খাবারে কেমিক্যালস মেশানো খুবই জঘন্য অপরাধ। এর মধ্যে কোনটা নিরাপদ, কোনটা নিরাপদ নয় সেটা বিচার করার চেয়ে খাবারে যদি কোন কেমিক্যালসই মেশানো না হয় তাহলে সেটা অবশ্যই উত্তম। কারন কোন কেমিক্যালসই নিরাপদ নয়, আজকে যা নিরাপদ, অক্ষতিকর মনে হচ্ছে, কালকে হয়ত জানা যাবে সেটা খুবই জঘন্য, ক্যান্সার উৎপাদনকারী, কিডনী, লিভার নষ্ট করে দেয়। যেমন, বেনজিন এবং ডাইক্লোরোমেথেনের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে কেমিস্টরা পানির মত এ দুটি কেমিক্যালস ব্যবহার করত,পরে জানা গেল এরা শরীরে ক্যান্সারের জন্ম দেয়, সেজন্য এখন এ দুটি দ্রাবক ব্যবহারে সবাই অনেক সচেতন। তাই দেখতে, শুনতে যত ‘বিনাইন’ শোনা যাক না কেন, কেমিক্যালসের সাথে আমাদের সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। কিছু ক্ষেত্রে ভয় মিশ্রিত বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। একজন কেমিস্ট তাই তার কাজের সময় পরিস্থিতি বুঝে গ্লাভস, ল্যাব কোট, গগলস, রেসপিরেটর, গ্লাস শিল্ড, সীসার জ্যাকেট ইত্যাদি নানা ধরণের ‘পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ (পিপিই) নিয়ে এ দূরত্ব বজায় রাখে।
আমেরিকাতে এক সময় পরিবেশের উপর রাসায়নিক বস্তুর ক্ষতি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রামের ফলে এনভাইরনমেন্টাল প্রটেকটিভ এজেন্সি (ইপিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে বর্তমানে বাজারজাত করা যেকোন কেমিক্যালসের জন্য একটা সেইফটি ডাটা শিট ( এসডিএস) পাওয়া যায়। এতে ঐ কেমিক্যালসের ক্ষতিকর প্রভাব,স্টোরেজ,নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে বলা থাকে। যেকোন নতুন কেমিক্যালস ব্যবহারের আগে সবার উচিত সে কেমিক্যালসের ব্যাপারে যতদূর পারা যায় সেটা জানার চেষ্টা করা। এসব ডাটাশীটে অনেক সময় মানুষের উপর কি প্রভাব ফেলবে সেটা বলা থাকে না,কারন ড্রাগস ক্যান্ডিডেট না হলে মানুষের উপরে তাদের পরীক্ষা হয় না। ফলে নতুন কেমিক্যালসের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী, তার পরিবেশ এবং ইকোসিস্টেমে এর প্রভাব কেমন হবে সেটাও জানা যায় না। তাই মাঝে মধ্যেই যেমন এফডিএ বাজার থেকে ঔষধ তুলে নেয় তেমনি ক্ষতিকর কেমিক্যালসও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া দাগী আসামীদের ‘ডার্টি ডজেন’ নামে চিহ্নিত করা আছে। তাই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারকারীকে নিজে থেকে সচেতন থাকার কোন বিকল্প নেই। আপাত বিনাইন কেমিক্যালসও দীর্ঘ সময়ের স্বল্পমাত্রার এক্সপোজারের কারণে শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
আজকাল নিত্য-ব্যবহার্য্য জিনিস-পত্রে, প্রক্রিয়াজাত খাবারে নানান কেমিক্যালস, প্রিজারভ্যাটিভস ইত্যাদি মেশানো হয়। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বলবে এগুলো ‘জিরো ফ্যাট’,’জিরো ক্যালরি’,’জিরো শুগার’, কোন ক্ষতি নেই। সেটা হয়ত ঠিক, কিন্তু স্বাদ এবং মান বজায় রাখতে যেসব কেমিক্যালস দেয়া হচ্ছে সেগুলোকে কিন্তু আমাদের শরীরের মেটাবলিক সিস্টেমের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়। শরীরের জন্য অপরিচিত এসব কেমিক্যালসের রেচন প্রক্রিয়ায় ঠিকই লিভার,কিডনীর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তাই অনেক সময় বলা হয়, ডায়েট, জিরো ক্যালরি কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করলে তাতে রেগুলার কোল্ড ড্রিংকস এর চেয়ে বেশি ক্ষতি। বর্তমানে রেগুলার কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া সারা দুনিয়ায় একটা ফ্যাশনের বিষয়, ‘কোকাকোলা কালচার’এর বিষফল। একটা কোল্ড ড্রিংকসে যে পরিমান চিনি থাকে সেটা একজন মানুষের প্রায় একবেলা খাবারের শর্করার মোট বরাদ্দের সমান। তাই ভারী তৈলাক্ত খাবারের পরে কোল্ড ড্রিংক্স পান করলে যতই তৃপ্তি লাগুক, সেটা আসলে বিষপানের সমতুল্য, যেটা সিস্টেমের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ ফেলে। সারা বিশ্বে ‘অবিসিটি’ বাড়ার জন্য এ চিনির নেশা অনেকাংশে দায়ী।
বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো সরাসরি খাবারে ‘নন ফুড গ্রেইড’ কেমিক্যালস মেশানো হয় যেটা খুবই জঘন্য কাজ, মানবতা বিরোধী অপরাধ,এতে নীতি নৈতিকতার কোন চিহ্ন বাকি থাকে না। এটা মানুষকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলার সমতুল্য। বাংলাদেশে খাবারে যেসব রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয় তার একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ
ক্যালসিয়াম কার্বাইডঃ ফল পাকানোর জন্য এটি অহরহ ব্যবহার করা হয়। ক্যালসিয়ামকার্বাইড থেকে স্বল্পমাত্রায় ইথিলিন গ্যাস তৈরি হয় যা ফল পাকাতে সাহায্য করে। কম মাত্রায় ইথিলিন গ্যাস ক্ষতিকর নয়, তার উপর উদ্বায়ী হওয়ায় বাতাসের সাথে মিশে যায়, ফলে সরাসরি মানুষের ক্ষতি হয়য় না। কিন্তু এরফলে বাতাসে ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (ভিওসি) এর পরিমান বাড়ে,পরিবেশের ক্ষতি,বাতাস দূষিত হয়। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের মূল ক্ষতিটি আসে এর সাথে ভেজাল হিসেবে থাকা আর্সেনিক এবং ফসফরাস থেকে। যার ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো, ডায়রিয়া, বমি, ভেদবমি, রক্তপাত, বুকে-পেটে ব্যাথা, চামড়া জ্বলা, গিলতে কষ্ট হওয়া,শ্বাস-কষ্ট ইত্যাদি। দীর্ঘদিন ধরে এক্সপোজড হলে পেপ্টিক আলসার।
ইথোফেনঃ এটিও ফলা পাকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এর রাসায়নিক নাম হলো, 2-Chloroethylphosphonic acid। এর থেকেও স্বল্পমাত্রায় ইথিলিন গ্যাস নিঃসৃত হয়, সাথে ফসফরিক এসিড এবং ক্লোরাইড আয়নও তৈরি হয়। ইথোফেনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে মানুষের উপর লং টার্ম কোন গবেষণা হয়নি, তবে পশুদের উপর গবেষণায় তেমন ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি। আমার মতে ইথোফেন কার্বাইডের তুলনায় কম ক্ষতিকর, ভাল করে ধুয়ে নিলে রেসিডুয়াল এসিড এবং ক্লোরাইড দূর হয়ে যাবার কথা।
ফরমালিনঃ বাংলাদেশে খাবারে মেশানো কেমিক্যালসের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য হলো ফরমালিন, এটি দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সার উৎপাদক হিসেবে স্বীকৃত। ফরমালডিহাইডের ৪০ আগ জলীয় দ্রবণ। জীববিদ্যার ল্যাবরেটরিতে স্পেসিমেন সংরক্ষণ করতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। অসাধু ব্যবসায়ী মাছ,মাংস, ফল তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করে যার ফলে মাছ মাংসে সহজে পচন ধরে না। ফরমালডিহাইড খুবই সক্রিয় রাসায়নিক যৌগ, এটি দেহে প্রবেশ করা মাত্র নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অল্প পরিমানে প্রবেশ করলে ব্রংকাইটিস এবং নিউমোনিয়া হবার সম্ভাবনা বেশি। পরিমানে বেশি মৃত্যু। পেটে গেলে গ্যাস্ট্রিক,এছাড়া কিডনী,লিভার সহ শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
নিষিদ্ধ পেস্টিসাইডঃ ফাও এর গবেষণায় বাংলাদেশী খাবারে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাসায়নিক যৌগ যেমন ডিডিটি, এলড্রিন, ক্লোরডেইন এবং হেপ্টাক্লোর ইত্যাদির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। National Food Safety Laboratory (NFSL) এর তথ্যানুযায়ী খাবারে এসব বিষাক্ত কেমিক্যালসের পরিমান ইইউ’র বেঁধে দেয়া লিমিট থেকে ৩ থেকে বিশ গুন বেশি। NFSL এর পরীক্ষায় বাজারের গাজর, সীম, টম্যাটো,লেট্যুস, ক্যাপসিকাম, কলা,আপেল,আনারস এবং আমে এসব ক্ষতিকর নিষিদ্ধ রাসায়নিক পাওয়া গেছে, দুধে পাওয়া গেছে এলড্রিন। শতকরা ৫০ ভাগ শাক-সব্জী এবং ৩৫ ভাগ ফল বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো। এসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরে জমতে থাকলে ক্যান্সার, প্রজননে সমস্যা এবং আরো অনেক প্রাণঘাতী রোগের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
কেমিক্যালস রঙঃ বাংলাদেশে আরেকটা ভয়াবহ ব্যাপার হল অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবার উজ্জ্বল, চকচকে, তাজা বানানোর জন্য এতে রাসায়নিক রঙ মেশায়। এসব রঙে থাকা ভারী ধাতু যেমন সীসা,ক্রোমিয়াম এবং আর্সেনিক শরীরে ক্যান্সার উৎপাদন করে, কিডনী এবং লিভার ড্যামেজ করে, বাচ্চাদের বৃদ্ধিতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় । এনএফএস এল ল্যাবে চাল, হলুদ, মাংস এবং জ্যুস পরীক্ষা করে তাতে এসব ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। হলুদে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের লেড ক্রোমেট পাওয়া গেছে যেটি কারসিনোজেনিক বা ক্যান্সার উৎপাদক। লেড ক্রোমেট এ ক্রোমিয়ামের যোজনী ৬, এবং দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানি ক্রোমিয়াম( ৬) মানুষের শরীরে ক্যান্সার উৎপাদনের জন্য দায়ী। এ নিয়ে হলিউডের একটি বিখ্যাত মুভি আছে, ‘এরিন ব্রকোভিচ’,যাতে নায়িকা জুলিয়া রবার্টস অভিনয় করেন। এছাড়া খাবারের লাল এবং নীল রঙের জন্য যেসব কেমিক্যালস ব্যবহার করাহয় সেগুলোতেও ভারী ধাতু থাকায় সমানভাবে ক্ষতিকর।
এন্টি বায়োটিক এবং গ্রোথ হরমোনঃ মাংসে যদি কোন পেস্টিসাইড বা ফরমালিন নাও থাকে তারপরেও বাজারের মাংস ক্ষতিকর কারন ফার্মের পশু-পাখীদের রোগ-বালাই থেকে মুক্ত রাখতে এবং তাড়া তাড়ি বেড়ে ওঠার জন্য তাদের নানান এন্টিবায়োটিক এবং গ্রোথ হরমোন দেয়া হয়। তাদের স্বল্পস্থায়ী জীবনে এসব কেমিক্যালস শরীর থেকে পুরোপুরি নিষ্ক্রান্ত হয়য় না, বা মেটাবোলাইট থেকে যায়। সেখান থেকে এসব এন্টিবায়োটিক যায় মানুষের শরীরে, আজকাল ঢাকা শহরে যে ‘সুপারবাগ’ এর কথা শোনা যাচ্ছে যাকে কোন এন্টিবায়োটিক কব্জা করতে পারছে না নির্বিচারে এন্টিবায়োটিক সেবন এবং পশু-পাখিদের উপর প্রয়োগ তার একটা কারন হতে পারে। আমেরিকাতে গরীব মানুষ বেশি মোটা, কারন তারা সস্তায় ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসিতে এসব পেস্টিসাইড আর হরমোন দেয়া চিকেন ফ্রাই আর বিফ বার্গার খায়। বাংলাদেশে যেহেতু উচ্চ-মধ্যবিত্ত এসব খাচ্ছে তাই তাদের মধ্যে ওবিসিটি বাড়ছে, খাবারের ব্যাপারে সচেতন না হলে ধীরে ধীরে সেটা সবাইকে ধরবে। চাইল্ডহুড ওবিসিটির সাথে ব্যায়াম না করা, কাজ না করার কোন সম্পর্ক নেই,সস্তা খাবারই এতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
মেলামাইনঃ কয়েক বছর আগে আরেকটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটেছে শিশুখাদ্য গুঁড়াদুধে মেলামাইন এর ব্যবহার। মেলামাইন একটি নাইট্রোজেন যুক্ত জৈব যৌগ, এটি প্লাস্টিক, রঙ,সার এবং কাপড় তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মেলামাইনের বর্ণ শাদা হওয়ায় একে সহজেই গুড়া দুধের সাথে মিশিয়ে দুধ বলে চালিয়ে দেয়া যায়, এর ফলে দুধের পরীক্ষায় প্রোটিনের পরিমান বেশি দেখায়। গবেষকেরা এখনো এ নিয়ে বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বর্তমানে খাবারে মেলামাইন সনাক্ত করার জন্য নানা ধরনের ‘কিট’ বের হয়েছে। শরীরে বেশি পরিমানে মেলামাইন প্রবেশ করলে কিডনীতে পাথর তৈরি হয়,কিডনীর ব্যথা, মুত্রথলীর সংক্রমন ও প্রদাহ হতে পারে।
বাংলাদেশে খাবারে এর বাইরে আরো নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। পত্র-পত্রিকায় যেগুলোর নাম আসে সেগুলোর কথা আমরা জানি। বর্তমানে বাঁচতে হলে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। খাবারের মত বিষয়ের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারের এমন ব্যর্থতা দুখঃজনক। এমন দেশ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মানুষ জেনে বুঝে খাবারে বিষ মেশায় আর মানুষ বাজার থেকে সে বিষ পয়সা খরচ করে কিনে আনে। সময় থাকতে মনা হুঁশিয়ার ।