৩য় পর্ব
ভারতে ও বাংলায় ইসলামের আক্রমণ:
আমি ইসলামের আরব উত্থান এবং তার ভারতের আক্রমণের ইতিহাসের ডিটেইলে যাবো না। সেটা নিয়ে কখনো আলাদা একটা লেখাই লিখবো। এখানে আমি যেটা করবো, সেটা হচ্ছে প্রাক-ইসলামিক ভারতের কথা’তো বললাম, এখন থেকে ভারতে ইসলামিক সাম্রাজ্যের শুরু থেকে দেশ-ভাগ পর্যন্ত একটি ওভার ভিউ তুলে ধরবো। যাতে করে খুব ডিটেইলে না গিয়েও হিন্দুকুশ পর্বত থেকে থেকে ইসলামিক শাসন বাংলার মেঘালয় পর্যন্ত কীভাবে এলো, কতটুকু একেকজন শাসকের সীমানা ছিলো, এবং তারা কতদিন শাসন করেছেন তার একটা সহজ বোধগম্য রূপ যেনো বোঝা যায়। আমি দেশ ভাগে গিয়ে থামবো। তারপরেরটা তারপর।
এখানে দেখুন মুসলিম শাসকদের একটি তালিকা ও তাদের শাসন আমলের একটি ডিউরেশ
নিচে আমি ভারতের মানচিত্রের একটি ধারাবাহিক মুসলিম শাসন আমলের ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরেছি। যাতে পাঠক বুঝতে পারেন, যে মুসলমানেরা কখনওই পুরো ভারত শাসন করেনি। এবং কোনও শাসকই দীর্ঘ মেয়াদী নন। তারা ভারত লুটতে এসেছিলেন। যিনি যতদিন পেরেছেন লুটেছেন। আবার তার হাত থেকে আঞ্চলিক শাসকরা তাদের অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু, মুশকিল হলো, বাঙলা ওই ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির কাছে যে গণহত্যার শিকার হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বাঙলা আর কোনোদিন মুসলিম শাসকদের হাত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। নালন্দা-ই ছিলো আমাদের বাংলার মানুষের শেষ উপস্থিতি। বারোশো সন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমরা আর বাঙালি হতে পারিনি। হ্যাঁ, ব্রিটিশ আমলে সো কল্ড ব্রিটিশ শাসন বাঙলায় হয়েছে বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু আমি ভাবি না। কারণ আমি জানি ব্রিটিশরা মুসলিম নবাব বা জমিদারদের হাতের নেটিভ ডিলিংসটা দিয়ে রেখেছিলো। দেশ ভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গ- বাঙলার ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু, পূর্ব-বঙ্গ একেবারেই মাটির নিচে। আটশ বছরের মাটির নিচে।
যেসব পাঠক এই লেখাটি পড়ে যাচ্ছেন, তারা নিচের ম্যাপগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের অতীতের জিও-পলিটিক্স পরিষ্কার দেখতে পাবেন। আমি ভারতের ইসলামিক শাসকদের নিয়ে লিখে এই লেখাটিকে আর তথ্য ভারাক্রান্ত করতে চাইনি। সেটা নিয়ে অনেক বইপত্র পাওয়া যায়। পড়ে দেখতে পারেন কৌতহল থাকলে। আমি যা বলতে চাইছি- সেটা নিচেই দেখানো আছে।
যে মগধের গৌরব দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাকে শুধু লণ্ডভণ্ড করতে দেখলাম এই মুসলিম শাসকদের শাসন আমলে। প্রাক-ইসলামিক যুগে বঙ্গের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষা, জ্ঞান, শিল্পকলায় যে চরম উৎকর্ষতা, সেটাকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতে দেখলাম। আমি যখন নিচের ম্যাপগুলোকে দেখছিলাম। বঙ্গের প্রাচীন ইতিহাস পড়ছিলাম, আমার চোখ ভিজে উঠছিলো আজকের এই বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই- প্রাচীন বাংলার চেয়ে গৌরব আর কোন জাতির আছে? কারা আর শিল্পে, সাহিত্যে, জ্ঞানে, ভাষায়, দর্শনে, গানে, শিক্ষায় পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে? পৃথিবীর আর কোন জাতির কাছে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ চতুর্থ বা পঞ্চ শতকে জ্ঞান নিতে, বা পড়তে আসতো? আমরা কী ছিলাম, আর এক হিংস্র বর্বর জাতি আমাদেরকে কী করে দিয়ে গেছে, সেটা জানুন। তুর্কির খিলজি আপনার পূর্ব-পুরুষ নয়। নালন্দা আপনার পূর্ব-পুরুষ।
যাইহোক, চলুন পাঠক- অতীতে যাই।
উমাইয়া খলিফার হুকুমে আরবের তায়েফ থেকে মুহাম্মদ বিন কাশেম ৭১১ এডিতে তৎকালীন মহাভারতের পাঞ্জাব এবং সিন্ধ প্রদেশ আক্রমণ করেন। এবং রাজা দাহের’কে পরাজিত করেন, হত্যা করেন। মন্দির ধ্বংস, নারীদের ধর্ষণ, দাসী হিসেবে তুলে নিয়ে যাওয়া, শিশুদের হত্যা করার মধ্যে দিয়ে এই জেনারেলের হাত ধরেই ইসলাম প্রথম ভারত উপমহাদেশে আসে। এরপর ক্রমান্বয়ে ৮৭০ সনে হিন্দু-রাজ্য আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরবরা আক্রমণ করে। তার প্রায় ৩০০ বছর পরে ঐ অধিকৃত অঞ্চলের মুসলিম নেতা মাহমুদ গজনী ভারত আক্রমণ করেন ১৭ বার। অসংখ্য মন্দির তারা গুড়িয়ে দেয়, লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ শিশু হত্যা করে, তার সহায় সম্বল সম্পত্তি বিনষ্ট করে। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো সুবিখ্যাত সোমনাথ মন্দির। ১০০০-১১০০ সনের ভিতরে মুসলিমরা প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে এই ভারতে। যা ছিলো তৎকালীন ভারতের জনসংখ্যার ১০%।
টার্কির মোহাম্মদ ঘুর বা ঘুড়ী ১২০৬-এ শেষ অবদি দিল্লির রাজাকে পরাজিত করেন। তিনিই প্রথম মুসলিম সলতনৎ দিল্লিতে প্রতিষ্ঠা করেন। অসংখ্য মানুষকে আবারো নিহত হতে হয়, ধর্ষিত হতে হয়, ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। যার সীমানা ভারতের পাঞ্জাব থেকে প্রায় এই বাঙলা পর্যন্ত ছিলো। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ততদিনে বাঙলা আক্রমণ করে- তিব্বতের দিকে চলে গেছেন।
এই শুরু হলো বাংলার অন্তিম কাল। এই সময়টায় যখন বখতিয়ার নালন্দাকে পুড়ছে, তখন সেন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো বিক্রমপুর (বর্তমান নাম মুন্সিগঞ্জ)। আহা! বিক্রমপুর। আজ যেখানে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। একটি নয়, দুটি। ছয় বা সাত-এর শতকের সময়ের। আহা রে!
ইখতিয়ার-উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলো- জাতিতে তুর্কি এবং পেশায় ভাড়াটে সৈনিক। আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী। গজনির সুলতান ঘোরীর সৈন্যবাহিনীতে চাকরীর প্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হয়। দেখতে খাট, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার বখতিয়ারকে দেখে সেনাধ্যক্ষ সন্তুষ্ট হননি। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে সে দিল্লিতে যায়। দিল্লির দরবারে কুতুবউদ্দিনের কাছে হাজির হন, তার কাছেও চাকরী পেতে ব্যর্থ হন। এরপর যান বদাউনে। সেখানে সে নগদ বেতনে চাকরী পায়। কিন্তু এতে সে তৃপ্ত ছিলো না। অল্প কদিন পরেই সে বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যায় আসেন। সেখানকার শাসক হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ভাগবত ও ভিউলী নামক দুইটি পরগনার জায়গির প্রদান করেন। এইখানেই বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু করে। সে অল্প সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে জেহাদের নামে পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকে। তার কথা নানান দিকে ছড়িয়ে পড়ে। লুটের মালের ভাগ পেতে এই জেহাদে আরো মুসলমান ভাগ্যান্বেষী মুসলিম সৈন্যরা যোগ দেয়। এইভাবে বখতিয়ারের সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে একদিন তিনি এক প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। কিন্তু, প্রতিপক্ষ কোনও বাধাই তিনি পেলেন না। দুর্গজয়ের পরে তিনি দেখলেন- দুর্গের সকলেই মুণ্ডিতমস্তক এবং দুর্গটি বই পত্রে ঠাসা। তিনি দুর্গটি জ্বালিয়ে দিতে বলেন। সমস্ত ভিক্ষুকে হত্যার নির্দেশ দেন। তিনি একজনকে জিজ্ঞেস করেন? এরা একটি বইয়ের এত কপি কেন করেছে? তাকে উত্তরে বলা হয়, একটি বইয়ের এত কপি নয়, এইসব প্রতিটিই আলাদা বই। তিনি উত্তরে তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন- আমাদের মুসলমানদের কেবল একটি বই, তাদের এত বই কেন? সব পুড়ে ফেলো। এরপর বঙ্গের অন্ধকার যুগ। বাংলার ইতিহাসে ঐ সময়ের পূর্বের আর কোনও বই বা সাহিত্য, কিছু পাওয়া যায় না। এমনি কী বাউলদের লেখা অনেক গানের স্বরলিপি বা গান ঐ সময়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আমাদের হাজার হাজার বছরের বাউল সভ্যতাও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
যারা ঢাকায় থাকেন তারা বিক্রমপুরে গিয়ে দেখে আসতে পারেন খনন কার্য। আর যাদের বাড়ি বিক্রমপুরে তাদের আর কী বলবো।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে ধরা হয়! আমি বুঝি না সিরাজ কীভাবে বাংলার হন? আর ব্রিটিশরা কীভাবে বহিরাগত!
সিরাজ ১৭৫৬ সালে বাংলার, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে মসনদে বসে। ওর বয়স ছিলো ২২ বছর। কোনও ঐতিহাসিক এর মতেই সে যোগ্য শাসক ছিলো না। আর বাংলার শাসক হবে- বাঙালি। সিরাজ তো বাঙালি না। সে আলীবর্দী খানের নাতি। আলীবর্দী খানের পিতার নাম মির্জা মুহম্মদ, তিনি আরব বংশোদ্ভূত। তার মা ইরানের খোরাসানের এক তুর্কি উপজাতি থেকে এসেছেন। তো এই যদি সিরাজের দাদা দাদির পরিচয় হয় তাহলে সেও বহিরাগত, ব্রিটিশরাও বহিরাগত। ব্রিটিশরা বরং সিরাজের চেয়ে শিক্ষায়-দীক্ষায় প্রশাসনিক দক্ষতায় অনেক ভালো। এখনো বাংলাদেশ যা কিছু করে খায়, রাষ্ট্রীয় আইন বা প্রশাসনিক আইনে, সেসব বাংলার নবাবী আইন না, ব্রিটিশ আইনেরই লেফট ওভার।
এই সময় বা এই শাসকদের শাসন আমলে বাংলায় তিতুমীরের কথা চলে আসে। তাকে অনেকেই আমরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী হিসেবে জানি। কিন্তু এইটুকু জানি বলেই ভুল জানি। তাকে আরেকটু জানা আবশ্যক।
১৮২২ সালে তিনি মক্কায় হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। তিনি একজন হাজ্বি। সেখানে তিনি সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এবং ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। বিজ্ঞ পাঠক যারা ওয়াহাবী মতবাদ কী জিনিস এটা জানেন না। তাদের কে যে কী বলবো জানি না। তবে, জামাত, আল-কায়দা, তালেবান, এবং আইএসআইএস সুন্নি ওয়াহাবি মতবাদের সমর্থক। বর্তমানে যা কিছু টেররিজম ইসলামের নামে হচ্ছে- তারা সকলেই ওয়াহাবি মতবাদের। যাইহোক তিতুমীরের পড়াশোনা মাদ্রাসায় এবং তিনি কোরআনে হাফেজ। তিতুমীর হজ্ব থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহ্বান্দ’ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীরের জানার কথা- এই ব্রিটিশ পিরিয়ডের আগে সুলতানি আমল থেকে মুঘল বা নবাবী আমল পর্যন্ত, ইসলামি শাসকদের কর ব্যবস্থা হিন্দু বা বিধর্মীদের বিষয়ে কী ছিলো। বিজ্ঞ পাঠকদের মনে কৌতূহল হলে একেবারে শেষের মুঘল সম্রাট আওরংজেবের বিধর্মীদের কর বিষয়ে বই-পত্র পড়ে নিয়েন। আমি একটি কর নিয়ে সামান্য বলি- জিজিয়া কর– মুসলমান কর্তৃক অমুসলমানদের নিরাপত্তা করই এক কথায় জিজিয়া কর। অর্থাৎ, আপনি যদি মুসলমান না হন কিন্তু আপনার দেশের শাসক যদি মুসলমান হয়, তাহলে আপনার জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আপনি তাকে জিজিয়া কর দেবেন। এই কর মুসলমানদের ওপর প্রযোজ্য নয়। তবে আপনি যদি সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন কিংবা মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন তাহলে আপনার জিজিয়া কর মৌকুফ করা হবে। যদিও সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয়াটা জিম্মিদের জন্যে ছিল অসম্ভব ব্যাপার।
আওরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৬৩৩) সময় মুসলিম ট্যাক্স যিযিয়া প্রযোজ্য ছিলো। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর ও কট্টরপন্থী মুসলিম শাসক। এই কারণে অনেক ধর্মান্তরিত হবার ঘটনা ঘটে। মুসলিম কর ব্যবস্থা নিয়ে লিখলে সেটা আরেক বিরাট আলোচনা হয়ে যাবে। সেদিকে এখন আর গেলাম না। তো, এই তিতুমীর হটাত হজ্ব থেকে এসে- ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে যে আন্দোলন শুরু করলো তাকে আমি কতটা আন্দোলন বলবো কতটা জঙ্গিবাদ জেহাদ বলবো বুঝতে পারছি না। হজ্বে যাবার আগে যার সব ঠিক ঠাকই চলছিলো ,হটাত সে কেন হজ্ব থেকে এসে ইসলামী আন্দোলন শুরু করবে? সে ব্রেন ওয়াস হয়ে আসলো বলে মনে হচ্ছে না? নাকী এখানেও আমেরিকার কোনও হাত আছে?
একটু পরেই দেশ ভাগের ম্যাপ চলে আসবে। তার আগে আরেকটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বলে নেই।
ফরায়েজি আন্দোলন: উনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা একটি সংস্কার আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ধর্ম সংস্কার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফরায়েজী শব্দটি ‘ফরজ’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাজেই ফরায়েজী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের লক্ষ্য হচ্ছে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করা। এ আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তউল্লাহ। তিনি অবশ্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, অবশ্য পালনীয়ই হোক বা ঐচ্ছিকই হোক, কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তউল্লাহ হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে বিশ বছর অবস্থান করে হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ শেখ তাহির সোম্বলের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান যে, বাংলার মুসলমানদের একটি অংশ বহুবিধ স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব-উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে উঠেছেন। সে কারণেই তিনি ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন।
আমার এই দুঃখ রাখার কোনও জায়গা নেই যে মহাত্মা গান্ধী এই জঙ্গিদের পালস ধরতে পারেননি। তিনি এই আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। এরাই পরে রায়ট লাগাবে। দেশ ভাগ করবে তিনি এর কিছুই বুঝতে পারেননি। তিনি এটাকে ভেবেছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এটা যে সুযোগ পেলেই নিজের দেশ, নিজের মাটির সাথেই বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেবে তিনি তার দূরতম কল্পনাতেও সেটা আনতে পারেননি। যে একই ভুল এখন শেখ হাসিনা করছে। ইসলামিক দলগুলোর সাথে একাত্মতা বা প্রশ্রয় দিয়ে। সে বিষয়ে পরে আসছি।
১৯৪৭ সন। দেশ ভাগ। তাকিয়ে আছি এই মানচিত্রটার দিকে। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তান। আমি যা কিছু লিখছি সবই আজকের এই বাংলাদেশের মানসিকতা এই নিচু মানসিকতা তৈরির মহা ইতিহাস। যার একটা বড় প্রমাণ ১৯৪৭। এই দেশ ভাগ হবার একদিন আগে থেকে হাজার হাজার বছর যে ভারত আমার আপনার দেশ ছিলো, সেটাকে কেটে, একপাশে সিন্ধু নদী যার উপরেই ভারতের নাম ইন্ডিয়া, আরেক পাশে তার গঙ্গা, যমুনা, এইসব কেটে আমরা কী পেতে পাকিস্তানের সাথে যোগ দিয়েছিলাম? এই দিকটা কেউ ভেবে দেখে না- তিতুমীর, হাজি শরীয়তউল্লাহ’র ওয়াহাবী মতবাদ কী আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেনি? বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান ১৯৪৬ সালে কুখ্যাত নোয়াখালী দাঙ্গার (১০ অক্টোবর ১৯৪৬) মধ্য দিয়ে শুরু হয়। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার পূর্ণিমার রাতে ২১৮ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়, ১০ হাজারের বেশী হিন্দু বাড়ী লুট করা হয়,২০০০-এর বেশী হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়, কয়েক হাজার হিন্দু রমণী ধর্ষিতা হন এবং শত শত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। এসব ঘটনার দুঃখজনক দিক হচ্ছে তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর মিঃ বরোজ বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক যে হিন্দু মহিলারা শত শত মুসলমান কর্তৃক ধর্ষিতা হবেন, কারণ এরা মুসলমান রমণীদের চেয়ে বেশী সুন্দরী।
আরেকটি দিক আছে, সেটা হচ্ছে বাংলার অলস, বিলাসী, ভোগবাদী, উর্দু বলা নবাবরা। জিন্নাহকে আমাদের বাংলাদেশের নবাবরাই পাকিস্তান বা মুসলমানদের জন্য দেশ বানানোর কু-বুদ্ধি দিয়েছিলো। টু-নেশন থিয়োরি দিয়েছিলো। যাতে তারা তাদের মতো ভোগ বিলাসে এই বাংলার মুসলিম প্রজাদের শাসন করতে পারে। আমাদের দেশই মুসলিমলীগ গঠন করে। ধর্মান্ধ জনগণকে বুঝিয়েছে, উসকিয়েছে হিন্দুদের দেশে থাকা যাবে না। হিন্দু জমিদাররা অত্যাচারী, তাদের জাতপাত অতি জঘন্য প্রথা। বলি, মুসলমান অত্যাচারী নবাব নেই? কোন মুসলিম জমিদার তার প্রজাদের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মেঝেতে বসেছিলও? যেই হিন্দুদের সাথে থাকবেন না বলে মুসলমানদের জন্য দেশ আলাদা করেছিলো ওই নবাব’রা, আজ সেই হিন্দুদের ভারতে ২৫ কোটি মুসলমান বাস কীভাবে করে? তাদের লজ্জা করে না? আজ আমরাই বা কেন মুসলমান হয়েও পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারিনি? এটাও কী বোঝেন না যে দেশ ভাগ ধর্মের কারণে হয়নি। এটা ছিলো মুসলিম নবাবদের বা নেতাদের রাজনৈতিক ফায়দা নেবার প্লেসই। আম জনতার নেতা কী একজন মুসলিম নবাবও ছিলেন আসলে? কিংবা জিন্নাহ? জিন্নাহ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য আইনি লড়াই লড়তে একজন ল’ইয়ার হয়ে কী পরিমাণ স্বর্ণ নিয়েছে জানেন? তার ওজনের সমপরিমাণ। পাকিস্তানে তার লাইফ-স্টাইল জানেন আপনারা কেউ? তার প্রাসাদোপম বাড়ি দেখেছেন? তিনি শুকর খেতেন, ব্ল্যাক-ডগ হুইস্কি খেতেন, তিনি হলেন মুসলিম দেশের কায়েতে আযম! জাতির পিতা? আমাদের দেশের মুসলিম নেতারা-তো এইসব জানতেন। তারপরও তারা ধর্মের ধোয়া তুলে তাকে মুসলমানদের নেতা বানান কীভাবে? কীভাবে মেনে নিলেন?
আমাদের দেশের দেশ ভাগের সময়ের মুসলিম নেতাদের আমি মরণোত্তর বিচার চাই। তাদের কারণে মানব ইতিহাসের যে বিপুল মাইগ্রেশন এবং কিলিং হয়েছে তার দায়ে। কই গান্ধিতো বিলাসী জীবন-যাপন করেননি জিন্নার মতো। চাইলে তিনি কী জিন্নার চেয়েও দশগুণ বিলাসী জীবন-যাপন করবার ক্ষমতা রাখতেন না? এই নেতাদের স্বভাবেই কী বোঝা যায় না- যে কোন দেশের জনগণ কেমন? আমাকে বলেন, পাকিস্তানে ১৯৪৭ সনে কতজন বিধর্মী ছিলো আর আজ কতজন আছে। পারসেন্টিজ দেখেন। বাংলাদেশেও দেখেন। ১৯৪৭ সালে কতজন বিধর্মী ছিলো আর আজ কত শতাংশ আছে। আমি জানি আমি চোখ বন্ধ করে জানি, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে মাইনোরিটি জনগণ আরো কমে কমে ১৯৪৭ সনে যদি ৩০/৪০ থেকে থাকে তবে এখন সেটা কমে কমে ২/৩%- এ এসেছে ঠেকেছে। এবার আসেন ভারত। সেখানে ১৯৪৭ সালে কত শতাংশ মুসলমান ছিলো আর আজ কত শতাংশ হয়েছে? এটাও আমি নিশ্চিত সেটা ডাবল ত্রিপল হয়েছে। এবং আরো লজ্জার কথা হলো এই যে বাংলাদেশ পাকিস্তান দুই দেশই- গান শোনে ভারতীয়, ছেলে-মেয়েদের পড়তে পাঠায় ভারতে, ঘুরতে আসে ভারতে, ব্যবসা করে ভারতে, চিকিৎসা করতেও ভারতেই যায়, আর সারাদিন ভারতকে গালাগালি করে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে আসে না, আমরাও পাকিস্তানে যাই না। বাহারে বাহ, মুসলমান। আমাদের বাংলা ভাষা মুসলমানদের না, এটাও ভারতীয়। বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধ, পশতুন প্রাচীন ভারতীয় ভাষা। এমনকি পাকিস্তান যে উর্দু বলে সেটাও ভারতীয়, উর্দু ভাষা লৌখনুতে তৈরি হয়। ১৭ শতকের মাঝামাঝি। পাকিস্তান বলে তাহলে আসলে পাকিস্তানিরা কী বোঝে কে জানে? আর আমরা বাঙ্গালিরা, মুসলিম বাঙ্গালি বলতে কী বুঝাই সেটাও আমার মাথায় আসে না।
১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত ভারত বাংলা ব্রিটিশদের শাসনে থাকে। যেহেতু ইংরেজরা ক্ষমতাটা নিয়েছিলো মুসলিম শাসকদের থেকে তাই মুসলিম শাসকরা এক প্রকার এক ঘরে হয়ে ছিলো এই সময় কালটাতে। তারা অপেক্ষা করছিলো আবার তাদের ইসলামী শাসন ফিরে পাবার।
আগস্ট ২০, ২০২৩; ২:৪০ পূর্বাহ্ন
মালুয়ানী চিন্তাধারা,মৌদির বংশবদ।