২০৫৫ বার পঠিত
ফোন করলেন বাংলা ভাষার অন্যতম পণ্ডিত ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের জনকদের একজন রবি চক্রবর্ত্তী। কদিন আগে শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্রের বই ‘বর্ণ সঙ্গীত’ নিয়ে কথা হচ্ছিলো ফেসবুক লাইভে। শুভাশিস বাবু বলছিলেন, সব ভাষাতেই মা শব্দটি ‘ম’ সংশ্লিষ্ট বর্ণ থেকে উদ্ভুত। যেমন, ইংরেজিতে ‘মাদার’। কিন্তু আমি তাতে বিনীত আপত্তি জানিয়েছিলাম। সে বিষয়েই কথা বললেন রবি চক্রবর্ত্তী। তিনি জানালেন, আমার কথা ভুল নয়, ‘ম’ ছাড়াও মা শব্দটি রয়েছে।
মানুষ যত জানে তত বিনয়ী হয়। আমাকে বিষয়টি জানানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না রবি চক্রবর্ত্তীর মতন পণ্ডিতজনের, তবু তিনি জানালেন। যেহেতু কলিম খান ও তার তত্ত্ব নিয়ে সেদিন আলাপ হচ্ছিল এবং তিনিও দেখেছেন অনুষ্ঠানটি। এত বয়স হয়েছে তবু স্মৃতি ও চিন্তা কতটা ধারালো, ঠিক মনে রেখেছেন। মনে রেখেই ক্ষাণ্ত হননি। আমাকে ও শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্রকে ফোন করে জানিয়েছেনও বিষয়টি। জ্ঞানচর্চার প্রতি একজন মানুষের কতটা নিষ্ঠা তার ফোনই তা প্রমাণ করে। নিষ্ঠা ও সাধনাই তাদের সত্যিকার পণ্ডিত করে তুলেছে, সত্যিকার মানুষ করে তুলেছে।
বিপরীতে আমাদের পড়তি ও উঠতি ‘পণ্ডিত’কুলের কী অবস্থা! বিনয়ের ধারে কাছে তাদের প্রায় কেউই নেই। বিনয় তো ‘দূর কা বাত’ কে কত ‘পণ্ডিত’ তা প্রমাণে উন্মুখ থাকেন তারা, সুযোগ পেলেই হলো। যেমন এখন আমাদের সংস্কৃতির স্পেল চলছে। সংস্কৃতি শেখাচ্ছেন ‘পণ্ডিত’গণ মানুষদের। তাদের আলাপের ঢঙ দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমনটা হলে ভালোই হয়, অনেকের জ্ঞানের দৌড় বোঝা যায়। নিজেকে নিয়ে খুব সংকোচে থাকি, কিছুই জানি না ভেবে। এমন আলাপ চললে সংকোচটা কাটে এবং উল্টো আহ্লাদিত হওয়া যায়।
অতি সম্প্রতি একজন বাংলাভাষী ‘পণ্ডিত’ আমাকে সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান দিলেন সামাজিকমাধ্যম দিয়ে এবং তা আমার একটা লেখার সমালোচনায়। তাকে আমি চিনি কিছুদিন ধরে, আমার দু’একজন বন্ধুর সামাজিকমাধ্যমের সঙ্গী হওয়ার সুবাদে। জানতাম তিনি লিখেন, নামী প্রকাশনা থেকে তার বই বের হয়। কিন্তু পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে নামী প্রতিষ্ঠান থেকে বই বের করলে একটু সমীহ করতে হয়। এমন ট্রেন্ডই আমাদের এখানে প্রচলিত। প্রতিষ্ঠান যত নামী লেখক তত দামী। সুতরাং একটু ভয়েই ছিলাম। তাই তার সমালোচনাতে সংকোচের মধ্যেও খুশি হয়েছিলাম। যাক আমাকে নিয়ে অন্তত তিনি লিখেছেন, ভালো লিখুন আর মন্দ লিখুন। তাকে স্যালিউট, তিনি আমার সংকোচটা কাটিয়ে দিয়েছেন। ‘আক্কেলমান্দ কা লিয়ে ইশারা কাফি’, তার অতটুকু লেখাতেই তাকে অনেকটা বোঝা হয়ে গেছে। তার সংস্কৃতি বিষয়ক জ্ঞানের সীমানা আন্দাজ করার পর আর আলাপে যাইনি, প্রয়োজন নেই বলে।
প্রকাশনী বিষয়ে একটু বলে নিই। আমার এক বন্ধু পাণ্ডুলিপি দিলেন এক নামী প্রকাশনীতে। কর্ণধার ছাপাতে চাইলেন ষাট হাজার টাকা। প্রশ্ন করতেই তেড়ে এলেন। বললেন, কোন প্রতিষ্ঠান থেকে বই বের করতে চাচ্ছেন এটা মাথায় রাখতে হবে। বন্ধু বেচারার বই ছাপানো সম্ভব হয়নি। তার বইটি গবেষণা বিষয়ক, আগামীতে হয়তো দেশের বাইরে এমন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে, যা চিন্তা করতেই ভিরমি খাবে অনেকে।
রবি চক্রবর্ত্তী যেভাবে বললেন, ‘তোমারটাই ঠিক ছিলো’, শুনে নিজে সংকুচিত হয়ে উঠছিলাম। বিশাল ব্যক্তিত্বের সমুখে যা হয় আর কী। আর আমাদের যে ‘পণ্ডিত’দের কথা বললাম, তাদের কাজ-কারবারে হয় উল্টোটা। মেঘ কেটে যাবার মতন সংকোচ কেটে যায়, ক্রমশ ভোরের আলোর মতন স্বচ্ছ হয়ে উঠি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন