তিন সপ্তা আগে, মে মাসের ২৫ তারিখে আমেরিকাতে একজন সাদা পোলিস অফিসার মারফত জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কালো মানুষের খুন নিয়া সারা পৃথিবীতে খুব হৈচৈ শুরু হইছে। আমি যেহেতু ফেইসবুকে মূলতঃ বাংলাদেশি পাঠকদের উদ্দেশ্যেই লিখি, তাই আমি অনেকবার চিন্তা করছি এই নিয়া কী লেখা যায়। বর্ণবাদ বিষয়টা কী, বা সাদা (অর্থাৎ ইওরোপীয় বা শেতাঙ্গ) চামড়া- ও কালো (অর্থাৎ আফ্রিকান বা কৃষ্ণাঙ্গ) চামড়ার ডাইকোটমি কী, এইটা বাংলাদেশে বাস করেন এমন মানুষ, বিশেষতঃ সংখ্যাগুরু মুসলমানের পক্ষে বোঝা কঠিন।
বর্ণবাদ বলতে আমাদের অঞ্চলের ঔপনিবেসিক পাচাটা দাস মনঃবৃত্তিওয়ালা সস্তা রঙ ফর্সা করার টিভি এ্যাড বা বিয়ার পাত্রীর গায়ের রঙ ফর্সা হইতে হবে, বা হুমায়ুন আহমেদীয় রোমান্টিকতায় কলোনিয়াল হ্যাংওভারআক্রান্ত পুরুষপতিদের পর্বত হইতে শিখরে বেদীর উপর বসিয়া তপশ্চরণ করতে করতে ফর্সা মেয়ে রূপবতী, আর শ্যামলা বা কালো মেয়ে মায়াবতী মার্কা দুই টাকার স্থূল ডায়লগের প্রডাকশান- (যেন কালো মেয়ে রূপবতী হইতে পারেন না), বা খেমটা বাদ্য বাজাইয়া খেউড়ে গীত গাইয়া প্রত্যহ প্রাতে উপটান চন্দন বৈকালে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি দিয়া অঙ্গ মার্জিত করিয়া ‘স্বর্গে আছেন ইন্দ্রের শচী, এমন শচী দেখলে হয় অরুচি, ইংরাজের মিস কচি কচি অঙ্গভঙ্গি বহুতর’ গান গাওয়া সাদা চামড়া বিদেশিনীর পর্নো দেইখা হাত মারা গৌরিভক্ত স্বামীর ঠ্যাঙ্গের তলদেশে ঈষদষ্ণু জবাকুসুম তেল ঘষা মার্কা আপাত সরল কোনো বিষয় না।
বর্ণবাদ রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থী, উগ্র জাতীয়তাবাদী হিটলারিয় ‘আমি শ্রেষ্ঠ’ জাতীয় কুৎসিত সাম্প্রদায়িক চিন্তার ফসল। এই চিন্তা শুধু গায়ের রঙ নির্ভর না, এই চিন্তা শুধুমাত্রই সাদা-কালো কেন্দ্রিক না, এই চিন্তা হিন্দু বনাম মুসলিম, বাঙ্গালি বনাম আদিবাসী, বরিশাল বনাম কুমিল্লা কেন্দ্রিকও হইতে পারে। বর্ণবাদের ইন্টারেস্টিং বিষয় হইতেছে, বর্ণবাদ সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকলেও তা সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে সংখ্যাগুরুর চিন্তাপদ্ধতি। যেই কারণে বাংলাদেশে বাস করা সংখ্যাগুরু মুসলমান বেশিরভাগক্ষেত্রেই এই বিষয় বুঝেন না। উনারা তখনই বর্ণবাদ বুঝেন যখন উনারা বিদেশে, বিশেষতঃ ইওরোপ বা আমেরিকার মত সাদা চামড়ার খ্রিশ্চান অধ্যুষিত এলাকায় যান। উনারা তখনই বর্ণবাদ বুঝেন যখন মুসলমান পদবী থাকার কারণে ইওরোপের এয়ারপোর্টে অন্যদের চাইতে বেশি সময় চেকিং এর শিকার হন, বা গায়ের রঙের কারণে চাকরি পান না। বা পাইলেও একই যোগ্যতার সাদা চামড়ার মানুষের চাইতে কম বেতন পান।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়, এই কথা শুনলে বেশিরভাগ বাঙ্গালী মুসলমান চিংড়ি মাছের খুব ক্ষেইপা লাফাইয়া উঠেন। চিংড়ি মাছ না যদিও। বাংলাদেশে বেশিরভাগক্ষেত্রে সংখ্যালঘু নির্যাতন রাজনৈতিকভাবে হয় সত্য, নাসিরনগর বা রামুর ঘটনায় রাজনৈতিক স্বার্থ ছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে নিয়মিত বর্ণবাদের প্রাকটিস হয়, তা বাঙ্গালী মুসলমান মানতে নারাজ। ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে মালা**উনের বাচ্চা, আকাটার বাচ্চা জাতীয় গালির চল আছে, ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে হিন্দুদের গরু খাওয়াইয়া ধর্মনাশের রসিকতা চলে, ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে উনাদের বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে উনাদের নিয়মিত ধর্ম পালটায় ফেলার বিনামূল্যে উপদেশ দেওয়া হয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও যে উনাদের দেবদেবী নিয়া হাস্যরস করা হয়, তা বাঙ্গালী মুসলমান বুঝতে অপারগ।
