‘সাইজ ডাজ ম্যাটার’, গডজিলার মত বড় প্রাণির ক্ষেত্রে আকার যেমন একটা ফ্যাক্টর, ছোট ছোট কণিকার ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। ন্যানোবস্তুর ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এর আকার এবং আকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সংজ্ঞানুযায়ী, কোন বস্তুকণিকার দৈর্ঘ্য বা প্রস্থের যে কোন একটি মাত্রা যদি ১০০ ন্যানোমিটারের চেয়ে কম হয় তাহলে সেটা ন্যানোবস্তু বলে পরিগণিত হবে।
আমেরিকার National Nanotechnology Initiative(NNI) এর মতে ন্যানোপ্রযুক্তির সংজ্ঞা –
“A science, engineering, and technology conducted at the nanoscale ( 1 to 100 nm), where unique phenomena enable novel applications in a wide range of fields, from chemistry, physics and biology, to medicine, engineering and electronics.”
ন্যানোপ্রযুক্তির কাজ হলো ন্যানো মাত্রায় বস্তুর আকার এবং আকৃতির পরিবর্তন করা এবং ন্যানোমাত্রার কারণে বস্তুর নতুন ধর্মের উপস্থিতির সন্ধান ও সেটার ব্যবহার।
আধুনিক বিজ্ঞান খুব বড় বস্তু যেমন গহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, মহাবিশ্ব ইত্যাদি নিয়ে যেমন গবেষণা করে তেমনি আবার খুব ক্ষুদ্র বস্তু নিয়েও গবেষণা করে। মহাবিশ্বের বড় বড় বস্তু পর্যবেক্ষণ করে আমরা অনেক জেনেছি, আরো অনেক জানার বাকি আছ। তবে মহাবিশ্বের প্রকৃত আকার জানা না থাকায় সেটাতে একধরণের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়ে গেছে। অপরদিকে ছোট আকৃতির বিষয়গুলো মানুষের হাতের নাগালে আছে। মানুষ অণু, পরমাণু, এমনকী পরমাণুর গঠন উপাদান ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন সম্পর্কে অনেক জানে।
অনু-পরমাণুর জগতে মানুষ ন্যানোমিটার আকারের বস্তু সম্পর্কে জানতে পারলেও সেগুলোকে গবেষণাগারে তৈরি করা হতো না। ন্যানোপ্রযুক্তি আসার আগে বিজ্ঞানীদের ব্যবহার্য্য বস্তুর উপাদানগুলোর সর্বনিম্ন আকৃতি ছিল মাইক্রোমিটার পর্যন্ত। যে কারণে বিজ্ঞানীরা মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে সেগুলোকে দেখতে পেতেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সাধারণ গুড়া, পাউডার এগুলো সব মাইক্রোমিটার সাইজের। প্রাণিজগতে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার আকার মাইক্রোমিটার পর্যায়ে, সেজন্য সেগুলোকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায়।
আমেরিকান বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান আধুনিক সময়ে ন্যানো প্রযুক্তির ধারণা প্রচার করেন। ১৯৫৯ সালে ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সভায় তিনি একটি বক্তব্য দেন যার শিরোনাম ছিল, “There’s Plenty of Room at the Bottom”। সেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন আমরা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ২৪ খন্ডকে একটা আলপিনের মাথায় লিখতে পারব না?
“Why can’t we write the entire 24 volumes of the Encyclopedia Britannica on the head of a pin?”
