না! গাছের উপর পাখি বা কাউয়া কোনোকিছুই নাই। তারপরও কিছুক্ষণ পরপর ছিটা ছিটা পানি পড়তেছে। এইটা তো কাঠবাদাম গাছ, আগার দিকের কয়েকটা পাতা লাল। কিসের পানি কে জানে। একটু আগেই ঘাসের উপর দিয়া পেটমোটা কাঠবিড়ালী দৌড়াতেছিল, পাতার ফাঁক দিয়া কাঠবিড়ালী মুততেছে নাকি? এই পার্কে সবগুলা বেঞ্চ বুক্ড হয়া আছে। দশ-বিশ কদম দূরে বটগাছের গোড়াটা পাকা করা, সেইখানে বসা যায়। প্রবলেম হইল, সেইখানে একটা মেয়ে বসা। মেয়েটার সামনে ছোলা, পপকর্ন, চা, চানাচুর, আচার—দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস। সেইগুলা সে একটু একটু কইরা চইখা রাইখা দিতেছে। হাতে একটা আমড়া, আমড়া শেষ না হইতেই চিৎকার দিয়া উঠল—চাচা, ঝালমুড়ি দেন। মেয়ের চাচা খালি পার্কে পাক খাইতেছে—এইদিকেও আসছিল কয়েকবার। অতনুর দিকে সরু চোখে তাকায়া কী জানি বলতে গিয়াও বলল না।
মেয়েটাও তার দিকেই তাকায়া কেমন কইরা পায়ের মাঝখানের আঙুলটা নাচাইতেছে… একবার আঙুলটা বুড়া আঙুলের উপরে উঠায়, আবার বুড়া আঙুলের নিচে নামায়। মাঝখানের আঙুলটা অসম্ভব লম্বা আর চিকন, দেখলেই গা হাত পা শিরশির করে। দিদিমা বলত, পায়ের মাঝখানের আঙুল লম্বা হইলে নাকি অঢালা টেকাপয়সার মালিক হওয়া যায়। অতনুর নিজের আঙুল দুইটাও অনেক লম্বা।
আবারও ঘাড়ের উপর পানির ছিটা পড়তেছে। অতনুর ভয় ভয় লাগতেছে। সন্ধ্যা নামতেছে, গাছের উপরে কাকপক্ষী কিচ্ছু নাই। ফরিদের উপর চরম মেজাজ খারাপ হইতেছে তার। একঘণ্টা ধইরা বইলা যাইতেছে… এই তো দাদা! আর পাঁচ মিনিট বসেন, আমি কাছেই—আইসা পড়ছি।
ফরিদরে নিয়া সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারতেছে না। সাথীর সাথে ব্রেক-আপের মূল হইল এই ফরিদ। সাথী ওরে দেখলেই মেজাজ খারাপ করত, আরো আজব ঘটনা হইল ফরিদ সাথীরে সহ্যই করতে পারে না। এইটা এত এক্সট্রিম পর্যায়ে গেছিল যে, ফরিদ একবার বইলাই ফেলল—
‘দাদা, তুমি ব্রাহ্মণ। মা-বাপের একমাত্র পোলা, কত আশাভরসা কইরা রাখছে। তারা কি মাইনা নেবে? আর এই যে সাথী আপা—সে তো টাইম পাস্ করতেছে তোমার লগে। সে বিয়া করবে তাগো ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই জাকিররে। সব খবর লওয়া শেষ আমার।
সেগুলা নাইলে বাদ দিলাম, তোমারে কোন দিনটায় শান্তি দিছে কও তো। দুই মিনিট পরপর লোকেশন চেক করে। ফোন ধরতে দেরি করলে কী করে তা তো আমি নিজেই দেখছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভিডিও কল দিয়া দেখাইতে হয়—কই আছো, কার লগে আছো। ফেবু পাসওয়ার্ডও তার কাছে। এগুলা কি প্রেম? মাথা বেইচা দেওনের নাম প্রেম?’
ফরিদের কথায় যুক্তি আছে, অতনু বুঝে এইসব। কিন্তু সাথীরে রিপ্লেস করা যায় না। সে ভালোবাসে তারে। অন্য কোনো মেয়ের কথা চিন্তাও করা সম্ভব না। একবার এই ফরিদ এক মেয়ের সাথে পরিচয় করায়ে দিল, মালবিকা কুন্ডু নাম। দুই দিন অতনু কথাও বলছে, কিন্তু কোনোভাবেই জমে না। মাথায় খালি সাথী ঘুরপাক খায়।
এই যে আঙ্কেল! অনেকক্ষণ ধইরা ভাবতেছি একটা কথা কমু। আমার মানিব্যাগটা হারাইছি এইখানেই। বিকাল থেইকা খুঁজতেছি খেয়াল করছেন মনে হয়।
– ও আচ্ছা। আমি দেখি নাই।
– কাছেই বাস-স্ট্যান্ড। দিঘির পাড়ের বাস। নয়ডা বাজলেই বাস বন্ধ। বহুত বিপদে পড়ছি আঙ্কেল। ষাইট টেকা কইরা টিকেট। যদি একটু হেল্প করতেন। বাড়িত গিয়া আপনের বিকাশ নম্বরে…
– ও…কিন্তু!
– কিন্তুমিন্তু কইয়েন না বাবা। জুয়ান ভাতিজী নিয়া রাইতে কই থাকুম কন! পায়ে ধরি, একটু দেহেন। দুইশো টেকা দেন। আমার ভাতিজীরে আপনের পাশে বসায়া দিয়া যাই। আমি ধরেন এই গেলাম আর এই আইলাম। এই সামনেই দিঘির পাড় বাসস্ট্যান্ড।
– এই যে দুইশো টাকা। কিন্তু ভাতিজী রাইখা যাবেন মানে? এরে রাইখা যাবেন ক্যান? না না! এরে নিয়া যান।
– (ওই রুজিনা এইমিহি আয়া বয়) আংকেল, বুঝবেন না কী জ্বালায় আছি। একটু দয়া কইরা বইতে দেন।অতনুর মাথায় কিছু ঢুকতেছে না। সবকিছু এমন আচানক হইতেছে, সব কন্ট্রোলের বাইরে। রুজিনা তার পাশে বসা। শরীরের রং ছাইবর্ণ মেয়েটার, ঠোঁটটা আরজিনার শরীরের মতো চিকচিক করতেছে। নাকে সাদা পাথরের নাকফুল, সেইটাও হীরার মতো চিকচিক করতেছে। চোখে টানা কাজল। কালো মানুষ এত সুন্দর হয় কেমনে? দূরে যখন বইসা ছিল এত কালো তো লাগে নাই! আাচ্ছা, সে কি কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের ট্র্যাপে পড়ছে? ঐ চাচামিয়া তার ভাতিজীরে ক্যান তার কাছে দিয়া যাবে!
এই যে শুনছেন! আর কতখন বসায়া রাখবেন? চলেন ঐ দিকটায় যাই। ঝোপের পিছনেই আন্ধার।
– কী কও এগুলা। ঐ ব্যাটা কে তোমার? চাচা না!
– চাচা, তয় হেই চাচা না। রাইতে এই চাচা নাগর হইয়া যায়। তাতাড়ি চলেন তো!
– এই মেয়ে, চুপ থাকো।
আরে ফরিদ! তরে যে কী করতে মন চাইতেছে।- ওয়াও দাদা, ব্রেকাপ হওনের লগে লগেই শুরু হয়া গেছে! ব্রাভো। রিয়েল ম্যান!
– কী কছ্! এই মেয়েরে তার চাচা আমার কাছে জিম্মা রাইখা সামনের বাসস্টপে গেছে টিকেট কিনতে।
– অতনুদা, তুমি এহনও সত্য যুগেই আছো। এই মাইয়া স্লাট, আর তার কথিত চাচা পিম্প। এগুলা এইখানে নতুন নাটক শুরু হইছে। এরা বুইঝা ফেলছে কম্পিটিশনের যুগ, আর পুরুষেরা শিকার করতে ভালোবাসে। এইজন্য ভোলাভালা সাইজা কাস্টমাররে একধরনের বিনোদন দেয়। একচুয়ালি এরা প্রফেশনাল…..
– জ্বী ভাইজান! আপনের অনেক বুদ্ধি। আর একশো টেকা বাড়ায়া দেন। চলেন তিনজনে মিলা ঝোপের দিকে যাই। আমার লগে গাঁজাও আছে। চলেন চলেন।
– এই মেয়ে! থাপ্পর খাইছো?
দেখছস্ ফরিদ, কেমন সাহস! ঐ যে অর চাচা আইতেছে। অখনি সব ক্লিয়ার হয়া যাইব।
– ঐ মিয়া, তোমার ভাতিজী কী কইতেছে এইসব? দালালী তো ভালোই শিখছো।
– আংকেল এই নেন আশি টেকা। আর লাগব না। পকেটে যা ভাংতি আছে রিকশা ভাড়া হইয়া যাইব। ও আল্লা! রুজিনা কী কইছস? বেদ্দবী করছস?
– ভালোই ব্যবসা। দেখি টিকেট দেখি।
– এই যে ভাই দুইটা টিকেট।
ফরিদ ভালো কইরা টিকেট দুইটা চেক করতেছে। অতনুর মাথায় আবারও কয়েক ছিটা পানি পড়ল। মেয়েটারে এখন আর অতো কালো লাগতেছে না কেন কে জানে। ফরিদের তর্কাতর্কি আর ভাল্লাগতেছে না। অতনুর কী করা উচিত, সাথীরে আরেকবার ফোন দিবে? ফোন ধইরা যদি আবার ফরিদের গলা শুনতে পায়, তাইলে তো আরেক ভেজাল। আট বছর ধইরা এই প্রেম, এই সাথীরে ছাড়া সে কেমনে থাকবে! ফরিদরেই বরং বুঝায়া বলতে হবে। ফরিদ বুঝে সব, ওরে নিয়া ঝামেলা। তারপরও সে অতনুর পিছ ছাড়ে না। আকার ইঙ্গিতে অনেকবার বুঝাইতে চাইছে অতনু। কিন্তু ফরিদ ইচ্ছা কইরাই আঠার মতো লাইগা থাকে।
এই যে! আপনের বন্ধু কথার তালে পইড়া চাচামিয়ার লগে দূরে যাইতাছেগা। চলেন এই সুযুগ কাজে লাগাই। এই লন প্যাকেট, ব্যানানা ফ্লেভার।
– দূরে সইরা বসো রুজিনা। এক থাপ্পর খাইবা।
– আরে আসেন না।
– ঐ ফরিদ! আমি গেলাম, তুই থাক এগো লইয়া।
অতনু শরীর ঝাড়া দিয়া উঠে। রুজিনা হিহি কইরা হাইসাই যাইতেছে। অতনু পিছ ফিরা তাকাইতেই রুজিনা একটা বাজে ইঙ্গিত কইরা চোখ টিপ মারল। অতনুর মন খারাপ হয়া গেল। সাথীও হাসতে হাসতে এমন চোখ টিপ দেয়। সাথীর আরেকটা বদভ্যাস আছে, কথা বলতে বলতে অতনুর শার্টের বুতাম ঘুরানো। কত বুতাম যে ঢিলা হইয়া আছে, কতগুলির বুকের দিকে বুতামই নাই।
সাড়ে আটটা বাজে। অতনুর কেন জানি হলে যাইতেই ইচ্ছা করতেছে না। এই কাছেই পল্টনে নাকি ফরিদের মামার বাসা, সেইখানে গেলেও হয়। ফরিদের অবশ্য রাজি হওয়ার কথা না। সাথী একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করছে, ফরিদের বিষয়ে স্পেসিফিক কোনো তথ্য জানা নাই। যেমন ফরিদ কই থাকে, দেশের বাড়ি কই, কই পড়াশুনা করছিল। অথচ এই ফরিদ অতনুর বাড়ি তো আছেই, শরীয়তপুরে তার পিসির বাড়ি পর্যন্ত ঘুইরা আসছে।
আর কতক্ষণ এমন দাঁড়ায়া থাকতে ভাল্লাগে। ঐ বেটার সাথে কিসের এত কথা? ভাতিজীর দালাল হইলে হউক। ১২০ টাকা খাইলে খাউক। ধুর! অতনুর হাতে প্যকেটটা রইয়া গেছে। আজব… এইটা তো ম্যাগী নুডুলসের মশলার প্যাকেট! রুজিনা মেয়েটার বিষয়টা আসলে কী! মেয়েটা চরম ফাজিল আর অফকোর্স সে পতিতা না। পার্কের ভিতরে গিয়া আরেকবার কি রুজিনার সাথে কথা বলা উচিত? মেয়েটার প্রবলেমটা কী আসলে!
