০
৪৩৬ বার পঠিত
ফাগুন বাবা, রাগ করিস না তুই। তোকে নিয়ে না লিখে আমি লিখছি, গুজব, ডেঙ্গু নামক গজব, গণপিটুনি এসব নিয়ে। অথচ তোকে নিয়েই তো আমার লিখার কথা ছিলো। তোকে বাদ দিয়ে তো আমি অসম্পূর্ণ বাবা। কিন্তু কী করি বল, তোর মত কত ছেলে যে হারিয়ে যাচ্ছে, তোর মা আর আমার মতন সন্তানহারা হচ্ছে কত বাবা-মা। শুধু সন্তান নয়, সন্তানকে রেখে যাচ্ছে বাবা-মাও।
প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে। যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন মানুষ। দেখ না ডেপুটি সেক্রেটারি, যাদের কেউ কেউ মানুষের চেয়ে বড় বেশি ‘স্যার’ হয়ে উঠেন, তাদের স্বজনরাও মারা যাচ্ছেন। তোর সাথে তো দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্যার সিনড্রম’ নিয়ে কথা হয়েছিল। তুইতো নানা দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলি, ‘ওখানে তো কেউ কাউকে স্যার ডাকে না, অথচ ওরা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর প্রথম সারিতে।’ হ্যারে বাবা, আমাদের দেশেও ‘মৃত্যু’ সেই ‘স্যার’দের সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে এনেছে। একজন রিকশাওয়ালার সাথে মারা যাচ্ছে একজন ‘স্যারে’র স্ত্রীও।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের যখন পেটালো, তখন তুই তোর দায়িত্ব পালন করছিলি। লিখছিলি সেই পেটানোর কথা, ছাত্রদের আহত হবার কথা। সেই লাঠিওয়ালা পুলিশরাও আজ আক্রান্ত। গতকালই দেখলাম রাজারবাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শতেকের কাছাকাছি পুলিশ। মারাও গেছেন এক কর্মকর্তা।
‘লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, জবাব দেবে বাংলাদেশ’, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এটা ছিল আমাদের প্রিয় শ্লোগান। সেই লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাসধারী পুলিশরাও অসহায় ক্ষুদ্র প্রাণির কাছে। সামান্য মশার কাছে পরাভূত তারা। জানি তুই থাকলে হাসতি, বলতি দেখো, ‘মানুষও কখনো কখনো কতটা অসহায়। সময়ে শক্তিমানও পরাভূত দুর্বলের কাছে।’
জানি তো বাবা, তোকে হারিয়েই বুঝেছি। সময়ের কাছে কতটা অসহায় মানুষ। অলখে সব চালান যিনি, তার দাবার চালে ক্ষমতার মদমত্ত হয়ে উঠে নিরূপায়, মেরুদন্ডহীন কেঁচো। ধনবান হয়ে উঠে নিমিষেই ভিখারী। দেখেছি বাবা নিজেকে দিয়েও। তুই চলে যাবার পর থেকে, আমিও ফকির হয়ে গেছিরে। আমিও হাত পাতি, তবে একজনের কাছেই, ওই যে অলখে বসে আছেন যিনি, তার কাছে। জানি না, তুই তার খোঁজ জানিস কিনা। তোর কাছে সে খবর পৌঁছায় কিনা কোনো মাধ্যম। হয়তো পৌঁছায়, হয় তো বা না।
রাগ করিস না বাবা। তুই তো ফাগুন, এ দেশে বিদ্রোহের কাল। তুই তো চাইতি এ দেশটা ভালো থাকুক। প্রবল ইচ্ছা সত্বেও বিদেশে যাসনি। এ দেশেই কিছু করতে চেয়েছিলি, দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলি। তুই তো মানুষের একটু দুঃখ সহ্য করতে পারতি না। বন্ধুর মৃত্যুতে অঝোরে কেঁদেছিলি। মানুষের মৃত্যুতেও পানি ঝরতে দেখেছি তোর চোখ থেকে। যদিও বিষাদ লুকনোটা শিখে গিয়েছিলি এ বয়সেই। তবুওতো আমি বাবা, তোর বিষাদ আমার চোখকে ফাঁকি দেয় কি করে।
তুই তো প্রতিবাদ করতি অন্যায়ের। চোখের সামনে ঘটা কোনো অন্যায়ই তুই মেনে নেসনি, সাধ্যমত রুখে দাঁড়িয়েছিস, আপোষ করিসনি। আমারই রক্তের ধারা তোর শরীরে, তুই তো আমারই অংশ। সেই আমিই কিভাবে নিশ্চুপ থাকি চারিদিকের এমন হাহাকারে। মানুষের হাহাকার, বাবাদের হাহাকার, মাদের, স্ত্রীদের, সন্তানদের এমন হাহাকারে চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার প্রেরণাতো তুই। ত্যাগের বড় উদাহরণই তো তুই। এমন প্রেরণা আর উদাহরণ সামনে থাকলে আমার মতন বুড়োও পায় তারুণ্যের শক্তি। আমার মধ্যে ভর করিস তুই, তোর শক্তি-সাহস।
ফাগুন বাবা আমার, জানি তুইও খুশি হতি। খালি তোর জন্য নয়, আমি লড়ছি তোদের জন্য, এমনটা দেখে। গর্ব করতি, আমি মানুষের জন্য কথা বলছি দেখে। গর্ব করে বলতি, ‘দেখো আমি আমার আব্বুজির মত’। তোর কাছের বন্ধুরা সবসময় বলে তোর এমন কথা। যা তুই বলতি, ‘আমি আমার আব্বুজির মতন হয়েছি’। আজ আমি গর্ব করে বলছি, আমি তোর মতো হবার চেষ্টা করছি। তোর মতন লোভ-স্বার্থ-কপটতাহীন।
সে কারণেই আমি কথা বলছি, মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে, গণপিটুনির বিরুদ্ধে, শেয়ার বাজারসহ সকল লুটেরাদের বিরুদ্ধে, ধর্ম-সম্প্রদায়ের নামে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার চাণক্য কূট-কৌশলের বিরুদ্ধে। কথা বলছি দেশে দেশে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।
তুইও জানতি, আমিও জানি, অনেকে বলবেন, আমাদের লেখায় কি হবে। এমন অকালকুষ্মান্ডদের দেখা মেলে সবখানেই। এরা যদি বুঝতো একটা আঘাতে দরোজা ভাঙে না, আঘাতের পর আঘাত করতে হয়। প্রতিটা আঘাত এক এক করে গুনতে নেই, সবগুলো মিলেই একটা আঘাত এবং সেই সম্মিলিত বজ্রাঘাতেই দরোজা ভেঙে পড়ে।
ওরা না জানলেও তুই তো জানতি। তুই তো ফাগুন, গড়পড়তা কেউ নস। একুশ বছরেই তোর জানা ছিল ভারতবর্ষের আড়াই হাজার বছরে ইতিহাস। গ্রিক মিথোলজি থেকে আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞান। আইন থেকে ফটোগ্রাফি সবই ছিলো তোর আয়ত্বে। কী অদ্ভুত ক্ষমতা ধারণ করেছিলি নিজের ভেতর।
আমি ভাবি, ভেবে নিজেই আশ্চর্য হই, এত ধারণ ক্ষমতা ছিলো তোর। এতো আলো ছিলো তোর ভেতর, যার ফলে নিজেই হয়ে উঠেছিলি এক আলোকবর্তিকা। যে আলোতে এখন অনেকেই পথ চলতে চায়। অনেকেই চায় ফাগুন রেজা হতে। আমি নিজেও সেই আলোতেই পথ চলছি বাবা।
তোকে নিয়ে যতদিন বেঁচে থাকবো লিখে যাবো। জানি তুই বলবি, ‘শুধু আমার জন্য কেনো।’ না বাবা এখন যেমন লিখছি, তেমনি সবার জন্যই লিখে যাব। যতটা পারি, যেভাবে পারি। তোর তো চিন্তা ছিল এ দেশটাকে নিয়ে, তোর চিন্তার বাইরে যাবার ক্ষমতা আমার নেইরে বাবা।
তুই তো আমারই অংশ, দুজনেই মিলেমিশে দেশটাকে বাঁচানোর চিন্তা করেছি, করি। মানুষের পক্ষে, মজলুমে পাশে দাঁড়াই। বাবা আমার, তোর তারুণ্য ধার করে, উঠে দাঁড়াই ঋজু হয়ে। যেমন দাঁড়িয়েছিলাম নব্বইয়ে, যখন ঘটে গিয়েছিলো গণঅভ্যুত্থান।
ফুটনোট : তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। যিনি ফাগুন রেজা নামেই পরিচিতি ছিলেন গণমাধ্যমে। প্রতিবাদী, আপোষহীন এক তরুণ। যার যাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল খুনিরা। তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তার দেহ ফেলে রাখা হয়েছিল রেললাইনের ধারে।
খুনিরা ভেবেছিল ফাগুনের মৃত্যুর পর সব থেমে যাবে। যায়নি। ফাগুনরা মরে না কখনো, এ কথা জানা ছিলো না খুনিদের। ওরা যুগে যুগে জন্মায়, মানুষের সাহসের প্রতিক হয়ে, প্রেরণার বাতিঘর হয়ে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন