০
১৫৫৭ বার পঠিত
আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, আমার বন্ধু বলেও যাকে দাবি করতে পারি সেই রিক ব্র্যাগ এর কথা আরেকবার স্মরণ করি। ‘রিক ব্র্যাগঃ জীবন ছোঁয়া এক গল্পের রূপকার’ শিরোনামে লেখা লিখেছিলাম আমার ‘পথ হারানোর পথ‘ গ্রন্থে, কলামে। রিক ব্র্যাগ (Rick Bragg) শুধু একজন সাংবাদিকই নন, একজন তুখোর গল্পকারও। কিন্তু তিনি গল্প লেখেন সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে, সরেজমিনে তদন্তের পর। নিউইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার (Pulitzer Prize), আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকমণ্ডলী প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজ পেপারস এডিটর’স ডিসন্টিংগুইশড রাইটিং এওয়ার্ড পেয়েছেন দু’দুবার। এছাড়াও চল্লিশটি ছোট-বড় সাংবাদিকতার পুরস্কার তার ঝুলিতে। সুতরাং রিক যে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রিক ব্র্যাগ লিখেছেন সাউথ ক্যারোলিনার এক মা সুসান স্মিথের কথা। মাত্র তেইশবছর বয়েসের এই মা তার দুই ছেলে, তিন বছরের মাইকেল এবং চৌদ্দ মাসের আলেকজান্ডার স্মিথ’কে গাড়িতে রেখে নদীতে ডুবিয়ে দেন গাড়িটি। তারপর পুলিসকে খবর দেন এই বলে যে এক কালো ষণ্ডামার্কা লোক তার গাড়িটি হাইজ্যাক করেছে তার দুই ছেলেসহ।
পুলিসি অনুসন্ধানে যখন জানা গেল আসলে এই মা-ই তার দুই ছেলের খুনী তখন সাড়া আমেরিকায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সকলের চোখে এই সুসান স্মিথ একজন খুনী, সামাজবিরোধী ব্যক্তি। রিক তখন নিউইয়র্ক টাইমস-এ ধারাবাহিক লিখলেন এই সুসান স্মিথের ওপর। তার লেখায় বের হয়ে এলো তেইশবছরের এই মায়ের করুণ কাহিনী।
সেই ছোটবেলা থেকে সৎ বাবার যৌন অত্যাচার, স্বামীর নির্যাতন আর অভাবের পেষণে কী করে এই তরুণী হয়ে ওঠে এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। রিকের লেখায় বের হয়ে আসে সভ্য সমাজের অন্তরালে জেগে ওঠা দুষ্ট ক্ষতের মতো গ্লানিকর ইতিহাস। আইনের বিচারে দোষী এই তরুণী, সমাজের চোখে নৃশংস এই মা হয়ে ওঠেন এক ট্রাজিক গল্পের নায়িকা!
এবার আসি পরীমনি প্রসঙ্গে। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ইকড়ি ইউনিয়নের শিংখালী গ্রামের বাসিন্দা এই পরীমনি। তিনি সেখানে মামার বাড়িতে থেকে বড় হয়েছেন। তার পুরো নাম শামসুন নাহার স্মৃতি। পরীমনি তথা স্মৃতির বয়স তখন মাত্র তিনবছর। তার বাবা মনিরুলের তখন ঢাকায় পোস্টিং। সেখানে একটি বাসায় আগুনে পুড়ে গুরুতর দগ্ধ হন পরীমনির মা সালমা। এ সময় মাত্র তিন বছরের সন্তান পরীমনিকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তার বাবা। ঢাকায় হাসপাতালে কিছুদিন দগ্ধ স্ত্রীর চিকিৎসা করান মনিরুল।
পরে তিনবছরের মেয়েকে নানা শামসুল হক গাজীর কাছে রেখে যান মনিরুল। এর দুইমাস পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মা সালমা। তিন বছরেই মা-হারা হন পরীমনি। পরীমনির বাবা ছিলেন পুলিস কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম। ২০১২ সালের কথা। কোনো একটা কারণে তার চাকরি চলে গিয়েছিল। তখন তিনি গ্রামের বাড়িতে থেকে ব্যবসা করতেন। আমরা শুনেছি, সেই ব্যবসার বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
এভাবে বাবা-মা-হারা মেধাবী, সুন্দরী একটি গ্রামীণ মেয়ে বাংলাদেশের চরম পুরুষতান্ত্রিক, লোলুপ ভণ্ডদের মধ্যে বড় হয়েছে। একটু চিন্তা করে দেখুন তাঁর ওপর দিয়ে কী ভয়বহতার স্টিমরোলার যেতে পারে! মেয়েটি যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আমেরিকার সুসান স্মিথের মতো সাইকোপ্যাথ হয়ে ওঠেনি সেটাই তো অস্বাভাবিক। অথচ সুসান স্মিথের কাহিনী পুলিৎজার পুরস্কার পায়, আর আমাদের পরীমনিরা সমাজের কাছে, মিডিয়ার কাছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, হাজারবার ধর্ষিত হয়, মৃত্যুবরণ করে।
পরীমনিকে সেই চূড়ান্ত পরিণতির দিকেই আমরা ঠেলে দিচ্ছি- পুরো সমাজ যেন অপেক্ষমাণ- এই ট্র্যাজিক নায়িকার শেষ পরিণতি দেখার জন্যে। আমাদের এই সামাজিক ব্যাধিকে ‘ম্যাস স্যাডিজম’ বা জন-ধর্ষকাম, জন-পীড়ন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
এই পীড়নের চির অবসান হোক!
ফ্লোরিডা, আগস্ট ১৩, ২০২১
লেখাটি শেয়ার করতে পারেন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন