উনিশ ও বিশ শতকে আমাদের মনীষীরা সবাই বলে গেছেন প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের মিলন সম্ভব নয়। কিন্তু সেই প্যারাডাইম কী এখনকার গ্লোবালাইজড বিশ্বের জন্যে সত্য। আজকের দুনিয়ায় কোরিয়া, জাপান, চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সবাই পাশ্চাত্যের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব দেশ পাশ্চাত্যের চেয়ে পিছিয়ে আছে, বা পাশ্চাত্যের চেয়ে তাদের কম উন্নয়ন ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা পাশ্চাত্যকে ছাড়িয়ে গেছে। তারপরেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে একবিংশ শতকে পাচ্য-প্রতীচ্য একটা কমন মিডল গ্রাউণ্ডে পৌঁছেছে।
প্রযুক্তির কারণে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের নতুন জেনারেশনের মানুষ একসাথে কাজ করছে। পাশ্চাত্যের তরূণ তার কলোনিয়াল অতীত নিয়ে ব্লিস্ফুলি ইগনোর্যান্ট, অপরদিকে প্রাচ্যের তরুণ তার চিন্তা-চেতনায় পাশ্চাত্যের তরুণের চেয়েও বেশি পাশ্চাত্যের। তার শিক্ষা-দীক্ষা, কালচার, চেতনা সবকিছু পাশ্চাত্যের। সে নিজদেশে ইংলিশ মিডিয়াম বা পাশ্চাত্যের কোন ভাষায় পড়েছে। স্বজাতির কালচার ও ঐতিহ্য নিয়ে সে আগেকার জেনারেশনের মত উদ্বিগ্ন নয়। ‘ইগনোর্যান্স ইজ ব্লিস’, আপনি যা জানেন না সেটা আপনার ক্ষতি করতে পারে না। নিজেদের অতীত সম্বন্ধে না জানা বা জানলেও সেটাকে পরাজিত মনে করে পাশ্চাত্যের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা থেকে তারা ইতোমধ্যে অনেক ছাড় দিয়ে বসে আছে।
একই ভাবে পাশ্চাত্যের তরুণকেও প্রাচ্যের শিক্ষিত, কোয়ালিফাইড তরুণকে সহকর্মী হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে। তার খেলার মাঠ, বিনোদনস্থল, পাড়া-মহল্লা এমনকী তার সমাজের মেয়েদেরকেও শেয়ার করতে হচ্ছে। না করে উপায় নেই, শুধু পাশ্চাত্যের অধিবাসী বা শাদা বলে তাকে কেউ চাকরি দিবে না। বিজনেস এখানে ইকুয়ালাইজার এর কাজ করছে। অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিতরাও ছোটখাট জবে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজ এখন তাদের শ্রম ছাড়া অচল।
পাশ্চাত্য নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছে। সারা দুনিয়া থেক অভিবাসীদের এনে তাদের সমাজে ঠাঁই দিয়েছে। তাদের খাবার-দাবার, কালচার এডপ্ট করে নিয়েছে। খাবার-দাবারে পাশ্চাত্য জনগোষ্ঠি এখন প্রাচ্যের সব খাবারে অভ্যস্ত। তেমনি প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পাশ্চাত্যের ফাস্ট-ফুড কালচার।পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রাচ্যকে অনেককিছু আয়ত্ত্ব করে নিতে হয়েছে। শুধু প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্যের ‘কোকাকোলা কালচার’ এখন দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দুনিয়ার ফাস্টফুড কালচার একরকম, বার্গার, পিজ্জা, পাস্তা।
পশ্চিমের শহরগুলোর রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন ইয়োগা, আকুপাংচার, ফেং শুই, কারাতে, কুংফু, তায়েকোন্ডো, সাইকি’র ব্যবসা । তারা উইকলি রিট্রিটে চলে যাচ্ছে কোন বাবার আশ্রমে। একইভাবে প্রাচ্যের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিজদেশে বসে পাশ্চাত্যের উৎসবে-পার্বণে শামিল হচ্ছে। নিউ ইয়ার, হ্যালোইন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ফাদারস ডে, মাদারস ডে, থ্যাঙ্কসগিভিং ডে এখন আস্তে আস্তে সর্বজনীন রূপ নিচ্ছে।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আপার ক্লাসের সবাই এখন একই ধরণের ড্রেস পরে। সেটা ধর্মভিত্তিক দেশ পাকিস্তান থেকে শুরু করে কম্যুনিস্ট চিন এবং উত্তর কোরিয়া হতে পারে। সর্বত্র পাশ্চাত্যের স্যুট-কোট, টাই পরা ভদ্রলোক। চেহারা না দেখলে বুঝার উপায় নেই যে এরা ভিন্ন ভিন্ন দেশের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছেন, দেবে আর নেবে, মিলিবে আর মিলাবে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এখন তেমনি মিলনের সূর। আগেকার মূল্যবোধের পতন এবং বাণিজ্য লক্ষ্মীর কৃপায় এমনটি সম্ভব হয়েছে।
গত শতকে ই এম ফর্স্টার, নীরদ চৌধুরী, জর্জ অরওয়েল, রুডিয়ার্ড কিপলিং, প্রমথ চৌধুরী এবং আরো অনেক লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অমিল নিয়ে লিখেছেন। তাদের লেখায় এটা ফুটে ওঠেছে যে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিলন সম্ভব নয়। এরা সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির মানুষ, তাদের জীবন দর্শন আলাদা, মূল্যবোধ আলাদা। এরা কখনো এক হতে পারবে না।
প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়-
আমরা পূর্ব, তোমরা পশ্চিম। আমরা আরম্ভ, তোমরা শেষ। আমাদের দেশ মানবসভ্যতার সূতিকাগৃহ, তোমাদের দেশ মানবসভ্যতার শ্মশান। আমরা উষা, তোমরা গোধূলি। আমাদের অন্ধকার হতে উদয়, তোমাদের অন্ধকারের ভিতর বিলয়।
আমরা নিশ্চল, তোমরা চঞ্চল। আমরা ওজনে ভারি, তোমরা দামে চড়া। অপরকে বশীভূত করবার তোমাদের মতে একমাত্র উপায় গায়ের জোর, আমাদের মতে একমাত্র উপায় মনের নরম ভাব। আমরা বাচাল, তোমরা বধির। আমাদের বুদ্ধি সূক্ষ্ম — এত সূক্ষ্ম যে, আছে কি না বোঝা কঠিন; তোমাদের বুদ্ধি স্থুল – এত স্থুল যে, কতখানি আছে তা বোঝা কঠিন। আমাদের কাছে যা সত্য তোমাদের কাছে তা কল্পনা; আর তোমাদের কাছে যা সত্য, আমাদের কাছে তা স্বপ্ন।
তোমরা বিদেশে ছুটে বেড়াও, আমরা ঘরে শুয়ে থাকি। আমাদের সমাজ স্থাবর, তোমাদের সমাজ জঙ্গম। তোমাদের আদর্শ জানোয়ার, আমাদের আদর্শ উদ্ভিদ। তোমাদের নেশা মদ, আমাদের নেশা আফিং। তোমাদের সুখ ছটফটানিতে, আমাদের সুখ ঝিমুনিতে। সুখ তোমাদের আইডিয়াল, দুঃখ আমাদের রিয়াল। তোমরা চাও দুনিয়াকে জয় করবার বল, আমরা চাই দুনিয়াকে ফাঁকি দেবার ছল। তোমাদের লক্ষ্য আরাম, আমাদের লক্ষ্য বিরাম। তোমাদের নীতির শেষ কথা শ্রম, আমাদের আশ্রম।
তোমাদের মেয়ে প্রায়-পুরুষ, আমাদের পুরুষ প্রায়-মেয়ে। বুড়ো হলেও তোমাদের ছেলেমি যায় না, ছেলেবেলাতেও আমরা বুড়োমিতে পরিপূর্ণ। আমরা বিয়ে করি যৌবন না আসতে, তোমরা বিয়ে কর যৌবন গত হলে। তোমরা যখন গৃহে প্রবেশ কর, আমরা তখন বনে যাই।
তোমাদের আগে ভালোবাসা পরে বিবাহ; আমাদের আগে বিবাহ পরে ভালোবাসা। আমাদের বিবাহ ‘হয়’, তোমরা বিবাহ ‘কর’। তোমাদের রমণীদের রূপের আদর আছে, আমাদের রমণীদের গুণের কদর নেই। তোমাদের স্বামীদের পাণ্ডিত্য চাই অর্থশাস্ত্রে, আমাদের স্বামীদের পাণ্ডিত্য চাই অলংকারশাস্ত্রে।
অর্থাৎ এককথায়, তোমরা যা চাও আমরা তা চাই নে, আমরা যা চাই তোমরা তা চাও না; তোমরা যা পাও আমরা তা পাই নে, আমরা যা পাই তোমরা তা পাও না। আমরা চাই এক, তোমরা চাও অনেক। আমরা একের বদলে পাই শূন্য, তোমরা অনেকের বদলে পাও একের পিঠে অনেক শূন্য।
তোমাদের দার্শনিক চায় যুক্তি, আমাদের দার্শনিক চায় মুক্তি। তোমরা চাও বাহির, আমরা চাই ভিতর। তোমাদের পুরুষের জীবন বাড়ির বাইরে, আমাদের পুরুষের মরণ বাড়ির ভিতর। আমাদের গান আমাদের বাজনা তোমাদের মতে শুধু বিলাপ, তোমাদের গান তোমাদের বাজনা আমাদের মতে শুধু প্রলাপ।
তোমাদের বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সব জেনে কিছু না জানা, আমাদের জ্ঞানের উদ্দেশ্য কিছু না জেনে সব জানা। তোমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি নয় কিন্তু অনন্ত, আমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি কিন্তু অনন্ত নয়- তার শেষ নির্বাণ। পূর্বেই বলেছি, প্রাচী ও প্রতীচী পৃথক। আমরাও ভালো, তোমরাও ভালো – শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা, এই দুয়ে মিলে যে ভবিষ্যতের তারা হবে- তাও অসম্ভব।
– বীরবলের হালখাতা, প্রমথ চৌধুরী
রুডিয়ার্ড কিপলিং এর বিখ্যাত লাইন, “ইস্ট ইজ ইস্ট, এণ্ড ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট, এণ্ড নেভার দ্য টোয়াইন শ্যাল মিট”।
0h, East is East, and West is West, and never the twain shall meet,
Till Earth and Sky stand presently at God’s great Judgment Seat;
– The Ballad of East and West – Rudyard Kipling
উনিশ-বিশ শতকের বুদ্ধিজীবীরা আজকের দিনটি কল্পনা করতে পারেননি। শিক্ষা-দীক্ষা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের কারণে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে দূরত্ব অনেক কমে এসেছে। অভিবাসনের সংখ্যা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি। প্রাচ্যের মানুষেরা এখন কয়েক পুরুষ ধরে পাশ্চাত্যে বসবাস করছে।
প্রযুক্তির কারণে আজকে তরূণেরা প্রাচ্যে বসে প্রতীচ্যের কোম্পানিতে চাকরি করছে। পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বা চাকরি নিয়ে প্রাচ্যের যেকোন দেশ থেকে পাশ্চাত্যের যেকোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভব। পাশ্চাত্যের মানুষদের জন্য এই অপশান আরো বেশি ওপেন। ইচ্ছে করলেই যে কেউ প্রাচ্যের যেকোন দেশে গিয়ে সেখানে থাকতে পারছে। সেখানকার কালচার, সঙ্গীত, চিকিৎসাবিদ্যা, চিত্রকর্ম, আর্ট শিখে পাশ্চাত্যের সাথে ফিউশন করে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে নিতে পারছে।
বিশ শতকের লেখক, বুদ্ধিজীবীরা প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলন নিয়ে কালোত্তীর্ণ চিন্তা করতে পারেননি। এটা খুবই স্বাভাবিক, তাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার জন্য তখনকার সময়ের প্রযুক্তি এবং ওয়ার্ল্ড অর্ডার দায়ী। আজকের ‘পোস্ট-ওরিয়েন্টালিস্ট’ চিন্তা ও প্রযুক্তির কারণে প্রাচ্য আর ততো রহস্যময় নয়, তেমনি পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা কেবলমাত্র বস্তুবাদী, ভোগ-বিলাসে উম্মত্ত প্রাণি নয়। নতুন প্রজন্ম প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সম্পর্কের নানা শেইড চিনে নিয়ে দু’জায়গাতেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে নিচ্ছে।