প্রাচীন মগধে ঘুরে বেড়িয়েছেন লুম্বিনির গৌতম। খৃষ্টপূর্ব ৪৮৩ থেকে খৃষ্টপূর্ব ৪০০ সালে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। তার ভাষাও কিন্তু ছিলো- মাগধি বা প্রাকৃত। বাংলা ভাষার পূর্ব-পুরুষ এই ভাষা। সম্রাট অশোক গৌতমের জন্মস্থানে তীর্থ করতে গিয়ে লুম্বিনীতে স্তম্ভ স্থাপন করেন। তাঁর অন্য একটি স্তম্ভে বিভিন্ন ধম্ম পুথির উল্লেখ রয়েছে, যার দ্বারা মৌর্য যুগে লিখিত বৌদ্ধ ঐতিহ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদের নিকটে হাড্ডা হতে আবিষ্কৃত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে গান্ধারী ভাষায় রচিত ও খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত সাতাশটি বার্চের ছালের গান্ধার বৌদ্ধ পুঁথিগুলি বর্তমানে টিকে থাকা বৌদ্ধ পুঁথিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম।
এই গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুরা তাদের বিষ্ণু অবতার মানে। মজার বিষয় হচ্ছে- বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে অসংখ্য বিষ্ণুর মূর্তি আপনারা দেখতে পাবেন। যা বেশির ভাগই বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) এর মাটির নিচ থেকে বা ডোবা, পুকুরের তল থেকে আহরিত। সারা বাংলাদেশের মধ্যে বিশেষ করে দিনাজপুর, রাজশাহী বা বগুড়া থেকেও কিছু বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছে। এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন’তো আপনার মাটির নিচে আপনার কোন পূর্ব-পুরুষ ঘুমিয়ে আছে? মজার বিষয় হচ্ছে- এইসব গ্রানাইটের বা কষ্টি পাথরের দুর্লভ মূর্তিগুলোর বেশির ভাগেরই কারো হাত ভাঙা অথবা কান বা মুখে আঘাতের কারণে ক্ষত, শরীরের কোনও না কোনও একটি অংশ নষ্ট। অথচ গ্রানাইট পাথরের স্বভাব হচ্ছে সে লাইম স্টোনের মতো সময়ের সাথে সাথে ভঙ্গুর নয়। এই কারণে পিরামিড লাইম স্টোন দিয়ে বানানোতে এই পাঁচ হাজার বছরে যতটুকু ক্ষয়েছে কিন্তু পিরামিডের ভিতরের সিক্রেট চেম্বার গ্রানাইট দিয়ে বানানোতে একটা চুল পরিমাণ ক্ষয়ে যায়নি। তাহলে এই বিষ্ণু মূর্তিগুলো পিরামিডের অনেক পরের সময়ে গ্রানাইট বা কষ্টি পাথরে তৈরি হয়েও এমন নষ্ট কীভাবে হলো মনে প্রশ্ন জাগে কী? এর উত্তর এই লেখায় যথা সময়ে দেবো।
আমি নাস্তিক। আমি কোনও ধর্মই পালন করি না। কিন্তু, আমার পূর্ব-পুরুষের তৈরি ধর্ম-দর্শনটা’তো আমার জানাটা উচিত। আপনি গৌতম বুদ্ধের বাণী পড়ে দেখেন, তার দর্শন পড়ে দেখেন। বৈষ্ণব সাহিত্য পড়ে দেখেন। এরা আমাদের পূর্ব-পুরুষ। আমি জানি, আপনি পালি, সংস্কৃত আজ আর পড়তে পারবেন না। কিন্তু কোরানের সাথে সাথে আপনি বৌদ্ধকেও পড়ে দেখেন। গীতা, রামায়ণ, বেদ পড়ে দেখেন। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার পূর্ব-পুরুষদের চিন্তা, চেতনা, বোধ, বেশী মানবিক, শুদ্ধ? নাকি আরবদের কোরানের?
হয়তো আপনি ভাবেন, আপনার অঞ্চলের পূর্ব-পুরুষের দর্শন বা রক্ত আপনার শরীরে নেই। যেই পাহাড়, নদী, জল, মাটি, ঘাসে হাজার হাজার বছর আগে তাঁরা হেঁটে চলে বেড়িয়েছে, জন্মেছে, মরেছে। সেই একই পাহাড়, নদী, জল, মাটি, ঘাসে কিন্তু আজ আপনি ও আমিও হেঁটে চলে বেড়াই। তাদের’কে প্রভাবিত করেছিলো প্রকৃতি এবং মানুষ। আপনাকে আমাকেও তাই করতে বাধ্য। এই কারণেই বাংলাদেশে কোনও মুসলমানের কাছে কিছু আর কেউ সহি মুসলমান না। এই দিগন্ত-বিস্তৃত ধানের ক্ষেত দেখলে আপনার মন উদাস হবেই। নদীর উপর কুপি জ্বালা নৌকা দেখে আপনার জানতে ইচ্ছে করবে কে গান গায়? মাঝির গানের সুর আপনার ভিতর মায়া তৈরি করে দেবে। রাতের বেলা জোনাকির আলো, উঠানের হাঁস, বট গাছের ছায়া, পুকুরের জল আপনাকে আরবিয় হতে দেবে না। বাংলার জোছনা রাতে খালি মেঠো পথে বাড়ি ফেরা হুহু লেলুয়া বাতাসে, আপনার মনে ইহুদি, হিন্দুদের কতল বা ঘৃণা করার চিন্তাটা চাপা পড়িয়ে দেয়। শীতকালে পিঠা খেতে খেতে চুলার ধারে বসে- নাস্তিক, মুরতাদদের ভুলে যাবেনই। আপনার মায়ের হাতের মাটির চুলার রান্না, আপনাকে খুরমা-খেজুরের কথা মনে আনতে দেবে না। রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেলে দেখবেন- লক্ষ্মী-প্যাঁচা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনাকে নাস্তিক হতে হলে- নাস্তিকদের ব্লগ পড়া লাগে না। এই বাংলার প্রকৃতিই আরবের মতো চরম পন্থি নয়। আপনি মিছেই মাথায় টুপি, দাড়ি, হিজাব, বোরকা দিয়ে মুসলমান-মুসলমান খেলছেন নিজের সাথে। এটা যে আপনাকে মানাচ্ছে না, হাস্যকর লাগছে, ভণ্ডামি লাগছে সেটাও হয়তো বুঝতে পারেন। বুঝবেন না কেন? আপনি তো আর বোকা না! কিন্তু মানতে পারেন না। সবাই করে, সবাই পরে তাই আপনাকেও করতে হয়, পরতে হয়। আপনাদের জন্য আমার বড় মায়া লাগে। আপনারা ‘না- ঘার কা, না- ঘাট কা’।
সম্রাট অশোকও কিন্তু এই মগধের। এটাও বেশ মজার না? তার সময়ে তিনি এই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে- একজন ভয়ংকর যোদ্ধাবাজ সম্রাট থেকে পুরোপুরি উল্টো শান্ত একজন মানুষে বদলে যান। তার সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক পৃষ্ট-পোষকতা তিনি করেছিলেন। তাঁর শহরও কিন্তু পাটলিপুত্র- বর্তমান পাটনা। আমরাতো সবে ১৯৪৭ সালে এই মানচিত্র নিয়ে মূল বাংলা থেকে আলাদা হয়েছি। আমরা মুসলমানরা কাটতেই জানি, নুনুর আগা থেকে নিয়ে- কল্লা হোক, কিংবা দেশ, আমরা কেবল কাটতেই জানি। জোড়া দেয়া আমাদের কাজ নয়। কিন্তু, ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের এক দিন আগে থেকে নিয়ে হাজার-হাজার বছর এই মগধ কিন্তু বাঙলা রাজ্য-ই ছিলো। অশোক কিন্তু- আমাদের জনপদেরই মানুষ।
(সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধদর্শন কতদূর তিনি পৌঁছিয়েছিলেন! তাদের জেনারেশনে তাঁরা কী করলেন, আর হায়! আমরা আজ কী করছি!)
(এটা সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের ম্যাপ। তার চেয়ে বেশী আর কেউ বোধকরি আমাদের পূর্ব-পুরুষের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে পারেননি।)
এই সাম্রাজ্যের অধীনে আমরা পেয়েছি হিন্দু বা সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, চার্বাক ধর্ম, বাউল ধর্ম, কত শত ভাষা, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্পকলা, এবং জ্ঞান। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত-কেও আমরা পেয়েছি। এই অঞ্চলের ইতিহাস বা গল্প চীনের লোকেরা লিখে রেখেছে, সুদূর মিশরের ফারাও থেকে মেসিডোনিয়ায় ছোট্ট রাজপুত্র আলেকজান্ডার তার শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে আমাদের পূর্ব-পুরুষের মহান কীর্তির কথা শুনেছেন। মানুষ বা ইতিহাস আজ অ্যালেকজান্ডারকে দ্যা গ্রেট বলে। কিন্তু অ্যালেকজান্ডারের কাছে এই ইন্ডিয়া, এই ইস্ট, দ্যা গ্রেট ছিলো। তাই সে উত্তর ভারত পর্যন্ত এসেছিলো। আমরা কিন্তু এই দেশে থেকেও এই জাতির ইতিহাস কিছুই জানি না। আমরা ব্যস্ত- পাদ দিলে ওযু ছুটে যায় কিনা তার সহি হাদিস খুঁজতে। অশোকের সময়ে আরবের মক্কার কোনও অস্তিত্ব, কোনও রুট, নাম, ম্যাপ আপনি কোথাও কোনও অফিসিয়াল ডকুমেন্ট থেকে নিয়ে দেখাতে পারবে না। খুঁজে পাবেন না, মুসলিম স্কলারদের কাছেও পাবেন না। কারণ সেটা ছিলো না। নেই।
আমি জানি না আমাদের পূর্ব-পুরুষদের মতো পৃথিবীর আর কোন জাতি এত দর্শন বা সভ্যতা একটি সাম্রাজ্যের অধীনে দেখেছে কিনা। আমার জানা মতে এমন জাতি আর নেই। প্রতিটি মহান জাতির সভ্যতার ভিত্তি একটি বিশেষ আদর্শ বা প্রধান ভাবধারার উপরই। কিন্তু আমাদের পূর্ব-পুরুষের সাম্রাজ্য যেনো একটি নেইল নদের পাশে গড়ে ওঠা একটি ইজিপশিয়ান সভ্যতা কেবল নয়। এই সাম্রাজ্য যেনো মহান সিন্ধু, রাবি, ঝিলম থেকে- গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর মতো বড় বড় দর্শনের জল এই সাম্রাজ্যের মানুষের মনের অববাহিকায় হাজার হাজার বছর প্রবাহিত করেছে। যেই পর্বত থেকে এমন নদী সৃষ্টি হতে পারে, তেমন একটি হিমালয় পর্বত ছিলেন গৌতম। যিনি বয়ে গিয়েছিলেন এই বাংলার বুকের উপর দিয়ে। এবং এই গৌতম নদীর অববাহিকায় কী কী শাখা নদী সৃষ্টি করেছিলো- এখন বলবো।
যখন একটি জাতি একটি সাম্রাজ্য গঠন করে। এবং সেই সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা আসে, তখন তার প্রভাব বা ছাপ ওই অঞ্চলের শিক্ষায় বা আদর্শে বা দর্শনে পরে। একটি অঞ্চলে কেমন শাসক কেমন শাসন চালাচ্ছেন, সেটা বুঝতে হলে আপনাকে ওই সময়ের সাহিত্য বা সমকালীন দর্শন বা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাতে হবে। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে (এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০-১১০০ অব্দ, আমার মনে হয় তারো অনেক অনেক কাল আগের)। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত সবচেয়ে প্রাচীন বেদ- ঋগ্বেদের একটি শ্রুতি
Sangachhadhwam Samvadadhwam
Samvo-manaansi Jaanataam.
ইংরেজি অনুবাদ:
‘May we march forward with a common goal.
May we be open-minded and work together in harmony’
Samaano Mantrah Samiti samaanee,
Samaanam Manah sahachitta meshaam.
ইংরেজি অনুবাদ:
May our prayers be one.
May we belong to one brotherhood.
Samaanee va Aakootih Samaanaa Hridayaani vah.
Samaanamastu vo Mano Yathaa vah Susahaasati.
ইংরেজি অনুবাদ:
May our aspirations be harmonious.
May our minds be in unison.
May we strive to reduce disparity.
May we be bound in strong fellowship and unity.
Sangacchadhvam (Isha Basya) from the Rig Veda. X. 191.
(Adapted from translation of the Convent Vedanta Society of Northern California and from Nehal Raval’s Aradhana)
deva bhagam yatha purve sanjanana upasate
ইংরেজি অনুবাদ:
Come together! Speak together! Let our minds be all of one accord as the gods of old sat together in harmony to worship.
samano mantra: samiti: samani samanam mana: saha cittamesam/
samanam mantramabhi mantraye va: samanena vo havisa juhomi//
ইংরেজি অনুবাদ:
Let our speech be one; united our voices! May our minds be in union with the thoughts of the Wise.
Sharing a common purpose; we worship as one.
samani va akuti: samana hrdayani vah
samanamastu vo mano yatha va: susahasati
ইংরেজি অনুবাদ:
Let our aim be one and single! Let our hearts be joined as one. United be our thoughts.
At peace with all, may we be together in harmony.
এই ইংরেজি লাইনগুলো পড়লেই বোঝা যায়- দর্শনে মানবিকতায়, চেতনার কোন উৎকর্ষতায় পৌঁছালে এমন করে ভাবা যায়, লেখা যায়। আমি বেদের মাত্র একটি শ্রুতির কয়েকটি লাইনের উদাহরণ দিলাম। বেদে এমন বা এর চেয়েও গভীরতর শ্রুতি বাণী হাজার হাজার রয়েছে। আমি আবারো বলছি- এরা আমাদের পূর্ব-পুরুষ। আমাদের বুকের ভিতর ঘুমানো পিতা।
আমাদের এই জনপদের দর্শন থেকে আমরা নির্মাণ করেছিলাম- নালন্দা। সংস্কৃত ভাষায় ‘নালন’ শব্দের অর্থ: পদ্ম। আর ‘দা’ শব্দের অর্থ: প্রদান করা বা দেয়া। নালন্দা অর্থ: পদ্ম দেয়া। বা যেখানে পদ্ম দেয়া হয়। পদ্ম ছিলো জ্ঞান বা প্রজ্ঞার একটি প্রাচীন প্রতীক।
এই পদ্মের ছয়টি পাতার প্রতিটিতে একটি করে গভীর অর্থ রয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত বলেন, সেটা জেনারেল শিক্ষায় হোক আর ইসলামিক শিক্ষায়, একবার এই চার্টটি পড়ে দেখুনতো আপনার শিক্ষায় এর একটি বিষয় আপনি আপ্ত করেছেন কিনা? কিংবা আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আপনাকে এর একটি বিষয় নিয়ে আপনাকে শিক্ষা প্রদান করে কিনা?
আমি জানি, উত্তর হবে- না। আপনাকে এই ‘নালন্দা’ আপনার প্রতিষ্ঠান দেয়নি। দেখুন, আমি এখন পাঁচশ শতকের কথা বলছি। পাঁচশ শতক থেকে বারোশো শতক। সাতশ বছরের এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রাচীনতম এক মাস্টার পিস। এখানেও আমার পূর্বের একটি কথা আবার বলতে হয়- ‘যখন একটি জাতি একটি সাম্রাজ্য গঠন করে। এবং সেই সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা আসে, তখন তার প্রভাব বা ছাপ ওই অঞ্চলের শিক্ষায় বা আদর্শে বা দর্শনে পড়ে। একটি অঞ্চলে কেমন শাসক কেমন শাসন চালাচ্ছেন, সেটা বুঝতে হলে আপনাকে ওই সময়ের সাহিত্য বা সমকালীন দর্শন বা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাতে হবে।’
গুপ্তা ডায়নেস্টির এই নালন্দাও বিশ্ববিদ্যালয়ও কিন্তু প্রাচীন বাংলায়। বিহারে। প্রাচীন কালের এক অতি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানী গুণীরা এখানে আসতেন। ফিলোসফি, মেডিসিন, এস্ট্রোনমি, ফিজিক্স, ম্যাথ, হিস্ট্রি এবং আরো নানান বিষয় এখানে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা দেয়া হতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ছিলো দৃষ্টিনন্দন পদ্মের ঝিল। এই নালন্দাকে আর্কিটেকচারাল এবং এনভায়রনমেন্টাল মাস্টারপিস বলা হতো। আটটি আলাদা আলাদা কম্পাউন্ড ছিলো, দশটি টেম্পলস ছিলো, ম্যাডিটেশন হল ছিলো, ক্লাসরুম ছিলো, এর ভিতরেও লেক এবং পার্ক ছিলো। নয়টি লাইব্রেরী ছিলো। বলা হয়- ওই সময়ে পৃথিবীর সব চেয়ে বেশী বইয়ের কালেকশন ছিলো নালন্দায়। ছাত্রদের জন্য ডরমেটরি ছিলো। এখানে চৈনিক পর্যটক হিউএন সাং এসে থেকেছিলেন কয়েক মাস। তার রচনায় নালন্দার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়।
পৃথিবীর প্রথম এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দশ হাজার ছাত্রের বাসস্থান ছিলো। এবং দুই হাজার অধ্যাপক থাকতে পারতেন। নালন্দা ওই সময়ের একমাত্র গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি ছিলো। কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, পার্সিয়া, টার্কি থেকে এখানে ছাত্ররা, শিক্ষকরা পড়তে বা কেউ পড়াতে আসতো। সেখানে ভর্তি হওয়াটা ছিলো অনেক কঠিন। তাঁরা নতুন নতুন ফিলসফি গ্রহণ করতে সাদরে। নব্বই লক্ষ পাণ্ডুলিপি ছিলো নালন্দায়।
শোনা যায়- সম্রাট অশোক এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এক লক্ষ মুদ্রা দান করেন। তারপর এর কাজ শুরু হয়। সেই হিসেবে ধরলে হয়তো এর ইতিহাস খৃষ্টপূর্বই হবে। এরপর গুপ্তা ডাইনেস্টি, পালা ডায়নেস্টি সবাই অর্থ দিয়ে এই মহান বিদ্যাপীঠকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবিষ্কার করা হয় স্ক্রিন গ্রাফটিং, শূন্যের ‘০’, অসীম তত্ত্বের, এবং ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ এই সংখ্যা সিরিজের।
(বর্তমান নালন্দা)
বারোশো সনে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলা আক্রমণ করেন, তখন তিনি, এই নালন্দা’কে পুড়িয়ে দেন। জীবন্ত পুড়ে যায় যারা ভিতরে ছিলো। আর যারা বাহিরে বের হতে চেষ্টা করেছিলেন, তাদের প্রত্যেককে গলা কেটে জ্বি হ্যাঁ, গলা কেটে হত্যা করা হয়। তিন মাস সময় ধরে জ্বলেছিলো নালন্দার জ্ঞানভাণ্ডার পাণ্ডুলিপিগুলো। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম, বর্বরতম কাজটির নায়ক এই খিলজি। উপরে বলেছিলাম না, বিষ্ণুর কষ্টি পাথরের মূর্তিগুলো কীভাবে এমন ক্ষতিগ্রস্ত হলো? বা তাদের গায়ে কেন আঘাতের চিহ্ন? এই বখতিয়ারের পরবর্তী অনুসারীরাই যেখানে এই বিষ্ণু মূর্তি পেয়েছে তাকে ধারালো তলোয়ার বা বর্শা দিয়ে আঘাত করে নষ্ট করে ধারেকাছে কোনও মজা পুকুর বা ডোবায় ফেলে দিয়েছে। এখন যেভাবে সিরিয়ার প্রাচীন আর্কিওলজিক্যাল মূর্তিগুলো আইএসআইএস ধ্বংস করছে, ঠিক এভাবে হয়তো বা আরো বর্বর ভাবে তারা আমাদের মহান অতীতকে ধ্বংস করেছিলো। তখন যে বৌদ্ধিস্ট বা হিন্দু মাইগ্রেশন এই অঞ্চল থেকে হয়েছে এটা দিনের আলোর মতো বোঝা যায়। যারা জ্ঞানীগুণী ছিলো তাঁরা প্রায় সবাই নিহত হয়েছে, আর বাকিরা প্রাণ ভয়ে পালিয়েছে। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। আর বাকি কিছু ডোম, জেলে, চাষা-ভুষা একেবারে প্রান্তিক মানুষ হয়তো বা রেহাই পেয়েছিলো। তাই এই বাংলাদেশ আর মাথা উঁচু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আদর্শে দাঁড়াতে পারেনি। শেখ মুজিবর রহমানের মতো একজন মহান নেতা ছাড়া আমাদের হাতে গর্ব করার আর কিছুই নেই। বৌদ্ধরা প্রাণ বাঁচাতে তৎকালীন দুর্গম জঙ্গল বা পাহাড়ে যে গিয়েছে, আজো অব্ধি বৌদ্ধদেরকে আর সমতলে তেমন দেখা যায় না। তাঁরা আজও সেই পাহাড়েই বেশী। পৃথিবীর এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষের জ্ঞানের যে দ্বীপ সেদিন যে নিভেছিলো, আজো সেই অন্ধকার কাটেনি। ছাইয়ে ঢাকা পড়ে যায় নালন্দা। একসময় জঙ্গলে, মাটিতে পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়। সাপ, বাঘ, হিংস্র জানোয়ায়ের অভয়ারণ্য ছিলো শত-শত বছর এই নালন্দা। এরপর ১৯১৫ সালে, প্রায় সাতশ বছর পরে এর খনন কাজ শুরু করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।
শিক্ষায়, জ্ঞানে যারা পৃথিবীকে আলো দিতো। পৃথিবীর জ্ঞানের আলো যারা এই বাংলায় ধরে রেখেছিলো। আজকের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আপনি কী নিয়ে গর্ব করেন? নালন্দাকে নিয়ে নাকি খিলজিকে নিয়ে, নিজেকেই প্রশ্ন করুন। বারোশো সন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই বাংলায় আমাকে একটি উদাহরণ দেখান গর্ব করার মতো, যা মুসলমানরা সেই সময়ের পূর্ব থেকে ভালো কিছু করার দৃষ্টান্ত রেখেছে।
এই নালন্দার একজন অধ্যাপক (৯৮০-১০৫৩) বৌদ্ধ পণ্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক। দশম-একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পণ্ডিত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণিভুক্ত হন। পরে দীপঙ্কর মগধের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আচার্যদের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন। এই বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) খনন করে দুইটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া গেছে। যার আর্কিওলজিক্যাল কাজ করছে জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে পাহাড়পুর বিহার, সোমপুর বিহার, বগুড়ায় বিহার, মহাস্থানগড়, পৃথ্যু রাজের ভিতরগর, ওয়ারি, বটেশ্বর, অথচ এই দেশে ৯৪% মুসলিম। সিরাজুদ্দৌলা হলেন বাংলার, বিহারের উড়িষ্যার মুসলিম নবাব! কী ভাবে? আসুন, জানি।