১৪৮০ বার পঠিত
কাকন রেজা:
প্রশ্নটা হলো ধর্ষণ বা নির্যাতনটা খারাপ না ভিডিও ভাইরাল করাটা খারাপ। নিঃসন্দেহে দুটোই খারাপ। মুশকিল হলো আমাদের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এ দুটোর একটা খারাপকে ভালো হিসেবে মেনে নিতে হবে। ভিডিও ভাইরাল না হলে এ দেশে কোন বিচারিক কাজ দ্রুত হয় না। ভিডিও থাকলেই শুধু বিচারের গতিটা পায়। রিফাত হত্যার ভিডিও ছিলো বলেই বিচারিক কার্যক্রম গতি পেয়েছে। নোয়াখালীর নারী নির্যাতনের ভিডিওটা ছিলো বলেই নির্যাতনের মাত্রাটা চোখে পড়েছে। না হলে, বলা হতো নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সুতরাং এখন অভিযোগ প্রমান করতে ভিডিওটা জরুরি। সে কারণেই ভিডিও ভাইরাল করাটাকে মন্দের ভালো বলতে হয়।
ওই যে কিশোরকে পিটিয়ে মারা হলো তার ভিডিও না থাকলে প্রভাবশালীরা বলতো, ওতো এমনি এমনি পটল তুলেছে। সুতরাং ভিডিও এর ভূমিকা অস্বীকার করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আর যদি অস্বীকার করা হয়। তাহলে এই যে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, খুন, দখলের ঘটনাগুলোকে ভালো বলতে হয়। এসব ঘটনার প্রমানের ভিডিও ভাইরাল করা যদি দোষের হয়, তবে লজিক্যালি ঘটনাগুলো নির্দোষ হয়ে দাঁড়ায়। এটা কোনো কঠিন লজিক নয়, সহজ ও বোধগম্য লজিক।
নোয়াখালীর ভিডিওটা সুস্থ মাথার মানুষেরা কি সম্পূর্ণ দেখতে পেরেছেন? জানি পারেননি। সম্ভব নয়। এ রকম অনেক ভিডিও ক্লিপই সম্পূর্ণ দেখা সম্ভব হয় না। রিফাতকে কোপানের দৃশ্য, বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মারার দৃশ্য সুস্থ মানুষের মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে অক্ষম। এতে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। মানুষ ক্রমশ নিরাবেগ হয়ে ওঠে। শুভ চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। তা সত্বেও আমাদের বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ভিডিওটা জরুরি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে সবারই সাথে একটা গোপন ক্যামেরা রাখা উচিত, যাতে সকল দৃশ্য রেকর্ড হয়। যেন সে আক্রান্ত হলে, মারা গেলে ভিডিওটা থেকে যায়। তাহলেই যদি বিচারের গতি ত্বরান্বিত হয়।
সাগর-রুনি হত্যার ভিডিওটা থাকলে হয়তো বিচার বিলম্বিত হতো না। তদন্ত রিপোর্ট পেছাতো না। সাংবাদিক ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা ধরা পড়তো। তনু-আফসানারা বিচার পেতো। অন্তত রায়টা হতো। তারপরের কথা পরে। হত্যাকারী চিহ্নিত করাই এখন বড় ব্যাপার। অন্তত তাদের থেকে অন্যদের সাবধান থাকার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। যেহেতু নিজের নিরাপত্তা নিজেরই নিশ্চিত করতে হবে। কথা তো সত্য, বাড়ি-বাড়ি কিংবা শোয়ার ঘরে জনে-জনে নিরাপত্তা দেয়া তো সম্ভব নয়। এত লোকবলই বা কোথায়। যা আছে তার একটা বড় অংশই তো প্রটোকল মেইনটেইন করতেই খরচ হয়। বাকিটা যায় ‘সরকার’, ‘অনভূতি’ এবং ‘রাষ্ট্রবিরোধী’তায় অভিযুক্তদের আটক আর ফাটকে দিতে। তারপরেও যা বেঁচে থাকে তারো নানান কাজ রয়েছে। কাজের আর কি শেষ আছে? জানি তো, নেই।
যাক গে অকাজের কথায় আসি। এই যে ঘটনা ঘটার পর কিছু লোকের মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের নামে চিৎকার করে। বড় বড় কথা হয়। তারপর সব শেষ। এমন প্রতিবাদের ধারা কী আদৌ কোনো কাজে আসছে? কিংবা প্রতিবাদের কি ধারাবাহিকতা রয়েছে? এক, দুই, উর্ধ্বে সাত দিন প্রতিবাদের আয়ু। তারপর সব বায়ুতে মিলায়। প্রথম দিনে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়। দ্বিতীয় দিন বাড়ে। তৃতীয় দিন থেকে কমতে থাকে। সাতদিনের মাথায় থাকে সাত জন। এটাই বাস্তবতা। আমাদের দেশের একটা শ্রেণি আছে যারা কিছু ঘটলেই শাহবাগ মোড়ে বা প্রেসক্লাবের সমুখে দাঁড়িয়ে যান। এ দাঁড়িয়ে যাওয়াটা মূলত প্রতিবাদ না নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য, এমন প্রশ্নটা থেকে যায়। কারণ সপ্তাহ শেষে সেই প্রতিবাদে উপস্থিতির সংখ্যা ঠেকে সাতে। প্রথম দু’তিন মিডিয়ার আধিক্য থাকে, অ্যাটেনশনটা পাওয়া যায়। পরে মিডিয়াও থাকে না, অ্যাটেনশন সিক করাও হয়ে উঠে না। অতএব অবস্থা ও সংজ্ঞা অনুযায়ী এমন প্রতিবাদ অ্যাটেনশন সিকিংয়ের মধ্যে পরে। প্রতিবাদকারীরা অ্যাটেনশন সিকার।
না, এমন কথায় রাগ করার কোনো কারণ নেই। নেই এ কারণে যে, আজ পর্যন্ত আপনাদের প্রতিবাদে কোন কিছুই বন্ধ হয়নি। নিজেরাই চিন্তা করে দেখুন, সব কিছুতেই প্রতিবাদ করেছেন। দাঁড়িয়েছেন শাহবাগে কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে। লাভ হয়েছে কি? হয়নি। ধারাবাহিক যখন কোন চিন্তা বা কৌশল কাজ না করে তখন সে চিন্তা বা কৌশল নিয়েই চিন্তা করতে হয়। ভাবতে বসতে হয়। অথচ সেই ভাবতে বসার সময় আন্দোলনকারী আপনাদের হয়নি। সঙ্গতই ধর্ষণ, খুন, গুম, নির্যাতনের ধারাবাহিকতা থামেনি। উল্টো ক্রমবর্ধমান হয়েছে। হিসেব করে দেখুন এই ব্যর্থতা আপনাদের।
প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে? এই প্রশ্ন এবং তার উত্তরটা জরুরি। আপনারা যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের প্রতি দেশের আমজনতার বিশ্বাস কতটুকু? কিংবা আপনাদের সাথে সাধারণ রিকশাওয়ালা থেকে গলির দোকানদারের মানসিক যোগাযোগ কতটুকু? আপনারা তাদের চিন্তার সাথে কতটুকু যুক্ত হতে পেরেছেন? আপনাদের কারো প্রগতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কিংবা মার্ক্সবাদের আলাপ সাধারণের চিন্তা বা মস্তিষ্ক নিতে পেরেছে কি? তাদের কি আপনারা প্রস্তুত করতে পেরেছেন এমনসব আলাপগুলোয়? সোজা এবং এক কথায় পারেননি। কেনো বলি, তাদের কাছে যখন আপনি জটিল তত্ত্বে সবকিছু ব্যাখ্যায় করতে যান। তাদের কাছে অচেনা যে ভাষা, সে ভাষায় কথা বলতে গেলে, তারা আপনাকে বুঝতে পারে না। আপনাকেও তাদের কাছে অচেনা মনে হয়। আপনাদের বলা কথাকে অযথা মনে করে। কারণ আপনি সোজা কথায় তাদের বলতে পারেন না, ‘আপনার এই জিনিসটা নাই তার জন্য দায়ি অমুক। আপনি এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। আপনার সন্তান, পিতা, ভাই হত্যার বিচার পাচ্ছেন না এরজন্যে দায়ি এই লোকগুলো।’ আপনি পরিষ্কার ভাবে কোনো কিছুই চিহ্নিত করতে পারছেন না। আর পারবেনই বা কী করে। আপনার-আপনাদের তো ম্যালা হিসেব-নিকেশ করতে হয়। রিপ্লেসমেন্টের কথা ভাবতে হয়। রিপ্লেসমেন্টে আপনার-আপনাদের লাভ কতটুকু তার যোগ-বিয়োগ করতে হয়। আপনার ও আপনাদের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এই যোগ-বিয়োগে কিন্তু সেই রিকশাওয়ালা বা গলির দোকানদার অর্থাৎ সাধারণ মানুষ মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যায়। থাকে শুধু আপনি-আপনারা আর এস্টাব্লিসমেন্ট। আপনার তত্ত্বের সমাপ্তি ওইখানেই এবং প্রতিবাদেরও।
এর বাইরেও কথা রয়েছে। আপনারা সংখ্যায় অল্প। অল্প কারণ, আপনারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি অহেতুক তত্ত্ব কপচাতে গিয়ে। আস্থা অর্জন করার প্রথম শর্ত হলো মানুষের কাছে সহজেবোধ্য হওয়া। আপনারা তত্ত্বের জালে জড়িয়ে সেই সহজবোধ্যতা হারিয়েছেন। সাধারণ মানুষ আপনাদের ব্যঙ্গ করে বলে ‘তাত্ত্বিক আইছে’। তাই সাধারণ মানুষের কথা বললেও, তাদের দাবির পক্ষে বললেও মানুষ আপনাদের আস্থায় রাখে না, বিশ্বাস করে না। উল্টোদিকে তারা যাদের বিশ্বাস করে আপনি-আপনারা তাদের বিশ্বাস করেন না। এখানেও সেই এস্টাব্লিসমেন্টের প্রশ্ন। সে প্রশ্নে যখন আপনি-আপনারা তাদের মুখোমুখি হন তখন আপনার সামনে থাকে শুধুই সম্ভাব্য এস্টাব্লিসমেন্ট। তারা এস্টাব্লিস্ট হলে আপনাদের কী হবে। এমন ভাবনার জটিলতায় সাধারণ মানুষ এবং তাদের না পাওয়াগুলো আবার হাওয়া হয়ে যায়।
এই যে মানুষের আস্থার জায়গায় না যেতে পারা, এটা আপনাদের যেমন অযোগ্যতা। তেমনি মানুষের আস্থায় যারা আছে তাদের সাথে কৌশলগত যোগাযোগেও রয়েছে আপনাদের চরম ব্যর্থতা। এই যে অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তিনপক্ষই। সাধারণ মানুষ ক্রমাগত নির্যাতন, ধর্ষণ বা হত্যাকান্ডের মুখোমুখি হচ্ছে। আপনার মুখোমুখি হচ্ছেন জেল-জুলুমের। অপরপক্ষ যারা সাধারণের আস্থায় রয়েছে কিন্তু আপনাদের অনাস্থায় তারাও চরমভাবে নিগৃহিত হচ্ছেন। সুতরাং এই যে ট্রায়াঙ্গেল। ত্রিভুজ দ্বন্দ্ব। এটা কিন্তু ভয়াবহ। এই ত্রিকোন দ্বন্দ্বেই আটকে রয়েছে মূল সমাধান। এটা যতক্ষণ আপনারা না বুঝে উঠতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের প্রতিবাদ নিরর্থকই থেকে যাবে। আর জুলুম হবে ‘টু বি কন্টিনিউড’।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন