বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন অনেক বৈচিত্র্যময় এবং গতিশীল। কৃষি পণ্য উৎপাদনে বড় পুঁজি বিনিয়োগ হালে শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষি উৎপাদন ব্যাপকতা লাভ করেছে। ভূমিসহ কৃষি উৎপাদনের নানাবিধ উপকরণ ইজারা বা ভাড়া নেওয়া প্রায় সর্বত্রই প্রচলিত। বর্গাচাষ সংকুচিত হয়ে ক্রম বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যেমন উপস্থিত বা অনুপস্থিত ভূমি মালিকদের জমি ইজারা বা ভাড়া নিচ্ছেন, তেমনি শহুরে বিনিয়োগকারীরাও গ্রামীণ মালিকদের জমি ইজারা বা ভাড়া নিয়ে নানাবিধ কৃষিপণ্য উৎপাদনে পুঁজি খাটাচ্ছেন। আবাদে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার দ্রুত হারে বাড়ছে। এসব আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির বেশিরভাগই দেশের কল-কারখানায় উৎপাদিত। প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে কৃষি ঋণ প্রাপ্তি বা গ্রহণের প্রবণতাও বেড়েছে। চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনসহ কৃষিতে কর্পোরেট উপস্থিতি আজ স্পষ্ট দৃশ্যমান। চেইন শপিং সেন্টার বা সুপার মার্কেটের উত্থান কৃষি ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কৃষক আর আগের মতো পারিবারিক ভোগকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা না করে বাজারজাত করার লক্ষ্যে কৃষি পণ্য উৎপাদন করছে। এখন কৃষক আপন শ্রমকেও উৎপাদন ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত করে লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে শুরু করেছে। বর্গা প্রথাসহ প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক কৃষির বিভিন্ন রূপ বা সামন্ত অবশেষ ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। কৃষিজাত দ্রব্যকে পণ্যাকারে উৎপাদনের এ পরিবর্তন ইতিবাচক এবং কৃষির অগ্রগতিতে সহায়ক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য যেমন ধান, গম, ডাল বা দুধের গড় উৎপাদন আগের তুলনায় বাড়লেও এখনো অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। অথচ কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সমূহ সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগানো বাংলাদেশের কৃষির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।তবে বর্তমান অবস্থার জন্য শুধু কৃষি উপকরণের সমস্যা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষহীনতা বা কৃষি যন্ত্রপাতির সীমিত ব্যবহার দায়ী নয়, কৃষি ভূমির মালিকানার ধরন বা ভূমি ব্যবহারের অধিকারের ধরনও বহুলাংশে দায়ী। আবার প্রায়শই কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য আদায় করতে সক্ষম হয় না। এ কারণগুলো বস্তুত কৃষির সার্বিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে। বস্তুত, কৃষির বৈপ্লবিক বিকাশে চলমান বাস্তবতার উপলব্ধিজাত নতুন কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, যার লক্ষ্য হবে পণ্য বাজারজাত করার জন্যই উৎপাদন। এই কৃষক শ্রেণী মুনাফার লক্ষ্যে বিনিয়োগ করবে, শ্রম দেবে। এদের চেষ্টা থাকবে সর্বদা কম ব্যয়ে অধিক পণ্য উৎপাদন। এবং এই কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ইতিবাচক ভুমিকা নিতে সক্ষম।
অতীতে এদেশে কৃষি বলতে সাধারণভাবে কেবল শস্য উৎপাদনই বোঝানো হতো। মাছ চাষ, হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগল পালন ইত্যাদিকে কৃষির আওতায় গণ্য করা হতো না। এমনকি ফল বাগিচাকেও কৃষির অন্তর্ভুক্ত মনে করা হতো না। তদুপরি, এ দেশের নীতি-নির্ধারকরা খাদ্য-শস্য বিশেষত ধান উৎপাদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ফলে, ধান উৎপাদন আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু ডাল বা তেল বীজের উৎপাদন মোটেও বাড়েনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে কমে গেছে। একমাত্র দানাদার খাদ্যশস্য বিশেষ করে ধান উৎপাদনকে মুখ্য করায় ইতোমধ্যেই বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। আমরা ভোজ্য তেল, ডাল ও মশলার ক্ষেত্রে আমদানী-নির্ভর হয়ে পড়েছি। নদী-নালা, বিল-ঝিল এবং হাওর-বাওড়ের দেশ বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন যথেষ্ট বাড়লেও এখনো মাছ আমদানী করা হয়। তবে আশংকাজনক হারে কমে গেছে মিঠা পানির প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন। দেশের বদ্ধ জলাশয়ে (মুলত চাষের মাছ) প্রতি হেক্টরে উৎপাদন যেখানে প্রায় ৩৩০০ কেজি, সেখানে উম্মুক্ত জলাশয়ে (প্রাকৃতিক মাছ) প্রতি হেক্টরে উৎপাদন মাত্র ২৬৭ কেজি।
এটা ঠিক, আমাদের উৎপাদনশীলতা আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু খাদ্যশস্য উৎপাদনে এমনকি ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে কৃষি জমির ক্রম হ্রাসমান প্রবণতা। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২১২ হেক্টর কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে দেশের বর্তমান মোট আবাদী জমির এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জলা ও বনভূমি কমে যাবার হার আরো বেশি। এ হারে কমতে থাকলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আর মাছ তথা আমিষের চাহিদা পূরণ থেকে যাবে সুদূর পরাহত। কেননা, বিলীন হয়ে যাবে প্রাকৃতিক মাছের বেশিরভাগ উৎসস্থল এবং চিরতরে হারিয়ে যাবে অসংখ্য প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছ ।
বাংলাদেশের কৃষির জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমাদের চেনা প্রজাতির ফসল উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একদিকে খরা ও মরুময়তা বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে অতিবৃষ্টি ও বন্যার প্রকোপ। বাড়ছে লবণাক্ত এলাকা। ঋতুর পরিবর্তনে শীতকাল হ্রাস পাচ্ছে, গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হচ্ছে। বর্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যাবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তাই পরিবর্তিত জলবায়ু সহনশীল জাত তথা খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন এবং তা কৃষক পর্যায়ে নিয়ে আসা বাংলাদেশের কৃষির জন্য আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা (ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হওয়া) ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বড় প্রতিবন্ধক। ক্ষুদ্র জোত আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী এবং সাশ্রয়ী নয়। নির্দিষ্ট সেচযন্ত্রের আওতাধীন জমি খণ্ডগুলো একই সমতলে থাকে না বিধায় পানি ও সারের অপচয় ঘটায়। তাছাড়া, জমির আইলের কারণে যে জমি আবাদ করা যায় না তার পরিমাণ কম নয়। কৃষিতে ক্ষুদে উৎপাদন বজায় থাকার এটি একটি অন্যতম কারণ যা কৃষিতে পুজিতান্ত্রিক বিকাশের বড় বাধা। ক্ষুদ্র জোতগুলোকে বড় জোতে রূপান্তর ঘটিয়ে চাষাবাদ করা বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আর বড় জোত করতে যৌথ খামার বা সমবায় খামার প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই।
প্রাকৃতিক নিয়মে উদ্ভিদ মাটি থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেড়ে উঠে। মাটিতে উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান উপস্থিত থাকলে এমন মাটিকে উর্বর মাটি বলে। আমাদের সৌভাগ্য প্রকৃতি বাংলাদেশের মাটিকে সবসময় উর্বর রাখার ব্যবস্থা করেছে। যেমন প্রতি বছর পলিমাটি সমৃদ্ধ বর্ষার পানি ফসলী ভূমিকে উর্বর করছে। আবার এদেশের কৃষকও ফসলী ভূমিকে উর্বর রাখতে প্রতি বছর ফসল পরিবর্তন করে বা ফসলের বহুমুখীকরণ করে মাটির উর্বরা গুণ অক্ষুন্ন রাখত। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল ও বিদেশী প্রজাতির চাষাবাদে ক্রমর্বধমান হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, একই ফসল বছরের পর বছর চাষ এবং বাঁধ দিয়ে সেচ প্রকল্প করে বর্ষার পানির প্রবেশ ও নির্গমনের ব্যবস্থা না রাখা মাটিকে অর্নুবরতা ও বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাসায়নিক সার ফসলের প্রয়োজন মেটালেও মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। তাই অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর নির্ভরতা অদূর ভবিষ্যতে অনিবার্যভাবে কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বংশ পরম্পরায় এদেশের কৃষক শস্যবীজ নিজেই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে আসছে। এমনকি উফশী জাতের বীজও কৃষক সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে হাইব্রিড সব্জি ও ধানবীজ উৎপাদন করা যায় না। এই বীজের প্রসারে কৃষকের বীজের ওপর আজন্ম অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষক বহু জাতিক কোম্পানী ও তাদের দেশীয় দোসরদের হাতে জিম্মি হতে চলেছে। এ অবস্থা দেশের কৃষির বিকাশে শুভ হতে পারে না। গোটা কৃষি ব্যবস্থাই কিছু উচ্চাভিলাষী দেশী-বিদেশী কোম্পানীর জিম্মি হতে পারে।
এদেশে গবেষণাগার পর্যায়ে এবং কৃষক পর্যায়ে ফলনের বিস্তর ফারাক হতে দেখা যায়। কেননা গবেষণাগারের নিবিড় চাষ প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে বজায় থাকে না। আবার বাজার দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য না জানা থাকায় কৃষক বিভিন্ন ভাবে বঞ্চিত হয়। তাই কৃষককে নতুন প্রযুক্তি সর্ম্পকে সচেতন ও দক্ষ করা, কৃষি সর্ম্পকিত বিভিন্ন তথ্যে সমৃদ্ধ করা কৃষক ও কৃষির বিকাশে অত্যন্ত জরুরী।
একটি দেশের কৃষির বিকাশের সাথে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠছে না। পাশাপাশি গড়ে উঠছে না বিভিন্ন কৃষি পণ্যের সংরক্ষণাগার ও গুদামজাত করণের সুব্যবস্থা। কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি শিল্পও পরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠছে না। এটা এদেশের কৃষি বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায়।
বাংলাদেশের কৃষিনীতিতে প্রধানত সমতলের কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অপরদিকে, পাহাড়, হাওর, চরসহ বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অঞ্চলের কৃষিকে নিদারুণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন কম হচ্ছে। তাই বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্যকে সমগুরুত্ব দিয়ে কৃষিনীতি সাজাতে হবে। তাছাড়া যে জমি যে ফসল চাষের উপযুক্ত সে অনুযায়ী চাষ পরিকল্পনা করতে হবে।
কৃষি ও কৃষকের উন্নতিতে আরেকটি বড় বাধা বিদ্যমান বাজার ও বিপণন ব্যবস্থা। কোন ফসলের উৎপাদন বেশী হলে অথবা আন্তর্জাতিক বাজারে ওই পণ্যের দাম কম থাকলে দাম পড়ে গিয়ে উৎপাদন ব্যয়ের নিচে চলে যায়। ফলে, কৃষক মার খায় এবং কৃষক ওই ফসল উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। উৎপাদন বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষাও নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে বর্গা চাষী এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক অর্থ সংকটের কারণে ফসল তোলার সাথে সাথে বিক্রি করতে বাধ্য হয় যখন উৎপাদিত পণ্যের দাম সবচেয়ে কম থাকে। আর কৃষকের ঘাম ও শ্রমের ফসল থেকে ফায়দা লোটে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া, মজুদদার ও ব্যবসায়ীরা। আবার দ্রুত পচনশীল কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় ভরা মওসুমে দাম কমে গিয়ে উৎপাদন খরচ উসুল না হলেও কৃষক এসব পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে, মধ্যস্বত্বভোগীদের বিভিন্ন কূটকৌশলের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের উচ্চমূল্য বজায় থাকে, বিশেষ করে দূরবর্তী শহরের ভোক্তা পর্যায়ে। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে কৃষি পণ্যের মূল্যের বিশাল ফারাক কৃষির বিকাশে অন্যতম প্রধান বাধা। শিল্প মালিকেরা তার পণ্যের মূল্য নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে যা কৃষকেরা পারে না। তাই উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মুনাফা রেখে সুলভ মূল্যে ভোক্তাদের নিকট কৃষি পণ্য পৌঁছে দেওয়াও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিল্প মালিকদের মত কৃষকদের তার উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণের পরিবেশ সৃষ্টি তথা কৃষকের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে কৃষির বৈপ্লবিক রূপান্তর এবং কৃষকের টেকসই উন্নতি সম্ভব নয়।
সাধারণত বড় কৃষক ব্যতীত অন্যেরা বিশেষত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক এবং বর্গা চাষি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ তথা ব্যাংক ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। এরা বরাবর পুঁজির সংকটে ভোগে। ফলে, সঠিকভাবে চাষাবাদ করতে পারে না বলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। অথচ বাংলাদেশে এরাই বেশি পরিমাণ জমি আবাদ করে থাকে। ইদানীং এনজিওগুলো ফসলভিত্তিক ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং সুদের হারও অনেক বেশী। এত উচ্চসুদে কৃষি পণ্য আবাদ করে মুনাফা করা কষ্টসাধ্যই বটে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল বিপন্ন হওয়া বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এ সংকটকে আরো গভীর করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাঝে মাঝে ক্ষয়ক্ষতি এত মারাত্মক হয় যে যা থেকে উত্তরণ ঘটানো অনেক সময়ই দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। কৃষক হয় নি:স্ব। এক্ষেত্রে শস্য বা কৃষি বীমার প্রচলন ঘটানো গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মাথা তুলে দাঁড়াবার অবকাশ সৃষ্টি হতো যা কৃষির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য জরুরী।
প্রকৃত কৃষক তথা সকল শ্রেণীর কৃষক এবং কৃষি উৎপাদকের জন্য কেবল কৃষি জমি ব্যবহারের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন অকৃষক ভূমি মালিকানা রহিত করা। এই মুহূর্তে মালিকানা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটানো না গেলে অথবা অকৃষক ভূমি মালিকানা উচ্ছেদ না করা গেলেও অন্তত কৃষকের কৃষি জমি ব্যবহারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কৃষক যেন একটি নিরাপদ সময় পর্যন্ত লীজ বা ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। যার জীবন-জীবিকা কৃষিকর্মের সাথে সম্পর্কিত নয় বা কৃষি প্রধান নয় তার হাতে কৃষি জমি থাকতে পারবে না। খাস জমি প্রকৃত কৃষক তথা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ভূমিহীন কৃষক বা বর্গা চাষীকে বন্দোবস্ত দিতে হবে। তবে কঠোর শর্ত থাকতে হবে যে বন্দোবস্তপ্রাপ্তরা নিজেরা চাষাবাদ না করলে বা কোনোভাবে জমি হস্তান্তর করলে বন্দোবস্ত বাতিল হয়ে যাবে। খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য থাকবে বর্গা চাষী থেকে উদ্যোক্তা চাষীতে রূপান্তর করা, ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোক্তা থেকে বড় কৃষি উদ্যোক্তায় রুপান্তরিত করা। একইভাবে, জলাভূমি প্রকৃত মৎস্যজীবী – জেলে ও মৎস্য চাষীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। অবশ্য লীজ নেওয়া জলাশয়গুলোর একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সংরক্ষিত রাখতে হবে। পুকুর, নদী ও খাল খনন ও জলাভূমি রক্ষার মাধ্যমে মৎস্য চাষ বৃদ্ধির পাশাপাশি এই পানি হবে সেচের প্রধান উৎস। সাধারণ সম্পদে (খাল, বিল, নদী, বন) সাধারণ জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে।
বাংলাদেশে সর্বমোট কৃষি জমির পরিমাণ ৮২.১০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলী জমির পরিমাণ ২৮.৭৩ লাখ হেক্টর, দুই ফসলী জমির পরিমাণ ৪১.৩০ লাখ হেক্টর এবং তিন ফসলী জমির পরিমাণ মাত্র ১০.২৭ লাখ হেক্টর। সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বল্প মেয়াদী এবং খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করে সব কৃষি ভূমিই তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ৪টি ফসল উৎপাদনও কঠিন নয়। বাড়তি জনগণের খাবার সংস্থান করেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও ধরে রাখা এবং শস্যের মূল্য সহনশীল মাত্রায় রেখেও কৃষিকে লাভজনক করার জন্য বছরে কমপক্ষে ৩টি ফসল উৎপাদন সম্ভব করে তুলতে হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের কৃষককে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব কৃষিতে বিশাল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। তাই আমাদেরও ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। কৃষি পণ্যের মূল্য সহনশীল মাত্রায় রাখার জন্য কৃষি উপকরণ তথা সার, বীজ, ডিজেল বা সেচ প্রযুক্তিতে বড় ধরনের ভর্তুকি দিতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে সহজে উৎপাদিত ফসল মুনাফা সহযোগে বিক্রি করতে পারে, সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি পণ্য ক্রয় করতে হবে। ভর্তুকি যেন সরাসরি কৃষকের ঘরে যায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এমত নীতি সকল কৃষি পণ্যের জন্য প্রযোজ্য হবে।
টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করতে কৃষিকে হতে হবে জলবায়ু ও পরিবেশ বান্ধব। বাংলাদেশের জলবায়ুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল বর্ষাকালে উজান থেকে আসা বরফগলা ও বৃষ্টির পানি এবং দেশের অভ্যন্তরের বৃষ্টির পানি দেশের সমভূমির দুইতৃতীয়াংশকে পানিতে তলিয়ে দেয়। আবার শীতকালে বৃষ্টি হয় না বলে নদীর প্রবাহ কমে যায়, খাল-বিল শুকিয়ে যায়। বর্ষার পলিবাহিত পানি জমির উর্বরতা বাড়ায় এবং অসংখ্য প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছের বিচরণ ও লালন-পালনের বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমি সৃষ্টি করে। অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তাঘাট, ডাইক-ড্যাম নির্মাণ এবং সেচ প্রকল্পসমূহ বর্ষার পানির স্বাভাবিক অপসারণ ব্যাহত করছে। ব্যাহত করছে মাছের চলাচল ও লালন-বিচরণ। এ অবস্থা একদিকে বন্যার প্রকোপ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে যা প্রকারান্তরে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। সেচে ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে যা আগামীতে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা সৃষ্টি করছে। তাই জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী-খালগুলোকে নাব্য রাখতে হবে এবং নদী ও বিল-ঝিলের গভীরতা বাড়িয়ে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে যেন শীতকালে সেচে ব্যবহার করা যায়। বিল-ডোবা শুকিয়ে শস্যভূমি বাড়ানো যাবে না। আবার কীটনাশক ব্যবহার করে বিল-নদীর পানি দূষিত করে মাছসহ জলজ প্রাণী ধ্বংস করা যাবে না।
কৃষি সমস্যার সমাধানে এবং কৃষকের দাবী আদায়ে কার্যকর কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কৃষক হলো বাংলাদেশের জনগণের সবচেয়ে অসংগঠিত অংশ। নামধারী কৃষক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে কৃষকদের মধ্যে দলীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এভাবে অকৃষক বা কৃষক স্বার্থবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠন, বিশেষত স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো কৃষকের সমস্যা সমাধানের কথা বলে তাদের দলীয় শক্তিবৃদ্ধি করে, ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যায় এবং কৃষি ও কৃষককে উপেক্ষা করে। স্বাধীনতা-পূর্ব কালের মতোই পরবর্তী কালেও এ অবস্থার হেরফের হয়নি। তাই রাজনৈতিক দল ও সরকারকে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য সর্বপ্রথম কৃষকের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন। একমাত্র শক্তিশালী কৃষক সংগঠনের পক্ষেই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষায় এবং কৃষি সংস্কারে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব, এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষায় ঔপেনিবেশিক ধারাবাহিকতার বিদ্যমান স্থানীয়শাসনের স্থলে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন স্থানীয় সরকারের কাছে এবং স্থানীয় সরকার জনগণের নিকট জবাবদিহিতে বাধ্য থাকবে। স্থানীয় সরকারের কাছে স্থানীয় জনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় করারোপ ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। স্থানীয় বিরোধ মীমাংসার আইনী ও বিচারিক দায়িত্বও স্থানীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম মূল্য (পণ্যের উৎপাদন খরচ +মুনাফা) নির্ধারণ ও স্হানীয় বাজারে ন্যূনতম মুল্যে স্হানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় তদারকির ব্যবস্হাসহ স্থানীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্য রক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনের আইনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোটা দাগে বলা যায়, বিশেষত কৃষি থেকে বিশ্বমানের উৎপাদনশীলতা অর্জন করতে হলেঃ ১. উন্নত ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। ২. সকল প্রকারের কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের অনুকূল কৃষিনীতি প্রণয়ন করতে হবে। ৩. প্রকৃত কৃষক বা কৃষি উৎপাদক হবে কৃষি জমির মালিক, নিদেনপক্ষে কৃষি জমির ব্যবহারের নিয়ন্ত্রক। ৪. বৃহৎ উৎপাদনে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করতে হবে। যেমন জমির ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হওয়া এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। যৌথ খামার পদ্ধতি প্রচলনের মাধ্যমে এ বাধা দূর করা সম্ভব। ৫. কৃষক তথা কৃষি উৎপাদকের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ৬. আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান ও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বর্তমানে ধানের বাজার দর কম থাকায় কৃষকের লোকসান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কম থাকায় পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ার পরও চাল আমদানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ধানের বাজার দর কৃষকের অনুকূলে রাখতে অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে অধিক আমদানি শুল্ক আরোপ করতে হবে। ৭. সর্বোপরি, কৃষি উন্নয়ন দর্শনে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। উন্নয়নকে নিছক প্রবৃদ্ধি দিয়ে পরিমাপ করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে কৃষকের উন্নতি এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখা ও পরিবেশের ক্ষতি না করা হবে কৃষিনীতির দর্শন।