১
৫৬৬ বার পঠিত
কিছুদিন আগে বেশ ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছে আধুনিক বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর’ এর। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে প্রায় ২৮০০ বর্গফুটের এই বুকশপ ক্যাফে দীপনপুরের প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে বই। বই কেনার পাশাপাশি এক কাপ চা বা কফি খেতে খেতে বই পড়ার চমৎকার ব্যবস্থাও রয়েছে ক্যাফেটিতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং ওয়াইফাই সুবিধা সম্বলিত দীপনপুরে ছোটদের বই নিয়ে করা হয়েছে শিশুতোষ কর্নার দীপান্তর। বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস, চা, কফি, ফ্রেশ জুস নিয়ে দীপনপুরের ভেতরেই যে কর্ণার রয়েছে তার নাম ‘দীপাঞ্জলি’। এছাড়া ‘দীপনতলা’ নামে ছোট একটা মঞ্চও রয়েছে। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য রয়েছে আরামদায়ক সোফা ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারেও কি তাই? না।
খেয়াল করুন, বইয়ের দোকানটির নাম বুকস্টল, লাইব্রেরি, বুকশপ কিংবা পাবলিশার্স নয়, “বুকশপ ক্যাফে”। তাতে সমস্যা কী? সে বিচারে যাওয়ার আগে একটি পুরোনো বিষয় মনে করাইঃ
দেশে যখন প্রথম লাক্সারি কোচ (প্রচলিত অর্থে নাইট কোচ) চালু হল সে সময় ধনী-দরিদ্র শ্রেণিভেদে সকলেই তাতে যাতায়াত করত। একেবারে শীর্ষ ক্ষমতাবান ধনীরা বিমানে/ ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করত। তা বাদে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে ওই নাইট কোচে চেপে বসত। একসময় মোডিফিকেশনের দরকার পড়ল।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যামফোর্ডের ভাষায় এই ‘দরকার পড়া’ ব্যাপারটা আর কিছু নয়, ভোগেচ্ছাকে চাগিয়ে দেয়া। চাহিদাকে অসীম করার টুলস হাজির করা। এইসব কাজ করার জন্য কর্পোরেট বডিগুলো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ‘মগজ’ কিনে নেয়। সেই সব মগজগুলো রাতদিন অষ্টপ্রহর মানুষের ভোগেচ্ছা বাড়ানোর নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। ভোগেচ্ছাকে বিভিন্নমুখি করে এবং শেষ পর্যন্ত পুরোনো প্রডাক্টই নতুন নামে হাজির করে। সহজে বললে বাংলাদেশে একটি বহুজাতিক কোম্পানী সেই ষাঁটের দশক থেকেই একটি সাবানকে ‘নতুন’ মোড়কে হাজির করে চলেছে মূল নাম ঠিক রেখে।
সেভাবেই এক সময় নাইট কোচগুলো ফিক্সড ৩ সিট বাই ২ সিট থেকে দুপাশে দুই সিট। ক্যাসেটে গান। টিভিতে হাসির নাটক। পরে চেয়ার কোচ। আরও পরে সেলুন কোচ। তারও পরে সুপার সেলুন। ৪২ সিট। ৩৬ সিট। এভাবে মোডিফাই হতে হতে এক সময় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত! এরও পরে বিশ্বের নামি-দামী কোম্পানীর বহুমূল্য গাড়ি। এরপর ওই ৩০ বা ৩৬ সিটের ভেতরেই ৬টি বা ৮টি বিশেষ সুবিধাযুক্ত সিট রাখা হল। এভাবে যত বেশী মোডিফাই হতে লাগল তত বেশী সেই আগের এজমালি ‘চেয়ারকোচ’ তার জৌলুশ হারাতে লাগল। এবার সরাসরি যাত্রীদের ক্লাস ভাগ হয়ে গেল।
উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত অনেক টাকা দিয়ে ওই বিশেষ সুবিধাযুক্ত সুপার লাক্সারি কোচে যাতায়াত করতে লাগল। তাদের ক্লাস অনুযায়ী কর্তৃপক্ষও সেবাদান করতে লাগল। আর ওদিকে সাধারণ বাস রইল কম ভাড়া দিতে পারা গরিবদের জন্য। সিটের কাভার নেই, ফান নেই, রাইট জ্বলে না, জানালায় কাচ নেই, দুই সিটের মাঝে পর্যাপ্ত জায়গা নেই…. অর্থাৎ যতটা কম সুবিধা দিয়ে চালানো যায়। তাতেও ওই গরিব যাত্রীদের সমস্যা নেই, কারণ তাদেরকে এই বাসেই যেতে হবে। এটা সেই নিউটনের থার্ড ল’। এয়ারকন্ডিশনড সুপার লাক্সারিতে যত সুবিধা বাড়ল ঠিক সেই পরিমান সুবিধা কমে গেল সাধারণ কোচ থেকে।
ঢাকার বাজারে এখন ‘পাঠক সমাবেশ’, ‘দীপনপুর’, ‘পূর্ব পশ্চিম’ এর মত বুকশপ ক্যাফে হয়েছে। শিগগিরই ‘বাতিঘর’ নামে আরও একটি বিশাল ‘বুকশপ ক্যাফে’ হতে চলেছে। এই ধারা অব্যহত থাকবে (সুপার স্যালুন লাক্সারি কোচের মত)। মাঝে মাঝেই দেখা যাবে কোনো স্থানে এরকম একটি ক্যাফে উদ্বোধন হচ্ছে। কোনো ‘বরেণ্য’ লেখক উদ্বোধন করছেন। যে গতিতে এবং যে হারে এই ধরণের ক্যাফে জন্মাবে সেই একই গতিতে ঢাকার হাতে গোণা সাধারণ বইয়ের দোকানগুলোর ঝাপ বন্ধ হতে থাকবে। মধ্যবিত্তের যে অংশ বই টই পড়ে টড়ে, তারা বই এবং কফি এক সাথে বিকিকিনি করতে ক্যাফেতে বসবে। গরিব পাঠকরা সাধারণ দোকানে যাবে। সাধারণ দোকানগুলো ‘ক্যাফে’ হতে না পেরে এক সময় সাধারণ ‘নাইটকোচ’ দশাপ্রাপ্ত হবে। তারপর কোনো এক সময় সবার অলক্ষে বন্ধ হয়ে যাবে।
কোন কোন জায়গা থেকে কতগুলো বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে সেই খতিয়ান দিয়ে লেখার কলেবর বাড়িয়ে লাভ নেই। অর্থনীতির সূত্রানুয়ায়ী বন্ধ হলে কথা ছিল না। বন্ধ হয়েছে বাঙালির পাঠাভ্যাস ধীরে ধীরে শূণ্যের কোঠায় নেমে যাওয়ায়। সেই শূণ্যের কোঠা থেকে রাইজিংয়ের জন্য বিদ্ব্যৎজনেরা ‘বুকশপ ক্যাফে’ নামক ‘কমোডিটিজ’ হাজির করেছেন। এখন হয়ত আপার মিডল ক্লাসের একটি অংশ লোক দেখাতে হলেও ক্যাফেমুখি হবে, তাতে করে কি দেশে বইয়ের পাঠক বাড়বে? পারবেন তারা বাড়াতে? না। কোনো চ্যালেঞ্জ ট্যালেঞ্জের প্রশ্ন নয়, সাদাসিদে কথা- কফিসহ বই কিনবেন সমাজের ০.০২ শতাংশ মানুষ। ক্যাফের সাথে পাল্লা দিতে কিছু দোকান নাম কা ওয়াস্তে মোডিফাই করতে গিয়ে বইয়ের দাম বাড়িয়ে বসবে। তাতে করে সাধারণ ক্রেতাও বই বিমুখ হয়ে উঠবে।
দিন শেষে টিকে থাকবে ক্যাফে, কফি, ফাস্ট ফুড। বই এবং পাঠাভ্যাস কর্পূর হয়ে উবে যাবে। ভয়টা এখানেই।
ঢাকা
১৩ আগস্ট, ২০১৭
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
আগস্ট ১৩, ২০১৭; ২:০২ পূর্বাহ্ন
অধুনা বাংলাদেশে একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে নিজের গ্যাটের পয়সা খরচ করে বাহারি রঙের প্রচ্ছদে বই বের করা। এর পাশাপাশি রয়েছে পাবলিকের কাছ থেকে ধার করে এনে ফটু তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘এই দ্যাখ আমি এত্তোগুলা বই কিনসি’। অথচ এরা বছরে একটা বইও কিনেছে কিংবা পড়েছে কীনা সন্দেহ। বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ একদমই নেই। এমন কিছু মানুষকে দেখেছি তারা তাদের ড্রয়িংরুম ভর্তি বইয়ের পসরা সাজিয়ে রেখেছে, তার পাশে দামি তানপুরা, তবলা কিংবা গিটার। এদের কিলালেও কোন বইয়ের ভিতরে কী লেখা আছে তার এক লাইনও বলতে পারবে না। আর তানপুরা গিটার বা তবলা বাজানোর তো কথাই নাই। এরা না বোঝে লেখাপড়া, না বোঝে সুর-তাল। এরাই আবার সমাজের এলিট কালচারাল ব্যক্তিত্ব হিসেবে ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’।