দাদা চলো। অনেক চাপাচাপি কইরাও শালার থিকা টাকা বাইর করতে পারলাম না। তবে সে বিকাশ করবে। আমি আমার নম্বর দিছি।
– ফরিদ, মেয়েটারে যা ভাবছস, তা না।
– দাদা, কাহিনী তো খারাপ। তোমার হইছে কী? আহো রিকশা লই, হলে দিয়া আসি। ভাইগ্য ভালো তোমার, আজকা সাথী আপা ভিডিও কল দেয় নাই। হাহাহা।
– আজকে হলে যাইতে ইচ্ছা করে না, ফরিদ। চল তোর মামার বাসায়।
– হে হে, আমারেই তারা রাইতে জায়গা দেয় না। লগে তুমি গেলে ত খবরই আছে। এর চাইতে চলো সামনের মাজারে গিয়া শুয়া থাকিগা। সকালে উইঠা সোনারগাঁ বেড়াইতে যামু। আমার মামতো ভাই জসীমের একটা মটর সাইকেল আছে, সেইটা দিয়া রওনা দিমুনে।
– হ, যাওয়া যায়। ঐ দিকটা ঘুইরা টুইরা পরে ট্রলার দিয়া বাড়িত যামু। মারে জানায়া রাখি তাইলে।
– হুররর্ দাদা! এতো আগেই জানানের দরকারডা কী?
তুমি আসলেই! সেইবার নীলগিরি যামু বইলা টেকাপয়সা জমা দিলাম, আর তুমি গিয়া সাথী আপারে জানাইলা। হেয় দিল ব্যাগরা।
– ওহ, সাথীরে ফোন দেওয়া দরকার।
– তাইলে তুমি হলে যাওগা। সে সাথীরে ফোন দিবে। সাথীর বিয়া সামনের সপ্তাহে, বুঝলা? পাত্র ডেনমার্কে থাকে।
– হু, বলছে আমারে।
– কখন কথা কইলা?
অতনু জবাব না দিয়া হনহনায়া হাঁটতে থাকে, বিরক্তিতে মুখ তিতা হয়া যায়। এত খবর ফরিদ জানে কেমনে? ওর জানারই বা দরকার কী? এর আগেও সে এই কাজ করছে। সাথী কই, কোন পোলার লগে বইসা… কোন রঙের জামা পইরা কী কী খাইতেছে সব ডিটেইলে জানাইত। এমনভাবে কইত, মনে হয় এই কামের জন্য ওরে অতনু পে করে। এখনো সে পিছে পিছে আসতেছে আর সাথীর বিয়া বিষয়ক সব তথ্য দিয়াই যাইতেছে। একবার কী হইল, সে সাথীর বিষয়ে গোপন এক্সক্লুসিভ সব তথ্য যোগাড় করছে। মোবাইলে ভিডিও কইরা আনছে সাথীর গাঁজা খাওনের সিন। অথচ এই কাহিনী নতুন না, অতনু জানে এইসব।
হাঁটতে হাঁটতে মাজারের সামনে আইসা দাঁড়াইছে অতনু। ফরিদ একটু দূরে মোবাইল কানে, আঙুল নাড়ায়া সে অতনুরে মাজারে ঢুকতে বলে। ভিতরটা ধুঁয়ার আন্ধার, খিচুরী রান্না হইতেছে। যেই মহিলা রানতেছে, তার একটা হাত দেখা যাইতেছে। তার বিশাল এক ঘোমটা, লাল কাপড় দিয়া সারা শরীর ঢাকা। অতনু হোগলায় বইসা রান্ধুনীর কারবার দেখে। সে পিতলের হাতায় কইরা চাইরবারে একেকটা মালসায় খিচুরি বাড়তেছে। অথচ দুইবারে এইটুক খিচুরি দেওন যায়। একটা সময় সেই মহিলা তারে ইশারায় ডাকে। আশেপাশে ফরিদরেও দেখা যাইতেছে না। অতনু আগায়া যাইতেই হাতে মালসা ধরায়া দেয়।
বাবা, আপনে তো তুলারাশি, এত রাইতে ঘরের বাইরে কেন?
– তাজ্জব ব্যাপার! আপনে পুরুষ মানুষ?
– হ বাবা, আমি আগুন আর ধুঁয়া সহ্য করতে পারি না। কিন্তু রান্দনের কাজটাও আবার আমারই।
– আমার রাশি তো তুলা না, মেষ। ধুয়া সহ্য করতে না পাইরা ঘুমটা দিছেন ঠিক আছে, কিন্তু খোঁপা কইরা ফুল মাথায় লাগাইছেন যে!
– সবকিছু আজকেই জানা লাগবে? বাবা, আপনারে একটা কথা বলি, মিলায়া দেখেন। সবার জন্য ছয় ঋতু, কিন্তু আপনের জন্য এক ঋতু। আপনে শীত কী জিনিস আজও অনুভব করেন নাই। আপনে নিদাঘ, আগুনের হলকা। আপনের জন্য এই দুনিয়ায় খালি গ্রীষ্মকাল আছে।
– ও, তাই!
– বাবা, সামনে আপনের বিপদ। অঙ্গহানি। এই বিপদ আপনে কাটাইতে পারেন এক শর্তে। এই মাজার থেকা তিনদিন বাইর হইবেন না। প্রচুর গরম লাগব, প্রচুর ডাক আসব… কিন্তু এই মাজারে পইড়া থাকতে হইব।
– আইচ্ছা ঠিকাছে। আমার সাথে বন্ধু আছে একজন। তারে বইলা দেখি।
– ভুল করতেছেন বাপধন, আপনের বন্ধু নাই।
লাল কাপড় পরা লোকটা ঝামটা মাইরা চইলা গেল। মনে হয় রাগ করছে। একটু দূরে গান হইতেছে, কয়েকজন লোক কেমন কইরা নাচতেছে। গান ও নাচের ধরনটা সিলেটী গো ধামাইল দেওয়ার মতো। অতনু খাওন হাত দিয়া সরায়া রাখে, ঘুমে চোখ ঢইলা পড়তেছে। ফরিদের বিষয়টা বুঝতেছে না সে, টানা এককঘণ্টা মোবাইলে ফিসফিস করতেছে। তার কোনো কথাই স্পষ্ট শোনা যায় না, মাঝেমইধ্যে শুধু ‘অপরেশন’ শব্দটা একটু শোনা গেল। অতনুর খুব পানির তিয়াস, ঘুমের ঘোরে চাইয়া সে ফরিদরে কয়েকবার ডাকে। ফরিদ কোত্থাও নাই।
সকাল আটটা বাজে। দুইটা লোক মাজারের ফ্লোর ঘইষা ঝকঝকা কইরা ফেলছে। তাদের কানেও ফুল গোঁজা। মনে হয় ফুল নিয়া এই মাজারে কোনো আচার আছে। অতনু মোবাইলের দিকে তাকায়ে দেখে সাথীর কল।
তুমি কই?
– বলা যাবে না, জানলে রাগ করবা।
– তুমি ব্রোথেলে, আমি জানি। তুমি মানুষ না। অতনু তুমি তলে তলে কতদূর যাইতে পার জানতাম। এইজন্যই…..
– থামো তো তুমি। আমি একটা মাজারে আছি, রাতেও ছিলাম এইখানে।
– তুমি সারারাত প্রস্টিটিউটের সাথে ছিলা। খবর পাইছি আমি।
– সাথী, প্লিইজ। তোমার এই সন্দেহ বাতিক নিয়া জীবনেও সুখী হইতে পারবা না।
– একদম চুপ, শুওরের বাচ্চা। কোনো যোগাযোগ করবি না আমার সাথে।
– সাথী!
অতনুর ঘাম দিয়া সারা শরীর গোসল হয়া গেছে। মাথা দিয়া খালি আগুন বাইর হইতেছে। গোসল করতে পারলে মাথাটা ঠান্ডা হইত। মাজারটায় গোছলের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ফরিদ সমানে চিল্লাইতেছে। সে মামাতো ভাইয়ের কাছ থিকা বাইক আনছে, এখন তার মামার বাড়িতে নাকি তুলকালাম কাণ্ড। এখন যেইটা করতে হইব সেইটা হইলো তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া, আর সোনারগাঁ ঘুইরা টুইরা বিকালের মইধ্যে বাইকটা ফিরত দেওয়া। কিন্তু অতনুর কোনোখানেই যাইতে ইচ্ছা করতেছে না। গতরাইতের রাইন্ধইন্যা লোকটা আগায়া আসতেছে তার দিকে। এখন তারে লুঙ্গি ফতুয়ায় নরমাল লাগতেছে। সে কথা বলতেছে না, হাতে ইশারায় থাকতে বলতেছে। এই লোকের হাতে যে চাইরটা আঙুল সেইটা গতরাতে চোখে পড়লো না ক্যান! আজব!
দাদা, তুমি কি আসলে যাবা? চলো তো। যেইখানেই যাও, লেটকা মাইরা বইসা পড়ো।
– ফরিদ, মাজারের খাদেম আমারে তিনদিন থাকন-খাওনের দাওয়াত দিছে। জায়গাটা পছন্দ হইছে আমার।
– অতনু দা, সবারই লাভ-লাইফে ঝামেলা হয়। সেইজন্যে এমন করবা তুমি? এই মাজারগুলি হইলো দান্দালের জায়গা। পয়সার লাইগা এমন কাহিনী করে অরা।
– তা ঠিক। কিন্তু আজব ঘটনা আছে একটা। ঠাকুরদা আমার কুষ্ঠী করছিল নিজ হাতে। কাগজের পিছনে লাল কালি দিয়া ‘নিদাঘ’ শব্দটা লেখা। অনেকরেই এই বিষয়টা দেখাইছি, কেউ কিছু বলতে পারে নাই। অনেকদিন পর এই লোকের মুখে এই শব্দটা শুইনা আশ্চর্য হইছি। সে স্পষ্ট বলছে—তুমি নিদাঘ।
– তুমি না, অতনু দা! এই যুগে কুষ্ঠী আর মাজার নিয়া আসলা? ওকে বুঝছি, তুমি যাইবা না। আমি গেলাম জসীম ভাইয়ের কাছে, বাইক দিয়া আসি।
– না, চল যাই। ঐদিক দিয়া বাড়ি যামু।
সাত দিন পর
গায়ত্রী সান্যাল ছেলে অতনুর পায়ের কাছে বসা। নার্স রেবা অতনুর অবস্থা নিয়া বলতেছে…
একটা লোক অতনুরে এমার্জেন্সিতে ভর্তি করানোর সময় নোট লিখা দিয়া গেছে। বাইক এক্সিডেন্ট, অতনু কোমরে আর পেটে আঘাত পাইছে। একটা ক্লিনিকে চারদিন ট্রিটমেন্টের পর অতনুর সঙ্গের জন মারা গেছে। তার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নাই বইলা বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করা হইছে।
গায়ত্রীর চোখে জল। ফরিদ ছেলেটা খুব ভালো ছিল। গত ঈদে ফরিদ অতনুরে মলম পার্টির হাত থেকা বাঁচায়া বাড়িতে নিয়া আসছিল। মাসীমা মাসীমা বইলা পাগল হয়া যাইত। আহা বেচারা।
অতনু ফরিদের বিষয়টা জানে না। অতনু জাইগা উঠার পর গায়ত্রী একবার এক্সিডেন্টের কথা জানতে চাইল, অতনু মনেই করতে পারতেছে না। সে বারবার বলে—মা! এক সাধু আমারে সাবধান করছিল। বলছিলো. ..নিদাঘ! নিদাঘ! দেখো মা আমার ভিতরটা কেমন পুড়তেছে।
সুদীপ বাবু রিপোর্ট নিয়া ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেছিল। তিনি বললেন, এগুলা এক্সিডেন্টের ইনজুরী না। অরগান মিসিং কেইস, অতনুর একটা কিডনি নাই। ডাক্তার দ্রুত পুলিশরে জানাইতে বলল। তার থেকেও জরুরি ওরে ঢাকায় কোথাও এডমিট করা। আরেকটা যে কিডনি, সেইটাও কাজ করতেছে না।
এইদিকে, ফরিদ চুল ফালায়া দিছে…দাড়ি বড় করতেছে। নতুন এ্যাসাইনম্যান্ট নিবে তিন মাস পর। এই কাজগুলিরে সে আর্ট হিসাবে নিছে। এগুলার প্রস্তুতি বিশাল জিনিস। অতনু, রশিদ, মিলা, নজরুল, বাদল, লিপি…এদের জন্য তার খারাপ লাগে না। আফটার অল, হি ইজ আ পারফর্মার!