানরতদের ঈর্ষা করে থাকেন। এই ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে প্রকাশ করেন। বিভিন্ন ইস্যুতে, বিভিন্ন তর্কের আসরে। কেউ যদি ভেবে থাকেন আমি জার্মানিতে বাস করি বলেই জার্মানির সাফাই গাইছি, কথাটা মোটেই সত্য নয়। শাদাকে শাদা, কালোকে কালো বলা কিংবা কোদালকে কোদাল বলার মতো সৎসাহস আছে বলেই আমি সত্য বলার সাহস রাখি। যা সত্য নয় কিংবা যা আমার জানার বাইরে, তা নিয়ে আমি কথা বলি না। যা জানি তা আমি নির্দ্বিধায় বলি, বলবো। আপনার শুনতে ভালো না লাগলে শুনবেন না, ভালো লাগলে শুনবেন। সংশয় হলে গুগলের জামানায় ভেরিফাই করে নিবেন। ব্যাস। না জেনে ফুটফাট কমেন্ট করবেন না।
যে প্রসঙ্গে লেখাটি শুরু করেছিলাম। আমেরিকা প্রসঙ্গে। অর্থাৎ আমেরিকা রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার বিষয়ে। নিউজ মিডিয়ার কল্যাণে ইতোমধ্যে নিশ্চয় জেনে থাকবেন, আমেরিকান পুলিসের নির্যাতনে জর্জ ফ্রয়েড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি কদিন আগে মারা গেছেন। পুলিসের হাতে এই ব্যক্তির নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা সিএনএন এর সংবাদে দেখার পর থেকে ক্রোধ ও ঘৃণায় পুরো শরীর গুলিয়ে উঠছিল। সেদিন এটা নিয়ে লিখবো লিখবো করেও লিখতে পারিনি। নিরস্ত্র মানুষের ওপর রাষ্ট্রের গুণ্ডাবাহিনী (পুলিস কিংবা দলীয় কর্মী যেই হোক)যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের খুন করে; তখন সেই রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্র বলা সম্ভব না। আমেরিকাতে এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার ঘটেছে এবং ঘটমান।
জর্জ ফ্রয়েডকে গ্রেফতার করার সময় পুলিস তার বুকের ওপর হাঁটু দিয়ে এমনভাবে চেপে ধরে নির্যাতন করে যে, তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেন। বারবার কাকুতি মিনতি করলেও পুলিস তাতে কান দেয় নি। হতভাগা লোকটি মারা যায়। এরপর আমেরিকাতে শোরগোল শুরু হয়েছে, কিছুদিন আন্দোলন চলবে; এরপর আবারও এরকম ঘটনা ঘটতে থাকবে।
আজ প্রিয় বন্যা আহমেদ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে পুলিসের নির্যাতনে জর্জ ফ্রয়েডের মৃত্যু নিয়ে একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। ওই স্ট্যাটাসে পুলিসের নির্যাতনে ফ্রয়েডের মৃত্যুর বিষয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। পুরো লেখাটির মধ্যে একটি অনুচ্ছেদ আমার মনে দাগ কেটেছে। এই কথাগুলো আমেরিকার কেউ বলুক এটা অনেকদিন ধরে আমি মনে মনে কামনা করছিলাম। যে লেখাটির কারণেই এই রচনা লেখা।
তিনি লিখেছেন-
“… আমেরিকা হচ্ছে পোস্ট নিও লিবারেল পুঁজিবাদের স্বর্গরাজ্য – একদিকে সম্পদের ছড়াছড়ি, আর অন্যদিকে এটা একমাত্র উন্নত দেশ যেখানে গণ-স্বাস্থ্যসেবা নেই, ম্যাটারনিটি ছুটি বলতে কিছু নেই, দুর্বলের জন্য তেমন কোন সোশ্যাল সাপোর্ট সিস্টেম নেই, সর্বোচ্চ কয়েদিতে ভরা এখানকার জেলখানা, ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশচুম্বি, বর্ণবৈষম্যের শেষ নেই, চারদিকের বন্দুকের ছড়াছড়ি, কোভিড-১৯-এ সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাইনরিটি গরিবেরা, যাদের মধ্যে কালোদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি… । তবে আপনি ধনী বা টেনেটুনে মধ্যবিত্ত হলে অবশ্য আলাদা কথা, যদিও কয়েক দশক ধরে মধ্যবিত্তদের সংখ্যাও ক্রমশ সংকুচিত হইয়ে আসছে, ওনাদেরও বেশ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এই সাদা মধ্যবিত্তদের একটা অংশই ক্ষেপে গিয়ে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিল ‘পরিবর্তনের’ আশায় – কিন্তু সেই আলোচনা আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।…“
এছাড়াও কমেন্টবক্সে ইমতিয়াজ মির্জার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বন্যা আহমেদ ছোট করে একলাইন লিখেছেন। যা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই কথাগুলো আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি আর বন্ধুদের আক্রমণের শিকার হচ্ছি। অথচ কেউ বোঝারই চেষ্টা করছেনা যে এই কথাগুলো কী কারণে বলছি। বন্যা লিখেছেন-
“আমরা বাংগালিরা তো খুব রেসিস্ট জাতি…”
বন্যার কথাকে আমি শতভাগ সমর্থন জানাই। কুর্নিশ করি এই সাহসী উচ্চারণের জন্য। আমাদের আরও জোরালো উচ্চারণ করা জরুরি। বাঙালিদের স্বার্থেই।
এবার আসি উদ্ধৃত করা বন্যা আপার প্রথম অংশের আলোচনায়। তাঁর লেখাতে প্রমাণ হয় আমেরিকা উন্নত দেশ হওয়া সত্বেও সেখানে গণ-স্বাস্থ্যসেবা নাই। গর্ভবতী নারীদের ম্যাটার্নিটি ছুটি নাই। দূর্বল কিংবা অসহায়দের জন্য তেমন সোস্যাল সাপোর্ট সিস্টেম নাই। আমেরিকার জেলখানা বিপুলসংখ্যক কয়েদীতে ভরা। ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশচুম্বি। বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান। যে কেউ প্রকাশ্যে অস্ত্রবহন, বন্দুক নিয়ে যে কারুর ওপরে হামলে পড়তে পারে (যেহেতু আগ্নেয়াস্ত্র অবাধে কেনাকাটার সুযোগ আছে) ইত্যাদি।
আমেরিকার সাথে জার্মানির তফাৎ এটাই যে উপরের একটিও জার্মানিতে নাই। অর্থাৎ জার্মানির সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি আমেরিকার বিপরীত।
লেখাটি শুরু করেছিলাম আমেরিকান পুলিসের হাতে জর্জ ফ্রয়েডের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। বলতে এসেছিলাম, আমেরিকান পুলিস বনাম জার্মানির পুলিসের মধ্যে মোটাদাগে তফাৎ হলো জার্মান পুলিসরা শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত ও মানবিক। জার্মানির পুলিস কোনো ব্যক্তিকে হাঁটুচেপে ধরে খুন করা তো দূরের কথা, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জোরে ধমক দেবারও ক্ষমতা রাখে না, ধমক দিয়ে থাকলে পত্রিকায় নিউজ হবার আগেই সেই পুলিস চাকরি হারান।
বন্যার স্ট্যাটাস পড়ুন নীচে:
https://www.facebook.com/bonya.ahmed/posts/3128603577161414