বাংলা প্রবলভাবে বেদ বিরোধী। শোনা যায় বৈদিক আগ্রাসন বাংলায় করতোয়া নদ পর্যন্ত এসে ঠেকেছিল, সমগ্র বাংলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মহাভারতের পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময়, বিরাট রাজার আশ্রয়ে আত্মগোপনের সময় হয়ত আমাদের রংপুর এলাকায় ছিল। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এখনো বিরাট নগরীর ধ্বংসাবশেষ আছে, যেটা স্থানীয়ভাবে বিরাট রাজার ঢিবি নামে পরিচিত।
কবি আল মাহমুদের ভাষায়ঃ
“আমারও আবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব ।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ ?”
‘অমিতাভ গৌতম’ মানে বৌদ্ধ ছাড়াও তখন দেশজুড়ে নানা মত ও পথের মানুষ ছিল, যেমন তান্ত্রিক, নাথ যোগী, নাঙ্গা সন্ন্যাসী, জৈন বীর ইত্যাদি। চীনের পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর লেখায় প্রাচীন সমতট অর্থাৎ বর্তমান নোয়াখালী অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়। হিউয়েন সাং লিখেন,
প্রায় ৮০০ কি মি ( ৩০০০ লি) এলাকা জুড়ে সমুদ্র তীরবর্তী এ অঞ্চল নীচুভূমির এবং এখানকার জমি উর্বর। এখানে নিয়মিত চাষাবাদ হয়, ফসলের মাঠে শস্যাদি ভরপুর, সর্বত্র ফুল এবং ফল-ফলাদি জন্মাতে দেখা যায়। এখানকার আবহাওয়া নরম এবং মানুষের ব্যবহার অমায়িক (agreeable) !
এখানকার মানুষের গড়ন শক্তপোক্ত , শরীর গাট্টাগোট্টা এবং কালো বর্ণের। তারা শিক্ষানুরাগী, এবং জ্ঞানার্জনের জন্য তারা নিয়মিত পরিশ্রম করে। আচার্যদের মধ্যে সত্য এবং ভিন্ন মতাবলম্বী (false) দু’ধরনেরই আছে। এখানকার ৩০ টির মতো সংঘে প্রায় ২০০০ এর মত বৌদ্ধ পুরোহিত আছেন। এরা সবাই থেরাবাদের অনুসারী। এছাড়া শ’খানেকের মত বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দিরও আছে। তবে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আছে নির্গ্রন্থ নামের নাঙা সাধুর বাস।
এছাড়া ছিল নানা লৌকিক ধর্ম, ব্রত ইত্যাদি যেমন, মনসারপূজা, চণ্ডীপূজা, বনবিবিরপূজা। বুঝা যায় বাংলায় অনার্য দেবতা শিবের আধিপত্য ছিল, মনসা, চণ্ডী, পার্বতী, কালী এরা সবই শিবের সাথে জড়িত। এছাড়া ছিল আদিবাসী সাওতাল, ওরাও, ওরাং, গারোদের নিজস্ব নিয়ম-নীতি।
মনসা পূজা প্রসঙ্গে বলা যায়, পূরাণে সাপ খুবই সিম্বলিক প্রাণী। ডাক্তারের প্রতীকে এখনো গ্রিক চিকিৎসা ও নিরাময়ের দেবতা Asclepius এর প্রতীকে সাপের অস্তিত্ব দেখা যায়। সাপের খোলস ছাড়িয়ে নবজন্ম নেয়ার অদ্ভূত ক্ষমতা মানুষকে পরিবর্তনের আহবান দেয়। সাপের এই খোলস পরিবর্তনের কাহিনী আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে সুমেরিয়ান সভ্যতায় দুনিয়ার প্রথম আখ্যান কাব্য ‘এপিক অফ গিলগামেশ’ এ আছে। বইটি সুমেরিয়ান সম্রাট আসুরবানিপলের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল। রাজা গিলগামেশ পরপারে গিয়ে অমরত্বের জন্য ফুল নিয়ে আসে, কিন্তু পথিমধ্যে তার অনবধানতা বশত একটা সাপ সেটা খেয়ে ফেলে। ফলে গিলগামেশের বদলে সাপ অমরত্ব পায়। যার কারণে এখনও আমরা বছর বছর সাপকে খোলস বদলাতে দেখি।
মোট কথা বাংলায় বেদের প্রভাব ছিল না, ইতিহাস থেকে জানা যায় গোটা বাংলায় মাত্র সাত-আট ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল। মহাভারতের ভীম নাকি নদী পার হয়ে দক্ষিণ বাঙলায় পৌছে নদীর অপর পার থেকে ভাইদেরকে বাঙাল ভাষায় খারাপ সম্বোধন করে ডেকেছিল। পাণ্ডবেরা ভীমের পরিস্থিতি দেখে আর ওপারে আসার সাহস করেনি।
কিন্তু কেন বাংলার এই বেদ বিরোধীতা?
বাঙালি স্বাধীনচেতা, বৈদিক অত্যাচার, জাত-পাতের ভেদাভেদ ইত্যাদি মানুষকে বেদমুখী হতে দেয়নি। সেজন্যই কি বৈদিক পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও শ্রী চৈতন্য প্রেমের জয়গান গেয়েছেন, জাত-পাতের ব্যবধান তুলে দিতে চেয়েছেন। মহাপ্রভুকে নিয়ে লালন বলছেন, “পেয়ে ঈশ্বরের রচনা , তাই বলে সে বেদ মানে না”। চৈতন্য তার অনুসারীদের জন্য শুধু বৈদিক জ্ঞান নয়, জ্ঞান-ভক্তির কথা বলেছেন।
বেদ বিরোধীতায় লালন ফকিরও বলেছেন,
“লালন তোকে নিতান্তই বেদে পেয়েছে”।
“বেদ পুরাণাদি রাগের অনুবাদি
নব অনুরাগী তা দেয় রে ফেলে”।
“বেদে কি তার মর্ম জানে।
যেরূপে সাঁইর লীলাখেলা এই দেহভুবনে”।।
বাংলা ভাষার উৎপত্তির পেছনেও এই বেদ তথা সংস্কৃত বিরোধীতার একটা প্রভাব আছে। গৌতম বুদ্ধের সংস্কৃত বিরোধীতার কারণে বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা স্থানীয় মানুষের ভাষায় ধর্মচর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। যার ফলে বাংলার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ আমরা বৌদ্ধ ভিক্ষু, মহাথেরোদের দ্বারা রচিত হতে দেখি।
কিন্তু বেদের জ্ঞানে সমস্যা কোথায় ?
বেদ-উপনিষদ দুনিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতম, এগুলো জ্ঞানের আকর বই। এ বইগুলো ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম অবদান, দুনিয়ার সম্পদ। প্রাচীন ঋষিরা হাজার হাজার বছর ধরে নানা পর্যবেক্ষণ করে যেসব বলে গেছেন সেসবের উপরে ভারতীয় দর্শন প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানবাদীরা মনে করেন, জ্ঞানের পথ ছাড়া মুক্তি নেই। ভারতীয় দর্শনে শয়তান নেই, শয়তানের বদলে অজ্ঞানতার কারণেই জীবের সকল সমস্যা। অজ্ঞানতাই যেহেতু সব সমস্যার মূল, তো সে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে জ্ঞান ছাড়া আর কেই বা সাহায্য করতে পারে। দুই যোগ দুই সমান চার কেউ এটা একবার বুঝে গেলে আর কখনো ভুলে না, চরম প্রতিকূল পরিবেশেও সেটা স্মরণ করতে কোন বেগ পেতে হয় না। অন্ধকারে ‘রজ্জুতে সর্প ভ্রম’ হলে সেটা দিনের আলোয় দেখে নিলে যেমন সকল সন্দেহ দূর হয়ে যায়, সাপের ভয় আর থাকে না। তেমনি জ্ঞানাগ্নি দিয়ে অজ্ঞানতা (মায়া) সরালে, জ্ঞানগঙ্গায় স্নান করে অজ্ঞানের তিমির দূর করলে আর কোন ভয় থাকে না।
বাংলার বেদ বিরোধীতার একটা কারণ হতে পারে জ্ঞানের পথে হাটা সবচেয়ে কষ্টকর, তাই এ পথ সবার জন্য নয়। জ্ঞানের পথ শুষ্ক, কঠোর, পরিশ্রমের পথ, তার উপরে জ্ঞানের উৎস সহজপ্রাপ্য নয়, বেশিরভাগ জ্ঞানই ক্রিপ্টিক, গুপ্ত, গুরুর কাছ থেকে না পেলে অন্য কোন উপায় নেই। বেদের ভাষা সংস্কৃত, অক্ষর পরিচিতি থেকে শুরু করে নতুন একটা ভাষা শেখা তো চাট্টিখানি কথা নেই, তার উপরে যার কোন বই নেই, বেদকে তাই বলা হয় শ্রুতি। গুরু-শিষ্য পরাম্পরায় এ জ্ঞান প্রবাহিত হয়। জ্ঞান এখনো গুপ্ত, আমি যদি রাসায়নিক বিক্রিয়া লিখি তাহলে প্রশিক্ষিত কেমিস্ট ছাড়া বাকীরা বুঝতে পারবে না। গণিতবিদ বা পদার্থবিদেরা সবকিছুকে গাণিতিক প্রকাশে দেখতে পছন্দ করেন, যেটা গণিতের সঠিক জ্ঞান না থাকলে বুঝা যাবে না।
ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো জ্ঞানে অধিকার নেই। আগেকার দিনে নীচু বর্ণের কেউ বেদ পাঠ করলে তার প্রাণ যেত। বৈদিক গুরুর অনুকরণ করে পরোক্ষভাবে তার শিক্ষা নেয়া্র কারণে আমাদের অঞ্চলের মানুষ নিষাদ একলব্যকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার আঙ্গুল কেটে দিতে হয়।
