১০০২ বার পঠিত
আধুনিক এবং চরম সভ্যতার যুগে বসবাস করেও চলছে এক নীরব নির্যাতন। আর সে নির্যাতন চলছে একান্ত নিভৃতে, গৃহে চার দেয়ালের ভেতরে।
নির্যাতন শব্দের সাথে দৈহিক নির্যাতনের কথা স্বভাবতই মনে আসে। কিন্তু,না এই নির্যাতন যতটুকু মানসিক ততটুকু শারীরিক নয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন যিনি, ডাক্তারের ওষুধে ভালো হয়ে উঠার সুযোগ রয়েছে। মানসিক নির্যাতন ক্ষয় করে মনকে, পঙ্গু করে দেয় এবং অথর্ব করে দেয় তার চিন্তা চেতনাকে।
এর শিকার হচ্ছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী। উচ্চবিত্তেও আছে, নিম্নবিত্তেও অনেক আছে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায় সামাজিক দায়বদ্ধতা তাদের অনেক কম থাকে।
এই নির্যাতনের নাম ‘পরকীয়া প্রেম’ ইংরাজিতে যাকে বলে Extra-marital affair.
এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে পারি ব্যাপারটাকে।
অতীতের নির্যাতন, ধর্মীয় প্রভাব , সামাজিক প্রেক্ষাপট সর্বদায় নারীর বিপক্ষে অবস্থান, এবং পরিত্রানের পথ ইত্যাদি।
অতীতে মানসিক নির্যাতন পর্যালোচনা দেখা যায় জমিদার প্রথা, রাজা বাদশাহ বা এইসব উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিগন মনোরঞ্জনের জন্য কর্মকাণ্ড করতেন বহির্বিশ্বে বা নিজ দেশে এ জন্য তাঁদেরকে কোন অপরাধী বলে গণ্য করা হতোনা। তাদের এক বা একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিল বাগানবাড়ি। ছিল রক্ষিতা ইত্যাদি।
অবধারিতভাবে তাদের স্ত্রীরাও এই সব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন সারাজীবন। যেনো তারা ধরেই নিয়েছিলেন নারীমাত্রই সম্ভোগের বস্তু। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাই তারা স্বামীগণের বহুগামিতাকে মন্দ চোখে দেখার সাহস করেন নি।
অতীতে এইরকমভাবে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করে রক্ষিতা বা বাঈজী রাখা হতো। রাজা বাদশাহ বা জমিদারগণ তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য অধিক সময় সেখানেই ব্যয় করতেন।
রাজা বাদশাহর স্ত্রীরা একপ্রকার জড়বস্তুর মতোই নানান সাজসজ্জায় নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। একসময় তাদের রাজত্বের অবসান ঘটে। অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হয়। সেইসাথে সভ্যতার আলো প্রবেশ করতে শুরু করে। একদিকে ইংরেজ রাজত্ব দমন নীতি চালিয়েছিল, কিন্তু কিছু সভ্যতার আলো আমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছিল তা অতি সত্য কথা।
বর্তমান সভ্যতার আলোকে এই আলোচ্য বিষয়টা প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বামী অফিসে যান বা কর্মক্ষেত্র যার যেখানে অবস্থান। সেখানে নারী সহকর্মী থাকেন অথবা যেখানে থাকেন না সেখানেও দেখা যায় অনেকক্ষেত্রে পরকিয়া প্রেমে আসক্ত হন। হয়তো প্রশ্ন হবে ব্যপারটা তো একররফা হয় না। দুই বা ততোধিক জনের জড়িত হয়েই ঘটনা ঘটে থাকে। মেনে নেয়া যায় যুক্তি।
স্বামী ঘরে ফেরেন কিন্তু অশান্তির কালো মেঘ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হতে থাকে। স্ত্রীর নানা কারণে অবহেলা শুরু হয়। চার দেয়ালে আবদ্ধ গৃহবধুটা নিষ্পেষিত হতে থাকেন। তাদের মাঝে কলহ বিদ্বেষ শুরু হয়। আর স্ত্রী যদি হন স্বামীর উপার্জনে নির্ভরশীল তাহলে তো কথাই নেই। অশান্তি এমন চরম আকার ধারণ করে যে স্ত্রীকে একসময় বাধ্য করা হয় গৃহত্যাগে।
ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায় সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ওপরে। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে সন্তানদের মাঝে দেখা যায় এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ। তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। স্ত্রীরাও সামাজিকভাবে হেয় হতে থাকেন। শোনা যায় নানা কথা। একান থেকে সে কান। স্ত্রীরাই নাকী স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পারেন না তাই তারা হন বহির্মূখী।
এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ কী বলেছেন তা দেখে নেয়া যাক,
“ পুরুষ নারীকে গৃহে বন্দী করেছে,তাকে সতিত্ব শিখিয়েছে, সতীত্ব নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকে করে তুলেছে নিজের গৌরব। পুরুষ উদ্ভাবন করেছে নারী সম্পর্কে একটি বড় মিথ্যে, যাকে সে বলেছে চিরন্তন নারী। তাকে বলেছে দেবী, শ্বাশ্বতী, কল্ল্যাণী, গৃহলক্ষী, অর্ধেক কল্পনা ;
কিন্তু, পুরুষ চেয়েছে ‘চিরন্তন দাসী’। পশ্চিমে নারীরা শোষিত, তবে মানুষ-পুরুষ দ্বারা শোষিত; আমাদের অঞ্চলে নারীরা শোষিত পশু-পুরুষ দ্বারা। এখানে পুরুষেরা পশুরই গোত্রীয়, তাই বঙ্গীয়, ভারতীয়, আর পূর্বাঞ্চলীয় নারীরা যে শোষণ পিড়নের শিকার হয়েছে, পশ্চিমের নারীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।“
[নারী- হুমায়ুন আজাদ-পৃঃ১৫]
ধর্মীয় কারণগুলো আলোচনায় আনতে গেলে অবধারিতভাবেই অনেকগুলো বিষয় এসে পড়ে। ইসলামধর্মের বা হিন্দু যে কোনো ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যেতে পারে বহুগামিতা, দাসীর সাথে সহবাসে সম্মতি প্রদান, একের অধিক বিবাহে অনুমতি, নারীর মানসিক নির্যাতনের সাথে তা ওৎপ্রোত বে জড়িত।
প্রশ্ন আসতে পারে যে অনেক পূরণো আমলে বা ১৪০০ সালে কী হয়েছিল তা ছিল ভিন্ন কথা। এখনকার পটভূমিতে তা আসেনা।
কিন্তু একথা কেউ অস্বীকার করতে পারিনা, যে শিশুটি ধর্মীয়ভাবে অনুশীলন করে এসেছে তার ছায়া বা তার প্রভাব বড় হয়ে উঠা যুবকের ওপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়বে না। যে দেশে ধর্মের ওপরে ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করা হয় সে দেশে কেন প্রভাবে পড়বেনা? নিশ্চয় বলা যেতে পারে ষোলোআনা প্রভাব পড়বে। ধর্মীয়ভাবে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নারীকে কীভাবে দমন করে রাখা হবে সেই নির্দেশ দেয়া আছে।
এই প্রসঙ্গে কিছু কথায় আসা যাক-
“ বাঙ্গালি সমাজকে অবদমমিত কাম-দিয়ে ঘেরা সমাজও বলা যায়; এবং ওই অবদমন নিয়মিতভাবে প্রকাশ পায় ধর্ষণরুপে। তবে শয্যায় তাদের আচরণ সম্পর্কে কিছু জানা যায়না। বাঙ্গালি নারীপুরুষের কাম জীবন সম্পর্কে কিন্সে ও অন্যান্য পুরুষের যৌন আচরণ (১৯৪৮) নারীর সাড়ার (১৯৫৩) বা মাস্টার্স জনসনের মানুষের যৌন সাড়ার (১৯৬৬) মতো বই লেখা হওয়ার কোন সম্ভনবা নেই, তবে এ বিষয়ে যে কিছুই লেখা হয়নি, তাতে বোঝা যায় বাঙ্গালির কাম জীবন সুস্থ নয়। যা গোপন করে রাখা হয়, তা সাধারণত অসুস্থ হয়ে থাকে।
এটা নিষিদ্ধ বিষয়; আর এর পীড়ন ভোগ করে নারী। বাঙ্গালি নারীর যৌনজীবন বলৎকার ও চরম বিরক্তির অবসাদের সমষ্টি। উচ্চ শিক্ষিত কিছু নারী আমাকে জানিয়েছেন তাঁরা পূলক সম্পর্কে কিছু জানেন না তাদের স্বামীরা লাফ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছেন, এই তাদের চাঞ্চল্যকর কামজীবন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা সাধারণত ভোগ করে স্বামীর বলৎকার। বাংলাদেশের প্রতিটি শয্যাকক্ষ যদি থাকে, নারীর জন্য অবসাদ কক্ষ বা বিরক্তিকর অবসাদ কক্ষ।
[নারী-হুমায়ুন আজাদ পৃঃ২২৭]
এই থেকে আমরা জানতে পারি একান্ত ভেতরের গোপন কথা যা বাইরে কম প্রকাশ পায়। পেলেও ছিঃছিঃ রব উঠবে। জানামতে একজনের কাহিনী তুলে ধরা যাক –
স্বামী বহুগামী। এবং স্ত্রী স্বামীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। স্বামী গৃহপরিচারিকার সাথে শয়ন করতে বা সহবাস করতে পছন্দ করতেন (অবশ্যই অগোচরে)। তাই স্বামীকে কাছে পাবার জন্য স্ত্রীটি গৃহ পরিচারিকার কাপড় পরিধান করে স্বামীর কাছে নিজেকে উন্মোচিত করতেন। কেননা ওই গৃহপরিচারিকার কাপড়ের গন্ধ ছাড়া স্বামীর কাম উদ্রেক হতো না।
বিয়ের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক বিয়ের পরে হয়ে পড়ে অতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। অথচ ভালোবাসার প্রথম শর্তই হচ্ছে বিশ্বাস।
ভালোবাসা বোধকরি এখন একটা আভিধানিক শব্দ হয়ে গিয়েছে। পরিশেষে এই বলে শেষ করি-
‘তুমি আমায় বিশ্বাস দাও
আমি তোমায় রঙিন জীবন দেব’
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
আগস্ট ২৬, ২০১৭; ৮:৪৬ অপরাহ্ন
সুন্দর লিখা।