আমাদের অঞ্চলে হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষের পিছনে ঐতিহাসিক কারণ আছে অবশ্যই। উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারদের মারফত নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ধর্মান্তরিত মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন চালানো হইছে তাও সত্য। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে কৃষক বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে বিংশ শতকের মাঝখানে আইসা জমিদারপ্রথা অবলুপ্তির পরেও আধুনিক প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এই হিন্দু-মুসলমান বিভেদ প্রকট দেইখা আমি আশ্চর্য্য হই। ইসলামই সর্বশেষ এবং সেই সূত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম এই ধারণা থিকাই হিন্দু বা আদিবাসীদের প্রতি মুসলমানের ঘৃণার সূত্রপাত, এমন ভাবলে সরলীকরণ হয় নিশ্চয়ই। এই ঘৃণার শিকর আরো গভীরে।
মুসলমানরাই খারাপ আর হিন্দুরা খুব ভালো এমনও আমি বলি না। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান এবং ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুর দিকে তাকাইলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা যেমন রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংখ্যাগুরুর মারফত নির্যাতনের শিকার, তেমনি ভারতের মুসলমানরাও একই প্রকার নির্যাতনের শিকার। সুতরাং পাশাপাশি এই দুই রাষ্ট্র দেইখা বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না, বর্ণবাদের সাথে অতি আবশ্যিকভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা এবং সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার রাজনীতি জড়িত। ব্রিটেন যখন ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ইওরোপিয়ান ইউনিয়ান থিকা বাইর হইয়া যাওয়ার রাজনৈতিক প্রসেসিং শুরু করছে, তখন ব্রিটেনের বেশিরভাগ মানুষ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিছেন ‘বাইরের’ ‘বিদেশী’ মানুষরা আইসা উনাদের সব চাকরি খায়ে ফেলতেছেন এমন উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা থিকা। এই চিন্তার সাথে অতি অবশ্যই মুসলিম বিদ্বেষও জড়িত ছিলো।
আমি তখন লন্ডনে। একদিন অনেক রাতে ল্যাবের কাজ শেষ কইরা বাড়ি ফিরতেছি। সিঁড়ি বাইয়া আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেইন স্টেশানে নামতে দেখলাম পুরা প্লাটফর্মে শুধুমাত্র একজন কালো ভদ্রলোক দাঁড়ায়ে আছেন। উনার গায়ে নীল রঙ্গের হুডি, কানে হেডফোন, উনি দেয়ালে হেলান দিয়া গভীর মনোযোগে ফোন ঘাঁটাইতেছেন। উনারে দেখার সাথে সাথে আমার শিরদাঁড়া দিয়া ঠান্ডা একটা স্রোত নাইমা গেল। ভাবলাম, ট্রেইন না নিয়া বরং বাসে কইরা বাড়ি যাই। বাসে এইসময় নিশ্চয়ই অনেক লোকজন থাকবেন। কিন্তু তারপরেই আমি খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকের আমার দিকে ভুলেও কোনো নজর নাই, উনি উনার ফোন নিয়াই ব্যস্ত। দুই মিনিট পরে ট্রেইন আসলো, আমরা দুইজন একই কম্পার্টমেন্টেই উঠলাম। আমি ভাবলাম, উনারে দেখার সাথে সাথে আমার এইসব চিন্তার রহস্যটা কী। উনার গায়ের রঙ দেইখাই কি আমি ভয় পাইছি? এই ভয়ের উৎসই বা কই?
না, এই ভয়ের উৎস ধর্ষক হিসাবে পুরুষের ‘খ্যাতি’ না, এই ভয়ের উৎস বর্ণবাদ। লন্ডনে ধর্ষণ সহ অন্যান্য অপরাধের সংখ্যা কম না। এরমধ্যে কালো চামড়ার অপরাধী বা ধর্ষক যেমন আছেন, সাদা চামড়ার অপরাধী ও ধর্ষকও আছেন। কিন্তু কালো একজন মানুষ দেখার সাথে সাথে আমার যে চিন্তার জন্ম হইছে, তার পিছনে কালো মানুষদের নিয়া পশ্চিমা মিডিয়ার প্রপাগান্ডার রাজনীতি জড়িত। যেইভাবে মিডিয়ায় মুসলমান মাত্রই জঙ্গি এমন জিনিসও প্রচার করা হয়।
আমি মিডিয়া দিয়া প্রভাবিত হইয়া এমন বর্ণবাদী চিন্তা করতে পারছি ভাইবা বহুদিন খুব লজ্জিত ছিলাম নিজের কাছেই।
পৃথিবীতে এখন আর বেশিরভাগক্ষেত্রেই ‘এক জাতি- এক রাষ্ট্র’ কনসেপ্ট নাই। তা থাকা সম্ভবও না, উচিতও না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আজকের দিনে যেকোনো প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে যদি কোনো এক সম্প্রদায় বা জাতি ৭০% এর উপরে বাস করেন, তাইলে তা থিকা সংখ্যালঘুর প্রতি বর্ণবাদ জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ২০১৯ সালের ইউ-এস সেনসাস বুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকাতে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩% মানুষের গায়ের রঙ কালো। সুতরাং সংখ্যাগুরু সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলশ্রুতিতে কালো চামড়ার মানুষের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি হয়, যেইভাবে ভারতে মুসলমানদের প্রতি এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতি সংখ্যাগুরুর বিদ্বেষ জন্মায়।
হ্যাঁ, একদিনে একটা হেটারোজিনাস বা ভিন্নধর্মী মানুষের সমাজ তৈরি করা সম্ভব না অবশ্যই। একদিনেই আমেরিকায় ৫০% সাদা আর ৫০% কালো ও হিস্প্যানিক, এশিয়ান মানুষ দিয়া সমতা আনা সম্ভব না। চাইলেই বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিতে ৫০% মুসলমান ও ৫০% হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ যুক্ত করা সম্ভব না। যেইটা সম্ভব, তা হইলো, সংখ্যাগুরু থাকা অবস্থায় সংখ্যালঘুরর উপর সকল প্রকার বর্ণবাদ ও বর্ণবাদের নামে নির্যাতনের বিরোধিতা করা।
কারণ, পৃথিবীতে আপনি এক রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু থাকলেও অন্য রাষ্ট্রে গিয়া আপনি সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে মুসলমান হিসাবে আপনি সংখ্যাগুরু হইলেও ভারত বা আমেরিকায় গিয়া আপনি সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে বাঙ্গালী হিসাবে আপনি সংখ্যাগুরু হইলেও ইওরোপে গিয়া আপনি সংখ্যালঘু। আর বর্ণবাদ যেহেতু সবসময়েই দ্বিপাক্ষিক, ‘আমি বনাম অপর’এর রাজনীতি, তাই একপক্ষে বর্ণবাদ বিদ্যমান থাকলে অপরপক্ষেও বর্ণবাদ থাকবে। আমেরিকাতে কালোদের প্রতি যেমন সাদাদের বিদ্বেষ আছে, তেমনি কালোদেরও সাদাদের প্রতি বিদ্বেষ আছে। কিন্তু কালোরা যেহেতু ক্ষমতায় না, তাই আমেরিকাতে শুধুমাত্র কালোরাই নির্যাতিত হন। যদি কালোরা ক্ষমতায় থাকতেন, তাইলে আপনি বিশ্বাস করতে পারতেন, ২৫শে মে’তে খুন হওয়া জর্জ ফ্লয়েড একজন সাদা চামড়ার মানুষ হইতেন।
এই মূহুর্তে পশ্চিমা সাদা চামড়ার দুনিয়ায় ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস’ বইলা একটা বিশাল আন্দোলন চলতেছে। এই আন্দোলনরে আমি অতি অবশ্যই ছোট কইরা দেখি না, কিন্তু আমি এই আন্দোলনের সাথে ‘মাইনরিটি লাইফ ম্যাটারস’ ট্যাগলাইন যুক্ত করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর সমস্ত সংখ্যালঘুই ‘ব্ল্যাক’ বা কালো।
আমি বিশ্বাস করি, বর্ণবাদের উৎস উগ্র জাতীয়তাবাদ হইলে, উগ্র জাতীয়তাবাদের উৎস সামগ্রিক জীবনে মানুষের ব্যর্থতার আক্ষেপ। যেই মানুষ তার প্রাত্যাহিক জীবনে যত ব্যর্থ, সেই মানুষ ততই উগ্র জাতীয়তাবাদী। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ক্ষমতার কুৎসিত রাজনীতি করা ডোনাল্ড ট্রাম্প বা হিটলারের মত অতি বুদ্ধিমান বা ধুরন্ধর মানুষরা ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ সাধারণ মানুষদের বোঝাইতে সক্ষম হন, উনাদের এই ব্যর্থতার জন্য ‘অপরপক্ষ’ অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা দায়ী। তাই সাদা চামড়ার মানুষ কালো চামড়ার মানুষদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ পোষন করেন, মুসলমানরা করেন হিন্দুর প্রতি, বাঙ্গালীরা করেন আদিবাসীদের প্রতি। এইটাই আইডেন্টিটি পলিটিক্স। মানুষ যেহেতু নির্দিষ্ট বর্গে থাকতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাই নিজের বর্গের মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে অপর বর্গরে তার শত্রু তৈরি না করলে নিজের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করার অন্য কেউ থাকে না। হ্যাঁ, অতি অবশ্যই, মুসলমানদের হিন্দুর প্রতি যেই বিদ্বেষ, হিন্দুরও মুসলমানের প্রতি একই বিদ্বেষ থাকে। কিন্তু যেই রাষ্ট্রে মুসলমান সংখ্যাগুরু, যেই রাষ্ট্রে হিন্দু বা আদিবাসীরা মুসলমানের উপর নির্যাতন চালাইতে পারেন না, এই নির্যাতন সংখ্যাগুরুই চালান। একইভাবে যেই রাষ্ট্রে হিন্দু সংখ্যাগুরু, সেই রাষ্ট্রে তারাই সংখ্যালঘু মুসলমানের উপর নির্যাতন চালান।
জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনারে তাই শুধু একজন (বা চারজন) শেতাঙ্গ পোলিস অফিসারের মারফত একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের খুন হিসাবে দেখলে ভুলভাবে দেখা হবে। আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের এইসব ব্যর্থতার জন্য মেরিটোক্রিসি, রাষ্ট্রকাঠামো, পুঁজিবাদ এবং বিশ্ব রাজনীতি দায়ী। অপরপক্ষ বা সংখ্যালঘুরা দায়ী না। আমাদের বুঝতে হবে, আধুনিক পৃথিবীতে শুধু মুসলমানরা, শুধু হিন্দুরা, শুধু আদিবাসীরা, শুধু সাদারা, শুধু কালোরা যার যার রাষ্ট্রসীমা ভাগ কইরা একলা একলা থাকতে পারেন না। মুসলমানের সাথে হিন্দুর বাণিজ্য করতে হয়, হিন্দুর সাথে শেতাঙ্গর এক হাসপাতালে যাইতে হয়, শেতাঙ্গর সাথে আদিবাসীর একই ট্রেইনে উঠতে হয়। তাই বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালী বা মুসলমানের রাষ্ট্র এমন উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনা থিকা বাঙ্গালী মুসলমানের বাইর হইয়া আসতে হবে। সংখ্যালঘুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাইতে হবে। না চাইতেই হরেদরে সবাইরে দ্বিনের দাওয়াত দিয়া মুসলমান বানাইয়া ফেলার প্রাগৈতিহাসিক বর্ণবাদী চিন্তা থিকা বাইর হইতে হবে। মানুষ ভিন্ন রকমের হয়, এবং এই ভিন্নতাই সুন্দর ও স্বাভাবিক, এই ভাবনা ভাবা শুরু করতে হবে।
সারা পৃথিবীতে সাধারণ মুসলমানরা সাদা চামড়ার খ্রিশ্চান ও ইহুদী মানুষের হাতে যেই নিগ্রহের শিকার হন, তা থামাইতে চাইলে তাদের নিজেদের নিজ নিজ রাষ্ট্রে শিয়া, কাদিয়ানি, সমকামী, হিন্দু, আদিবাসী মানুষদের উপর রাজনৈতিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের নির্যাতন থামাইতে হবে। কারণ বর্ণবাদ সবসময়েই দ্বিপাক্ষিক। শুধুমাত্র যার হাতে ক্ষমতা, তারাই সেই বর্ণবাদরে ব্যবহার কইরা সংখ্যালঘুরে শত্রু বানাইয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতারে ঢাইকা রাইখা নির্যাতন চালাইতে পারেন।
তাই নিজে সংখ্যালঘু হইয়া বর্ণবাদের শিকার না হইতে চাইলে নিজ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, উগ্র জাতীয়তাবাদের ডানপন্থী রাজনীতিরে ‘না’ বলতে শিখতে হবে, ব্যক্তি পর্যায় থিকা শুরু কইরা সকলক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্ণবাদের প্রতিবাদ করতে হবে।
পৃথিবীতে শুধু আমরাই ভালো, বাকি সবাই খারাপ, শুধু আমরাই সত্য, বাকি সবাই ধইঞ্চা, পৃথিবীতে শুধু আমাদেরই অধিকার আছে, বাকিরা মইরা যাক- পৃথিবীতে সবাই মুসলমান হইয়া গেলে আর নির্যাতন থাকবে না, পৃথিবীতে শুধুমাত্র আর্য জাতিরাই উন্নত রক্তের অধিকারী, এমন অশিক্ষিত রক্ষণশীল অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন বর্ণবাদী ধারণা থিকা বাইর হইয়া আসতে হবে। পৃথিবীতে ভিন্নধর্মী মানুষ আছেন এবং থাকবেন। আমাদের শিখতে হবে সকল ভিন্নতা সহ সকলের সম অধিকার নিশ্চিত কইরা কীভাবে সুস্থভাবে পৃথিবীতে বাস করা যায়।
জর্জ ফ্লয়েডের খুনের সেই বিভৎস ভিডিওটা যদি আপনার দেখার দুর্ভাগ্য হয়, যদি একজন সাদা মানুষের হাঁটুর চাপে একজন কালো মানুষের শ্বাসবন্ধ হইয়া মৃত্যুর আগে নিরুপায় হইয়া ‘মা, মা’ বইলা ডাকার ভয়ংকর দৃশ্য আপনি দেইখা থাকেন, তাইলে জানবেন, পৃথিবীর সব সংখ্যালঘুরাই আপনাদের মত সংখ্যাগুরুর নির্যাতনে একইভাবে কান্দেন, একইভাবে ঘর বাড়ি আগুনে পুইড়া যাইতে দেইখা, একইভাবে প্রতিদিন মানসিকভাবে ছোট হইতে হইতে ‘ভুল’ রাষ্ট্রে জন্মানোর দুঃখে মারা যান।
তাই সংখ্যাগুরু হওয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘অহংকার’ বন্ধ করেন।
কারণ পৃথিবীতে সব সংখ্যালঘুরাই জর্জ ফ্লয়েড। আপনি শুধু জানেন না, আপনি কোনোদিন জর্জ ফ্লয়েড হইয়া যাবেন।
তাই বর্ণবাদরে ‘না’ বলেন।
এখনই।
বিনীত
নাদিয়া ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস, মাইনরিটি লাইফ ম্যাটারস’ ইসলাম।