করোনাভাইরাস মহামারি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভাষণে করোনা মোকাবেলায় সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সাফল্য রয়েছে বলে দাবি করেন শেখ হাসিনা। নেত্র নিউজের ফ্যাক্ট চেকাররা তার দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে পাঁচটি অসত্য দাবি ও পাঁচটি অর্ধসত্য দাবি চিহ্নিত করেছেন।
দাবি ১: “এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অসত্য।
বাস্তব চিত্র:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে এমন দাবি করলেও, করোনা মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া প্রকৃত পদক্ষেপ ও আচরণের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কভিড-১৯ ভাইরাস কমিউনিটি সংক্রমণে পৌঁছে যাওয়া ও একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পরও ২১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও সতর্কতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঢাকায় নির্বাচন আয়োজন করে। হাসিনা নিজেও ভোট দিতে কেন্দ্রে উপস্থিত হন। ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫ ভোটারের ওই আসনে সম্ভাব্য জনসমাগম নিয়ে সরকার ও শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন না থাকলেও, ভোটাররা ঠিকই উদ্বিগ্ন ছিলেন। যার প্রতিফলন দেখা যায় ভোটার উপস্থিতিতে। ওই উপ-নির্বাচনে মাত্র ৫.২৮% ভোটার ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। শুধু ঢাকায় নয়, একইদিন ঢাকার বাইরেও দুইটি আসনে — গাইবান্ধা-৩ এবং বাগেরগাট-৪ — উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
যদি “মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা” শেখ হাসিনার ও তার সরকারের “সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার” হতো, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ জমায়েতের শঙ্কায় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়া হয় ১৮ মার্চ। তখন আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হয় ১৪ জন [১]। ২১ মার্চ দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়া হয় ও আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হয় ২৪ জন [২]।
নির্বাচনের আগের দিন ২০ মার্চ বেনারনিউজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “করোনাভাইরাস: জনসমাগম নিষিদ্ধ হলেও নির্বাচন হচ্ছে, অফিস-আদালতও খোলা” [৩]। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম বন্ধ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের পরামর্শ উপেক্ষা করেই শনিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের তিনটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও অফিস-আদালত চলছে।”
বেনারনিউজের এই প্রতিবেদনেই করোনা মোকাবেলায় সরকারের অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি বলা হয়েছে, “করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রস্তুতির ঘাটতি, অবহেলা এবং সময়ক্ষেপণ নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।”
“পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ এবং সরকারের নিজস্ব রূপরেখা বাস্তবায়নে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটছে। ফলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে পড়েছে,” বেনারকে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলাম। “প্রস্তুতি গ্রহণে তিন মাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অহেতুক বিলম্ব এবং অবহেলার কারণে পরিস্থিতি জটিল হতে চলেছে।”
এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসেই করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে জাতীয় সংসদে। চীন থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের যথাযথভাবে পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গাফেলতি করছে অভিযোগ করে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে ৬ ফেব্রুয়ারি বিবৃতি দাবি করেছিলেন সাংসদ মুজিবুল হক [৪]।
২০ মার্চ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস মানবাধিকার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, “While authorities discouraged mass gatherings, they have not offered much else to build confidence they are adequately responding to the crisis” [৫]।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর সরকারের চরম নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও গত কয়েক সপ্তাহে করোনা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অসংখ্য প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম তুলে ধরা হলো। শেখ হাসিনার উপরোক্ত দাবি যে সত্য নয়, এসব শিরোনাম থেকেই সেই ধারণা পাওয়া যাবে।
৮ ফেব্রুয়ারি বাংলানিউজের শিরোনাম, “ওসমানী বিমানবন্দরে থার্মোমিটার দিয়ে চলছে করোনা পরীক্ষা!”
১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, “করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে ঢিলেঢালা ভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা সব বন্দরে”।
২৮ ফেব্রুয়ারি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার শিরোনাম, “Coronavirus: BD ill-prepared to fight potential outbreak”।
৬ মার্চ ডেইলি স্টারের শিরোনাম, “Lack of coordination, flaws in govt plan on tackling possible Coronavirus outbreak: Experts”।
৬ মার্চ ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনার প্রস্তুতি: থার্মাল স্ক্যানার মাত্র একটি”।
৮ মার্চ যমুনা টিভির প্রতিবেদন, “করোনাভাইরাস প্রতিকারে যথাযথ প্রস্তুতি নেই: হাইকোর্ট”।
১৩ মার্চ নিউ এইজের শিরোনাম, “Coronavirus fears grip Bangladesh amid doubts over preparedness”।
১৮ মার্চ নিউ এইজের প্রতিবেদন, “Bangladesh lacks preparation for tests, treatment for coronavirus”।
১৯ মার্চ বিডিনিউজের শিরোনাম, “অপ্রতুল সুরক্ষা উপকরণ, আতঙ্কে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা”।
২০ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম, “করোনাভাইরাস পরিস্থিতি: অপ্রস্তুত হাসপাতালে আতঙ্কে চিকিৎসক”।
২৪ মার্চ দেশ রূপান্তরের একটি বিশেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষুব্ধ আ.লীগ নেতারা”।
২৪ মার্চ প্রথম আলোর শিরোনাম, “করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতিতেই ঘাটতি ছিল অনেক”।
দাবি ২: “আইইডিসিআর-এর হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। এছাড়া সোসাইটি অব ডক্টরস তাদের ৫০০টি নম্বর উন্মুক্ত করে দিয়েছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অর্ধসত্য।
বাস্তব চিত্র:
১৬ কোটি মানুষের দেশে করোনা পরীক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর ১৮টি মোবাইল নম্বরকে হটলাইন হিসেবে চালু করে। ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের পর ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে মানুষকে ইমেইল ও ফেসবুক পেইজের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
“হটলাইন”গুলোতে মানুষজন কেমন সেবা পাচ্ছিলেন বা তা যথেষ্ট ছিল কিনা তা বুঝতে নিচে কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম তুলে দেয়া হলো:
১৭ মার্চ জাগোনিউজের শিরোনাম, “জ্বর সর্দি কাশি: হটলাইন-আইইডিসিআর, কোথাও মিলছে না পরামর্শ”।
১৯ মার্চ ঢাকা ট্রিবিউনের শিরোনাম, “Coronavirus: Frustration rising over inadequate hotline services”।
২৩ মার্চ দৈনিক সমকালের শিরোনাম, “হটলাইনে ঢোকাই কঠিন”।
অর্থাৎ, হটলাইন সেবা চালু করা হলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
অন্যদিকে, “সোসাইটি অব ডক্টরস তাদের ৫০০টি নম্বর উন্মুক্ত করে দিয়েছে” বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এসব নম্বর কোথায় ও কার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো পাবলিক ডোমেইনে এ ধরণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হলে এই সংক্রান্ত তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হবে এমনটাই স্বাভাবিক ছিল।
দাবি ৩: “সরকার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অসত্য।
বাস্তব চিত্র:
৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়া ও ১৮ মার্চ প্রথম রোগী মারা যাওয়ার পর ২০ মার্চ বেনারনিউজের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকারি উদ্যোগের অপ্রতুলতা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ডাক্তার এবং নার্সদের জন্য হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, গাউন ইত্যাদি ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় মেডিকেলগুলোতে সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বর এবং সর্দিকাশির চিকিৎসা দিতেও ভয় পাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।”
প্রতিবেদনে বলা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিজেদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে পাঁচ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন। ওই মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান বেনারকে বলেছেন, “হাঁচি-কাশিসহ সব ধরনের সংক্রমণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ঢুকছেন। অথচ চিকিৎসকদের জন্য নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।”
সরকারের পক্ষ থেকে ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা যে গ্রহণ করা হয়নি তা আরও স্পষ্ট হবে নিচের সংবাদ শিরোনামগুলো দেখলে।
১৮ মার্চ নিউ এইজের প্রতিবেদন, “Bangladesh lacks preparation for tests, treatment for Coronavirus”।
১৯ মার্চ বিডিনিউজের শিরোনাম, “অপ্রতুল সুরক্ষা উপকরণ, আতঙ্কে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা”।
২০ মার্চ ঢাকা ট্রিবিউনের শিরোনাম, “Coronavirus: Inadequate protective gear leaves Bangladesh health workers at high risk”।
২০ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম, “করোনাভাইরাস পরিস্থিতি: অপ্রস্তুত হাসপাতালে আতঙ্কে চিকিৎসক”।
২৬ মার্চ বিডিনিউজের আরেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনাভাইরাসে পরীক্ষার ১০ ল্যাবের ৭টিই চালু হয়নি”।
দাবি ৪: “চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুইটি সমুদ্র বন্দর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনসহ সকল স্থলবন্দরের মাধ্যমে বিদেশ ফেরৎ যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯৮১ জন যাত্রীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অর্ধসত্য।
বাস্তব চিত্র:
বিমানবন্দর ও অন্যান্য বন্দরে বিদেশফেরতদের জন্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সত্য। কিন্তু সেই পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নিচের খবরগুলো থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
১১ ফেব্রুয়ারি বাংলানিউজের শিরোনাম, “করোনা ভাইরাস: ঢাকা ছাড়া সব বন্দরেই অব্যবস্থাপনার চিত্র”।
২ মার্চ বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানায়, তাদের দুইজন রিপোর্টার বিদেশ থেকে ফেরার সময় দেখেছেন ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে না এবং স্ক্রিনিংয়ে বড় ধরনের গাফিলতি হচ্ছে [৬]।
৭ মার্চ ডিবিসি নিউজের শিরোনাম, “করোনা শনাক্তে স্থলবন্দরগুলোতে নেই কার্যকর ব্যবস্থা”।
১০ মার্চ ডেইলি স্টারের শিরোনাম, “বুড়িমারী স্থলবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার নেই, ডিজিটাল থার্মোমিটারই ভরসা”।
২১ মার্চ বার্তা সংস্থা ইউএনবির প্রতিবেদনের শিরোনাম, “Covid-19 screening at Dhaka airport falls short, shares returning Bangladeshi”।
দাবি ৫: “জানুয়ারি মাস থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অসত্য।
বাস্তব চিত্র:
উপরের সংবাদগুলো থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের সরকার ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যথেষ্ট কর্মসূচি ও প্রস্তুতি নেয়নি। এখানে আরও কিছু সংবাদ তুলে ধরা হলো:
৮ মার্চ যমুনা টিভির প্রতিবেদন, “করোনাভাইরাস প্রতিকারে যথাযথ প্রস্তুতি নেই: হাইকোর্ট”।
১৩ মার্চ দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, “করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই রেলের”।
১৪ মার্চ দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, “করোনা ঠেকানোর প্রস্তুতি নেই: ঝুঁকি নিয়েই গন্তব্যে লাখো লঞ্চযাত্রী”।
২০ মার্চ জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে একটি মতামত নিবন্ধ প্রকাশ করে যার শিরোনাম, “করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতিহীন বাংলাদেশ”।
২২ মার্চ দেশের ৬৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে তারা বলেছেন, “মহাবিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেই, সমন্বয় নেই, আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত উপকরণ ও ব্যবস্থাপনা দেশে নেই; নেই চিকিৎসকদের রক্ষার ব্যবস্থা, নেই যথেষ্ট মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ভেন্টিলেটার! পরীক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া সরকার আক্রান্ত সংখ্যার যে তথ্য দিচ্ছে তা তাই বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। দেশের হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান দুর্বলতা ও প্রস্তুতিহীনতা অনুধাবন করে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন” [৭]।
২৩ মার্চ বাংলাট্রিবিউনের প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনা মোকাবিলার সরঞ্জামের ঘাটতি আছে: ওবায়দুল কাদের”।
২৪ মার্চ দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, “করোনাভাইরাস পরীক্ষা: কিট ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব”।
২৪ মার্চ এসএ টিভির শিরোনাম, “চট্টগ্রামে করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি এখনো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ”।
২৬ মার্চ দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, “করোনাভাইরাসের পরীক্ষা অপর্যাপ্ত”।
দাবি ৬: “করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া আরও তিনটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অর্ধসত্য।
বাস্তব চিত্র:
প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছেন ২৫ মার্চ। তার আগের দিন ২৪ মার্চ প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনা-আক্রান্তদের চিকিৎসায় সব হাসপাতাল প্রস্তুত নয়”। করোনা আক্রান্তদের জন্য যে ছয়টি হাসপাতাল ঢাকায় নির্ধারিত করা হয়েছে সেগুলোর প্রস্তুতির অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রথম আলো জানিয়েছে দুইটির প্রস্তুতি তখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আর একটি মোটামুটি প্রস্তুত রয়েছে।
সরকার নির্ধারিত একটি হাসপাতাল হচ্ছে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে হাসপাতালটির প্রধান ফটকের যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দৃশ্যমান একটি নোটিশে লেখা রয়েছে,
“সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা সংযোজনের প্রক্রিয়া চলছে। এখনো হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা চালু হয় নাই। সুতরাং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অথবা করোনাভাইরাস সংক্রমণের সন্দেহভাজন রোগীদেরকে সরকার-ঘোষিত অন্য হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হইল।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিন ২৬ মার্চ একাত্তর টিভি একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করেছে “করোনা চিকিৎসায় প্রস্তুত নয় হাসপাতাল” শিরোনামে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “ঢাকার পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত বলা হলেও একটি ছাড়া কোনোটিতেই প্রস্তুতি নেই”।
ছয়টি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সত্য। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় পর্যন্ত প্রস্তুত ছিলো না।
দাবি ৭: “ঢাকায় ১০ হাজার ৫০টি সহ সারা দেশে ১৪ হাজার ৫৬৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অসত্য।
বাস্তব চিত্র:
প্রধানমন্ত্রী যেদিন ভাষণ দেন, ওই দিনই বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম: “করোনাভাইরাস: বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-আইসিইউ-হাসপাতাল শয্যা কতোটা আছে?” প্রতিবেদনে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে জানানো হয়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ঢাকা মহানগরীতে মোট আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১০৫০টি (হাসিনা তার ভাষণে এই সংখ্যাটি বলেছেন ১০,০৫০)।
২৪ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সারা দেশে আইসোলেশনের জন্য ৪ হাজার ৫৩৯টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে, এর মধ্যে ঢাকায় প্রস্তুত আছে ১ হাজার ৫০টি শয্যা [৮]।
দাবি ৮: “সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকায় আশকোনা হাজী ক্যাম্প এবং টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অর্ধসত্য।
বাস্তব চিত্র:
আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এক পর্যায়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আরেকটি কোয়ারেন্টিন সেন্টার করা হবে। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এরপর সরকার উত্তরা দিয়াবাড়ী এলাকায় কোয়ারেন্টিন সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী আশকোনা ও দিয়াবাড়ীর সম্ভাব্য সেন্টার দুইটি পরিচালনার দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয়দের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে ২০ মার্চ সেনাবাহিনী সেখানে কোয়ারেন্টিন সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরে আসে এবং জানায় যে, সরকার নতুন কোনো জায়গা দিলে সেখানে কোয়ারেন্টিন সেন্টার নির্মাণ করা হবে। আইএসপিআরের বরাতে এই খবর ২১ মার্চ প্রকাশ করে ঢাকা ট্রিবিউন, দেশ রূপান্তর, ইত্তেফাক ইত্যাদি সংবাদমাধ্যম। অর্থাৎ, ঢাকায় বর্তমানে একটিমাত্র কোয়ারেন্টিন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে।
দাবি ৯: “বিদেশ থেকে যাঁরা আসছেন তাঁদের তালিকা ঠিকানাসহ জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন আগত প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করছেন।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অর্ধসত্য।
বাস্তব চিত্র:
২৪ মার্চ প্রথম আলোর “করোনা নিয়ে ‘খারাপ পরিস্থিতির’ আশঙ্কা পুলিশের” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জানুয়ারি থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ দেশে এসেছেন। এর মধ্যে মার্চ মাসের ২০ দিনেই এসেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার। আর গতকাল পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৭৯০ জন। দেশে আসার সময় সঠিক ঠিকানা না দেওয়া এবং পাসপোর্টের ঠিকানায় অবস্থান না করার কারণে ফিরে আসা এসব লোককে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।”
অর্থাৎ, সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, বাস্তবে বেশিরভাগকেই কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন তা করতে পারেনি।
দাবি ১০: “[স্বাস্থ্যকর্মীদের] সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।”
ফ্যাক্ট-চেকিং সিদ্ধান্ত: অসত্য।
বাস্তব চিত্র:
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দুই দিন দিন আগে ২৩ মার্চ বাংলাট্রিবিউনের প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনা মোকাবিলার সরঞ্জামের ঘাটতি আছে: ওবায়দুল কাদের” ।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আগের দিন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম “পিপিই সঙ্কট চরমে”। এতে বলা হয়েছে, “আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে কোনো চিকিৎসক যেন এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হন সেজন্য তারা পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে দেশের কোনো জেলাতেই পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। ফলে আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্টরা।”
২৪ মার্চ প্রথম আলোর শিরোনাম, “সুরক্ষায় রেইনকোট ভরসা চিকিৎসকদের”।
২৫ মার্চ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের প্রতিবেদনের শিরোনাম, “সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই, বরিশালে চিকিৎসা দিতে অনীহা চিকিৎসকদের”।
২৬ মার্চ প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, “করোনায় সুরক্ষা পোশাকের সংকট কাটছে না”।
==============
ইন-টেক্সট সূত্র:
[১] প্রথম আলো, “করোনায় বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যু”, ১৮ মার্চ ২০২০
[২] ইত্তেফাক, “চীন থেকে চিকিৎসক-নার্স আনার পরিকল্পনা”, ২১ মার্চ ২০২০
[৩] বেনারনিউজ, “করোনাভাইরাস: জনসমাগম নিষিদ্ধ হলেও নির্বাচন হচ্ছে, অফিস–আদালতও খোলা”, ২০ মার্চ ২০২০
[৪] প্রথম আলো, “করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে, সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন”, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
[৫] ব্র্যাড এডামস, “Bangladesh should address vulnerability to Coronavirus”, ২০ মার্চ ২০২০
[৬] বিবিসি বাংলা, “করোনাভাইরাস: ঢাকা বিমানবন্দরে যা দেখলেন বিবিসি সংবাদদাতারা”, ২ মার্চ ২০২০
[৭] দ্য ডেইলি স্টার, “প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি: ৬৩ নাগরিকের ১০ দাবি”, ২২ মার্চ ২০২০
[৮] দেশ রূপান্তর, “কোয়ারেন্টাইনে প্রস্তুত ২৯৪ প্রতিষ্ঠান”, ২৫ মার্চ ২০২০