০
১২১৪ বার পঠিত
এক.
আমাদের প্রতিটা দিন যায় কর গুনে। আমাদের প্রতিটা নিঃশ্বাস পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে। সন্তানহারা পিতা-মাতার এমনটাই হওয়ার কথা। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা, সন্তান হিসাবে আমাদের ছিলো কিন্তু সম্পদ হিসাবে ছিলো দেশের। ওর মতো মেধাবি ও সৎ একজন গণমাধ্যমকর্মীর চলে যাওয়াটা আমাদের চেয়ে দেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর। ওকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা রাষ্ট্রযন্ত্রের।
জিনিয়া নামের গণমাধ্যমকর্মী মেয়েটিকে উপাচার্য নামের ‘আশ্চর্য’ মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিলেন। বললেন, সে বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। এটাই হয়, জিনিয়ারা যখন হাটে কারো হাঁড়ি ভাঙার চেষ্টা করেন, তখন সেই চেষ্টার বিপরীতে আবিষ্কার হয় ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। জিনিয়াদের নাশ করতে সবরকম চেষ্টা চলে। জিনিয়ার কপাল ভালো এখন পর্যন্ত তার বিষয়টি শুধু বহিষ্কারের উপর দিয়ে গেছে এবং অবশেষে তা প্রত্যাহারও হয়েছে। ফাগুন রেজা’র মতন পরিণতি তার হয়নি। তাকে অন্তত পৃথিবী থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।
জিনিয়া’র মূল দোষটা হলো সে গণমাধ্যমে কাজ করে। তার দ্বারা কারো কালো-কর্ম প্রকাশ্য হতে পারে। টেনে আনতে পারে গর্ত থেকে সাপ। তাই তাকে নাশ করতে হবে। জীবন না হলেও শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটাতে হবে। যাতে সে মানসিক অশান্তিতেই মরে যায়। যেমন এখন আমরা মরছি, ফাগুন চলে যাবার পর। ফাগুনেরও মরতে হতো না, যদি সে গণমাধ্যমে কাজ না করতো। না হয় সাব-এডিটরের কাজ করতো, কেনো আবার রিপোর্টিং এবং ফটোগ্রাফি করতে গেলো! আরে বাবা, এ দেশে নাকমুখে গুজে পেটে-ভাতে বেঁচে থাক, এর বেশি কী দরকার!
কী প্রয়োজন, মানুষের ভালো করার। কেনো আপোষহীন থাকা। তারচেয়ে হাত পেতে নিতো। ‘দিবে আর নিবে মেলাবে মিলিবে’ নীতিতে চলতো তাহলেই হয়তো ‘ফাগুন রেজা’ বেঁচে থাকতো। জিনিয়াদের এমন অবস্থায় পড়তে হতো না। কদিন আগে আরেক তরুণ গণমাধ্যমকর্মী প্রদীপ দাসকে অপদস্ত হতে হয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়। এমন ঘটনা নেহাতই কম নয়। তবে, অনেক গণমাধ্যমকর্মী ভালোও আছেন। আছেন ঝোলে-ঝালে চমৎকার, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কাটছেন। থাকুন এবং কাটুন তারা। আর ফাগুনে’রা মরে যাক। জিনিয়ারা বিপদে পড়ুক। প্রদীপেরা অপদস্ত হউক।
দুই.
ঢাকা যে লাসভেগাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমাকে বেশ আগে জানিয়েছিলো ফাগুনই। বলেছিলো, এসব নিয়ে কেনো রিপোর্ট হচ্ছে না। ক্রাইম বিটের রিপোর্টরা কেন রিপোর্ট করছেন না। আজ ফাগুন থাকলে বলতাম, ‘দেখ বাবা, কত রিপোর্ট হচ্ছে ক্যাসিনো নিয়ে। ক্যাসিনোর অ্যানাটমি চলছে রীতিমত।’ অথচ এতদিন নাকের ডগাতেই চলেছে এসব। আমাদের চোখ থাকে মূলত সিগন্যালের দিকে। কখন কোন বিষয়ে সবুজ বাতি জ্বলে। কখন কোনটার ক্লিয়ারেন্স আসে, সেই আশায় বসে থাকে গণমাধ্যমের মানুষেরা। অনেকটা ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা চালকের মতন। সবুজ বাতি জ্বললেই নড়তে পারবো, নচেৎ নয়।
ফাগুন, তুই থাকলে বলতি, ‘দেখো বলেছিলাম না। ঢাকাও লাসভেগাস হয়ে উঠেছে।’ তুই এত জানতি বলেইতো ঝামেলাটা। এই বয়সেই তোর সাবলীল ইংরেজি অনেককেই বিস্মিত করতো। ঈর্ষান্বিতও হতেন হয়তো কেউ কেউ। গণমাধ্যমের ইংরেজিতে শুদ্ধতা আনতে চেয়েছিলি তুই, এমনটাই বলেছেন তানজিল রিমন। ইংরেজি গণমাধ্যমের ভুল নিয়ে প্রশ্ন রেখে বলেছিলি তুই, ইংরেজি গণমাধ্যমে ভুল থাকবে কেনো, এমনটা। কিন্তু বাবা, সব শুদ্ধ করতে চাইলেই কি করা যায়? যায় না। শুদ্ধতার প্রশ্নে উল্টো আরো বিপদে পড়তে হয়। যেমন পড়েছে জিনিয়া। পড়েছিল প্রদীপ।
কিছু মানুষের বিস্ময়কর ধনীতে পরিণত হওয়া নিয়ে ফাগুনের প্রশ্ন ছিলো। এক দশকে শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিকদের নিয়ে অনুসন্ধিৎসু ছিলো সে। দেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ের কারণ নিয়েও ভাবনা ছিলো তার। রাজনীতি নিয়েও ছিলো অগাধ পড়াশোনা। চলে যাবার আগে পলাশীর উপর লেখা বিশেষ একটি বই পড়ছিলো ফাগুন। যতটুকু পড়েছিলো সে পাতাটি আজো ভাঁজ করা আছে। বইটি রয়েছে হয়তো পঠিত হবার প্রতিক্ষায়। যেমন আমরা অসম্ভব জেনেও উন্মুখ থাকি তার পদশব্দ শোনার আশায়। আমি আর ওর মা, চোখে মেলে রাখি দরোজায়। যদি অশরীরী হয়েও দেখা দেয়।
তিন.
চার মাস হয়ে গেলো ফাগুন নেই। জানি, ও আর ফিরবে না। মেনে নিতে কষ্ট হয়। বাবা’র হৃদয়, মা’র মন মানতে চায় না। তবু সত্যের অমোঘতা অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। তবে প্রশ্ন করার ক্ষমতা রয়েছে। কেনো ইহসান রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা’র মতন একজন প্রতিশ্রুতিশীল গণমাধ্যম কর্মীকে অকালে চলে যেতে হলো। খুন হতে হলো। গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের একজন সাব-এডিটর নিজের দেশের বাড়িতে ফিরতে গিয়ে নিখোঁজ হলেন। তার মৃতদেহ পাওয়া গেলো রেলসড়কের পার্শ্বে। তার শরীরে অন্য অংশে কোনো আঘাত নেই, আঘাত রয়েছে মাথার পেছনে, মুখে ও গলায়। এটা সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়, নিশ্চিত হত্যাকান্ড।
কিন্তু চারমাসেও হত্যাকান্ডর কোনো কারণ বের হয়নি, ধরা পড়েনি সন্দেহভাজনরা। কেনো পড়েনি, এই প্রশ্নটা নিহত সন্তানের পিতা হিসাবে করতেই পারি এবং হত্যা মামলার বাদি হিসাবে এটা আমার এখতিয়ারের মধ্যে। আমার এই এখতিয়ার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা কারো থাকার কথা নয়। আমার বিচার প্রাপ্তিতে বাদসাধার কারো কথা নয়। কিন্তু কোথা থেকে যেনো বাদসাধা হচ্ছে। সময় হলে, সুযোগ এলে সে কথাও বলবো। কোনো কিছুই ‘আনপেইড’ যায় না। সব দেনারই শোধ দিতে হয়। অলখে থাকেন যে নিরঞ্জন, পার্থিবতা না পারলে তিনি নিজ দায়িত্বে সেই দেনার শোধ করে দেন।
চার.
ফাগুন নেই, কিন্তু ফাগুনের আদর্শটা রয়ে গেছে। সৎ ও আপোষহীন থাকার আদর্শ। একজন বাবা হিসাবে ছেলের আদর্শ নিয়ে বাকিটা চলার প্রত্যয়ে পথে নেমেছি। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলো না, এমনটা সাধারণত হয় না। বরং উল্টোটা হয়। কিন্তু আমি এবং আমার পরিবার সেই অসাধারণ অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। যতই যাচ্ছি ততই জেদ বাড়ছে।
প্রতিটা সময় কানে বাজছে, ‘আব্বুজি, আমি কাওয়ার্ডের মত বাঁচতে চাই না।’ বাবা ফাগুন, তুই কাওয়ার্ডদের মতো বাঁচিসনি, সাহসী মানুষের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিস। তোর মৃত্যু হয়তো অনেক মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। অনেক তরুণকে করেছে প্রত্যয়ী। অনেককেই ভাবতে শিখিয়েছে দেশ ও মানুষের ভালোটা।
তুইও ভালো থাকিস বাবা, অন্য ভুবনে, পরম ও অসীম দয়াময়ের আশ্রয়ে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন