বাংলাদেশের কবি লেখকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বারবার এরকমই মনে হয়েছে, যদিও সেই ছোট বেলাতেই সৈয়দ হকের ‘হৃদ কলমের টানে’ পড়ে জেনেছিলাম প্রতিদিন নিয়ম করে পড়া ও লেখা করতে হয়। আর চারুকলার ছাত্র হিসেবে জানি প্রতিদিন প্রতিক্ষনে আঁকাটা চালাতে হয়, আর সঙ্গীতের রেওয়াজের কথা, কিংবা ক্রিড়ার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন নিয়ে নতুন করে আমার বলার কিছু নেই।
খ
চারুকলায় পড়বার সময় শিক্ষকেরা বলতেন বস্তু দেখ এবং তা আঁকো, বারবার আঁকো,
দেখা-আঁকার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বস্তুর খুটিনাটি সব তোমার স্মৃতিতে জমিয়ে
ফেল। অধিকাংশ ছাত্রই এটাকেই শিল্প ভেবে এটাতেই আটকে যায়। আবার অনেকে ‘এগুলি হচ্ছে কপি করা কিন্তু শিল্প হচ্ছে স্বাধীন ও ইত্যাদি ইত্যাদি’ বচনে এই প্রকৃতি অধ্যায়নের অনুশীলনটিকে এড়িয়ে যায়। যে আটকে যায় সে দক্ষ চিত্রকর হিসেবে বাজারে করে টরে খায়। আর ‘শিল্প-স্বাধীন’ ক’দিন পর নিজেই নিজের কপি করতে থাকে। তার স্মৃতির ভান্ডার ও আকৃতি বোধের পুঁজি যে সল্প। তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমারা একটি সুবিধা পেতাম- সেটা হচ্ছে বিদেশ ভ্রমন এবং সেখান থেকে কিছু বই ক্যাটালগ এনে তাহাতে মুদ্রিত ছবি ভাস্কর্যের কপি করা। তো এ চর্চা বা অভ্যাস আমাদের আজো আছে, তবে এখন আমরা গুগল স্মার্ট।
গ
আমি ‘শিল্প স্বাধীন’ ক্যাটাগরির ছাত্র, সকলে আমাকে সেটাই জানে বা ভাবে। কিন্তু আসল চরিত্রটি হচ্ছে আমি ভয়াবহ অলস। আমাদের কালে শুয়ে শুয়ে একা একা বিনোদন ছিল একটিই- সেটা বই পড়া। আর আমি সেই অলস যে টেবিলে বসে পড়তে হয় বলে স্কুলের বইও পড়তাম না। এ হেন অলস বেশ ভেবে ভেবে বের করলাম- আরে শিক্ষকেরাতো বার বার দেখতে বলেছেন তারপর আঁকতে বলেছেন, তো দেখতে থাকো দেখতে থাকো দেখতে
থাকো- কার ঠোটের ভাজে ক’টি দাগ…
শিক্ষক নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, নাহিদ আখতার, মুর্শিদা আরজু আল্পনা ড্রইং ক্লাস নিতে এসে বলেন তুমি খালি আড্ডা মেরে বেড়াও তাই তোমাকে হায়েস্ট মার্ক দেয়া হলো না… আমার মন খারাপ হয়না! সহপাঠি বন্ধুরা দিনরাত পেন্সিল কাগজ ক্ষয় করে চলছে, আমি জানি এই পরিশ্রমের অনেক দাম।
ঘ
মানুষ অভাস্যের দাস, আমিও তাই। অলস আমি আলস্য যাপন করতে গিয়ে পাঠক হয়ে উঠেছি, চারুকলা পাঠাগার তাই আমার ঠিকানা। কিছু সময় টেবিলে বসেই বই ঘাটাঘাটি, কিছু পড়া আর লাইব্রেরিয়ানের বদান্যতায় কার্ড ছাড়াই একাধিক বই নিয়ে হলে গমনের সুযোগ। বদান্যতার ফলাফল বিএফএ পরীক্ষার সময় লাইব্রেরী কার্ড জমা দিতে গিয়ে নতুন করে কার্ড করতে হয়েছিল, হা হা হা…
ঙ
চারুকলায় প্রচলীত ধারনা হচ্ছে- যে রিয়েলিস্টিক বা বাস্তবানুগ (আসলে হওয়া উচিত ন্যাচারালিস্টিক বা প্রকৃতিনুকারীক) কাজ করা হয়েছে বিএফএতে, এমএফএ ক্লাসে এসে তা থেকে বেরিয়ে ‘মডার্ন’ হতে হবে এবং মডার্ন মানে কিউবিস্টিক ফর্মে আঁকা-ঝোকা। কিন্তু ইউরোপীয় শিল্প ইতিহাস বলছে মর্ডানিটির শুরু ইম্প্রেশিনিজম বা প্রতিচ্ছায়াবাদ থেকে।
চ
আমি ‘শিল্প স্বাধীন’ ক্যাটাগরির ছাত্র, সকলে আমাকে সেটাই জানে বা ভাবে। আমিও নিজেকে সেখানেই দেখী, তাই ক্লাসের বাইরে আমার যখনই কাগজের সাথে দেখা হয় তখন কথা হয় সেভাবে। তবে আমি স্বাধীন বা স্ব-এর অধীন, তাই যেখান সেখান দিয়ে রাজপথ পেরুনোর বাংলাদেশী হাত তোলা বা দৌড় স্বাধীনতা থেকে নিজেকে বিরত রাখী। রাস্তা যে সকলের, আমি বা আমার বাপের নয়। সিগনাল মেনেই রাস্তা পার হই। প্রকৃত অলস হেলেদুলেই পথ পেরোয়।
ছ
আমি অলস হলে কি হবে প্রকৃতি খোড়গোশ ও কচ্ছপের দৌড় লাগিয়ে রেখেছে। ট্রাকে দাড়ালে হয় কচ্ছপ হও নয়তো খড়গোশ। বন্ধুরা খোড়গোশ হতে চাইলেন আমি কচ্ছপ। কিন্তু সভ্যতা তো প্রকৃতির অতিরেক। নগরে বসে জঙ্গল বুক চলবে কেন! তো ইশপের গল্পের কল্যানে অামি বিশেষ ভাবে খ্যাত হয়ে উঠলাম। আরে বিপদ! তাই নিয়তি টানলেন রেখা অথবা আমিও নগর থেকে দূর হলাম।
আমি আর কন্যা-পুত্র আর রঙ-তুলি-কাগজ নিত্য আনন্দে আছি। কিন্তু নগরে রেখেছে পা নগর কি তোমাকে রাখবেনা মনে। নগর যে নগর, তার থাকে রেজিস্টার বুক। সে রেজিস্টার বুক হঠাৎ হঠাৎ খোলা হয় কারো কারো চোখে ভাসে এর ওর নাম। সে রকম এক চিঠি এলো, সেখানে জানা গেল- যে কখোনই সমুদ্র বিহারে যায়নি সেই নাম ভেসে উঠেছে আটলান্টিক পাড়ে, ভূমধ্য সাগর তটে। এটা কী?
জ
আমি যেন ৩ বর্ষের ছাত্র, ১ম বর্ষের পথ খুজে চলা ছোটদের বলছি- কাজ করে যাও, ইতিহাসের যদি তোমাকে প্রয়োজন থাকে তবে ইতিহাস তোমাকে ফসিল বানিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখবে। আর যদি সামাজিক সাফল্য চাও তবে বাজারের পথ ধর…
আমি তো ইতিহাসের পথে হেটেছি, তবে কেন এ বাঁশির ডাক? না, রং তুলির সাথে প্রতিদিন কথা হলেই পথে থাকা হয়না। চোখ মেলে দেখার অভ্যাসটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। ছবি (ও ভাস্কর্য) হচ্ছে দেখবার ও দেখাবার আনন্দ।*
ঝ
ছাড়লাম চাকুরে জীবন, বহুজাতিকের মুদ্রার ঝলক। ব্রান্ড মার্কেটিং নামক গ্লামার জগৎ। কতদিন বিছানায় বই বুকে নিয়ে ঘুম দেয়া হয় নাই। দুপুরের ঘুম গুলোর সাথে অফিস টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কথা কইতে হয়েছে।
দেখবার ও দেখাবার আনন্দ, আর দেখানোর জন্য শিল্পের লাগে গ্যালারী। চারুকলার গ্যালারীকে জয়নুল গ্যালারী করবার আয়োজনে বাংলাদেশের সকল দাপ্তরিক তালিকা থেকে আমার নাম কাটা গ্যাছে বহু আগেই। তাই পুরস্কার, সম্মান, প্রেম সব থেকে আমি দূরে, এ নগরেই পরবাসী। আর আমিতো অলস ঘরকুনো। তো কি করা যায়?
ঞ
আহারে স্ত্রী কন্যা পুত্র! এতো ভালোবাসা রাখি কোন হৃদয়ে। বাসার অর্ধেক খালি হল…
চ
শিক্ষক আবুল বারক আলভী বললেন- ‘ইতোমধ্যে আমি এখানে তিনবার এসেছি, ছয় মাস পরে আমি আবার আসবো এবং আমি জানি ছয়মাস পর এসে আবার নতুন কিছুই দেখবো’ তো চলুক এভাবেই…
ছ
নিয়মিত অধ্যায়ন ও অনুশীলনের চেয়ে বড় প্রেরণা আমি তো আজো খুঁজে পেলামনা, কেউ পেলে আমাকে একটু জানাবেন, প্লিস…
আগস্ট ২৮, ২০১৭; ১০:৪৭ অপরাহ্ন
বই হাতে অবকাশ যাপনের দিন আমারও ছিল একসময়। কিন্তু পকেটের অনুমতি না পাওয়াতে এখন অনলাইনের লেখারাই ভরসা।
আগস্ট ২৯, ২০১৭; ৫:৪৪ পূর্বাহ্ন
পকেটই দুনিয়ার রাজা।
আগস্ট ২৯, ২০১৭; ৫:৪৭ পূর্বাহ্ন
হাহাহা।
পকেটের চিন্তায় মশগুল থাকলে জগৎ সংসারে গোলমাল হবার সমূহ সম্ভাবনা।
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।