এসব কিছু বিবেচনা করলে বাংলা অঞ্চলের বেদ বিরোধীতাটা স্বাভাবিক মনে হওয়াটা অনুচিত বোধ হয় না। তার উপর বাঙালির খাদ্যাভ্যাসও ঠিক বৈদিক নিয়মের অনুকূলে নয়। বাঙালি মাছ-মাংস খাবে আবার ব্রাহ্মণ্য নীতিও করবে এটা তো হয় না! পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে এখনো তাই গরু, মাছ-মাংস খাবার ঘোষণা দিতে হয়।
খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্য।
তবে বেদের জ্ঞান, সাথে ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষার অন্যতম মর্যাদাবান ভাষা সংস্কৃত, সংস্কৃত ব্যকরণ, এ ভাষায় রচিত শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, গণিত, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি মানব জাতির অমূল্য সম্পদ। সংস্কৃতের সাথে আমাদের বাংলা ভাষার সাথ ঘনিষ্ঠতাও উল্লেখযোগ্য। বেদ বিরোধীতার আড়ালে হয়ত আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, যেটা পাশ্চাত্য এবং দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে খুবই সাদরে গৃহীত হচ্ছে।
বেদে মায়া কথাটা খুব চালু। লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার মহামানব প্রকল্পে প্রায় ‘মায়া কাটাতে হবে’ বলতেন, তো মায়া কি জিনিস? মায়াকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই জটিল একটা ব্যাপার। একটা গল্পে মায়াকে রাজার ১৮ তম হাতীর সাথে তুলনা করা হয়েছে।
এক রাজার ছিল ১৭ টি হাতী। তো মারা যাবার আগে রাজা উইল করে গেলেন যে সে মারা যাবার পরে তার বড় ছেলে পাবে অর্ধেক হাতী, মেঝ ছেলে পাবে এক তৃতীয়াংশ, আর একেবারে ছোটছেলে পাবে এক নবমাংশ। কিন্তু ১৭ কে ২, ৩, বা ৯ দিয়ে ভাগ যায় না, ফলে ছেলেদের মধ্যে মারামারি বাঁধার উপক্রম। এ সময় রাজার মন্ত্রী এসে রাজকুমারদের তার হাতীটাও দান করেন ফলে মোট হাতীর সংখ্যা দাড়াল ১৮। বড়ছেলে অর্ধেক হাতী (৯ টি) নিল, তারপর মেঝছেলে তার ভাগের এক তৃতীয়াংশ মানে ৬ টি হাতী নিয়ে নিল। তারপরে ছোটছেলে তার এক নবমাংশ ২ টি হাতী নিল, শেষে দেখা গেল শুধু মন্ত্রীর হাতীটাই বাকি আছে, তখন মন্ত্রীও তার হাতীটা নিয়ে নিল। এতে করে সবার মধ্যে গোল বাধার যে সম্ভাবনা ছিল সেটা ঘটল না। মায়া হল তেমনি ১৮ নম্বর হাতীটার মত, এমনিতে প্রয়োজন নেই, কিন্তু হিসেব মেলানোর জন্যে লাগে।
আরেকটা বহুল প্রচলিত গল্প দিয়ে শেষ করি। একবনে এক বাচ্চা সিংহ হারিয়ে গিয়ে ভেড়ার পালের সাথে যুক্ত হয়। ভেড়াদের সাথে বড় হতে হতে সিংহটি নিজেকে ভেড়া মনে করত, তাদের মত করে ঘাস খেত। অন্য সিংহ বা হিংস্র প্রাণী দেখলে ভেড়াদের সাথে সেও দৌড়ে পালাত। একদিন অন্য এক সিংহ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে তাকে থামিয়ে বলল, সে কোন ভেড়া নয়, সে আসলে সিংহ, বনের রাজা, খাদ্যচক্রে সবার উপরে, তার কাউকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। সিংহটি প্রথমবারের মত এমন জ্ঞান পেয়ে খুব এনজয় করতে লাগল। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে সে আবছা কিছু মনে করতে পারলেও অন্য ভেড়াদের সাথে বেরিয়ে আবারো ঘাস খেতে শুরু করল। বন্য সিংহটি আবারো সেটা দেখল এবং তাকে ধরে আবারো জ্ঞান দিল, এবারে সাথে একটা আয়নাও ধরিয়ে দিল। যখনই সিংহের মনে সন্দেহ হবে, তখন সে যেন আয়নাতে নিজেকে দেখে নেয়।
অক্টোবর ১২, ২০২২; ৮:০০ অপরাহ্ন
পুরানে জাত পাতের ভেদাভেদ আছে। কিন্তু বেদে নেই। আর্য সমাজ অত্যাচারী ছিল না । বাঙালি হয়ে বলছি।।