১
১৪১৬ বার পঠিত
মুহম্মদ নিজেই ছিলেন সংস্কারবাদী। কুরাইশ গোত্রের এতিম অবস্থা থেকে বড় হবার পর তার দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় ভাবনা হয়ে ওঠে কুরাইশ গোত্রের বিরোধী। আরবের মাঝে অবস্থিত মক্কা ছিল জীবন ধারণের জন্য অত্যন্ত কঠিন, সেই সময় এক পাশে ছিল বাইজেনটাইন সম্রাজ্য, অন্যপাশে যথারীতি পারস্য সম্রাজ্য। দুই মহান সম্রাজ্যের মাঝে থাকা সৌদি আরব ছিল নানা গোত্রে বিভক্ত, কোন শক্তিশালী শাসক নেই, আরবের মরুভূমির কঠিন জীবনে নিয়মগুলো ছিল কঠিন। গোত্রগুলো একে অপরের সাথে লড়াই করে সম্পদ রক্ষা করতো। এই কঠিন পরিস্থিতিতে মক্কা কোন সুপরিচিত স্থান ছিল না, ইসলামপন্থীরা বলে থাকেন কাবা শরীফের গুরুত্বের কথা, সেটা কিছুটা সত্যি। নানা গোত্রের নানা দেবতা ছিল কাবা শরীফে, সব গোত্র বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এক হয়ে পুজো করতো, সেই সময়ে যুদ্ধ কেবল বন্ধ থাকতো, পরবর্তীতে ইসলামের বিবর্তনে এই প্রথার নাম হয় হজ। যাই হোক, সেই কঠিন পরিস্থিতিকে ইসলামপন্থীরা বলে থাকে আরবের অন্ধকার যুগ।
মুহম্মদ বাবা-মা খুব অল্প বয়সে হারিয়ে চাচা আবু তালিবের কাছে বড় হতে থাকেন, খুব অল্প বয়সেই চাচা তাকে ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত করেন এবং সেই সুবাদে তাকে মক্কার বাইরে, সারা সৌদি আরব ভ্রমণের সুযোগ মেলে। সে দেখতে পায় প্রাচীন ধ্বংস হয়ে যাওয়া নানা স্থাপনা, শুনে নানা নবীর গল্প, ধর্মের গল্প। এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে কিশোর ও তরুণ মুহম্মদ ছিলেন সৎ, সত্যবাদি যা সেখানে বেমানান ছিল। এই তথ্য মহানবী মারা যাবার মাত্র ২০ বছর পর প্রখ্যাত অমুসলিম আর্মেনিয়ার ইতিহাসবিদের কাছ থেকেও পাওয়া যায়। মহানবী আগ্রহী ছিলেন চাচা আবু তালিবের মেয়ে’কে বিয়ের ব্যাপারে কিন্ত বাপ-মা না থাকায়, গরিব মুহম্মদ’কে মেয়ের পাত্র হিসেবে পছন্দ করেন নি আবু তালিব। খাদিজা নামের ব্যবসায়ী বিধবা’কে মুহম্মদ বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন মুহম্মদ থেকে ১৫ বছর বড়। সেই সময়ে এটাও ছিল রীতিবিরুদ্ধ এবং অস্বস্তিকর, মেয়েরা কখনই ছেলের থেকে বয়সে বড় হতো না, পরবর্তী ২৫ বছর তিনি খাদিজার সাথেই ছিলেন, খাদিজা মারা যাবার আগ পর্যন্ত তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করেন নি। খাদিজা নিজেই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন এবং সেটাও ছিল সেই সমাজে ব্যতিক্রম।
মুহম্মদ পরবর্তীতে ধ্যানে বসতেন সমাধান খুঁজতে জীবনের, তিনি নিজে কষ্টকর জীবন পার করছেন এবং তিনি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন সেই প্রশ্নের উত্তর ধ্যানে বসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী আরও অনেক নবী। সেই নবীরা ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মেরও প্রবাদ পুরুষ। মূলত ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ান ইহুদি একই গাছের শাখা প্রশাখা। যাই হোক, ধ্যান থেকে ফিরে এসে তিনি যে দর্শন প্রচার করেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং তিনি ও তাঁর অনুসারীরার পড়েন প্রাচীনপন্থীদের ক্ষোভের মুখে। একই ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন জেসাস, এমনকি কিছুদিন আগে যখন বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করতে চান। মুহম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা এক সময় বাধ্য হয়ে মক্কা ছেড়ে সিরিয়ার এক শহরের ক্রিশ্চিয়ান রাজার আশ্রয়ে যান এবং কিছুদিন পড়েই কুরিইশ গোত্রের মাঝে, মানে মক্কায় ফেরতও আসেন। ঠিক এখানেই সালমান রুশদীসহ অনেকেই দাবি করেন তিনি কাবাঘরে মূর্তিপূজো মেনে নিয়েছিলেন এবং নেগোসিয়েশন করেছিলেন শয়তানের সাথে, সেই থেকেই সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভারসেস’ এবং ১৯৮৯ সালে মুসলিম বিশ্ব এই তত্ত্ব নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং বইটির অসংখ্য কপি পোড়ানো হয়, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমানী সালমান’কে হত্যার জন্যে ঘোষণা দিয়ে দেন। যাই হোক, এতসবেও একটা ব্যাপার স্পষ্ট, সব ধর্ম প্রচারকরাই ছিলেন প্রগতিশীল। সেই সময়ের সাপেক্ষে, ইসলাম ১৪০০ বছর আগে আরবের সেই সমাজের জন্যে ছিল পারফেক্ট, সেই সমাজ ও সময়ের প্রেক্ষিতে আধুনিক। মুহম্মদ পরবর্তীতে যুদ্ধ করেছেন, সফল হয়েছেন, কষ্টের মাঝে দিয়ে গেছেন – তাঁকে নানাভাবে দেখার সুযোগ আছে। মুসলমানরা তাঁকে যেভাবে দেখে কিংবা ক্রিশ্চিয়ান’রা জেসাস’কে যেভাবে দেখে সেখানে ধর্মীয় কারণ খুব বেশি, এই নবীদের যাপন ও দর্শন দেখতে চান না তাঁরা। মুহম্মদ নিজে কখনও জোর দেন নি কাউকে ইসলাম গ্রহণ করার, তাঁর চাচা আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ করেন নি অথচ মুহম্মদের পরবর্তী অনুসারীরা ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছে বহুবার, আজও পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা মানবেতর যাপন করছে।
ধর্ম আমরা শিখি যেভাবে এই যুগে, সেভাবে ধর্ম আজ কেবল বাড়তি বোঝা এবং বিভক্তির কারণ। বিজ্ঞান ও দর্শনের চরম উৎকর্ষের এই যুগে পুরনো অনেক কিছুই বাতিল হবে, সেগুলো সহনশীল্ভাবে মেনে নেয়ে হয়তো উচিত কিন্ত মৌলবাদ স্থান, কাল ও পাত্র মানে না। মৌলবাদের সাথে জড়িত ছিল সবসময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ। প্রগতিশীল ভাবনা সমাজ ও দেশের জন্যে সহায়ক, প্রগতিশীলতা হল পুরনো মতবাদ ও ভাবনা যখন একটা সমাজে কাজ করে না, তখন তা একমাত্র সমাধান। মুহম্মদ বা যে কোন ধর্ম প্রচারক ছিলেন সবার আগে প্রগতিশীল, তাদের নেতিবাচক দিকগুলোকেও তা ছাপিয়ে ওঠে। এই লেখায় তাই মুহম্মদের প্রগতিশীলতাকেই সামনে আনা হল।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
এপ্রিল ২৮, ২০১৮; ৮:১০ অপরাহ্ন
নবী মুহাম্মদ কারও উপর ইসলাম চাপিয়ে দেয় নি কথাটা সঠিক না। কোরানে একাধিক আয়াতে (২ঃ১৯৩, ৮ঃ৩৯ ও অন্যান্য) বলা হয়েছে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যতক্ষণ-না ইসলাম একমাত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ঃ৫-৬ আয়াতে পৌত্তলিকদেরকে যেখানে পাও সেখানে হত্যার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যদি-না তারা ইসলাম গ্রহণ করে নিয়মিত নামাজ আদায় করে এবং যাকাত দেয়। নবী কিভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছিল তার দু’টি দৃষ্টান্তঃ
(১) ৬২৭ বা ৬২৮ সালে নবী সিরিয়ার পাদদেশে অবস্থিত দুমাত আল-জান্দাল অঞ্চলে বসবাসকারী কাল্ব নামক খৃষ্টান গোত্রের বিরুদ্ধে শিষ্য আব্দ আল-রহমানের অধীনে এক বাহিনী পাঠান। তিনি আল-রহমানকে নির্দেশ দেনঃ “In the name of Allah and in the way of Allah, fight him who believes not in Allah”। এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করতে রাজী হলে নবী গোত্রপতি আল আস-বাগ-এর কন্যাকে বিয়ে করার আদেশ দেন আল-রহমানকে। আক্রমণের মুখে আস-বাগ ইসলাম গ্রহণ করে এবং আল-রহমান আস-বাগের কন্যা তুমাদিরকে বিয়ে করে মদীনায় নিয়ে আসেন। (Ibn Sa’d, Al Tabakat Al Kabir, II:110)
(২) ৬৩১ সালের শেষ দিকে নবী খালিদ বিন উয়ালিদের অধীনে এক বাহিনী পাঠান ইয়েমেনের কাছাকাছি নজরান অঞ্চলে। নবী খালিদকে নির্দেশ দেনঃ “to invite them to Islam for three days”, and “if they should decline, then he was to fight them”। খালিদ নজরানে পৌছে বলেন, ‘‘O people, accept Islam, and you will be safe”. (al-Tabari, The History of al-Tabari, IX:82)। আক্রমণে মুখে দেখানকার বানু আল-হারিস খৃষ্টান গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
বলা আবশ্যক যে, নবীর মৃত্যুর সাথে সাথে মদীনার বাইরের সব গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, যে বিদ্রোহ ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে দমন করেছিল খলিফা আবু বকর। মুহাম্মদের অধীনে ইসলামের মহানুভব বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে থাকলে এভাবে তারা বিদ্রোহ করতো না।
মুহাম্মদকে প্রগতিশীল বলাও ঠিক না, কেননা আরব সমাজের প্রায় সব নৈতিক ভাবনার অধগতি ঘটিয়েছিলেন তিনি।