এতে তিনি অনু পরমাণু মাত্রার যন্ত্র আবিষ্কার করার কথা বলেন। তাঁর প্রকল্প সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে আধুনিক ন্যানো প্রযুক্তির জনক বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি ফাইনম্যান সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। তখন তার আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘Surely You’re Joking, Mr. Feynman! (Adventures of a Curious Character)’ পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম। পদার্থবিদ্যার উপরে তাঁর দেয়া লেকচারগুলো ‘ ফাইনম্যান লেকচার সিরিজ’ নামে পরিচিত। অনেকের মতে এই লেকচারগুলো পদার্থবিদ্যার লেকচারের জন্য আদর্শ। ২০০৬ সালে ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে আমার আগ্রহ শুরু হবার আগে ফাইনম্যানের এই ভবিষ্যতবাণীর ব্যাপারটা জানা ছিল না। ফাইনম্যান আসলেই একজন জিনিয়াস ছিলেন, পদার্থবিদ হয়েও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নানা বিষয়ে সমস্যার সমাধান ও নতুন দিক নির্দেশ করে গেছেন।
ফাইনম্যানের পনের বছর পরে ১৯৭৪ সালে নরিও তানিগুচি নামের এক জাপানি বিজ্ঞানী ন্যানো প্রযুক্তির সংজ্ঞা দেন,
“nanotechnology mainly consists of the processing of separation, consolidation, and deformation of materials by one atom or one molecule”
বিশ শতকের শেষ দিকে ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহ তৈরি হবার পরে ন্যানোবস্তু উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি বের হয়। এসব পদ্ধতিকে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, তার একটা হলো ছোট থেকে বড় আকারের বস্তু তৈরি করা। পরমাণু পর্যায় থেকে শুরু করে পরমাণুর সাথে পরমাণু যোগ করে বা অণুর সাথে অণু যোগ করে ন্যানো আকারের বস্তু তৈরি করা। আরেকটি পদ্ধতি হলো বড় থেকে ভেঙ্গে ছোট করতে করতে ন্যানোবস্তু তৈরি করা, একাজে সূক্ষ মেশিনাদির ব্যবহার করতে হয়। ইংরেজিতে এই দুই বলা হয় ‘বটম আপ’, আর ‘টপ ডাউন’।
ন্যানোবস্তুর ছোট আকারের কারণে তাদের উপরিতলের আয়তন অনেক বেশি হয়, মানে তারা অন্য আরেকটা তলের সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত থাকতে পারে।
অণুর আকার ন্যানোমিটার হলেও আমরা সেগুলো বড় আকারে দেখি, সূক্ষ কণিকাগুলো একে অপরের সাথে জড়িয়ে বড় মাইক্রোমিটার সাইজের কণিকা তৈরি করে। ন্যানোবস্তুকে সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যাবে না তার জন্য বিশেষ ধরণের প্রযুক্তি লাগবে, স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, টানেলিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ন্যানোবস্তুর ছবি তোলা হয়।
ন্যানোবস্তুর আকারের সাথে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয় সেগুলো হলো- গলনাংক, বিক্রিয়ার ক্ষমতা, যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, আলোক, বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় গুনাবলী এগুলো সব বস্তুর আকারের উপর নির্ভরশীল।
আকৃতির কারণে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয় তার একটা হলো প্রভাবকের ক্ষমতা। প্রভাবকের ক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য ‘তালা-চাবি’ তত্ত্ব দিয়ে আমরা বুঝতে পারি প্রভাবকের ক্ষেত্রে আকৃতির একটা ভূমিকা আছে। চাবি যেমন একদম খাপের খাপ না মিললে তালা খোলে না, প্রভাবককে ঠিক তেমনি অণুর যেই এলাকায় কাজ করবে সেই এলাকায় তালার খাঁজে চাবির মত মিলে যেতে হবে। ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে প্রভাবকের স্থানিক অবস্থান ও আকৃতির উপরে প্রভাবকের কার্যকারিতা নির্ভর করে। প্রভাবক কাজ করতে হলে তার একটিভ সাইট খোলা থাকতে হবে, ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে প্রভাবক এমনভাবে অবস্থান নিবে যাতে করে সক্রিয় এলাকা অন্য বস্তুর সাথে যুক্ত হতে পারে।
তথ্য সংরক্ষণের জন্য ন্যানোবস্তুর আকৃতি কাজে লাগে। বস্তুকণা যত ছোট হবে ততো তাদের প্যাকিং ভালো হবে, বস্তুকণার মধ্যকার খালি স্থান কমে আসবে, ফলে তারা যেকোন ক্ষুদ্র এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে। ন্যানোমিটার আকারের বস্তুর পৃষ্ঠতলের আয়তন অনেক বেশি হওয়ায় অল্প পরিমাণ ন্যানোবস্তু দিয়ে বেশি পরিমাণ এলাকা স্বচ্ছভাবে আচ্ছাদন করা যায়। আকৃতির সাথে ন্যানোবস্তুর আলোর সাথে সম্পর্ক নির্ভর করে।
ন্যানোবস্তুর ঐতিহাসিক ব্যবহারঃ
ন্যানোবস্তুর মধ্যে ন্যানোকণিকা ও ন্যানোটিউবের অনেক প্রাচীন ব্যবহার আছে। প্রাচীন মিশরে প্রসাধনী সামগ্রীর পরীক্ষা করে তাতে মারকারি সালফাইডের ন্যানোকণিকার সন্ধান পাওয়া গেছে।
ভারতের তামিলনাড়ুতে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পোড়ামাটির কাজে ন্যানোবস্তুর প্রয়োগ দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করে সেসব পোড়ামাটির বাসন-কোশনে ন্যানোটিউব পাওয়া গেছে। যেটা সম্ভবত কার্বন ন্যানোটিউবের সবচেয়ে প্রাচীন উদাহরণ।
প্রাচীন বিভিন্ন শিল্পকর্মে কার্বন ন্যানোটিউব ও ন্যানোবস্তুর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তারা সেগুলো ইচ্ছে করে বানাননি। উচ্চ তাপমাত্রায় ধাতুকে প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তাদের অজান্তেই এসব ন্যানোবস্তুর তৈরি হয় যেটা প্রকারান্তরে তাদের তৈরি জিনিসপত্রকে স্থায়ীত্ব দেয় এবং বিশেষ গুনাবলীর সংযোগ করে। তামিল সভ্যতায় উচ্চ তাপমাত্রায় লোহাকে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানী করা হতো। সতেরশ শতকের দামেস্কের তলোয়ারের একই লোহা ব্যবহার করা হয় যাতে কার্বন ন্যানোটিউবের কারণে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।
খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে তৈরি লাইকারগাস পেয়ালাতে ন্যানোবস্তুর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে অনুবীক্ষণ যন্ত্র (TEM) দিয়ে তাতে ৫০-১০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের ন্যানোবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। এক্স-রে দিয়ে গবেষণা করে জানা যায় পেয়ালার ন্যানোবস্তু আসলে সোনা ও রূপার সংকর কণিকা যাতে রূপা ও সোনার অনুপাত ৭ঃ৩।
সোনার ন্যানো কণিকা ৫২০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে সেজন্য বস্তুকে লাল বর্ণ দেখায়। অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির কণিকার উপস্থিতির লাল-বেগুনি রঙের সৃষ্টি করে। অপরদিকে রূপার কণিকার দ্বারা আলো বিচ্ছুরিত হয়ে সবুজ বর্ণ তৈরি করে। মধ্যযুগের অনেক গীর্জার জানালার কাচেও ন্যানোবস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে সতেরশ শতকের দামাস্কাসের তলোয়ারে ন্যানোটিউব ও ন্যানোকণিকার উপস্থিতি দেখা গেছে যার কারণে দামাস্কাসের তলোয়ার ইওরোপিয়ানদের তলোয়ারের চেয়ে পৃথক ছিল। ক্রুসেডের সময় ইওরোপিয়ানরা প্রথমে লক্ষ্য করেন দামাস্কাসের তলোয়ারে একটা ঢেউ খেলানো ভাব আছে এবং খুব ধারালো ও শক্ত। দামাস্কাসের তলোয়ার উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে প্রসেসিং এর সময় সেখানে কার্বন ন্যানোটিউব ও অন্যান্য ন্যানো কণিকা তৈরি হয় যেগুলো দামাস্কাসের লোহাকে এর বিশেষত্ব দেয়। কামারের হাঁপরে কয়লা দিয়ে লোহার হাতিয়ার বানানোর সময় ন্যানো কার্বন নরম লোহার পরমাণুগুলোর মধ্যেকার শূন্যস্থান দখল করে লোহাকে আরো শক্ত করে, লোহার গঠনগত দূর্বলতা করে তাকে মরিচার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে ।
একটা কাগজের পাতা দিয়ে কুপি বাতির ধোঁয়াকে সংগ্রহ করলে কার্বনের যেসব কণিকা তৈরি হয় সেগুলোর মধ্যে ন্যানো আকৃতির কার্বন অণু আছে।
বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৫৭ সালে সোনার দ্রবণ তৈরি করেন যেটা দেখতে সোনালী লাল বর্ণের। ফ্যারাডে দেখিয়েছেন আলোর প্রভাবে কিভাবে সোনার কণিকাগুলো ভিন্ন ভিন্ন রঙ ধারণ করে।
আধুনিক সময়ে বিজ্ঞানী রিচার্ড স্মলি জ্বালানী তেলে ৬০ টি কার্বন দ্বারা গঠিত যৌগের সন্ধান পান । ১৯৮৫ সালে ১৪ নভেম্বর বিখ্যাত ন্যাচার পত্রিকায় ‘C60: Buckminsterfullerene’ শিরোনামে এক আর্টিকেলে তিনি ৬০ কার্বনের তৈরি ফুটবল আকৃতির ন্যানোযৌগের বিবরণ দেন। ন্যানোবস্তুর গবেষণায় এই আবিষ্কার একটি মাইলফলক। স্মলি ফুটবলের মতো দেখতে কার্বনের এই বস্তুকণিকার নাম দেয়া ফুলারিন। স্থপতি বাকমিনস্টার ফুলার ভূ-আকৃতির স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। কার্বন-৬০ যৌগের আকৃতি গোলাকার হওয়ায় ফুলারিনের নামে নামকরণ করে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
“During experiments aimed at understanding the mechanisms by which long-chain carbon molecules are formed in interstellar space and circumstellar shells, graphite has been vaporized by laser irradiation, producing a remarkably stable cluster consisting of 60 carbon atoms. Concerning the question of what kind of 60-carbon atom structure might give rise to a superstable species, we suggest a truncated icosahedron, a polygon with 60 vertices and 32 faces, 12 of which are pentagonal and 20 hexagonal. This object is commonly encountered as football. The C60 molecule which results when a carbon atom is placed at each vertex of this structure has all valences satisfied by two single bonds and one double bond, has many resonance structures, and appears to be aromatic.” – Nature,volume 318, pages 162–163 (1985).
ফুলারিনের আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারা বিভিন্নভাবে এই যৌগটিকে বুঝার চেষ্টা করেন, এর ব্যবহার বের করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তেমন সফলতা লাভ করেননি। এই সময় ন্যানোবস্তুর দ্রবণীয়তা এবং তাদের ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকার ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের সামনে আসে।
১৯৯১ সালে কার্বন ন্যানোটিউব ও ২০০৪ সালে গ্রাফিন আবিষ্কার হলে ন্যানোবস্তুর দ্রবণীয়তার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়। কারণ ন্যানোবস্তুকে কোন কিছুতে দ্রবণীয় না করা গেলে সেটা নিয়ে বেশি কিছু করা অসম্ভব, এছাড়া তাদের মধ্যকার জট ছাড়ানোর জন্যেও ন্যানোবস্তুকে বিভিন্ন দ্রাবকে দ্রবীভূত করতে হবে।
ফুলারিন নিয়ে মানুষ যেরকম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, একইভাবে তারা কার্বন ন্যানোটিউব নিয়ে পড়ল। ন্যানোটিউবের মত বস্তুকণিকার কাঠিন্য, বৈদ্যুতিক, চুম্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক আশা-ভরসার সৃষ্টি হলো। স্মার্ট বস্তু তৈরি করার ব্যাপারটা অবশেষে মানুষের করায়ত্ত্ব হলো। যে কোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথমে আবিষ্কার হওয়ার পরে প্রাথমিক সময়টাতে অনেকে সেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নতুন এলাকায় কে কার আগে দখল করবে সেটার প্রতিযোগিতা লেগে যায়। নতুন টেমপ্লেট হওয়ায় এর উপর যা কিছু করা হবে সেটাই নতুন হবে, গবেষণা প্রকাশের জন্য যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ফলে ফুলারিন আর ন্যানোবস্তু নিয়ে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা করেও অনেকে নামী-দামী প্রকাশনায় নিজেদের কাজ প্রকাশ করতে পেরেছেন। নতুন ফিল্ডের জন্য এসব কাজের দরকার আছে। কিন্তু প্রাথমিক কাজগুলো শেষ হবার পরে সেখান থেকে নতুন সম্ভাবনা বা প্রয়োগ না পাওয়া গেলে আস্তে আস্তে সুসময়ের মাছি গবেষকেরা দূরে সরে যান। তখন গবেষণায় কিছু ভাটা পড়ে, কিন্তু ত্যাগী গবেষক, বিজ্ঞানীরা লেগে থাকেন। তাদের গবেষণা নতুন গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে, তারা এর সীমাবদ্ধতা ও সীমানা নির্ধারণ করেন। ন্যানোবস্তু নিয়ে গবেষণা প্রাথমিক ধাপগুলো পেরিয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত একটি শাখা। প্রায় প্রতিদিনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখা থেকে বিভিন্ন প্রকারের ন্যানোবস্তু উৎপাদন ও তাদের নতুন নতুন ব্যবহার সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
২০০০ সালে ক্যালটেকের এক বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণার জন্য আলাদা ফান্ডের কথা বলেন। এর তিন বছর পরে প্রেসিডেন্ট বুশ ‘ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এক্ট’ সাক্ষর করে একবিংশ শতাব্দীতে ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। যার ফলে ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে National Technology Initiative (NNI) প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
ন্যানোবস্তুর গবেষণায় মানুষ দেখল প্রকৃতিতে ন্যানোবস্তুর একটা কাঠামোগত হায়ারার্কি আছে। ন্যানো প্যাটার্ণিং এর মাধ্যমেও প্রকৃতি রঙ ও রূপের অনেক খেলা দেখাচ্ছে। ন্যানোবস্তুর ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতিকে অনুসরণ করে অনেক নতুন বৈশিষ্ট্যের বস্তু তৈরি করতে পারি যেগুলো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে, এরসাথে বস্তুর ব্যবহারের নতুন সীমাও নির্ধারণ হবে।
এখন পর্যন্ত ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণা নিয়ে ২০ লাখের উপরে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ ন্যানোকণিকা ও ন্যানোটিউব নিয়ে গবেষণা। এরবাইরে ন্যানোতার, ন্যানোদন্ড, কোয়ান্টাম বিন্দু এসব বিষয় নিয়েও অনেক গবেষণা হচ্ছে।
ন্যানোটিউবঃ
১৯৯১ সালে ডক্টর ইজিমা গবেষণা করে কার্বন ন্যানোটিউব আবিষ্কারের পর থেকে ন্যানোটিউব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। ন্যানোটিউবের বিশেষ আকৃতি এবং অসাধারণ ভৌত, রাসায়নিক গুনাবলীর কারণে বিজ্ঞানীরা ন্যানোটিউবের বিভিন্ন প্রয়োগ নিয়ে আশাবাদী হন। যার কারণে প্রথম দশকে ন্যানোটিউব নিয়ে গবেষণায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। একুশ শতকের প্রথম দশকে ন্যানোতিউব নিয়ে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে ব্যাপারটা বুঝা যাবে। ২০১০ সালের পর থেকে ন্যানোটিউব নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছাস কিছুটা কমে আসে, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বছরে প্রায় ৮০০০ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে আমেরিকার কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল এসিএস ন্যানো’ প্রতিষ্ঠা হয়, এখন পর্যন্ত তারা কার্বন ন্যানোটিউব নিয়ে ১০০০ এর উপরে আর্টিকেল প্রকাশ করে।
৩০ বছর ধরে ন্যানোটিউব গবেষণা থেকে বিভিন্ন কম্পোজিট বস্তু তৈরি করা ছাড়া এর তেমন ভালো কোন প্রয়োগ বের হয়নি। বিভিন্ন পলিমারের সাথে ন্যানোটিউব মিশিয়ে পলিমারের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে বিভিন্ন কাজের উপযোগী পলিমার তৈরি করা।
শরীরে ঔষধ সরবরাহকারী মাধ্যম হিসেবে ন্যানোটিউব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এছাড়া সেন্সর, ব্যাটারি, সৌরবিদ্যুত ইত্যাদি নানা বিভাগে ন্যানোটিউব নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। ন্যানোটিউব ও অন্যান্য বস্তু দিয়ে তৈরি কম্পোজিট রাডারের রেডিও তরঙ্গ শোষণ করে তাপ বিচ্ছুরণ করে ফলে ন্যানোটিউব দিয়ে তৈরি কোটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাডারকে ফাঁকি দেয়া যুদ্ধ জাহাজ তৈরি হচ্ছে।
গ্রাফিনঃ
ন্যানোটিউবের মত কার্বনের তৈরি দ্বিমাত্রিক পদার্থ। গ্রাফিনের একটা স্তর আরেকটি স্তরের উপর বিছানো থাকে ফলে গ্রাফিন খুবই পাতলা, স্বচ্ছ বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বৈদ্যুতিক পরিবহনের কাজে গ্রাফিনকে ব্যবহার করার ভাল কোন উপায় বের হয়নি। গ্রাফিনের চেয়ে এখন গ্রাফিনের অক্সিজেন যৌগ গ্রাফিন অক্সাইড ও এর বিজারিত যৌগের ব্যবহার নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে।
ন্যানোকণিকাঃ
জৈবিক ও রাসায়নিক এই দুই প্রক্রিয়াতে ন্যানো কণিকা প্রস্তুত করা হয়। জীবানু, এনজাইম, ছত্রাক এমনকী বিভিন্ন গাছ ও গাছের নির্যাস থেকে ন্যানো কণিকা তৈরি করা হয়। এছাড়া আমিষ, শর্করা ও কৃত্রিম পলিমার দিয়ে ন্যানো কণিকা বানানো সম্ভব।
ন্যানোকণিকার প্রকারঃ গবেষণাগারে অনেক ধাতু, ধাতব যৌগ, জৈব যোগ থেকে ন্যানোকণিকা তৈরি হয়েছে। নিম্নে ধাতব ন্যানোকণিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ন্যানোকণিকার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া গেল।
রূপার ন্যানোকণিকাঃ রূপার ধনাত্মক আয়নকে এলকোহল দিয়ে বিজারিত করে রূপার ন্যানো কণিকা তৈরি করা হয়। জীবানুনাশক হওয়ায় বস্ত্রবয়ন শিল্পে, সূর্যের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষার ক্রিম, পানি পরিশোধনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
সোনার ন্যানো কণিকাঃ সোনার ক্লোরিনযুক্ত যৌগ ক্লোরঅরিক এসিড (HAuCl4) কে বিজারিত করে সোনার কণিকা তৈরি করা হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আমিষ যৌগের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে সোনার ন্যানো কণিকা ব্যবহৃত হয়। আঙুলের ছাপে ডিএনএ’র উপস্থিতি সনাক্তকরণেও সোনার ন্যানোকণিকার ব্যবহার আছে।
তামার ন্যানো কণিকাঃমাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের সাহায্যে তুঁতে কে বিজারিত করে তামার ন্যানো কণিকা প্রস্তুত করা হয়। সেন্সর এবং জীবানুনাশক হিসেবে তামার ন্যানো কণিকার ব্যবহার হতে পারে।
বর্তমানে খাদ্য, ঔষধ,এবং ঔষধ সরবরাহ কাজে বিভিন্ন ন্যানো কণিকার ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে।
ন্যানো বিন্দুঃ ন্যানো বিন্দু বা কোয়ান্টাম ডটের আলোক সম্পর্কিত গুনাবলীর কারণে এর সেমিকন্ডাক্টর ও ডিসপ্লে প্রযুক্তিতে এর নানা ধরণের ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে।
ন্যানোতারঃ
ধাতুগুলোর মধ্যে তামা, রূপা, ও সোনা সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী ধাতু। এদের মধ্যে রূপা চ্যাম্পিয়ন, রূপার তার তামা ও সোনার তারের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী। শুধুমাত্র রূপার ন্যানোতার নিয়ে এ যাবত ১ লাখের বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যুতের সুপরিবাহী ধাতুগুলো দিয়ে ন্যানোতার তৈরি করে সেগুলো দিয়ে ন্যানোমাত্রার বস্তুর গঠন পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ পরিবাহী ফ্লেক্সিবল বস্তু বানানোর গবেষণা হচ্ছে যেগুলো দিয়ে নানা আকার ও আকৃতির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বানানো যাবে। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিকস এবং সৌর প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য স্বচ্ছ ধাতব যৌগ ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। ভঙ্গুর ও প্রকৃতিতে ইন্ডিয়ামের স্বল্পতা থাকায় বিকল্প উপাদান হিসেবে ইলেক্ট্রনিকস ডিসপ্লে প্রযুক্তিতে ন্যানোতার ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই শাখায় অনেক বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। ন্যানোতারের অসাধারণ বিদ্যুৎ পরিবহন ক্ষমতা, এরসাথে আকার-আকৃতিতে অনেক ক্ষুদ্র হওয়ায় বিদ্যুৎ পরিবহন বা বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে তাদেরকে খুব সহজে ব্যবহার করা সম্ভব। ফলে ভবিষ্যতে যেকোন আকার-আকৃতির ফোন, ল্যাপটপ বানাতে কোন বাধা রইল না।
ন্যানোরডঃ সোনার ন্যানোদন্ড দিয়ে ক্যান্সারের স্টেম কোষ এবং বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়াকে সনাক্ত করা সম্ভব।
ন্যানো ডায়মন্ডঃ ডায়মন্ডের কাঠিন্যকে ব্যবহার করে বিভিন বস্তুকে শক্ত, মজবুত করার কাজে ন্যানো ডায়মন্ডের ব্যবহার করা হচ্ছে।
ন্যানোপ্রযুক্তি বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। ন্যানোবস্তু নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক আগ্রহ ও গবেষণার তুলনায় ন্যানোবস্তুর প্রয়োগ কম হওয়ায় একসময় ন্যানোবস্তু নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছাসে একসময় ভাটা আসে। বর্তমানে পুরোদমে ন্যানোবস্তু নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, এবং তাতে নিত্যনতুন সাফল্য দেখা দিচ্ছে। একইসাথে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ন্যানোবস্তুর প্রভাব নিয়েও অনেক আলাপ-আলোচনা আছে। ছোট আকার-আকৃতির হওয়ায় ন্যানোবস্তু মানুষের রক্তের সাথে মস্তিষ্কের যে সীমানা প্রাচীর ( ব্লাড-ব্রেইন-ব্যারিয়ার) সেটা ভেদ করে চলে যেতে পারে। টেক্সটাইল শিল্পসহ অন্যান্য অনেক শিল্পে ন্যানোকণিকার ব্যবহার বাড়ায় সেগুলো ক্ষতিকারক উপাদান হিসেবে পরিবেশে ছড়াচ্ছে। ন্যানোপ্রযুক্তির বিকাশের সাথে নিরাপত্তা মূল্যায়ন করার ব্যাপারেও এখনো অনেক গবেষণা বাকি আছে।
ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণায় অতিবেগুনী, অবলোহিত, রমন, রঞ্জন রশ্মির ব্যবহার এবং তাদের দেখার জন্য কিছু নতুন ধরণের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন। এসব যন্ত্রপাতির বেশিরভাগ গবেষণাগারে পাওয়া যায়। অর্থাৎ অল্প বিনিয়োগ করেও ন্যানোপ্রযুক্তির চর্চা করা সম্ভব। ন্যানোপ্রযুক্তিতে বস্তুর আকার ছোট করাটাই মূল লক্ষ্য, নতুন রাসায়নিক বস্তু তৈরি করতে হবে না।
বর্তমানে ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার সবার শীর্ষে আছে চিন, তারপরে আমেরিকা। জাপান, কোরিয়া, ভারত ও সৌদি আরব মিলে ন্যানোপ্রযুক্তির গবেষণায় এশিয়া অনেক এগিয়ে আছে। ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে এশিয়ার অগ্রগতির সাথে শামিল হয়ে বাংলাদেশেও ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বিদেশ থেকে ন্যানোপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে কাজ করছেন, এদের গবেষণায় ফান্ডিং দেয়া হলে বাংলাদেশ থেকেও ন্যানোপ্রযুক্তির অনেক আবিষ্কার সম্ভব হবে।