পুরুষ রচিত ধর্মের চোখে নারী – শেষ পর্ব (ইসলাম ধর্ম)

1 মতামত পাওয়া গেছে

যদিও একটিমাত্র লেখা পড়েই একটি ধর্মে নারীর অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করা সহজ কথা নয়, তবে সমাজে মুসলিম মেয়েদের অবস্থানের যে সামাজিক চিত্র আমরা প্রায়শই সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি, নানান ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে, তাতে আলোচ্য লেখাটির সাথে সহমত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই বলেই মনে হয়। অনেকেই কোরানকে ধর্মগ্রন্থ বলে মানেন। কিন্তু এই সব নির্দেশ যে গুলি এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে কোরানের বাণী বলে, সেগুলি পড়লে বোঝা যায়, এই নির্দেশগুলি আসলেই একটি বিশেষ সময়কালে একটি বিশেষ অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সামাজিক কিছু বিধিবিধান মাত্র। ঐতিহাসিক ভাবে সেই আঞ্চলিক বিধিবিধানগুলিই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে নানান রাজনৈতিক কার্যকারণে। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এই যে নিতান্তই সামাজিক বিধিবিধান, যা পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডীতে প্রতিপালন যোগ্য, তার সাথে ধর্ম অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার কি যোগ থাকতে পারে? সে সময়ে আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি। রাষ্ট্রীয় সংবিধানের বালাই ছিল না, সাম্প্রদায়িক বিধিবিধানই ছিল শেষ কথা। শুধু ইসলাম বলে নয়, সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। কিন্তু আজকের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবাস্থায় যেখানে প্রতিটি দেশের নাগরিককে তার রাষ্ট্রীয় সংবিধান মেনে চলতেই হবে, সেখানে আজ এই সব প্রাচীন সাম্প্রদায়িক বিধিবিধানের তো কোনরকম প্রাসঙ্গিকতাই থাকা উচিত নয়। একটি দেশের আইন সেই দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যেই এক হবে। সম্প্রদায় ভিন্ন অন্যরকম হবেই বা কেন? আজ সময় এসেছে সকল সম্প্রদায়েট মধ্যেই এই সচেতনতা জেগে ওঠার।

এটা দেখা যায় প্রায় সকল ধর্মেই নারীকে অবহেলিত রেখে তাকে পুরুষের ভোগ্যপন্য করে রাখার নানান রকমের বন্দোবস্ত করা আছে। অন্তত অধিকাংশ ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালেই সেকথা বোঝা য়ায়। আর এর কারণই একটাই। মূলত নারীর উপর প্রভুত্ব করার উদ্দেশ্যই নানান সময়ে নানার ধর্মের উৎপত্তি। যেসময় থেকে মানুষের সমাজ সভ্যতার দখল পুরুষের কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে, সেসময় থেকেই পুরুষ নানান ছলে বলে ও কৌশলে নারীকে নিজের আয়ত্তাধীনে রাখার জন্যেই শত সহস্ররকমের বিধিবিধান চালু করতে শুরু করেছিল। দিনে দিনে যে বিধিবিধানগুলিকে কেন্দ্র করেই নানান সাম্প্রদায়িক ধর্মের কাঠামোগুলি রূপ পায়। ফলে ধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়ন মানেই নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বের রাজপথ। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে কোন ধর্মই ধোয়া তুলসীপাতা নয়।

এখন ইসলাম নিয়ে আধুনিক সময়ে এত সমস্যার কারণ, অন্য সব রিলিজিয়নগুলি সভ্যতার অগ্রগতির সাথে দিনে দিনে ধীরে ধীরে সমাজের উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব হারিয়ে চলেছে। একমাত্র ইসলামে এই কর্তৃত্ব এখনো সবচেয়ে প্রবল। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, যেখানেই ইসলাম ধর্মের বিস্তার হয়েছে, সেখানেই জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পরিসর, মুক্তচিন্তার স্বাধীন পরিসর সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষার সর্বিক বিকাশের ধারা যত বেশি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, ততবেশি করে ইসলামী বিধিবিধান সমাজের উপর জাঁকিয়ে বসে সমাজের উপর কর্তৃত্ব কায়েম রেখেছে। কিন্তু এই কর্তৃত্ব কায়েমের পিছনে কোন ধর্মীয় উদ্দেশ্যই নাই। সবটাই রাজনৈতিক। ফলে ইসলাম আর রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে দিনে দিনে পরিপুস্ট করে তোলার কারণেই আজও ইসলামী সমাজে রিলিজিয়নের এত দাপট দেখা যায়। যা অন্যান্য রিলিজিয়নে এমন প্রবল ও সর্বাত্মক ভাবে দেখা যায় না। আর যায় না বলেই ইসলামে নারীর প্রতি বৈষম্যও তীব্রভাবে বেআব্রু হয়ে পড়ে।

আলোচ্য প্রবন্ধে কোরানে উল্লিখিত যে বিধিবিধানগুলি দেখা গেল, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে সমাজ যত বেশি পুরুষতান্ত্রিক, সেই সমাজের কাছে এই বিধিবিধানগুলি ততই আকাঙ্খিত হবে। ফলে ঐতিহাসিক ভাবেই মুসলিম সমাজে এইসব বিধিবিধানগুলি তীব্রভাবে অনুশীলিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। কিন্তু আজকে একুশ শতকে এসে মুসলিম নারী ও মুসলিম পুরুষ উভয়কেই ঠিক করতে হবে, তাদের ভভিষ্যৎ কোন দিকে? মানব সভ্যতার সাথে পা মিলিয়ে সামনের দিকে? না কি কোরাণের বাণীর সাথে তাল মিলিয়ে ইতিহাসের পিছনের দিকে? এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সমাজকেই নিতে হবে। বাইরের থেকে জোর করে তাদেরকে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে পারে না। তাদেরকে বাইরে থেকে উদ্ধার করাও সম্ভবপর নয়।


আপনার মতামত দিন

আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।