১৩৭৪ বার পঠিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ নিয়ে কথা হচ্ছে। হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জন্য একটি প্রতিবাদ স্বরূপ। অতএব কথা ‘না’ হবার কথা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো তৎকালীন কোলকাতার ‘দাদা বাবু’দের তথাকথিত ‘জগাখিচুরি’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেগে উঠা একটি মনুমেন্ট, ভাস্কর্য। চাষাদের বিশ্ববিদ্যালয়। সেই চাষারা যারা এই উপমহাদেশের অন্নের জোগানদাতা। অন্য কথায় অন্ন দেবতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গে হোক এটা স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের হিংসুটে মধ্যবিত্ত আর লুঠেরা উচ্চবিত্তেরা চাইতেন না। কেনো চাইতেন না, কারণ তারা এ ভূমি থেকে খাজনা আদায় করবেন, শস্য তুলবেন। নিজেদের পকেট এবং পেট ভরাবেন। তাই ভূমিপুত্ররা মূর্খ থাকলেই তাদের সুবিধা। হিসাবটা শিখে ফেললেই তো মুশকিল। তখন প্রশ্ন উঠবে ন্যায্য পাওনার। তাই পূর্ববঙ্গের চাষাভুষোদের শিক্ষিত করার ইচ্ছা তাদের ছিল না। এখনও নেই। তখন মুখে বলেছে এখন সেই সাহসটা নেই। তবে ইচ্ছেটা আছে। আর মধ্যবিত্তদের তো কথাই নেই। ‘বাঙাল’ দেখলেই যারা চমকে সরে যান। সুনীল তার এক উপন্যাসে বলেছিলেন নিজের স্মৃতি থেকে এ সম্পর্কে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন কলকতার ঘটিদের প্রবল ‘বাঙাল’ বিদ্বেষ। ‘বাঙাল’দের সাথে বিয়ে-শাদিসহ কোন সম্পর্কে যেত না ঘটিরা। এমনকি সামাজিক মেলামেশাতেও ছিলো আপত্তি। এই হলো কলকাতার ঘটি মধ্যবিত্ত। এটা আমার কথা নয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা।
এরপর রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। অনেকেই বলতে চেষ্টা করছেন এবং নানা কিছু দিয়ে প্রমান করতে চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ সেই পশ্চিমবঙ্গের লুঠেরা উচ্চবিত্তেরই অংশ, নাকি? সামন্তবাদের প্রতিভু এই ভূস্বামী চাষাভুষোদের উত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন এটাই তো স্বাভাবিক ধারা। এর বাইরে যাবার মতন শক্তি রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে ছিলো না। ঠাকুরবাড়ির কারোরই ছিলো না। সুতরাং যারা প্রমান করতে চাইছেন তাদের মানসিকতা সামন্তবাদের পাইক-বরকন্দাজের। জ্বী হুজুরের চিন্তার।
রবীন্দ্রনাথের বিরোধীতা, না বিরোধীতার গুরুত্ব নিয়ে যারা অস্থির তাদের দুই পক্ষের চিন্তাতেই গোপনে জমিদার ভীতি ভর করে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তখন কী চেয়েছিলেন বা চাননি তার একশ বছর পরে প্রমান করে কী হবে। হওয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আরেকটু আলোচনা বাড়বে। তিনি আরেকটু বাড়ন্ত হবেন। এমনিতেই ওই ভদ্রলোককে ‘ঈশ্বররে’র তকমা পর্যন্ত দেয়া হয়ে গেছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ইবাদতের সমান আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর কত! পরম্পরায় দাসদের আনুগত্য আর কত বহণ করবে স্বাধীন ভূমির এক শ্রেণির পরাধীন মানুষ। আমরা যে স্বাধীন হয়েছি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা আজ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। কলকাতাকে তীর্থ মানার দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এটা কবে বুঝে উঠতে পারবে তারা। কবে দাস থেকে মানুষ হবে। পাওলো ফ্রেইরির ‘মুক্ত চিন্তার মানুষ’।
শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকে জগাখিচুরি বলেছিলাম, এতে অনেকে গোস্বা করতে পারেন। তাদের বলছি, ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে কলকাতার শহুরে মধ্যবিত্তদের দ্বারা সংস্কৃতি শাসিত হতে শুরু করে। ইংরেজদের ফেলে দেয়া প্যান্টলুন আর ‘কাউয়া’ কোট গায়ে তুলে সেই শহুরে মধ্যবিত্তরা সংস্কৃতিকে কথিত সভ্য করতে লাগলেন। পশ্চিমবঙ্গের আদি সংস্কৃতির মৃত্যুর শুরু সেখান থেকেই। আর তাদের গুরু হয়ে দাঁড়ালেন ইংরেজদের কৃতদার ঠাকুর গোষ্ঠী। অর্থাৎ ইংরেজ চলে গেলো কিন্তু তাদের ছায়ারা রয়ে গেলেন। ঘটিদের ‘নাকি’ কথার সমন্বয়ে শুরু হলো সেই অদ্ভুত জগাখিচুরি সংস্কৃতির মচ্ছব। আমাদের পূর্ববঙ্গের ‘চাষাভুষো’দের কেউ কেউ সেই বাবুদের ষষ্ঠাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে গুরু গুরু বলে মাঠে নেমে পড়লেন। তাদেরই পরম্পরা আজো কলকাতাকে সংস্কৃতির পাদপীঠ মানেন। কিছু হলেই ছোটেন কলকাতা। কলকাতার স্বীকৃতির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। এরাই সেই দাস পরম্পরা। জগার খিচুরির প্রসাদ পাওয়া দাসানুদাস।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর কলকাতার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বক্তব্যগুলো সম্ভবত এসব দাসানুদাসদের পড়া হয়নি। মৃত্যুর আগে স্বীকার না করলেও, মৃত্যুর পর হুমায়ূনের অবস্থান স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। কিন্তু ওই যে কথায় রয়েছে, বাবু বললেন ধরে আনতে, পেয়াদা আনলো বেঁধে। তেমনি কলকাতার বাংলাদেশি অনুগামীদের হুমায়ূনকে স্বীকার করতে গায়ে লাগে। জনপ্রিয় লেখক বলে, বহুজনের বলে হুমায়ূনের সাহিত্য কর্মকে খাটো করার প্রয়াস করেন। তাকে ঠাকুরদের অনুকরণে অচ্ছ্যুতদের লেখক বলতে চেষ্টা করেন। শেক্সপিয়রও যে জনপ্রিয় এটা তারা ভুলে যান। তাদের গুরু রবীন্দ্রনাথও জনপ্রিয়। কলকাতার ক্লাসিক ‘পানে’র আসর থেকে পাড়ার ‘চাট’ রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া জমে না। আপনাদের গগণেও চাঁদ উঠলেই তবে আসর জমে, ওপারের ‘কারণ’ সহযোগে।
যাক গে, বাদ দিই। জর্জ অরওয়েল তার ‘অ্যানিমেল ফার্মে’ এদের কথাই বলেছিলেন। শোষিতের মানসিক মুক্তি না মিললে তাদের শাসক বানালে হিতে বিপরীত হয়। তারা শাসকের চেয়ে বড় শাসক হয়ে দাঁড়ায় শোষকের চেয়ে বড় শোষক। আমাদের অনুদাসদের হয়েছে সেই অবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা যে ‘দাস চিন্তা’র এটাই তাদের বোধে নেই। তাদের যদি সংস্কৃতির শাসক মানা যায় তাহলে তারা সঙ্গতই হিংস্র হয়ে উঠবেন। জবরদস্তিতে চাপিয়ে দিতে চাইবেন নিজেদের চিন্তা, যা এ ভূমির সংস্কৃতি বিরুদ্ধ। এর অনেক নজিরই আমাদের সামনে রয়েছে।
সুতরাং চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই যা বলে গেছেন পাওলো ফ্রেইরি। দাসত্ব আর আনুগত্যের চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। মুক্ত হোন, মুক্ত মানুষ হয়ে উঠুন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন