২
৬০১ বার পঠিত
শহর যেন জন ডো’র কাছে বিছার কামড়, ভিমরুলের হুল। সবাই থাকে থাক, সে থাকবে না শহরে। তার আবার থাকা, থাকা মানে পড়ে থাকা। বউ ছেড়ে যাবার পর সেই কবে ঘর ছেড়েছে মনে নেই তার। তারপরে আর ঘরে ঢোকেনি, আর ওমুখো হয়নি। ডাউন টাউনের রাজপথে থাকতে সরকারী লোক এসে শীতের কামড়ের হাত থেকে বাচাতে শেল্টারে নিয়ে যেত তাকে। সেখানে কিছুদিন থেকে রাতের অন্ধকারে পালাত ডো- তাকে পালাতে হতো। ওখানকার লোকগুলো অসহ্য- শীতের কামড়ের থেকে অসহ্য। তারচেয়ে এইখানে এই সুফলা গ্রামের বুক চিরে ধাবমান হাইওয়ের বড় ব্রিজটার নীচে তার এই প্লাস্টিক মোড়ানো ছোট ঘরটা তার অন্যরকম স্বর্গ- বড্ড নিরাপদ, কোলাহল নেই মানুষের। সবথেকে বড় কথা এখানে সরকারী লোক তাকে আর ধরে নিতে আসে না, আসবে না। এখান থেকে হাটা দূরত্বে একটা পরিত্যক্ত ভবন চোখে পড়ে। ওটাতে থাকতে সাহস পায় না ডো, শেষে কোথায় কোন ঝামেলা হবে তাই ভেবে। দিনের বেলায় মাঝেমধ্যে ওটার ভিতরে গিয়ে হাটে সে। ভালোলাগা পুরানো গন্ধ বুক ভরে নিতে কখনও ভোলে না ডো।
ব্রিজের নীচের এই ঘরটা ডো’র নিজের হাতে গড়া। ঘরের খুব কাছ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। এই ঘরটা তার স্বর্গ- সত্যিকারের স্বর্গ। বড় রাস্তা ধরে খাল পার হয়ে ওপার গেলে একটা জাংক-ইয়ার্ড, মানে ময়লা ফেলার চাতাল পাওয়া যাবে। সেখানে মাঝে মাঝে দূরের ঐ ধূমায়মান বেকারিটা থেকে পরিত্যক্ত রুটি-বিস্কুট ফেলে দিয়ে যায়। খাবারের অভাব হয় না তাই ডো’র। খিদে লাগলেই ওগুলো ঘাটে সে। এতদিন কোন মনুষ্য প্রাণী তার চোখে পড়েনি আশেপাশে কোথাও। আজ একটা বাচ্চা ছেলে, বছর দশ হবে বয়স, ময়লা ঘাঁটছে আনমনে সেখানে। অবাক কাণ্ড! কথা বলতে গেলে পালিয়ে গেল। মনেহয় পেটে টান পড়েছে। আহারে, বেচারা- মনের ভিতরে কেমন জানি করলো ডো’র। কিন্তু মুখে তার ‘এ আবার কোন আপদ এলো’ গোছের ভাব জারি থাকলো কঠিন ভাবে। ময়লা ঘাটা শুরু করলো জন ডো আবার। আজকের ভাল রুটিটাই তাকে পেতে হবে। রোজ রোজ আসা যায় না ব্রিজ পার হয়ে এতটা দূরে, বুড়ো হাড়ে পরিশ্রম সয় না। সময় নিয়ে মন দিয়ে আবর্জনা ঘাটতে থাকে ডো। হঠাৎ করে একটা দস্তানা পেয়ে যায়, একেবারে নতুন- খাটি পশমের তৈরি। আনন্দ-উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠে সে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে আরেক পাটি দস্তানা। পেয়ে যায় আরেকটা। আজকে সে মহাভাগ্যবান। কার মুখ দেখে যে সে আজকে নিদ্রাভঙ্গ দিয়েছিল মনে করতে পারে না- হয়তো ময়লা ঘাটা কোন রেকুনের মুখ দেখে। শীত আসছে ধেয়ে আর মাসখানেক পরে। শীতের কামড় থেকে হাতটাকে বাঁচানো যাবে। নিজের একটুখানি সৌভাগ্য-সুখের ভাবনায় স্বপ্নালু হয় তার চোখ।
দুইহাতে দুটো রুটির কার্টুন আর দস্তানা জোড়া নিয়ে গুইসাপের মতন হেলে দুলে হেটে হেটে নিজের ছাপড়ায় ফিরে আসে ডো। ঘরে ঢোকার পথে জিনিসগুলো থপ করে রেখে প্লাস্টিকের ঘরের মেঝেতে একটুখানি জিড়োতে বসে। জিড়োতে বসে কখন যে তন্দ্রামতো এসে গেছে চোখে টের পায়নি সে। সহসা কার্টুনের খসখস আওয়াজে ঘুম টুটে গেল। চমকে চোখ মেলে দেখলো, কে যেন দস্তানাটা চিলের মতো ছো মেরে নিয়ে দৌড় দিলো। বাইরে এসে দেখলো ডো, সেই ছেলেটা একটা দস্তানা হাতে নিয়ে দৌড়চ্ছে প্রাণপণে। ছুটছে সে বড়রাস্তা ধরে ব্রিজটার দিকে। দেরী না করে ডোও আরেকটা দস্তানা হাতে নিয়ে অনুসরণ করলো দুষ্ট হতভাগা ছেলেটার। হাইওয়ে পাশ দিয়ে ছুটছে চোর, পিছে পিছে ডোও। ধরা পড়ার ভয়ে আতঙ্কিত বেওয়ারিশ চোরটা আকস্মৎ আড়াআড়ি পার হবার জন্যে ব্যস্ত সড়কে ঢুকে পড়লো। ব্যস্ত মানুষ, ব্যস্ত গাড়ী, যেখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে সোজা স্বর্গের দিকে। হতভাগা কি সেখান যেতে চায়? চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও পারলো না ডো। কত শত দিন সে চিৎকার করেনি, কথা বলেনি মানুষের সাথে, অনভ্যাসে গলা দিয়ে শুধু বাতাস ছুটে বেরিয়ে গেল। কিচ্ছু করার নেই- যা হবার তাই হলো। রাস্তার সাথে লেপটে গেছে হতভাগা ছেলেটা, গাড়ীর চাকার সাথে মিশে গেছে তার শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ। চলমান গাড়ীগুলো সব দাড়িয়ে গেছে ছবির মতন। ডো টের পেল তার নিজের ভিতরের বেসামাল ভাবের আসা যাওয়া- হৃদযন্ত্রের মত অন্য কোন অঙ্গ কি তার ভেঙ্গে পড়লো ভিতরে, বুঝতে পারে না ডো। তার জন্যেই এতটা হলো, কেন সে ছেলেটার পিছু নিতে গেল? তার ভিতরটা কাঁদলেও, বাইরের চেহারায় আটা থাকে শক্ত পাথর। লাশের দুই হাত ধরে টেনে টেনে ছেলেটাকে নিয়ে আসে পথের কিনারে ডো। ছেলেটার নিষ্প্রাণ হাতে তখনও শক্ত করে ধরা একপাটি দস্তানা। হাঁটু গেড়ে বসে লাশের দুই হাতে সে যত্ন করে পরিয়ে দেয় দস্তানা জোড়া।
-আমি তো তোকে আরেক পাটি দস্তানা দেবার জন্যেই তোর পিছু নিয়েছিলাম, কেন তুই সেটা বুঝলি না, হতভাগা- বিড়বিড় করে প্রলাপ বকে বৃদ্ধ। দূরে শোনা যায় পুলিশের গাড়ীর হুইসিল। আর দেরী করা যায় না। মৃত চোরের ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বাদী। বৃদ্ধ ডো’র চোখ দুটো একটুখানি কাঁদলো বুঝি, তাও ক্ষণিকের জন্যে। কাঁদা-কাটা তার কেন জানি পোষায় না। তারপর আবার সেই কাঠিন্য ফিরে এলো মুখে পাথরের অবয়বে। অতঃপর পাথরের মুখোশ মুখে এটে জন ডো গুইসাপের মতন হেলেদুলে এসে ঢুকে পড়ে তার নিজের ঘরে, তার প্লাস্টিকের স্বর্গে- যেখান থেকে সবাইকে সে দেখতে পায়, কিন্তু কেউ তাকে আর দেখতে পায় না, সরকারী লোকও না।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ডিসেম্বর ২১, ২০১৭; ৬:০১ পূর্বাহ্ন
নবযুগ ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।
আশাকরছি নিয়মিত আপনার লেখা পড়ার সুযোগ পাবো।
জানুয়ারি ২, ২০১৮; ৭:০১ অপরাহ্ন
অনেক ধন্যবাদ। লিখবো সময় পেলেই।