৯
২০২৯ বার পঠিত
ফরজ আলীর মন ভালো নেই। গতকাল ছিল ঈদের দিন। সব আনন্দ মাটি করে দিয়ে পেটের দাবী ক্রমশ বাড়ছে। তাই আবার ঢাকা যেতে হবে, আবার রিক্সায় প্যাডল মারতে হবে! ভাবতেই ফরজ আলীর দুই পা অবশ হয়ে আসে। শরীর আর পারে না আগের মতো, রিক্সা চালান বড়ই খাটনীর কাজ। শরীরে আগের মতো আর তাগদ নেই।
যেই আমেজ নিয়ে বাসের ছাদে করে, গাড়ী-ঘোড়ার যানজট পেরিয়ে, ধোয়া, ট্রাকের ভ্যাপু, ছিনতাইকারীর কবল, পকেটমারের খপ্পর সব কিছু অতিক্রম করে শেষে নৌকাযোগে বাড়ী ফিরে এসেছিল সে আশা উদ্দিপনা মিইয়ে গেছে খোলা টিনের মুড়ির মতো। কিন্তু আগের দিনের সেই ঈদের আমেজ আর নেই। মনে পড়ে সেই ছোট বেলার কথা, কৈশোরের কথা, লাটিম ঘুরানো সকালের কথা, সাইকেলের রিং দিয়ে গাড়ী বানিয়ে চালাতে চালাতে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় যাওয়ার কথা। সেই রাস্তায় ডি সি সাবের জীপ প্রথম প্রথম দেখে তাজ্জব হয়ে চেয়ে থাকার কথা। গাড়ীতে উঠার ইচ্ছের কথা। সময় গড়িয়েছে, ফরজ আলী ঢাকা শহরে প্রায়-ইগাড়ীতে উঠে, কিন্তু সেই কিশোর বেলার ডি সি সাবের জীপে উঠার সাধ আজও মেটেনি। কিছু কিছু সময় থাকে। যে সময়ের সাধ সে সময় না মিটলে, আর হয়তো মেটে না । এসব ভাবের কথা, দর্শনের কথা । ফরজ আলীদের দর্শন ভাবনা থাকতে নেই। ভাবতে ভাবতে ফরজ আলীর মনে পড়ে যায় গতকালের ইদ্গাহ মাঠের কথা।
“সকল মুসলিম ভাই ভাই,
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই”
ঈমাম সাবের এই কথা বুকের মধ্যে ক্যামন জানি খচ খচ করে বিঁধতে লাগল।
প্রথম কাতারে সাধারন মানুষের জায়গা হয় নাই। বসেছে কুচক্রী মাতব্বর, গরীবের ভি জি এফ কার্ড, কাবিখা ও অন্যান্য প্রকল্প মেরে দেওয়া চেয়ারম্যান, শহর থেকে ছুটিতে আসা ঘুষখোর আমলা আর গ্রামের দুরন্দর কিছু লোক। নামাজের আগে শুরু হোল চেয়ারম্যান সাবের ঈদ সৌজন্যমুলক বক্তব্যের নামে বিগত বছরে এলাকার উন্নয়নের ফিরিস্তি। বি টি ভি এমনি ফরজ আলী দেখা বাদ দিয়েছে, কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়, বি ভি’র উন্নয়নের ফিরিস্তি যেন ঈদগাহ মাঠে চলে এসেছে।
কিছু কিছু আমলাদের নাম প্রকাশ করে ধন্যবাদ দেয়া হোল তাদের আর্থিক সাহায্যের জন্য। এদিকে বৃষ্টিতে জায়নামাজ ভিজে যাচ্ছে তবু বক্তব্য যেন শেষ হয়না। মনে মনে শান্তনা দেয় ফরজ আলী, বছরে তো মাত্র দুইদিনই চান্স পায়, আচ্ছা দিক। বঙ্গদেশে মাইক্রোফোন মুখে পেলে যে কেউ ছাড়ে না সেটা এই গ্রামে এসেও প্রমানিত হোল।
নামাজ শেষে ফরজ আলীর খুব ভালো লেগেছিল যখন শহরের বড় বড় ছারেরা ফরজ আলীর সাথে কোলাকুলি করছিল, আর তাদের বগল থেকে জান্নাতুল খসবুর ঘ্রান আসছিল। অথচ এইসব মানুষদের কাছেই ভেরা যায় না ঢাকা শহরে। আল্লাহর কি কুদরত।
ফুলীর মা জানে ফরজ আলী চালের নাস্তা পছন্দ করে খেজুরের গুড়ের। কারন ফরজ আলী মূর্খ লোক হলেও স্বাস্থ্য সচেতন। লাচ্চা সেমাই ভাজতে তেলের সাথে মবিল দেয়, তত্তাবধায়ক সরকারের সময় বগুরায় রাব (RAB) অভিযান চালিয়ে ধরেছিল; এ খবর ফরজ আলীর চোখের আড়াল হয়নি।
দুধে ফরমানলিন, গুড়ো দুধে ম্যালামাইন কথাও শান্তি নাই।
ঈদগাহ হতে ফিরতেই ফুলীর মা খবর দিল, “আইজক্যা আমগোর সব্বাইকে বড় সাবের বাড়ী দাওয়াত। বাড়ীতে খাইতে মানা করছে।” আফাজ উদ্দিন সাব বড় ফরেস্ট অফিসার। গ্রামে সবাই তারে বড় সাব বলেই জানে। গ্রামের মসজিদের মাইক কিনে দিয়েছে, পূজার সময় হিন্দুদের ডোনেশন দেয়। সবাই তারে ছার ছার কইতে কইতে অস্থির। ফরজ আলী ভেবে পায় না মানুষ চাকরী করে এতো টাকা কোথায় পায়।
দেশের সরকার যখন ভাবে না, তখন ফরজ আলীর মতো মানুষদের এই নিয়ে ঘুম হারাম করে কি হবে? দেশ কি ফরজ আলীর একার? এমন ক্ষমতাবান লোকের দাওয়াত অমান্য করা করা যাবে না কড়া সূর ফুলীর মার গলায়। কারন সারা বছর ফুলীর মা ঐ বড় বাড়ীর কাজ করে দেয়। যদিও বড় বাড়ীতে আফাজ সাবের মা, আর কিছু দূর সম্পর্কের আত্নীয় ছাড়া তেমন কেউ থাকে না।
বিকেলে স্কুল মাঠের দিকে হাঁটতে বের হলো ফরজ আলী। আগের দিনে এই মাঠে ঈদের দিন বিকেলে হাডুডু খেলা হতো। খেলার খবর হাটে ঢোল দিয়ে দেওয়া হতো। খেলা হতো বিবাহিত বনাম অবিবাহিত। কখনও হতো “পাচুন বনাম কলম’’। বিবাহিত অবিবাহিত দের মধ্যে কোন কোন সময় পিতা পুত্র হতো পক্ষ বিপক্ষ। এরকম হলে খেলা জমতো ভালো।
“পাচুন-কলম” টাইটেলের খেলায় ফরজ আলী সবসময় পাচুন দলে পড়তো, কারন ক্লাস এইটের বেশী পড়া হয়নি ফরজ আলীর। তাগড়া জোয়ান ফরজ আলীর দল সবসময় জিততো। দুই তিন জনকে অনায়াসে টেনে নিয়ে আসতে পারতো। পাচুনের কঠিন দলের কাছে ফরজ আলীরা জিতলেও কলমের প্যাচের কাছে পাচুন দল হেরে যায় ফরজ আলীর বুঝতে সময় লেগেছে তেত্রীশ বছর।
আর তাইতো ফরজ আলীদের দলে যারা ছিল সবাই জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক।
কেউ কামলা খাটে, কেউ নৌকা চালায়, কেউ করে ঘাটে কুলীগিরী, কেউ গারমেন্ট-এ শ্রমিক। অর্ধাহারে অনাহারে পেটে আলসার ব্যাথা, সস্তা বিড়ি সঙ্গী।
আর যারা কলম দলে ছিল তারা বড় বড় অফিসার। এয়ারকোন অফিসে তাদের হুকুম তালিম জন্য কতোজন বেয়াড়া দাঁড়িয়ে থাকে! ওরা কতো টাকা পথে বিপথে উড়ায়। থাইল্যন্ড , সিঙ্গাপুর হতে ঈদের বাজার করে। অথচ ফরজ আলীর কালকের ভাতের চাল নেই। ফরজ আলীও একসময় ভালো ছাত্র ছিল। বাড়ী-ঘর যমুনায় ভেঙ্গে গেলো। অভাবের তাড়নায় আর পড়া হোল না। অথচ ফরজ আলীর ও ছিল উচ্চ শিক্ষার অধিকার। অধিকার-অনধিকারের দদ্যুল্যমান প্রশ্নের সীমারেখা উপচে ফরজ আলীর চোখ জলে ভরে যায়।
স্কুল মাঠে গিয়ে ফরজ আলী তেমন কাউকে দেখলনা। সবাই হিন্দি সিরিয়ালে অনুষ্ঠান দেখতে হয়তো ব্যাস্ত। কিছু ছেলে-পেলে বিক্ষিপ্তভাবে সিগারেট ফুঁকছে। ফরজ আলীকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। হয়তো তারা ফরজ ফরজ আলীকে চেনে না। তাছাড়া ফরজ আলীর ত্বকে শিক্ষিত মানুষের ন্যায় লাবন্য নেই। রোদে পোড়া মানুষেরা সন্মানের পাত্র নয় এটা হয়তো বেশ বুঝে গেছে আধুনিক ছেলেপেলের দল। তাইতো জুনিয়ার ছেলেরা ধোঁয়া উরাচ্ছে নাকের ডগায়। মাঠের কোনায় দেখলো গোল হয়ে বসেছে কিছু ছেলের দল। ধোঁয়া উড়ছে বেশ কুন্ডলী আকারে। বুজতে বাকী রইলো না ওটা গাঁজার আসর। ফরজ আলীর পা মাটিতে যেন গেঁথে গেলো। এটা আমাদের গ্রামের অবস্থা!
কি হবে এদেশের ভবিষ্যৎ!!!
ফরজ আলীদের কাঁধে দেশের ভাবনা তুলে দেওয়া হয়নি, এটা ভেবে নিজে নিজেই লজ্জা পায় ফরজ আলী।
রাতে ফুলীর মা বলল কালকের জন্য ঘরে কিন্তু চাল নাই।
“অল্প কিছু ট্যাহা আছে। ফুলীর কিছু জামাও বানাইয়া দেওন লাগবো। ওর বয়স হইতাছে। তুমার তো হেই খেয়াল নাইক্যা। আবার হুনলাম ঈদের পর থেইক্যা হরতাল শুরু হইবো। তহন তো আর তেমন ভাড়া পাইবা না”
বাদ দেও ত। এতো চিন্তা কইরা রাতের ঘুম টা নষ্ট কইরা দিও না বলে ফরজ আলী।
ফুলীর মা বলে … “হুনছো … এবার গঞ্জে গেলে একটু দেইখ্যা শুইন্যা ইস্ক্যা চালাইও। টি বি তে দেখছি, হরতালের সুম যেই ভাবে বোমা ফালায়, গাড়ীতে আগুন লাগাইইয়া দেয় , ইস্ক্যা ভাঙ্গে! বড় ডর লাগে ফুলীর বাপ। বড় ডর লাগে। মরা মাইনশের ছবির মধ্যে ভালো কইরা দেহি, আমার ফুলীর বাপ নাতো…!!”
