ওনাকে বা ওনাদেরকে নিয়েও লিখতে হয়, কপাল আমাদের। যাদের ক্যাশ হলো শুধু ঘৃণাবাদীতা। আমাদের গণমাধ্যমের কল্যাণে এরাই আলোচনায়। আমাদের গণমাধ্যম এদেরই তোয়াজ করে। প্রকাশ করে। অথচ একবারও ভেবে দেখে না অগণ’র পক্ষে গেলে মাধ্যমে গণ শব্দটির যোগ যথার্থতা হারায়। সম্ভবত প্রচার ও প্রচারণার শব্দগত পার্থক্য বুঝতে অপারগ বলেই এমন কাজ সম্ভব হয়। তাদের প্রচার যে মূলত প্রচারণা তা বোঝা যায় প্রচারণায় সৃষ্ট কলতলার তর্কতে। একে বিতর্কও বলা যায় না, বিতর্কতে যুক্তি থাকে, শুধু শুধু উক্তি থাকে না।
কারা এই কলতলার তর্ক করে। দেখবেন ঘৃণাবাদীদের লেখায় ঘৃণা উগড়ে দেয় বিপরীত পন্থার ঘৃণাবাদীগণ। যেমনটা হয়েছে শাল্লায়। ঘৃণাবাদীদের ঘৃণাটা উপরে যুদ্ধংদেহী হলেও ভেতরে কিন্তু এক। এরা পরস্পরের পিঠ চুলকে আলোচনায় থাকতে চায়। শাল্লাতেও তাই দেখা গেছে। যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার আসল চিত্রগুলো একে একে উঠে আসতে লাগলো, তখন নতুন চাল শুরু হলো। ইসলামের দাওয়াত কবুল করার জন্য হিন্দুদের চিঠি পাঠানো। একেবারে হাস্যকর কৌশল। বিবাদ জিইয়ের রাখার ছেলেমি প্রকাশ। একই প্রকাশ দৃশ্যমান তসলিমা নাসরিনদের মতন ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের লেখায়।
বলবেন, তসলিমাকে প্রতিক্রিয়াশীল বললাম কেনো। তসলিমা নয় এ ঘরানার সবাই তাই। এ কারণেই বললাম তিনি এবং তারা মানুষকে বিভাজিত করেন। না-না ভাবে, না-না কৌশলে। যেমন তসলিমা সম্প্রতি দাড়ির শ্রেণি বিভেদ করেছেন। দাড়ি দিয়ে বিভাজনের কৌশলটিতে বেশ নতুনত্ব রয়েছে। এমনভাবে করেছেন যাতে আড়ংয়ের চাকরি প্রত্যাখ্যাত অপমানিত তরুণটির প্রতিবাদ ঘৃণাবাদের বিভাজনের বিতর্কে আবর্তিত হয়। হোয়াইট সুপ্রিমেসি যেমন কালোদের মানুষ হিসেব গণ্য করে না, তেমনি বাংলাদেশের ‘ট্রিমড সুপ্রিমেসি’ দাড়িওয়ালাদের মানুষ হিসেব গণ্য করতে যেনো না চায়। আর এই অদ্ভুত ‘ট্রিমড সুপ্রিমেসি’ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন উদ্ভট চিন্তার ঘৃণাবাদীরা। এরা বিভিন্ন আঙ্গিকে বছর ভরে এমন বিভাজনের প্যাটার্ন আবিষ্কার করেন। আর সেই প্যাটার্নের প্যাটেন্ট বেচেন প্রকৃত সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে। এখন যেমন এসব গার্বেজের খরিদ্দার ভারতীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। গোপনে হয়তো বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও।
নারীবাদের আবোল-তাবোল ব্যাখ্যা দিয়ে এতদিন এরাই তলে তলে পুরুষতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এদের ছড়ানো ঘৃণার বিপরীতের বাংলাদেশে অত্যাচারী পুরুষ শ্রেণি তৈরি হয়েছে। নারীরা হয়েছে আরো বেশি অত্যাচারিত। সেই অত্যাচারের অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘তসলিমা হইছস’ এমন সংলাপ। মেয়েদের কেউ কেউ পড়াশোনা, সাংস্কৃতিক জীবন-যাপনের স্বাধীনতার চেয়ে জরায়ুর স্বাধীনতাকেই বেশি প্রগ্রেসিভ মনে করছেন। মূলত এই প্রগ্রেসিভ হলো এগ্রেসিভ, তা তাদের বোধে নেই। যে আচরণের প্রকাশ হলো ঘৃণা। এই ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা যারা আশা করেন তারা হয় বোকা নয় চালাক। বুদ্ধিমান অবশ্যই নয়। বোকার কথা জানাই, তারা এমনি এমনি খায়। আর চালাকের উদ্দেশ্য থাকে।
কী উদ্দেশ্য, জানতে চাইলে তসলিমাসহ এই শ্রেণির পাবলিকের সাম্প্রতিক লেখা সমূহ পড়ুন, কার্যকলাপ লক্ষ্য করুন। যদি বুদ্ধিমান হোন তাহলে বুঝতে পারবেন এসবের পুরোটাই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরোক্ষ সমর্থন করে। সে ভারতের হোক আর বাংলাদেশেরই হোক। উদ্দেশ্য, ভেতরে আঁতাত আর উপরে লড়িয়ে দিয়ে নিজেদের আলোচনায় রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বলতে পারেন। দেখেন ওদের পরস্পরের পিঠ চুলকানিতে জমে উঠেছে কলতলার বিবাদ। আর এই বিবাদের পরিপুষ্ট হচ্ছে অগণতান্ত্রিক শক্তি। রাজনীতিতে ব্যাকপাসে খেলাটাও কৌশলের অংশ। আর ঘৃণাবাদীরা এই ব্যাকপাসের খেলোয়ার।
উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন বাংলাদেশের কিছু মাধ্যমকে। এদের কাজ এমন কিছু বিষয়ে বিরোধীতা করা যাতে প্রতিপক্ষের তেমন কোনো ক্ষতির কারণ না ঘটে। সেই প্রতিপক্ষ কারা, যারা দিনের বিরোধী, রাতের পার্টনার, তারা। আপাত বিরোধীতার বিপরীতে সেসব মাধ্যমের একটা কুসুম কুসুম বিরোধী ইমেজ সৃষ্টি হয়। এই ইমেজ অনেকটা জিহাদীদের স্লিপার সেলের মতন। হওয়ারই কথা, ফর্মুলা তো এক ফ্যাক্টরিতেই তৈরি। এই স্লিপার সেল বিশেষ সময়ে জেগে ওঠে। যখন সেই দিনের বিরোধী-রাতের পার্টনার বিপদে, তখন ঘুম ভাঙে সেই সেলের। একটা ইস্যুতে যখন গণেশ উল্টানোর অবস্থা হয়, তখন সেই মাধ্যম নরম সুরে ইস্যুর বিপরীতে ‘বিরোধী বিরোধী খেলার পার্টনার’দের পক্ষে বলা শুরু করে। পাবলিক ভাবে এরা তো ‘বিরোধী’ ওরাই যখন পক্ষে বলছে তখন বোধহয় ঠিকই আছে। সেই চালাক শেয়ালের মতন সেই ‘বোধহয়’ এর ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় রাতের পার্টনাররা।
এটাই মূল কৌশল। আপনি যখন কথিত বিরোধীদের মুখ থেকে আপনার পক্ষে কথা বলাতে পারবেন, তখন আপনার জয় অর্ধেক নিশ্চিত। এমন আঁতাতের কথিত বিরোধী হলেন সেই ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলরা। এদের কাজ ঘৃণা জিইয়ে রাখা। নাহলে কীভাবে ঝালেঝোলে কাটবে জীবন। এদের চিনতে না পারলে প্রকৃত প্রগতিশীলদের মুক্তি নেই। মুক্তি নেই বিভাজনের জাল থেকে।
একজনকে বলেছিলাম, এত অধিকার অধিকার করেন, বিধবার চুল কেটে দেয়া, নিরামিষ ভোজন, আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কথা বলেন না কেন। ভিক্ষুর বিপরীতের মহিলা ভিক্ষুদের কী বলে এখন মনে পড়ছে না, তাদের অবস্থান নিয়ে কথা বলেন না কেন। সেবাদাসীদের জীবন-যৌবন সব উৎসর্গ করতে হয় এটা নিয়ে আওয়াজ তোলেন না কেন? সব ঠেকে কি এই ভূখন্ডের ইসলামেই? ঘৃণাবাদীরা চালাক, তাদের উদ্দেশ্য থাকে। তারা জানে কখন এড়িয়ে-বেড়িয়ে যেতে হয়, কখন ধরে থাকতে হয়। জানি, তারা উত্তর দেবেন না। তাদের মাথা যে বাধা। বাধা না থাকলে সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বলতেন তারা। সিলেক্টিভ বিষয়ে যখন কথা বলে কেউ তখন তার বা তাদের উদ্দেশ্য থাকে নিশ্চিত।
তবে এরাও যে মাঝে-মধ্যে বলে না তা কিন্তু নয়। এরাও বলে, লেখে। কখন, যখন দেখবে তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তখন। ঘৃণাবাদীদের লেখাতেও দেখবেন তেমনটা। তখন তারা অন্যদের সাম্প্রদায়িকতার উদহারণও তুলবেন সেই কুসুম কুসুম আলাপে। আর সেই আলাপের শেষেও দোষ হবে সব নন্দঘোষের। ওই যে, দেখতে না পারলে চলন বাঁকা’র মতন ব্যাপার স্যাপার।
আমার এক হিন্দু বনধুর কথা জানাই। তার দাড়ি আছে, যেমন ধ্রুব এষ এর আছে। তাকে একবার প্রগতির ধ্বজাধারী ‘কতেক’ চরম প্রতিক্রিয়াশীল ‘ভদ্দরনোক’ প্রশ্ন করলেন, তিনি মৌলবাদী কিনা। বন্ধুটি প্রচন্ড রেগে গেলেও উপায়ন্তর নাই দেখে তার ধর্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন। এই যে দাড়ি বা পোশাকের কারণে ধর্ম, বর্ণ, জাত, গোষ্ঠী’র পরিচয় এবং তা প্রকাশের বাধ্যবাধকতার আবহ সৃষ্টি, তারচেয়ে বড় অসভ্যতা আর কিছু নেই। একাত্তরের সেই হানাদার বাহিনীর মতন। পরিচয় নিশ্চিত করতে যারা লুঙ্গি খুলে দেখে নিত। তেমনি, আমার বন্ধুটিকে তার প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজ পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়েছিলো।
এই যে দাড়ি দেখলেই যারা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, তারাই ঘৃণাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল। তারা দাড়ির শ্রেণি বিভাজন করেন, জিহাদী দাড়ি, ফ্যাশানের দাড়ি, শিল্পীর দাড়ি। অর্থাৎ তাদের কাজ মানুষকে বিভাজিত করা। যেমন বর্ণাশ্রম মানুষকে বিভাজিত করেছে তেমন। অমন দাড়ি হলে সে অস্পৃশ্য-অচ্ছ্যুৎ। তেমন দাড়ি হলে সে রবীন্দ্রগোত্রীয় মানে অভিজাত। এই যে শ্রেণি বিভাজন এর বিরোধীতাই হলো প্রগতিশীলতা। আর যারা বিভাজন করেন তারা প্রতিক্রিয়াশীল।
এই প্রতিক্রিয়াশীলদের চিনতে হবে। যারা অহেতুক বিবাদ বাঁধিয়ে রেখেছেন এ দেশে। যারা দাড়ি দিয়ে মানুষকে বিভাজিত করছেন। পোশাক দিয়ে করছেন। বলছেন, হিজাব পরলে জিহাদি, ক্লিভেজ দেখালে রবীন্দ্রগোত্রীয়। ওই যে, যারা বলেন, ‘ নজরুল তুমি করিয়াছো ভুল, দাড়ি না রাখিয়া রাখিয়াছো চুল’, তারা আর এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই এক গুদামের মাল।
বিভাজনের এই যে ঘৃণ্য কৌশল, ধরে রাখার যে সূত্র, তার সুতাটাকে ছিড়ে দিতে হবে। নাঁটাই থেকে সুতা ছিড়ে গেলেই, উদ্দেশ্যবাদী ঘুড়ির ভোকাট্টা অবস্থা হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে মাটিতে। তাহলেই কে কী পরলো, দাড়ি রাখলো না ক্লিন শেভড, এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকবে না। সে অনুযায়ী বিভাজন করবে না। যেমন করে না ইউরোপের দেশগুলো। এমনকি তুরস্কের মতন দেশেও এই বিভাজন নেই। অথচ আমাদের দেশে এই বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। করছে ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল হাতেগোনা কিছু মানুষ। হিসেবে করে দেখুন, হাতেগোনা কিনা। আঙুলের গাঁট গুনুন, দেখবেন খুব বেশি গুনতে হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিছিলের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জিন্স পরা আর হিজাব পরা মেয়েরা একসাথে মিছিল করছে স্লোগান দিচ্ছে। মাথায় ঝুটি করা লম্বা চুলের ছেলেদের সাথে রয়েছে পাঞ্জাবি পরা ছেলেরাও। একসাথে হাঁটছে রাজপথে। এই যে ঐক্য, এটা ভাঙার জন্যই তৎপর হয়ে উঠেছে ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলরা। ওরা চিন্তা নয়, পোশাক-দাড়ি এসব দিয়ে পৃথক করতে চাইছে মানুষকে। মানুষের চিন্তার ঐক্যকে, মনের ঐক্যকে জোট বাঁধতে দিতে চাচ্ছে না বাহ্যিক আবরণ আর আভরণের বিভাজনে। ওরাই হলো প্রকৃত ঘৃণাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল।
অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। যারা এখনো ঘৃণাবাদ আর বিভাজনের গোপন সূত্র বুঝতে পারছেন না, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। সেই স্বর্গ মূলত নরক, গায়ে আগুনের আঁচ লাগলে বুঝতে পারবেন। তখন আর পোড়ার বাকি কিছু রইবে না। তবে আশার কথা তরুণদের অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন। ঘৃণাবাদীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আওয়াজ উঠছে। চারিদিকে পরিবর্তনের বাতাস বইছে। প্রকৃত প্রতিক্রিয়াশীলতা রুখতে সত্যিকার প্রগতিশীলদের ঐক্য এখন সময়ে দাবি। যে দাবি মানুষের ঐক্য চাইবে, দাড়ি বা পোশাকের নয়।