গত কয়েক বছর অনেকেই আমাকে বলেছেন, “আপনি ভাই দেশে থাকেন না, জানেন না দেশে কি পরিমাণ উন্নয়ন হইছে”। এবার যখন দেশ থেকে ঘুরে এলাম তখন সবাইকে স্বচক্ষে, সরেজমিনে দেখা “উন্নয়ন” এর ফিরিস্তি জানানোর একটা তাগিদ বোধ করছি। গত দশ-পনের বছরে দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজ-ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে যে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে এর মত বড় ক্ষতি বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে হয়নি। মাঝে-মধ্যে তাই মনে হয়, ‘বিকল্প নাই’ ভাবা বাংলাদেশী মানুষেরা এটা ডিজার্ভ করে।
প্রথমেই বলে নেই, একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে আর যাই হোক উন্নয়ন হয় না। দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অপোগন্ড, অর্বাচীন ‘সহমত ভাই’ বানানো ছাড়া এর আর কোন উপযোগিতা নাই। গত দশ বছরে দেশের এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণার মাধ্যমে মেধার বিকাশের বদলে ছাত্র-ছাত্রীরা লাইব্রেরিতে বিসিএস গাইড মুখস্থ করে ‘সহমত ভাই’ দের খেদমত করার চেষ্টায় নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। ‘সারভাইভাল অফ দ্য সহমত ভাই’। প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার কারিকুলাম যেটুকু আছে সেটাও সমসাময়িক দলবাজ আজেবাজে লেখকের রচনা, ডানপন্থী ক্ষমতার দোসরদের দ্বারা এডিটিং করা। ফলে কার্যত সাধারণ শিক্ষার নামে বাংলা মিডিয়াম মাদ্রাসা চলতেছে।
শিক্ষা তো গেল, গবেষণায়ও ‘উন্নয়ন’ এর কোন লক্ষণ নেই। বাংলাদেশে গবেষণা কাজকে নিরুৎসাহিত করার অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জনস্বার্থে গবেষণা ( গুঁড়ো দুধে সীসা) করে মন্ত্রণালয়ের কোপানলে পড়েছিলেন। হালের গণস্বাস্থ্যের করোনা কিট নিয়ে টানাহ্যাঁচড়াতেও সেটা ভালভাবে ফুটে উঠেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কিছু করবে না, কেউ করলে সবাই মিলে তার মুখ বন্ধ করতে চাইবে। বিজ্ঞান, মানবিক যে কোন গবেষণায় আশে-পাশের যেকোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক খারাপ। বাংলাদেশে জেনারেটেড ডাটা নিয়েও অনেকের সন্দেহ আছে। জিডিপি বেশি দেখানোর জন্যে একই ডাটা বারবার ব্যবহার করা হয়েছে এমন জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। মান-সম্মান বলতে তাদের আর কিছু বাকি নেই, নেতা/ আমলাদের দ্বারস্থ হতে পারলে তারা নিজেদের ধন্য মনে করেন। আমলাদের তুলনায় বেতন কম কেন এ নিয়ে অভিযোগ তুলে তারা অপমানিত হন। কলেজের শিক্ষক কর্মস্থলে রাজনৈতিক কর্মী ছাত্রদের হাতে, ভিন্ন ক্যাডারের সহকর্মীর হাতে নাস্তানবুদ হচ্ছেন।
শিক্ষিত হয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় তরুণ সমাজ সবাই ধুমায়ে বিসিএস পড়ছে। দেশ যদি উন্নয়নই হয়ে থাকবে তাহলে সবাই সরকারি চাকরির জন্যে এমন দেউলিয়া হত না। পনের বছর আগেও তো বিসিএস নিয়ে এমন ছিল না। যদি দেশের উন্নয়ন হতো তাহলে বেসরকারি কর্মসংস্থান বাড়ত। সবাইকে ব্যাংক, বীমা বা সরকারি আপিসের কাজ নিতে হত না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে লাইন দিয়ে লাইব্রেরীতে গিয়ে বিসিএস গাইড পড়ে। বিসিএস এর ফলাফল বের হলে জাতীয় পত্রিকায় হাস্যকর সব প্রতিবেদন বের হয় কে কীভাবে বিসিএস পরীক্ষার উত্তীর্ণ হলো।
বিদেশে দেড় কোটি শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করে তাদের পারিশ্রমিকের সবটুকু দেশে পাঠায়। দেশে অবকাঠামোগত যেটুকু সংস্কার হচ্ছে সেটা এদেরই অবদান। আর দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থা বলার মত নয়। কারখানার মালিক মনে করে সে তাদের পালনকর্তা, একবার শত মাইল হাঁটিয়ে তাদের ঢাকায় আনে আবার চলে যেতে বলে, এদিকে বেতন দিতে চায় না । অবশ্য দেশের আমলা-মুতসুদ্দি সবাই মনে করে তারা দেশটা চালায়, মানুষকে খাওয়ায়, পালন করে। ‘ট্রিকল ডাউন’ পদ্ধতিতে এটা উপর থেকে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। দেশের যেকোন সরকারি চালের বস্তা থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষার বই দেখলেই বুঝতে পারা যাবে। সবার মাঝে এখন “I my me mine ” সিন্ড্রম।
শিক্ষার পরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে কি হাল সেটা করোনা এসে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। পুরো স্বাস্থ্যখাতকে একেবারে ন্যাংটো করে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয় ফলে তারা আজেবাজে বকে যাচ্ছে। হাসপাতালের বালিশ, পর্দা কেনার জন্য অপচয়ের জন্য টাকা আছে কিন্তু দরকারি মেশিন কেনার টাকা নেই, সেসব মেইনট্যানেন্সের টাকা নেই। দেশের জনগণের টাকা-পয়সা যারা হ্যান্ডেল করেন তারা হলেন দেশের ‘ভিআইপি’, তারা দেশে চিকিৎসা নেন না। হাঁচি-কাশি হলেও সেটার জন্য তারা বিদেশে যান, তাই দেশে স্বাস্থ্যখাত গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমনে বিদেশে যাবার পরিস্থিতি না থাকায় ‘ভিআইপি’দের জন্য হাসপাতাল তৈরির তৎপরতা থেকে তাদের উদ্দেশ্য ভালভাবে বুঝা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারদের নেতৃত্ব নাই, একই কথা অন্যান্য সব বিশেষায়িত খাতের বেলায় বলা যায়। সব জায়গায় আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য। আমলাদের দরকার নেই সেটা নয় কিন্তু কিছু জায়গায় পরিচালনার জন্য বিশেষায়িত শিক্ষার চেয়ে সর্বকর্ম বিশারদ ম্যানেজার আমলা অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর। ফলে সর্বত্র বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা।
এরপরে আসা যাক প্রতিষ্ঠানের কথায়। দেশে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেই। সবাই সিদ্ধান্তের জন্য সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এর বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলোকে ধ্বংস করে অথর্ব করে দেয়া হয়েছে। জনমনে ঐসব প্রতিষ্ঠানের জন্য এখন কেবল ঘৃণা বিরাজ করতেছে। কিছুদিন আগে দূর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা মারা যাবার পরে দেখা গেল মানুষ লোকটাকে না চিনে কেবল দূর্নীতি দমন কমিশনে কাজ করত এজন্য খারাপ কথা বলতেছে। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে মানুষ সদ্য মৃত মানুষের খারাপ কর্মের কথা বলে না, সেখানে এমন প্রতিক্রিয়া দেখে আমি একটু তাজ্জব হয়েছিলা্ম। অথচ ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি ভাল মানুষ ছিলেন বলে জানা যায়। একই অবস্থা নির্বাচন কমিশনের, একটা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এখন সবার হাসির পাত্র। নির্বাচন হলে ভোটার আসবে কিনা এটা নিয়ে কমিশনের কর্তারা চিন্তিত। তারা দেশের মানুষের আস্থা হারিয়েছেন।
ভারতে দূর্নীতি দমন কমিশন চাইলে রানিং যেকোন মন্ত্রীকে কোমরে দড়ি দিয়ে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে কি সেটা সম্ভব? মন্ত্রী তো দূরের কথা এখন সরকারি চাকরিজীবীও ইনডেমনিটি ভোগ করতেছেন। অনুমতি না নিয়ে কাউকে এরেস্ট করা যাবে না। অবশ্য এটা আমলারা ডিজার্ভ করেন। কারণ ‘লাইলাতুল ইলেকশন’ করা নিয়ে আমলাদের মধ্য থেকে কাউকে পদত্যাগ করতে শোনা যায়নি, এতবড় একটা ঘটনার দায়িত্ব ‘বিচিলেস’ কর্মকর্তাদের কেউ নেয়নি। এ প্রসঙ্গে বলা যায় মুসলিম মেজরিটি দেশে ‘লাইলাতুল ইলেকশান’ শব্দটা ভালই দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। আমি প্রথম যখন এ শব্দবন্ধ দেখি তখন বেদম হেসেছিলাম। টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমলাদের আপাতত সন্তুষ্ট করা গেছে। তারা হয়ত ভাবছেন আমরাই এখন দেশ চালাচ্ছি, আমরাই এদের নির্বাচিত করে এনেছি। মন্ত্রী-এমপি, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর এদের কারোরই আর বেইল নাই। দেখতেই পাচ্ছেন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় জেলার দায়িত্ব আমলারাই পেয়েছেন। মন্ত্রী- এমপি, গ্রাসরুটের ‘চালচোর’ জনপ্রতিনিধি এরা বাংলাদেশে একে একে আরো অনেক বেইল নাই হয়ে যাওয়া গ্রুপের নতুন সংযোজন। বিএনপির মেজর জিয়া নাকি বলেছিলেন,
“আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকালট ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স।”
আর এখন দেখা যাচ্ছে,পলিটিক্স ইজ ইনভ্যালিড ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স। ব্যবসায়ী, আমলা এরাই এখন পলিটিক্স করবে।
দেশে দূষণ থামানোর কোন ব্যবস্থা নেই। গ্রামে-গঞ্জে যত্রতত্র ইটের ভাটা, পুরো দেশের বাতাস দূষিত। বাতাসে ক্ষতিকর মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি। ঢাকা শহরে করোনার আগে থেকেই মানুষ মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াত। বর্ষাকাল না থাকলে বাংলাদেশে মানুষ থাকতে পারত না। ঢাকায় কোন কারণে রাস্তায় বের হলে বাসায় ফিরে মাস্ট গোসল করতে হবে। উবার ছাড়া অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করলে প্রতিদিন একমুঠো ক্ষতিকর ফাইন পার্টিকেল, ধূলাবালি, গাড়ীর ধোঁয়া গিলতে হয়। জীবিকা অর্জনের জন্য যাদের সারাক্ষণ রাস্তায় থাকতে হয় তাদের ভবিষ্যত খুবই খারাপ। এরমধ্যে ‘উন্নয়ন’ এর নামে রূপপুর, রামপাল, ইত্যাদি পরিবেশ বিনষ্টকারী প্রকল্প চলছে।
বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে, মানুষ নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে নিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিরুদ্ধমত দমন, ৫৭ ধারা, ‘কারোই কোন বেইল নেই’, টেকনোলজি ইত্যাদি নানা কন্ডিশানের কারণে সমাজে একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নিজস্ব মতামত দিতে মানুষ এখন অনেক সাবধান, ভয়ে থাকে, নিজেকে সেন্সর করে নেয়। অকপট মতামত প্রকাশ একরকম হারিয়ে গেছে। বইমেলার সময় দেশে ছিলাম তখন দেখলাম আরেক খেলা। দলীয়, রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক পরিচয়ে ছাইপাশ ছাপা হচ্ছে আর মানুষ সেসব বই কিনে ছবি তুলে পোস্ট দিয়ে ‘সহমত ভাই’ সাজতেছে। দেশে এখন অনেক মিডিয়া, অনেক চ্যানেল, কিন্তু সবাই তোষামোদীতে ব্যস্ত, রাজা যে ন্যাংটা এটা বলার সাহস কারো নেই। কে যেন বলল, ‘দেশে এখন ২৬ টি বিটিভি’ আছে। এর মাঝে একটা শ্রেণি ক্যাসিনো অর্থনীতি, এসকর্ট সার্ভিস (পাপিয়া), ভোগ-বিলাস, মৌজ-মাস্তি নিয়ে বেশ আছে।
সবকিছু খারাপ এটা তো বলা যাবে না। তাই শুধু আপাতত দেশের ‘মানুষ খারাপ’ এটাতেই অনেকে সান্ত্বনা খুঁজছেন। বাকি সবাই খারাপ, কিন্তু ‘ওনাকে ভুল বুঝানো হয়েছে’ তাই যত সমস্যা। ওনার কাছে সঠিক তথ্য গেলে খুব দ্রুত দেখবেন সবকিছুর সমাধান হয়ে গেছে। মানুষ যদি এতই খারাপ হয় তাহলে আপনি মানুষের খেদমত করা ছেড়ে দিন। লিটারেলি বলা যায় আপনাদেরকে তো কেউ ডেকে এনে কোন দায়িত্বে বসায়নি। জনগণ যখন খারাপ তখন জনগণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখছেন কেন? জনগণ আপনার মহানুভবতা জানতে চায় না। এবারে দেশের ভাল কিছু বলা যাক-
- চড়া দামে কেনা, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ থাকে সারাক্ষণ, এটা একটা পরিবর্তন।
- বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামে করা হাইওয়ে সিস্টেম আগের চেয়ে ভাল।
- মেগা প্রজেক্ট, মেগা দূর্নীতি, যত দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প ততো ভাল, বছর বছর টাকা হাতিয়ে নেয়া যাবে।
- বাংলাদেশে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর নতুন দিগন্ত, কনস্ট্রাকশানে বাঁশের ব্যবহার, রেলওয়ের স্লিপারে বাঁশ এগুলো বংশদণ্ডের জীবনে, গ্রাসিফেরি গোত্রের জন্য একটা গ্রাউন্ডব্রেকিং অর্জন।
- গার্মেন্ট শিল্পের সাপোর্টিং ইন্ডাস্ট্রি, ব্যাংক এসব সুবিধার সাথে মানুষ কম পয়সায় ফ্যাশন করতে পারতেছে। দুনিয়ার ‘সেলাই দিদিমনি’ বাংলাদেশের বাসিন্দা হবার এটা একটা বড় বেনেফিট।
- অনন্ত জলিল, হিরো আলমের মত মানুষের উত্থান। দুজনের সরলতা আছে, এম্বিশান আছে। ফলে ধনী-গরীব সবার মাঝে শর্টকাটে ফেমাস হবার একটা নতুন ধান্ধা বের হয়েছে।
শেয়ার বাজার লুটপাট, ব্যাংক লুট, অর্থ-পাচার, সাইবার হ্যাকিং করে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। আপনি যদি পাচারকারি বা তার উচ্ছিষ্টভোগীদের দলে থাকেন তাহলে বাংলাদেশ আপনার জন্যে আদর্শ জায়গা। এত শস্তায় শ্রম দুনিয়ার আর কেউ দিতে পারবে না, যদিও বেকুবের দল মাঝে-মধ্যে ভয় দেখায় আফ্রিকা বা অন্য কোন দেশ আরো শস্তায় কাজ করতে রাজি হলে এখানেও গার্মেন্টস থাকবে না। সম্পূর্ণ বানোয়াটা কথা, বাংলাদেশের চেয়ে শস্তায় কেউ কাজ করবে না। এত মানুষও একসাথে কোথাও পাওয়া যাবে না। তার উপর বিপুল পরিমান মিঠাপানি দূষণ করে গার্মেন্টস শিল্প করার মত লাক্সারি দুনিয়ার অনেক দেশেরই নেই। জানেন কিনা একটা জিন্সের প্যান্ট বানাতে আনুমানিক ২০০০ লিটার পানি দূষিত হয়।
আপনি নিজেকে ইনসুলেটেড করে থাকতে পারলে কয়েকবার দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত নগরী খেতাব পাওয়া ঢাকা শহর আপনার জন্য স্বর্গ। ঢাকা শহর আপনার কাছে মনে হবে সিঙ্গাপুর, লস এঞ্জেলেস, কানাডা, ইওরোপ। সকালে বাসা থেকে এসি গাড়ীর গ্লাস তুলে কাজে যাবেন, আবার সেখান থেকে বাসায় ফিরবেন। ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ আপনার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। মাঝমধ্যে বিদেশ ভ্রমণ করবেন, ডাক্তার দেখাতে বিদেশে যাবেন। তারপর এখানে শস্তা-গন্ডায় ড্রাইভার, কাজের লোক, দারোয়ান, কুক, শোফার, বাটলার, উমেদার, পিচ্চি সব পাওয়া যায়। এরা আপনার জন্য জীবন দিয়ে দিবে। আপনি চাইলে তাদের মারদোর করবেন কেউ কিছু বলবে না। এজন্য আপনাকে পাওয়ারফুল কেউ হতে হবে না। আপনি এলিট নারীবাদী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ব্যাংকার, চাকরিজীবী, ছোটখাট ব্যবসায়ী যাই হোন কেন এসব আপনার সামর্থ্যের মধ্যে পড়ে। আপনি এদের খাওয়ান, পরান, থাকতে দেন, চ্যারিটি করেন। আপনার বদান্যতায় তারা দুটো খেতে পায়। আপনার চকচকে মুখে তখন শুধু আসবে, সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ! জাস্ট একটা সাধারণ জীবন-যাপন করেও আপনার ফিলিংস হবে আপনি একজন করুণার সাগর। এটা বাংলাদেশ ছাড়া আর খুব কম দেশেই সম্ভব।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনার সঙ্গমস্থলের মানুষের জীবনে ‘ওয়াটার এলিমেন্ট’ এর প্রভাব বেশি। এজন্য বাংলাদেশ আবেগের ডিপো। সেন্টিমেন্টালিজম, মধ্যবিত্তীয় পুতুপুতু ভাব নিয়ে আবেগ, আর হলিউড, বলিউডের যৌনতার সূড়সূড়ি নিয়ে রসেবশে থাকার জন্য বাংলাদেশ ভাল জায়গা। সমাজে সুস্থ যৌনতা নেই, তাই যৌনতার সূড়সূড়ি আছে। তার উপর জাতীয় জীবনে, ব্যক্তি জীবনে রাজনৈতিক তামাশা, ড্রামা এসব চলতেই আছে, ফলে কখনো বোরড হবার সময় নেই। ভাঁড় মন্ত্রীসভা, অথর্ব আমলাতন্ত্র অনবরত রসের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। কে যেন বলেছিল, প্রতি দশ বছর পরে বিদেশের জীবনে যখন একঘেঁয়েমি চলে আসে, তখন দেশে গিয়ে তিনি চার্জ নিয়ে আসেন। এটার ডাউন সাইড হলো বাংলাদেশে মানুষ কখনো একান্ত হতে পারে না, মানুষের চাপে একা হবার ফুরসত নেই। সবার প্রতিদিন ফোনে যে পরিমাণ কম্যুনিকেশান হয় সেটা অবিশ্বাস্য। কোন এক কারণে মানুষ টেক্সট ম্যাসেজ পাঠায় না, সব সময় ফোন করে। অবশ্য একান্ত হতে কে চায়? মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় নিজেকে। নিজের মুখোমুখি হওয়াটা খুব কম মানুষ সহ্য করতে পারে। তাই সুপারফিশিয়াল চিন্তা, স্যালুট, বিনম্র শ্রদ্ধা, সহমত ভাই, টক-শো, ক্রিকেট, বলিউড, হলিউড নিয়ে ভাল একটা জমজমাট ব্যবস্থা।
সবশেষে দেশের খাবার-দাবার । নানা জাতের মাছ, ফলমূল এসব এখনও একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। নিজের মত করে গড়ে নিতে পারলে একটু কসরত করে হলেও ফরমালিনমুক্ত ফল-মূল, মাছ, পেস্টিসাইড, হরমোন ছাড়া শাক-সব্জি, মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব।
এ লেখা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠির কাউকে খাটো বা হেয় করতে নয়। কোন রকম বিদ্বেষ থেকে নয়, দেশে থাকি না বলে নয়, আমি যা দেখলাম, বুঝলাম তাই বললাম। বাংলাদেশে আমি জীবনের প্রথম ৩০ বছর কাটিয়েছি। বাংলা আমার ভাষা, আমি বাঙাল, বাঙালি, বাংলাদেশি বইঙ্গা আমি চাইলেও এ পরিচয় কোনভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। আই এম স্টাক উইথ দিস আইডেন্টিটি!
কিন্তু কেন লিখি, না লিখলেও তো দিব্যি দিন চলে যেত। এটা একটা প্রশ্ন বটে? আমি নিজেও জানি না কেন লিখি, এটা একটা রোগ হয়ত, লেখাটা আমার জন্যে খানিকটা ক্যাথারটিক। বাংলাদেশ নিয়ে এখনো ভাবি বলেই লিখি, দেশের ভাল চাই বলে লিখি। আমার জন্ম বাংলাদেশে আমার চৌদ্দগোষ্ঠি বাংলাদেশে থাকে, বিদেশে থাকলেও আমার কালচার বাংলাদেশি। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা থাকবেই। অনেকেই বলেন বিদেশে থেকে অমনভাবে বলা যায়। আমরা দেশে থাকি তাই বলতে পারি না। এটা ঠিক ভয় আছে, অনেকে দেশে থেকে এর মাঝেও কথা বলছেন, ভয়টাকে জেনেই বলছেন। তারপরেও পরিস্থিতিটা আসলেই ভয়ের। ভয় আর আতঙ্কের জীবনে এখন ‘কবরের শান্তি’ নেমে এসেছে।
আমি সাধারণত নেগেটিভ চিন্তা করি না, ব্যক্তিজীবনে আমি খুবই পজিটিভ মানুষ, যদিও আমি পছন্দ করি এম্পটি মাইন্ড ।
“Positive mind is better than a negative mind, but the best is an empty mind.”
উপরে আমি যেসব বললাম এগুলো নেগেটিভ কথা না, এগুলো বাস্তবতার খন্ডচিত্র। শুনে হয়ত কারো কারো মনে হবে কমপ্যাশনের অভাব, কিন্তু সেটা ঠিক না। সার্জারির রোগীকে পেইনলেস সার্জারি করা যায় না, ছুরি-কাঁচি, স্কালপেল লাগাতেই হবে। তেমনি কোন ধরণের শুগার কোটিং দিয়ে কথা বলা বা এনেস্থেশিয়া লাগানো আমি পছন্দ করি না, এটা আমার ব্যর্থতা।
নানা ধরনের দল-মতের চশমা পরে দেখলে এগুলো দেখতে পাওয়া যাবে না। সামাজিক, রাজনৈতিক পড়াশোনা, পর্যবেক্ষণ, খবর-প্রতিবেদন এর নির্মোহ বিশ্লেষণ ছাড়া এগুলো চোখে পড়বে না। আমি বাংলাদেশী, বাংলাদেশে থাকি, ঢাকায় থাকি এমন সামান্য আবেগও অনেকক্ষেত্রে সত্য দেখা থেকে বিরত রাখতে পারে। কারণ মানুষ নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, এবং আমাদের মনের গঠন সবসময় আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থানকে সমর্থন দিয়ে যায়।
পরিবর্তন চাইলে সবার আগে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হবে। সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ সমস্যাটাকে অনুধাবন করা, সেটাকে স্বীকার করা। যেমন একজন মোটা মানুষ ওজন কমাতে চাইলে সবার আগে তাকে বুঝতে হবে আমি মোটা, আমাকে ওজন কমাতে হবে। তারপরে আসবে কতটুকু ওজন কমানো দরকার, কোন পন্থা অবলম্বন করতে হবে এসব ব্যাপার। উলটে সে যদি একদিন ব্যায়াম করে, তারপরে আরেকদিন মনে করে কি দরকার সুস্থ শরীর ব্যস্ত করার। তাহলে সমস্যাটাকে ট্যাকল করা যাবে না, সে যে মোটা সেই মোটাই থেকে যাবে। বাংলাদেশের ব্যাপারেও তাই, ‘উন্নয়ন’ এর গালগল্প না শুনে নিজে থেকে পরিস্থিতি যাচাই করে নিতে হবে। এবারে দেশে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা, আত্মসমালোচনাকে আমি তাই বাস্তবতার নিরিখ থেকে দেখতে চাই যাতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়, বুঝতে সুবিধা হয়।