খুব ভোরে ফরজ আলী নৌকা ঘাটে চলে যায় গঞ্জের দিকে, ঢাকার উদ্যেশ্যে।
পানি কেটে কেটে নৌকা চলে যায়। পেছনে পড়ে রয় পলি মাটির গ্রাম।
পড়ে রয় ফুলীর জন্য জামার তাগাদা, পড়ে রয় ফুলীর মায়ের অনাহারী পাকস্থলী, ভালবাসা ভরা চোখের জল। ফরজ আলীরা এভাবেই হয়তো আজীবন চলে যায়, ঠিক এভাবেই……
—
>>> চলবে…
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
আগস্ট ২১, ২০১২; ৬:০৬ পূর্বাহ্ন
সুন্দর এবং আলাদা স্বাদের লেখা।
আগস্ট ২১, ২০১২; ১১:২৩ অপরাহ্ন
অনেক অনেক ভালো লাগছে আপনাদের মতামত পেয়ে। আসলে আমি ব্লগিং করা জানি না । আলমগীর ভাই পোস্ট করে দিয়েছেন । উনাকে ধন্যবাদ । আপনাদের মতামত পেয়ে উৎসাহিত হলাম । ধন্যবাদ
আগস্ট ২১, ২০১২; ৭:৩০ পূর্বাহ্ন
জাহাঙ্গীর খানের প্রথম লেখাই হৃদয় ছুয়ে গেল যেন।
যেমন প্রাণবন্ত বাস্তব জীবনের কাহিনী, তেমন লেখার চমৎকার ধরণ।
সিরিজটা বেশ জমবে মনে হচ্ছে। স্বাগতম!*viannen_01*
আগস্ট ২১, ২০১২; ১১:২৬ অপরাহ্ন
অনেক আপ্লুত হলাম । কথা হবে পথে পথে
আগস্ট ২১, ২০১২; ১০:০৩ পূর্বাহ্ন
ভালো হয়েছে জাহাঙ্গীর ভাই ফেসবুকে অবশ্য আগেই পড়ছি এখানেও লেখা টা দেখে আরেকবার পড়লাম।আর এই ব্লগে আপনাকে দেখে খুবই ভালো লাগলো আশাকরি নিয়মিত আপনার লেখা পাবো এখানে
আগস্ট ২১, ২০১২; ১১:১০ অপরাহ্ন
আমরা কেউ ধর্ম নিয়ে হানাহানি, কাটাকাটিতে ব্যস্ত। আবার কেউ ধর্ম নিয়ে বিরামহীন খুচাখুচি, বাদ-অপবাদে।
এসব কিছুর মাঝে জীবনের এ টানাপোড়েন-ই যে আসল সত্য। লেখককে সাধুবাদ ব্লগে ভিন্নতার ছোয়া আনয়নের জন্য।
আগস্ট ২১, ২০১২; ১১:২৯ অপরাহ্ন
লেখার জগতে আমি খুব ই কাচা । তবুও ভালো লাগলো জেনে যে , আপনাদের ভালো লেগেছে
আগস্ট ২১, ২০১২; ১১:৪১ অপরাহ্ন
কাচাই যদি এমন প্রশংসা পায়, তাহলে পাকা লেখার কি হবে?
নবযুগে স্বাগতম।
আগস্ট ২৪, ২০১২; ১২:৩৬ অপরাহ্ন
থেকে ছুটিতে আসা ঘুষখোর আমলা আর গ্রামের দুরন্দর কিছু লোক।
আল্লাহ্পাক নিজেই ঘুষ খান এবং ঘুষ দেন। নবীজিও তাই করেছেন।
তাই আশ্চর্য হবার কিছু নেই—ঈদ ত ঘুষখোর, বদমাইসদের জন্যই।
এটা কি কাঁচা হাতের লেখা? মোটেই নয়। এটা ত পাকা হাতের লেখা মনে হচ্ছে—এক অনবদ্য ছোট গল্প।