০
১৫০১ বার পঠিত
আবরার ফাহাদ যেদিন নিহত হয়, সেদিন মনে হয়েছিল আমার ফাগুন আবার নিহত হলো। এখন প্রতিটি হত্যাই আমাকে আমার ফাগুনের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি বুঝি সন্তান নিহত হবার যন্ত্রণা, বাবা-মা’দের বুকের হুতাশন। তাই প্রতিটা হত্যা, প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে যন্তণাকাতর করে, করে দিশেহারা, একই সাথে প্রতিবাদীও।
আজ আমার ছেলে সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা তথা ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের পাঁচ মাস পূর্ণ হলো। ছেলে মারা যাবার পরে লিখেছিলাম, পিতা এবং সাংবাদিক হিসাবে আমার মতন দুর্ভাগা বোধহয় কেউ নেই। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যেমন ভারী, তেমনি একজন সাংবাদিকের কাছে তার সন্তানের হত্যাকান্ড নিয়ে লেখাও অসহনীয় ওজনের। কিন্তু আমাকে লিখতে হয়েছে।
আমার দুর্ভাগ্যের পাল্লা আজ আরো ভারী হয়েছে। সন্তানের পর মাকে হারিয়েছি। আমার মা জাহানারা রেজ্জাক, যিনি মাওলানা ভাসানীর অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে এসেছিলেন। সারাজীবন মানুষের সেবা করেছেন। কখনো জনপ্রতিনিধি হিসাবে কখনো সামাজিক সংগঠনের প্রধান হিসাবে। তার প্রিয় নাতি ছিলো ফাগুন রেজা। ‘ফাগুন’ নামটা তারই দেয়া। জন্মের পর থেকে দাদী’র হাতেই মানুষ ফাগুন। শুদ্ধ চলিত ভাষায় কথা বলা দাদীর কাছ থেকেই শেখা ফাগুনের। ভদ্রতা ও সভ্যতার পাঠ নেয়া দাদীর কাছ থেকেই। মানুষের প্রতি দরদটাও পাওয়া মূলত দাদী এবং দাদার কাছ থেকেই।
মা, ফাগুনের দাদী গত চার বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস সাথে কোমরের হাড় ভেঙে যাওয়া তাকে শয্যাশায়ী করেছিলো। তারপরেও তিনি ছিলেন। আর সে থাকাটাতেও আঘাত হানলো ফাগুনের মৃত্যু। জীবনের এত কঠিন সময় পার করেছেন তিনি, অসুখও তাকে খুব একটা পরাস্ত করতে পারেনি, তবে ফাগুনের চলে যাওয়ার পর তাকে রাখা যায়নি। গত ঊনিশ অক্টোবর সকালে তিনিও চলে গেলেন। গেলেন ফাগুনের কাছেই।
মা’কে ফাগুনের পাশেই দাফন করেছি। একদিকে সন্তানের শোক, অন্যদিকে মা। কী ভয়াবহ সময় কাটছে আমার, যা চিন্তারও বাইরে। এমন অবস্থায় নিজের টিকে থাকাটা কতটা কঠিন, কতটা যন্ত্রণাময়, তা বোঝানোর সাধ্য নেই। কিন্তু তারপরেও টিকে আছি। কেন আছি, সে কথাটা ফাগুনের চলে যাবার পরও বলেছি, আজও বলছি। টিকে আছি, আমার আরো সব ফাগুনের জন্য। সুকান্ত নই, অত বড় চিন্তার ক্ষমতাও নেই। বিশ্বকে নয়, এ দেশকে আমার অন্য সন্তানদের বাসযোগ্য করার চেষ্টায় বেঁচে আছি। প্রতিশোধ স্পৃহায় টিকে আছি। সে প্রতিশোধ কাউকে হত্যা করার নয়, বাঁচিয়ে রাখার। অন্য ফাগুনদের নিরাপদ জীবন দেবার।
ফাগুনের পর আবরার গিয়েছে। আমরা যদি না দাঁড়াই, টিকে না থাকি, প্রতিবাদ না জানাই, প্রতিরোধ না করি তবে তো লাশের মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হবে। আজ লেখা শুরু করার আগে দেখলাম, ময়মনসিংহে ব্যাগের মধ্যে একটি দেহাংশ পাওয়া গেছে। হাত-পা, মাথা নেই, শুধু মূল দেহটা ব্যাগে ভরে ফেলে যাওয়া হয়েছে। কি নৃশংস! একটা মানুষকে হত্যার পর তার হাত-পা মাথা বিচ্ছিন্ন করা, কতটা ঠান্ডা মাথার কাজ, কতটা ‘প্রফেশনাল’। একজন ‘প্রফেশনাল’ ছাড়া এমন কাজ করা স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
পুলিশ বলছে নিহতের বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। আরেক তরুণ। কোন বাবা-মা’র বুক যেনো খালি হলো। এই যে নৃশংসতা, এর বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতে হবে। উটপাখির মতন যারা বালিতে মুখ গুজে থাকেন, তাদের পেছনেও তাড়া করে মৃত্যু। নিজেরা অন্ধ সাজেন বলে, দেখতে পান না সেই আজরাইলের প্রতিভূদের মুখ। ভুলে যান, মরার আগেই তিনি চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে গেছেন মৃতদের মিছিলে। আর সে মিছিল ক্রমেই বর্ধমান।
আবার ফাগুনের কথায় আসি। ফাগুন পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়েছিলো। দোষটা আমার এবং আমাদের পরিবারের। জন্ম নিয়েই দেখেছে দাদা ও বাবা সাংবাদিকতায়। চোখ মেলেই দেখেছে, দাদা-দাদী-বাবা সবার হাতেই বই। ফলে ছোট বেলা থেকেই বইয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ ওর মৃত্যু প্রমান করে গেছে, পড়াশোনা এখন দোষের মধ্যে পড়ে। ‘বিদ্যা লাভে লোকসান, না অর্থ নাই মান’, যেনো এটাই ক্রমে সত্যি হয়ে উঠছে। না হলে, ফাগুনের মত প্রতিভাদের মেরে ফেলা হয়, আর ম্যানহোলের ঢাকনা চোর হয়ে উঠে শতকোটি টাকার মালিক, সমাজের মাথা।
ফাগুনের এক নানা ছিলেন এশিয়ার খ্যাতনামা সাংবাদিক। জ্যাঠা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। অনেক খ্যাত মানুষেরা প্রিয়জন, কাছের আত্মীয়। যাদের বাদ দিয়ে, যে পরিবারকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। এমন কি আমলাতন্ত্রেরও নয়। সুতরাং গতানুগতিকায় ফাগুনও সে পথে হেঁটেছিলো, আলোকিত মানুষ হওয়ার পথে। বেছে নিয়েছিলো সাংবাদিকতা।
না, ফাগুন ব্যর্থ হয়নি তার কাজে। এই বয়সে ইংরেজি গণমাধ্যমের সাব-এডিটর হওয়াটা খুব একটা ছোট বিষয় নয়। ওর কাজ ছিলো সবার কাছে প্রশংসিত। ইংরেজিতে ও কতটা ভালো ছিলো তা বুঝি তানজিল রিমনসহ অন্যান্যদের লেখায়। তানজিল রিমন জানিয়েছে, ফাগুন একটি বিশুদ্ধ ইংরেজি গণমাধ্যমের স্বপ্ন দেখতো। জানি, বেঁচে থাকলে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার ক্ষমতাটা তার ছিলো। আর সে কথাই বলেছেন খ্যাত সাংবাদিক রফিকুল রঞ্জু তার কথায়। তিনি বলেছিলেন, ফাগুনের মাঝে প্রকৃত সাংবাদিকতার আগুন ছিলো।
কিন্তু ফাগুনের ভেতরের সেই আগুনকে আলো হয়ে উঠতে দেয়নি আততায়ীরা। আজ পাঁচ মাস হলো, ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন হয়নি। কেন হয়নি, সে প্রশ্ন চেপে রেখে আশায় আছি, হয়তো জানতে পারবো কেনো তাকে হত্যা করা হলো। জানি, ‘কেনো’ এই শব্দটির উত্তর পাওয়া আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা জটিল, সেটাও উপলব্ধির বাইরে নয়। তারপরেও মানুষ আশা করে, মানুষ আশাবাদী প্রাণি। যেমন আমি আশা করি, আমাদের প্রতিবাদে, প্রতিরোধে যদি অন্য ফাগুনেরা বেঁচে যায়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন