০
১৪৩৭ বার পঠিত
আশা ও হতাশা, ভুল থেকে শেখাঃ জিয়া এবং এরশাদের শাসনে বাংলাদেশ, ১৯৭৫-১৯৯০
Trial and Error, Hope and Despair: Bangladesh Under Zia and Ershad, 1975–1990
শেখ মুজিবের সময়ে বাংলাদেশ ছিল দূর্নীতিগ্রস্ত, দারিদ্র্য ও বিশৃঙ্খল একটি দেশ, বিদেশীদের ভাষায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। মুজিব পরবর্তী সময়ে গত ৫০ বছরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অনেক উত্থান-পতন দেখা যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল দুজন সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের শাসনামল।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল আন্তর্জাতিকভাবে দরিদ্র্য একটি দেশ কিন্তু আশির দশকের শুরুতে এসে বাংলাদেশে পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে। তখন বাংলাদেশকে আর কেউ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলতে পারেনি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের শাসন বাংলাদেশকে শেখ মুজিবের বাংলাদেশী সমাজতন্ত্রের নামে পরিচালিত দূর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ একনায়কতন্ত্র থেকে সরিয়ে আনে। জিয়ার সময়ে মুজিবের সময়ের তুলনায় দেশে দূর্নীতি কমে এসেছিল, প্রশাসনেও কর্মদক্ষতা বেড়েছিল।
সমাজতন্ত্রের নামে মুজিব বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন, জিয়া সেগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে বাজার অর্থনীতি চালু করেন এবং কৃষি ও শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আনেন।
জিয়া অনেকগুলো নতুন উদ্ভাবনী প্রকল্প চালু করেন যেমন, ‘অধিক খাদ্য ফলাও’, দেশে পোশাক শিল্পের প্রতিষ্ঠা করেন, এবং কয়েক লক্ষ অদক্ষ শ্রমিককে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এক কথায় বলা যায়, তিনি বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে একটা টেকসই অবস্থানে উন্নীত করেন।
১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে আবারো শাসন ব্যবস্থার অধঃপতন ঘটে। দীর্ঘ নয় বছর পরে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগ পর্যন্ত তাঁর শাসনামল ছিল দূর্নীতিগ্রস্ত। তবে তার স্বৈরশাসন সত্ত্বেও তিনি জিয়ার পদাংক অনুসরণ করে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শস্তায় শ্রমিক রপ্তানীর ধারা বজায় রাখেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হবার পর থেকে বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থা বুঝতে হলে জিয়া ও এরশাদের ১৫ বছরের শাসনামলকে বুঝতে হবে। এদের শাসনামলের তুলনামূলক আলোচনা করলে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ‘গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন’ না ‘ গণতন্ত্রই উন্নয়ন’ এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
জিয়াউর রহমান মুজিবের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে আনেন যাকে মুজিব ও তার ‘সম্মানিত’ অর্থনীতিবিদরা সমাজতন্ত্র বলে বিক্রি করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে কিসিঞ্জারের দেয়া তলাবিহীন ঝুড়ি হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গ্রাম্য সালিশী ব্যবস্থা, দলীয়করণ, বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে বৈরিতা, ষড়যন্ত্র, পারস্পরিক ঘৃণা, ঈর্ষা এসব আবারো স্থান করে নেয়।
“পারিবারিক গণতন্ত্র” ও দুই ‘বেগমের লড়াই,’ ১৯৯১-২০২১
“Dynastic Democracy” Under the “Battling Begums,” 1991–2021
ইকনোমিস্ট পত্রিকা অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতবান দুজন নারী প্রধানমন্ত্রীকে বর্ণনা করার জন্য ‘দুই বেগমের লড়াই’, “Battling Begums” হিসেবে অভিহিত করে আসছিল। কারণ তারা দুজনেই পারিবারিক সূত্রে ক্ষমতার দাবীদার, আগেকার যুগে রাজা-বাদশার মৃত্যুর পরে তাদের বেগমেরা যেমন ক্ষমতার জন্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো, এদের মধ্যেও সেরকম প্রবণতা দেখা যায়। তারা একে অপরকে মোটেই সহ্য করতে পারেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের পারস্পরিক ঘৃণার যে প্রতিফলন দেখা যায় সেটাও ‘দুই বেগমের লড়াই’ কথাটায় ফুটে ওঠে।
১৯৯১ সাল থেকে খালেদা এবং হাসিনা একটা স্বল্প-গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। এক দিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের কালচার পারিবারিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়। ক্ষমতা, রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গ বিবেচনা করলে মুজিব ও জিয়ার পারিবারিক ডাইনেস্টি নেহেরু, বন্দরনায়েক বা ভুট্টোর পরিবার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
স্বৈরশাসক, একনায়কতন্ত্র, পারিবারিক রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের অভাবে (free of the hangover of autocracy and “dynastic” oligarchy) মুজিব আর জিয়া পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে থাকবে। অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক। ক্ষমতার জন্য ‘কুকুরের মাংস কুকুরে খাওয়া’র মত চরম পরিবেশে বাংলাদেশ যেন দুই বেগমের লড়াইয়ের চিরস্থায়ী ময়দানে পরিণত হয়েছে।
খালেদা ও হাসিনা দুজনেরই প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে। দুজনের কেউই উচ্চ শিক্ষিত বা দক্ষ প্রশাসক নন। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা জাতীয় নেতা বনে গেছেন। খালেদা তার স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধিত্ব করেন, অপরদিকে হাসিনা তার বাবা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উত্তরাধিকার পেয়েছেন। তাদের দুজনের অনেক গোপন দূর্নীতি, অদ্ভূত স্বভাব ও অদক্ষতা আছে।
হাসিনা ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম সরিয়ে দেশ থেকে জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলতে চাচ্ছেন। তিনি জিয়াকে ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে কবর দেয়া হয়নি এমন মিথ্যা কাহিনী প্রচার করে রাজধানী থেকে জিয়ার কবর সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন (“BNP knows Zia’s body not at Chandrima Udyan: PM”, New Age, Aug 26, 2021.)। মুজিব ডাইনেস্টিকে বিলীণ বা ভুলে যাবার হাত থেকে বাঁচাতে তিনি এসব কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে তিনি তাঁর সন্তান এবং মৃত ভাইয়ের নামে স্মারক ডাক টিকেট চালু করেন। এগুলো করে তিনি তাদের পারিবারিক রাজনীতিকে চিরস্থায়ী রূপ দেয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
খালেদা সরকারের দুই টার্মে যেটুকু গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার চর্চা ছিল, হাসিনার সময়ে তার ছিঁটেফোঁটাও আর নেই। ২০১৪ সাল থেকে হাসিনা একদলীয় একনায়কতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন, এই সময়টা দূর্নীতি এবং বিরোধীদের দমন-নিপীড়নের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। গত কয়েক বছর যাবত এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সীমানামুক্ত সাংবাদিকদের সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো হাসিনা সরকারকে স্বৈরাচার, দূর্নীতি পরায়ণ, নৃশংস হিসেবে বর্ণনা করেছে।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের রিপোর্টে প্রকাশ করেছে ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ৬০০’র বেশি মানুষ গুম হয়েছেন। হাসিনার দুঃশাসন এবং নৃশংসতার কাছে এরশাদের দূর্নীতিগ্রস্থ সিভিল-মিলিটারি শাসনকে অনেক সদাশয়, মৃদু, সভ্য ও দক্ষ মনে হবে। সহজে এই উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি আসবে না।
লেখাটি অধ্যাপক তাজ হাশমির লেখা ‘Fifty Years of Bangladesh, 1971-2021: Crises of Culture, Development, Governance, and Identity‘ বইয়ের দুটি অধ্যায়ের সারাংশের অনুবাদ।
প্রথম পর্ব বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর, ১৯৭১-২০২১ঃ অধ্যাপক তাজ হাশমি
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন